মোবাইল আসক্তি ও উত্তরণের উপায়

সাইফুর রহমান 1068 বার পঠিত

উপস্থাপনা :অধিকাংশ আবিষ্কারের মূল লক্ষ্য থাকে মানবকল্যাণ। কিন্তু মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে এসব আবিষ্কারকে অপব্যবহার করে থাকে। যেমন ‘নিউক্লিয়ার’ আবিষ্কৃত হয়েছিল মানবকল্যাণে।কিন্তু তা মানব ধ্বংসের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। অনুরূপভাবে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ অনেক অজানা বিষয় জানতে পারে। তথাপি এর অপব্যবহারে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রেরভয়াবহ ক্ষতিসাধন হয়’।[1] ফলে এর ভয়াল থাবা থেকে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলেরই আত্মরক্ষা যরূরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিম্নে মোবাইল ও ইন্টারনেটে আসক্তি ও উত্তরণের উপায় সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।

মোবাইল :বর্তমানে তথ্যের রাজ্যে বাঁধাহীন অবাধ বিচরণেরপ্রধান মাধ্যম মোবাইল ফোন। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির আর কোন উদ্ভাবনই প্রায় একই সময়ে এক সাথে সারা বিশ্বের মানুষের জীবনধারা আমূল পাল্টে দিতে পারেনি। কারণ অন্য কোন প্রযুক্তিই আবিষ্কারের সাথে সাথে বা এক দশকের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েনি, যেমনটা ঘটেছে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে। এটি নিঃসন্দেহে মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব’।[2]

মোবাইল ফোন পরিচিতি : মোবাইল হ’ল তারবিহীন টেলিফোন বিশেষ। মোবাইল ফোন (Mobile Phone) ইংরেজী শব্দ। এটিকে সেলুলার ফোন বা হ্যান্ড ফোনও বলা হয়। এটি এক একটি সেল নিয়ে কাজ করে বলে এটিকে সেলফোনও বলা হয়। মোবাইল ফোন বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ করে বলে অনেক বড় ভৌগলিক এলাকায় এটি নিরবচ্ছিন্নভাবে সংযোগ দিতে পারে। শুধু কথা বলাই নয়, আধুনিক মোবাইল ফোন দিয়ে আরো অনেক সেবা গ্রহণ করা যায়। যেমন- খুদে বার্তা, এসএমএস বা টেক্সট মেসে সেবা, ই-মেইল সেবা, ইন্টারনেট সেবা, ক্যামেরা, ব্যবসায়িক বা অর্থনৈতিক ব্যবহারিক সফটওয়্যার ইত্যাদি। যেসব মোবাইল ফোন এসব সেবা এবং কম্পিউটারের সাধারণ কিছু সুবিধা প্রদান করে, সেগুলোকে স্মার্টফোন বলা হয়’।[3]

মোবাইল ফোনের আবিষ্কার : ১৯০৮সালে প্রথম Caveradio ধারণার উদ্ভব হয়। যেটাকে মোবইল ফোনের জন্ম-সূত্র ধরা হয়। যদিও বাস্তবের মোবাইল ফোন এসেছে অনেক পরে। দুই বছর পর ১৯১০ সালে Larsmagnusericssonতার গাড়িতে টেলিফোন লাগিয়ে ফেলেন। ভ্রাম্যমান ফোন হিসেবে এটার নামই প্রথম আসে। যদিও eriesson-এর ফোনটা ঠিক radiophone ছিল না। ভদ্রলোক তার গাড়ি নিয়ে দেশময় ঘুরে বেড়াতেন এবং প্রয়োজন হলেই গাড়ি থামিয়ে ফোনের সাথে লম্বা দু’টি তার লাগিয়ে নিতেন, তারপর nationalphonenetwork ব্যবহার করে ফোন করার কাজ সারতেন’।[4]

