তাবলীগ জামায়াত ও বিশ্ব ইজতেমা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
অধ্যাপক আকবার হোসাইন
সারওয়ার মিছবাহ 310 বার পঠিত
ভূমিকা : কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কান্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় লিখেছেন,
দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশিথে যাত্রিরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ।
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত?
কে আছ জওয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।
কবির লেখায় এমন একটি জাহাযের চিত্র ফুটে উঠেছে যাকে অনেক দীর্ঘ কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। এদিকে মাঝ দরিয়ায় ঝড় উঠেছে। উত্তাল তরঙ্গের মাঝে তরির ডুবি ডুবি অবস্থা। বাতাসের তীব্রতায় পাল ছিঁড়ে হারিয়ে গেছে সেই কখন! নাবিকের চোখে মুখে একরাশ নিরাশা। জাহাযের এই দুর্দশাক্ষণে হাল ধরার জন্য প্রয়োজন একজন সাহসী জওয়ানের। যে মাতাল সমুদ্রের মাঝে জাহাযকে পরিচালনা করে নিয়ে যাবে তার গন্তব্যে। কে সেই জওয়ান? কে ধরবে নাবিকের ছেড়ে দেয়া হাল? কবি অধীর আগ্রহে তারই সন্ধান করছেন। ভবিষ্যৎ তার অপেক্ষায়।
কবির এই কাল্পনিক জাহাযের যাত্রী যেন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। যারা এককালে বোখারা, খোরাসান, বাগদাদ, কূফা, আনাতোলিয়া ও আন্দালুসগড়ে তুলেছিল, তারা আজ লাগিয়ে যুগের করুণায় কেবল নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সকল তরীর সম্মুখ থেকে পথনির্দেশকারী সোনালী জাহায ঝড়ের কবলে হয়েছে বিদিশা। অতীত ইতিহাসকে সম্বল করে করুণা কুড়িয়ে এগিয়ে চলেছে অতি সন্তর্পণে। এই জাহাযে যদি কোনো নাবিকের স্থান খালি হয় তবে সেই নাবিকের হাল ধরার জন্য কোনো জওয়ান আর এগিয়ে আসে না। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মত নাবিকদের শূন্যস্থান তাই শত শত বছর ধরে শূন্যই পড়ে থাকে। সবাই যেন জাহাযের যাত্রী হ’তে পেরেই খুশী। নাবিক হ’তে কেউ এগিয়ে আসে না। আর আসবেই বা কীভাবে! তারা তো ইলমের বড়াই করতে করতে ঠিকমত ছালাত, ছিয়াম আদায় করারও সময় পান না। এই নাজুুক পরিস্থিতিতে ইলমের ধারক ও বাহকদের কাফেলাকে শক্তি যোগানোর জন্য এবং তাঁদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ প্রয়োজন। অন্যথায় এই কাফেলা অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে সাগরের অতল তলে। আর তার কারণ আমাদের ভীরুতা, অলসতা ও বিলাসী জীবন যাপন।
দুই ধরণের চিন্তাধারা : বর্তমান সমাজের মানুষ মাদ্রাসা সম্পর্কে দুই ধরনের চিন্তাধারা লালন করে। যারা মাদ্রাসার ভেতরে অবস্থান করেন তারা মনে করেন, এই চার দেয়ালের মাঝেই দুনিয়া সীমাবদ্ধ। আমরা এখানেই রুযী রোজগার করব। এখানেই রাজনীতি করব। এখানেই দ্বীন প্রতিষ্ঠা করব। আমরা যেটাকে ভালো বলব সেটাই ভালো। আমরা যেটা অপসন্দ করব সেটা পরিত্যাজ্য। কারণ, আমরা আল্লাহর দ্বীনের ধারক-বাহক।
পক্ষান্তরে যারা মাদ্রাসার বাইরে অবস্থান করেন তারা মাদ্রাসা ও দ্বীনী শিক্ষাকে কোনো শিক্ষাই মনে করেন না। তারা মনে করেন, একটি গ্রামে যেমন একটি গোরস্থান থাকে, সেখানে কিছু লাশ দাফন করা থাকে। যারা সমাজের না কোনো কল্যাণে আসে, না কোনো ক্ষতি করতে পারে। তেমনই মাদ্রাসাও একটি নির্জীব স্থান। সেখানে যারা থাকে তারা না মানুষের কোনো উপকারে আসে, না কোনো ক্ষতি করে। তাদের সরল প্রশ্ন, আমাদের এই অগ্রগতির জীবনে মাদ্রাসার অবদান কতটুকু? তারা সমাজকে কী দিচ্ছে? এই টেকনোলজির যুগে মাদ্রাসা কারিকুলাম ছাত্রদেরকে কী শেখাচ্ছে?