আমরা যে মোবাইল ফোনকে চিনি তার জন্ম ১৯৭৩ সালে। আজকের বিখ্যাত মোবাইল ফোন নিমার্তা কোম্পানী মোটোরোলার হাত ধরে যাত্রা শুরু করে সেলুলার ফোন। মোটোরোলা কোম্পানীতে কর্মরত ড. মার্টিন কুপার এবং জন ফ্রান্সিস মিচেলকে মোবাইল ফোনের প্রথম উদ্ভাবকের মর্যাদা দেয়া হয়। তারা ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে প্রথম সফলভাবে প্রায় এক কেজি ওজনের একটি হাতে ধরা ফোনের মাধ্যমে কল করতে সক্ষম হন। মোবাইল ফোনের প্রথম বাণিজ্যিক সংস্করণ বাজারে আসে ১৯৮৩ সালে। ফোনটির নাম ছিল মোটোরোলা ডায়না টিএসিত্রমি-৮০০০ এক্স (Dayna Tac-8000x)।[5]

বাংলাদেশে মোবাইল ফোন প্রথম চালু হয় ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে। হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল) ঢাকা শহরেAMPS মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোন সেবা শুরু করে’।[6]বিশ্বে এখন মোবাইল ব্যবহারকারী সাড়ে সাতশ কোটির কাছাকাছি। বাংলাদেশে ১৮ কোটির বেশী। বাংলাদেশীদের ৪৮ শতাংশই ব্যবহার করেন স্মার্টফোন’।[7]

মোবাইল ফোনের অপব্যবহার : জ্ঞান ও তথ্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট এখন বহুল ব্যবহৃত, সর্বাধিক আলোচিত ও ব্যাপক সমালোচিত। এর প্রধান কারণ হ’ল মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের বাধাহীন ও শাসনহীন অবাধ ব্যবহার। ফলে সমাজজীবনে বয়ে নিয়ে আসছে বিপজ্জনক সব ভাইরাস, বয়ে নিয়ে আসছে অপসংস্কৃতি, অশ্লীল ও বিকৃতমানসিকতার সব ছবি। যা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অপব্যবহারের অবধারিতভাবে শিকার হচ্ছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে, বিশেষ করে মেয়েরা। মোবাইল ফোনের অপব্যবহার মেয়েদের লাঞ্ছনা ও নিযার্তনের একটা পথ তৈরী করে দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতন ও যৌন হয়রানীর শিকার হয়ে বিপুল পরিমাণ মেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের মোবাইল ফোন গ্রাহকদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশী অপাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে। যাদের বয়স ১২-১৬ এর মধ্যে। এমনকি স্কুলে পড়ুয়া ১০ বছরের ছেলে-মেয়েদের হাতেও এখন মোবাইল ফোন শোভা পাচ্ছে’।[8]

আমাদের সন্তানরা স্কুলে যাওয়ার নামে, খেলাধুলার নামে, স্মার্টফোন হাতে নিয়ে বাজার থেকে সদাই আনার নামে কোথায় যায়, কার সাথে মিশে? অধিকাংশ অভিভাবক সে খবর রাখে না। কিন্তু যখন একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলে, তখন আমাদের হুঁশ হয়। বিবেক জেগে উঠে। আহাযারী করে বুক ভাসিয়ে দেই’।[9] তাই বলা যায়, বর্তমানেপারিবারিক ও সামাজিক যে সব ভয়াবহ পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধ সংঘটিতহওয়ার প্রধান ও অন্যতম কারণ মোবাইল ফোনের অপব্যবহার। শুধু তাই নয়, দিনের বড় একটি সময় আমরা মোবাইল ফোনে ব্যয় করছি। বলা যায়,অধিকাংশ মানুষ যন্ত্রের দাসে পরিণত হয়ে গেছে। শুধু একটি জরিপের তথ্য থেকেই বোঝা যাবে, স্মার্টফোন আমাদের মহামূল্যবান সময় কিভাবে বিনষ্ট করছে। যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, সে দেশের প্রতিটি মানুষ ৩৬৫ দিনের মধ্যে গড়ে প্রায় ৩৭ দিনের সমান সময় (৩৬ দিন ১৮ ঘণ্টা) কাটান স্মার্টফোনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্রাউজ করে। আর আমেরিকার প্রতিটি মানুষ গড়ে বছরের ১০৯ দিনের সমান সময় অনলাইনে কাটায়’।[10]

মোবাইল ফোন ব্যবহারে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি : স্মার্টফোন আমাদের শরীর বা স্বাস্থ্যের উপর কাতটা প্রভাব ফেলছে।মোবাইল ফোন রেডিও ফ্রিকোনেন্সী ওয়েভের ভিত্তিতে কাজ করে। এক্সরে, আলট্রা ভায়োলেট বা গামা বিকিরণে যা ব্যবহৃত হয়। এটি তার চেয়ে কম ক্ষমতার। আমাদের চারপাশে এরকম অসংখ্য বিকিরণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেমন এফএম বেতারের তরঙ্গ, মাইক্রোওয়েভ ও বাতির বিকিরণ। তবে আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, মোবাইল ফোন ব্রেন টিউমার, মাথা বা গলার টিউমারের ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে দিতে পারে’।[11]১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ৮.১৫ মিনিটে হিরোশিমায় (জাপান) যে আনবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, সেখানে তাৎক্ষণিক সর্বোচ্চ কল্পনাতীত তাপমাত্রার সৃষ্টি ছাড়াও সে অদ্যবধি তেজস্ক্রিয়তার কিছু রেশ রয়ে গেছে। সেটা একবার ঘটেছিল। আর মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন একটা ক্রনিক পদ্ধতি যা সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে আবুল কালামের ভাষায়, Technology is meant to simplify our lifes, but excessive dependence on it has complicated our Lifes.‘প্রযুক্তির আবিষ্কার এবং ব্যবহার হওয়া উচিত ছিল আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করার জন্য, কিন্তু প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের জীবনকে জটিল করে তুলেছে’।[12]এখনকার মায়েরা বাচ্চাদের খাওয়ানোর সময় সেলফোনের বিভিন্ন প্রোগাম দেখিয়ে খাওয়ান। সে ক্ষেত্রে শুধু ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন নয়, এত ক্ষুদ্র পর্দায় দেখার জন্য চোখের সমস্যা হয়। সাধারণত বিজ্ঞানীদের মতে, ১৬ বছরের নিচে সেল ফোন ব্যবহার করা উচিত নয়। সাধারণত একটি কল গ্রহণ করলে ২০ সেকেন্ডের বেশী কথা না বলাই শ্রেয়। যদি ৩ মিনিট কথা বলা হয় তাহ’লে পরবর্তী ২০ মিনিট সেলফোন ব্যবহার না করা উচিত। মনে রাখতে হবে, ২০ মিনিটের অধিক সময় কথা বললে মস্তিষ্কের তাপমাত্রা ১০২°F-এর উপর উঠে যায় যা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে কম্পনের সৃষ্টি করে’।[13]

রেডিয়েশনের ধরণ সাধারণত Non Jonizing এবং Ionizing radiation হয়। বিদ্যুৎবাহী তার, রাডার, বিদ্যুৎচালিত যোগাযোগ যানবাহন, কম্পিউটার, বেইস স্টেশন ও সেলফোনে ব্যবহৃত হয় NonIonizing radiation. মোবাইল ফোনের ভয়াবহতা হ’ল, বেইস স্টেশন, রিসিভার এবং মোবাইল সুইস সেন্টার সব জায়গা থেকেই Radiation নির্গমন হয়। মোবাইল ফোন সেটের উৎপাদনকারী কর্তৃপক্ষের উচিত SpecificAbsorptionRate (SAR)উল্লেখকরা, যাতে গ্রাহকরা তা দেখে রেডিয়েশনের মাত্রা সম্পর্কে জানতে পারেন। মহাত্মা গান্ধীর ভাষায় সাতটি মৃত্যুসম পাপের একটি হ’ল Science without huminity.[14]

এছাড়া মোবাইল ফোন ব্যবহারে ক্লান্তি বা অবসাদ, মাথা ব্যথা, নিদ্রাহীনতা, স্মরণশক্তির হ্রাস, কানে শোঁ শোঁ করা, জয়েন্ট ব্যথা, সর্বোপরি কানেশুনতে যথেষ্ট ক্ষতি করে।