এই দু’টিই চরমপন্থী চিন্তাধারা। কেননা, যারা মাদ্রাসার ভেতরে আছেন তাদের ভাবা প্রয়োজন, মাদ্রাসা কারিকুলামে শিক্ষিত হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ কী? যুগের এই অগ্রগতিতে আমাদের কি কিছু করণীয় আছে নাকি আজও বাগদাদ ও নিশাপুরের জামে‘আ নিযামিয়ার পরিবেশ বিরাজ করছে? বর্তমান সমাজ আমাদের কাছে কী চায় এবং আমরা সমাজ থেকে কী চাই? সেগুলো প্রাপ্ত হওয়া এবং পূরণ করা কিভাবে সম্ভব?
আবার যারা মাদ্রাসার বাইরে অবস্থান করছেন তাদেরও ভাবা প্রয়োজন, মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের প্রভাব কতটা বিস্তৃত? বর্তমানে দুনিয়ার প্রতিটি কোণায় কোণায় অহির বিধান সম্পর্কে যে চরম মুর্খতা বিরাজ করছে তা থেকে বাঁচার উপায় কী? সর্বোপরি একজন সাধারণ মুসলমান এই আধুনিক যুগে কীভাবে দ্বীনের সঠিক শিক্ষা লাভ করে জান্নাতের পথ সুগম করতে পারবে?
ভিন্ন দৃষ্টিকোণ : আমরা যদি পৃথীবীর বিভিন্ন আন্দোলন, প্রতিষ্ঠান, মতবাদ ইত্যাদির দিকে তাকাই তবে দেখব, কোনো জাতিই কেবল নিজেদের গৌরবোজ্জল ইতিহাস পুঁজি করে টিকে থাকতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে নিজেদের উপযুক্ততা ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে হয়। অন্যথায় অস্তিত্ব হারাতে হয়।
আমাদের দেশে একসময় ধোপা সম্প্রদায় ছিল। তারা ধনী মানুষদের কাপড় কেচে দিত। আজকের যুগে ধোপা সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি ঘটেছে। কারণ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তারা এগিয়ে যেতে পারেনি। আজ ধনীদের কাপড় ওয়াশিং মেশিন কেচে দেয়। এখন যদি কোনো ব্যক্তি বুকে পিঠে ধোপার ব্যানার লাগিয়ে পথে পথে ঘুরে নিরাশ হয়ে মানুষকে দোষ দেয় যে, তাদের ওপর অবিচার করা হয়েছে। তাদেরকে কর্মচ্যুত করা হয়েছে। তাহ’লে তার হা-হুতাশ শোনার মত সময় ব্যস্ত পৃথিবীর মানুষের নেই। হ্যাঁ, সে যেটা করতে পারে সেটা হ’ল, ধোপার ব্যানার খুলে কাপড়ের ড্রাই ওয়াশ, ওয়াটার ওয়াশ, আইরনসহ যত ধরণের আধুনিক কলাকৌশল আছে সেগুলো রপ্ত করে আধুনিক মেশিনের ব্যবস্থা করে একটি লন্ড্রী কর্ণার খুলে বসা। তবেই সে তার উপযুক্ততা তুলে ধরতে পারবে এবং সমাজে টিকে থাকতে পারবে।
ঠিক তেমনই আমাদের ওলামায়ে কেরাম যুগের সাথে সামনে এগিয়ে না যাওয়ার কারণে তাঁদের উপযুক্ততা হারাচ্ছেন। আজ আমাদের অধিকাংশ আলেমের পর্যাপ্ত ভাষাজ্ঞান নেই। বহু কুরআন-হাদীছ জানার পরেও সাধারণ মানুষের সামনে সহজ-সাবলীল ভাষায় ইসলামের কিছু বিধি-বিধান উপস্থাপন করবেন এমন যোগ্যতা তাঁদের নেই। বাংলা ভাষার মাঝে প্রচুর পরিমানে আরবী, উর্দু, ফার্সী শব্দের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষদের জন্য তাদের ভাষাকে দুর্বোধ্য করে তুলেছেন। ফলে মানুষ ভুল জায়গা থেকে জ্ঞান নিতে বাধ্য হচ্ছে। আজ মানুষ ওয়াজ মাহফিলে জন্য আলেমগণকে দাওয়াত না করে হাযার হাযার টাকা খরচ করে জেনারেল পড়ুয়া বা কোনোকিছুই পড়েনি এমন মানুষকে বক্তা হিসাবে দাওয়াত করছে। এজন্য দায়ী কে?