মোবাইল ফোনের অপব্যবহার রোধে করণীয় : মোবাইল ফোনের অপব্যবহার রোধে পরিবারের দায়িত্ব অপরিসীম। প্রযুক্তি আমাদের সামনে বিশ্বের অবারিত জ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যার ফলে প্রযুক্তির পথ রোধ করা মানে জ্ঞানের অবাধ প্রবেশ ব্যাহত করা। কিন্তু পরিবারের দায়িত্বহীনতার কারণে খারাপ নেতিবাচক অশ্লীল কিছু বিষয় আমাদের অবুঝ শিশু-কিশোরদের মাঝে অনুপ্রবেশ করছে। কলুষিত করছে আমাদের প্রজন্মকে। এর প্রতিকার প্রথমে পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। পরিবারকেই আগে জবাব দিতে হবে কী করে ১২ বছরের ছেলে-মেয়েদের হাতে মোবাইল ফোন নামক একটা ভয়ংকর যন্ত্র তুলে দেওয়া হ’ল? এটা কোন দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়। আপনার পরিবার থেকেই আপনার সন্তানের পচন শুরু হ’ল।

সর্বোপরি মোবাইল ফোনের ক্ষতি থেকে বাঁচতে কিছু নিয়ম মেনে চলা যরূরী। রেডিয়েশন কমাতে চার্জে লাগানো অবস্থায় কথা না বলা। শিশুদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন দূরে রাখা। আইসিইউ এবং ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) মোবাইল ফোন ব্যবহার না করা। যত্রতত্র অ্যান্টেনা ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা’।[15]

রাষ্ট্রের করণীয় : এ ব্যাপারে রাষ্ট্রেরও অনেক করণীয় দায়িত্ব রয়েছে। রাষ্ট্র বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানী গুলোকে অবাধে ও যেনতেনভাবে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে কোন নীতিমালা বা শাসন বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানীগুলো মেনে চলছে না। এতে আপনার, আমার পরিবারের কি ক্ষতি হ’ল অথবা কি ক্ষতির সম্মুখীন হ’তে যাচ্ছে, এতে তাদের কিছু যায় আসে না। তারা হাযার হাযার কোটি টাকার এয়ারটাইম বিক্রি করছে এবং মুনাফাও করছে। লক্ষ্যণীয়-গত কিছুদিন আগেও ভারতের স্কুল-কলেজগুলোতে মোবাইল ফোন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে, যা বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রচার হয়েছে। আরও লক্ষ্যণীয়, ভারতের বেসরকারী মোবাইল কোম্পানীগুলোর ওপর সরকারের কঠোর নযরদারী রয়েছে। যেনতেনভাবে ব্যবসা করার সুযোগ মোবাইল ফোন অপারেটরের নেই’।[16] ভারতের অমুসলিম সরকার যদি এটা করতে পারে তাহ’লে এ বাংলাদেশের মুসলিম সরকার পারে না কেন?

ইন্টারনেট

বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক উন্নত। আর এর সকল কৃতিত্ব যার, তার নাম হ’ল ইন্টারনেট। গত ২২ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মোটামুটি ২১০ টি আলাদা দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এর বিস্তার। ইন্টারনেট হ’ল পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অনেকগুলো কম্পিউটার কেন্দ্রিক নিরবিচ্ছিন্ন নেটওয়ার্কের সমষ্টি। একটি কম্পিউটারের সাথে আরেকটি কম্পিউটারের সংযোগ থাকে বিভিন্ন উপায়ে। কোন কম্পিউটার সংযুক্ত থাকে পুরাতন কপার ক্যাবল দ্বারা। কোন কম্পিউটার ফাইবার অপটিক ক্যাবল যা আলোর স্পন্দনের মধ্যে ডাটা সেন্ড করার দ্বারা। আবার কোন কম্পিউটার বেতার কানেকশনে যুক্ত থাকে এটি রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করে এবং কোন কম্পিউটার সংযুক্ত থাকে স্যাটেলাইটের সাথে। আর এভাবেই আমরা উপভোগ করতে পারি ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজ সুবিধা, ই-মেইল সেবা, অথবা ডাউনলোড করি বিভিন্ন ফাইল’।[17]

ইন্টারনেটের ইতিহাস :১৯৫০ সালে ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের অগ্রগতির সাথে সাথে ইন্টারনেটের ইতিহাস শুরু হয়। ইন্টারনেট সম্পর্কে জনসাধারণ প্রথম ধারণা পায়; যখন কম্পিউটার বিজ্ঞানী অধ্যাপক লিউনার্ড ঐইনরক তার গবেষণাগার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস ইউসিএল থেকে অপানেটের মাধ্যমে একটি বার্তা স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনিস্টিটিউটে পাঠান। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে ব্রিটিশ কম্পিউটার প্রকৌশলী বার্নাস লি তার তথ্য ব্যবস্থাপনা প্রস্তাবটি ইউরোপিয়ান প্রতিষ্ঠান মার্নে জমা দেন। পক্ষান্তরে তিনিই আজকের (www) ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন সেদিন’।[18]

ইন্টারনেটের ধ্বংসলীলা: বিশ্ব ইন্টারনেট পরিসংখ্যানের হিসাবে বিশ্বের মোট ইন্টারনেটের অর্ধেক ব্যবহার করে এশীয়রা। আমেরিকায় ব্যবহৃত হয় ১৯.৫ শতাংশ, ইউরোপে ১৮ শতাংশ ও আফ্রিকায় ৯.৮ শতাংশ।[19] ‘অন্যদিকে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন (জিএসএমএ) বলেছে, বাংলাদেশে প্রকৃত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লাখ। এ হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনে একজন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। অবশ্য সরকারী হিসাবমতে, বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ কোটি ১৮ লাখ।[20]

ইন্টারনেট আসক্তি : মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন উন্নত দেশে গবেষণা শুরু হয়েছে। ইন্টারনেট ট্রেন্ডস (২০১৩) থেকে জানা যায় যে, আমরা গড়ে প্রতিদিন ১৫০ বার ফোন চেক করি। আমেরিকায় কিশোররা প্রতিদিন ৯ ঘণ্টা, ৮-১২ বয়সীরা ৬ ঘণ্টা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ে ব্যয় করে। ব্রিটেনে একজনগড়ে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের পিছনে ব্যয় করে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা ৪১ মি. যা সাধারণ একজন মানুষের দৈনন্দিন ঘুমের সময় থেকে ২০ মিনিট বেশী।[21]

ইন্টারনেট আসক্তিতে নৈতিক অবক্ষয় : বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ পর্ণো আসক্তি। পর্ণোগ্রাফীর মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন, ব্লাকমেইল,তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে’।[22]মূলত ইন্টারনেটের অপব্যবহারের ফলে আজ বিশ্বব্যাপী অশ্লীলতা, ভার্চুয়াল সম্পর্ক, গেমিং, তথ্য সন্ত্রাস, অনলাইন জুয়া প্রভৃতির প্রতি অন্যায় অপরাধ যেন এক বৈশ্বিক রূপ পেয়েছে।[23]

ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণের পিছনে প্রধানত পাঁচটি কারণ কাজ করে। (১) অশালীন বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি ঝোঁকপ্রবণতা; (২)ইন্টারনেটের মাধ্যমে নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রবল আগ্রহ; (৩) জুয়াসহ এক ধরনের নেশা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন খেলার প্রতি ঝোঁক প্রবণতা; (৪) নতুন তথ্য সংগ্রহের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ এবং (৫) সর্বশেষ কম্পিউটার গেমের নেশা। ইন্টারনেটে আসক্তরা সাধারণত সামাজিক তৎপরতা কমিয়ে দেয়, নিত্য প্রয়োজনীয় কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ হ্রাস পায়। পড়ালেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারে বাধা পেলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে’।[24] বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ১১তম ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস বা আইসিডিতে গেমের প্রতি আসক্তিকে ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত খসড়ায় গেমিং আসক্তিকে বর্ণনা করা কিছুর আকর্ষণ থেকে একজন দূরে সরিয়ে রাখে। বিশ্বের কিছু দেশ গেমিং আসক্তিকে ইতোমধ্যে একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশে এর চিকিৎসার জন্য প্রাইভেট অ্যাডিকশন ক্লিনিক রয়েছে। জাপানে কেউ যদি নির্দিষ্ট সময়ের বেশী গেম খেলে, তাকে সর্তকবার্তা পাঠানো হয়। চীনের সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট শিশুরা কতক্ষণ গেম খেলতে পারে তার সময় বেধে দিয়েছে’।[25]

ওয়াইফাইয়ের তারহীন ইন্টারনেট ব্যবস্থায় রাউটারের সাথে তড়িৎ-চম্বুকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে সংযুক্ত মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট ও ল্যাপটপের মতো ডিভাইস। ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের আবির্ভাব ও এক লাখ কোটির বেশী স্মার্ট ডিভাইসে ইন্টারনেট অব থিংস আইগুটি চালুর কারণে বিকিরণের এ সংকট আরো প্রকট হচ্ছে। চন্ডিগড়ের পোস্টগ্রাজুয়েট ইনিস্টিটিউট অব মেডিক্যাল এডুকেশন এ্যান্ড রিসার্চের (পিজিআই এম ই আর) সহযোগী অধ্যাপক ড. নেহেরু বলেন, কর্মক্ষেত্রে আমি অনেক রোগী বিশেষ করে তরুণদের দেখেছি, যারা জটিল কিছু উপসর্গ নিয়ে আমার কাছে এসেছে। এসব উপসর্গ আগে কখনো দেখা যায়নি। ১৯৮৫ সাল থেকে আমি এ পেশায় নিয়োজিত। কিন্তু যে উপসর্গগুলোর কথা বলছি, সেগুলো গত ১০ বছরের মধ্যেই দেখা গেছে। এর আগের ২০ বছরে এমন কিছু দেখিনি’।[26]ড. নেহেরু সম্প্রতি গ্লোবাল ওয়্যারলেস সুপারওয়েব নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। এতে তিনি প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে স্বাস্থ্যগত সমস্যার একটি প্রাসঙ্গিক সম্পর্ক উল্লেখ করেছেন। নেহেরুবলেন, এমন রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ের কোন পদ্ধতি আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হ’ল, বিকিরণের কারণে মানুষের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্থ হয়’।[27]

দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ শিশু ভুগছে দৃষ্টিশক্তির সমস্যায়। বাংলাদেশেও এটি আগ্রাসী থাবা বিস্তার করেছে। কালের বর্তমানে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা কমছে। কিন্তু ভয়াবহভাবে বাড়ছে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা। যে সমস্যার পেছনে অপুষ্টি নয় বরং দায়ী তথ্যপ্রযুক্তিআসক্তি’।[28]মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় এই রোগটিকে বলা হয় ‘মাইয়োপিয়া’ বা ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা। বর্তমানে এ রোগটিকে বলা হচ্ছে কম্পিউটার ভিগন সিনড্রোম। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাযার শিশু নতুনভাবে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হচ্ছে।ইন্টারনেট আজকে আমাদের যাপিত জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেট আবিষ্কারকারী অবশ্যই আমাদের ভালোর জন্য এই আবিষ্কার করেছিলেন।কিন্তু তিনি (টিম বার্নার্স লিঃ, ইন্টারনেট আবিষ্কারক)ইন্টারনেটের ধ্বংসাত্মক ব্যবহার দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হন।যা গত ১২ মার্চ ২০১৮ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www) বা ইন্টারনেট আবিষ্কারের ২৯তম দিবসে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত। হয়।[29]

ইন্টারনেট আসক্তি থেকে উত্তরণের উপায় : ইন্টারনেট আসক্তি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদেরকে এর দুনিয়াবী পদস্খলন ও ক্ষতিকর দিকসমূহ স্মরণ করতে হবে এবং এর অপব্যবহারে আখেরাতে জবাবদিহীতা ও শাস্তির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আল্লাহকে ভয় করতে হবে। নিভৃতে বা একাকী না থেকে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। সাথে সাথে প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস করতে হবে। কেননা মোবাইল ও ইন্টারনেটে অর্থলগ্নি করে ফায়েদা হাসিল করা ব্যক্তিরাই মোবাইল থেকে দূরে থাকে। এমনকি বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, ইলন মাস্ক সহ অনেকেই দিনের একটি অংশ বই পড়ে সময় কাটিয়ে থাকে।

উপসংহার : সার্বিক জীবনে সফলতা লাভের জন্য সময় ও স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব প্রদান অপরিহার্য। দৈনন্দিন জীবনে আমরা এ দু’টিই মোবাইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে নষ্ট করে থাকি। তাই সময় ও স্বাস্থ্যের নিরবঘাতক মোবাইল ও ইন্টারনেটের থেকে আমাদের সচেতন হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন।-আমীন!

সাইফুর রহমান

[লেখক : সভাপতি, দিনাজপুর-পূর্ব সাংগঠনিক যেলা।]


[1]. সেলফোন অপব্যবহার রুখতে হবে, তাজুল ইসলাম টিপু, সাপ্তাহিক লিখনী ঢাকা : (২৪-৩০ জুন ২০১৪) পৃ.-১৯।

[2]. মুজতাহিদ ফারুকী, ফিরে আসছে ‘বোবা’ ফোনের দিন, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১৩।

[3]. মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মোবাইলের ধ্বংসলীলা, প্রযুক্তির ধ্বংসলীলা সিরিজ-২. হুদহুদ প্রকাশন; ফেব্রুয়ারী ২০১৫, ১৩ পৃ.।

[4]. প্রাগুক্ত পৃ. ১৩।

[5]. প্রাগুক্ত পৃ. ১৪।

[6]. প্রাগুক্ত পৃ. ১৪।

[7]. মুজতাহিদ ফারুকী, ফিরে আসছে বোকা ফোনের দিন, দৈনিক নয়াদিগন্ত। ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩।

[8]. সেলফোন অপব্যবহার রুখতে হবে, তাজুল ইসলাম টিপু, সাপ্তাহিক লিখনী ঢাকা, ২৪-৩০জুন, ২০১৪ পৃ. ১৯।

[9]. কোন পথে আগামী প্রজন্ম, কাজী সুলতানুল আরেফিন, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১, পৃ-১০।

[10]. মুজতাহিদ ফারুকী, ফিরে আসছে বোবা ফোনের দিন, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩।

[11]. মোবাইল ফোন শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর, বিবিসির বিশ্লেষণ, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১০ মার্চ ২০১৮ প্রথম পৃ.।

[12]. সেলফোন এবং অপব্যবহার, অধ্যাপক ড. প্রাণ গোপাল দত্ত, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ জুন ২০১৭ পৃ. ০৪।

[13]. প্রাগুক্ত।

[14]. প্রাগুক্ত।

[15]. প্রাগুক্ত।

[16]. প্রাগুক্ত পৃ. ২১ কালাম-১।

[17]. ইন্টারনেট ধ্বংসসীলা, মাওলানা মাওলানা মাহমুদুল হাসান।

[18]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১-১২২।

[19]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০।

[20]. বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সার্বিক চিত্র, দৈনিক প্রথম আলো, ৫ এপ্রিল ২০১৮ পৃ. ০৩।

[21]. ইন্টারনেটের ধ্বংসলীলা পৃ. ৬১।

[22]. ইন্টারনেটের ধ্বংসলীলা পৃ.৬৪।

[23]. আসক্তির নাম যখন ইন্টারনেট, কফিল উদ্দিন চৌধুরী, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২০ মার্চ ২০১৮ পৃ.০৯।

[24]. গেমের নেশা একপ্রকার মানসিক রোগ, দৈনিক নয়াদিগন্ত ১০ নভেম্বর ২০১৮ পৃ.১২।

[25]. ভার্চুয়াল জগৎ : নীতি নৈতিকতা ও চরিত্রের ওপর প্রভাব, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা-ঢাকা, পৃ. ০৫।

[26]. প্রাগুক্ত।

[27]. প্রাগুক্ত।

[28]. প্রাগুক্ত।

[29]. সুত্র : দৈনিক নয়াদিগন্ত ১৪ মার্চ ২০১৮ পৃ. ০৫।



বিষয়সমূহ: পাপ শিষ্টাচার
আরও