বক্তব্যের মাঠ ছেড়ে যদি লেখনীর ময়দানে আসি তবে সেখানেও দেখা যাবে, তুলনামুলক কুরআন-হাদীছে অজ্ঞ ব্যক্তির বই থেকেই মানুষ দ্বীন শিখতে আগ্রহী। কারণ তাদের উপস্থাপনা এবং ভাষাশৈলী খুবই চমৎকার। এই ধরণের স্বল্পজ্ঞানী লেখকের বই পড়ে মানুষ বিপথেও যাচ্ছে। কী হবে আর দেয়ালে মাথা ঠুকে? যুগের সাথে চলতে গিয়ে আমরা পিছনে পড়ে গেছি। ভাষার দুর্বোধ্যতা দিয়ে ইলমের পরিমাণ আন্দাজ করার যুগ পার হয়ে গেছে কয়েকশো বছর আগে! আমাদের ওলামায়ে কেরামকে তা বুঝাবে কে?
যোগ্যতার বাছবিচার : আমাদের আজকের দাওরা পাস আলেমগণের একটি অভিযোগ, মাদ্রাসায় পড়ে কিছু হয় না। এই মতামতটি শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই দেবে যে, মাদ্রাসায় পড়ালে ছেলে-মেয়ে কুঁড়ে হয়ে যায়। তারা ভবিষ্যতে কিছু করতে পারে না। আচ্ছা, এই দোষ কি মাদ্রাসার? আমি এখানে ছোট্ট একটি দৃষ্টান্ত দিতে চাই। একসময় উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে হেকীমী দাওয়াখানার প্রচলন ছিল। সেখানে একেকজন হেকীম বসতেন যারা নাড়ী পরীক্ষা করেই অসুখ বলে দিতে পারতেন। তারা যে ঔষধ দিতেন তা আগুনে পানির মত কাজ করত। আজকের এই এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার চেয়ে তা হাযারগুণ ভালো ছিল এটা না বললেও হবে। তবুও আজ হেকীমী দাওয়াখানার অস্তিত্ব কোথায়? যদিওবা কালে-ভদ্রে দুয়েকটি দাওয়াখানা দেখা যায় সেগুলোতে কোনো রোগী আসে না। এর কারণ কী?
কারণ আজকের যুগে আর যোগ্য হেকীম নেই। আজও যদি নাড়ি পরীক্ষা করে নির্ভুল ওষুধ দেওয়ার মত হেকীম তৈরী হয় তবে এই টেকনোলজির যুগেও হেকীমী দাওয়াখানায় উপচে পড়া ভিড় হবে। কিন্তু সেই হেকীম কোথায়? আজকের যোগ্যতাশূন্য নাম কা ওয়াস্তে হেকীমরা যদি বলে, হেকীমী বিদ্যা অর্জন করে কিছু হয় না। তাহ’লে সে হেকীমী বিদ্যাকেই অপমান করল। সুতরাং যারা বলে, মাদ্রাসায় পড়ালে ছেলে-মেয়ে কুঁড়ে হয়ে যায়, তারা মাদ্রাসা শিক্ষাকে অপমান করছে। আপনার ছেলে যদি একযুগ আরবী ভাষা পড়ার পরে একলাইন আরবী শুদ্ধভাবে লিখতে না পারে তবে এই দোষ কি মাদ্রাসা শিক্ষার? আপনি কি ইতিহাস পড়েননি? কুরআন-হাদীছের গভীর জ্ঞান থাকায় আমাদের অনেক ইমাম তৎকালীন বাদশাহর উচ্চপদে চাকুরীর প্রস্তাব পেয়েছেন। এই ঘটনাগুলোর কারণ কখনো আপনি অনুধাবন করেছেন?
আরবী সাহিত্য প্রায় ১২টি আলাদা আলাদা বিষয়ের সমন্বয়। কোনো একটি বিষয়ে আপনি গভীর জ্ঞান অর্জন করুন। মানুষ আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাবে। আপনার সাহচর্যলাভে ধন্য হবে। একদিকে আপনার মাধ্যমে ইলমের একটি শাখা জীবিত থাকবে। অন্যদিকে আল্লাহ এর মাধ্যমেই আপনার প্রশস্ত রিযিকের ব্যবস্থাও করবেন ইনশাআল্লাহ। সুতরাং যোগ্যতাই মূল। যোগ্যতাই আপনাকে প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় টিকিয়ে রাখবে। এটি অর্জন করতে কখনো পিছপা হওয়া যাবে না।
শেষকথা : দুনিয়া কাউকে স্থান করে দেয় না। দুনিয়ায় নিজের স্থান নিজেকেই তৈরী করে নিতে হয়। দুনিয়ার সামনে নিজের উপযুক্ততা প্রমাণ করতে পারলেই তবে দুনিয়াতে টিকে থাকা যায়। অন্যথায় সময়ের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে যেতে হয়। দুনিয়ার সামনে নিজের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে পারলেই দুনিয়া প্রয়োজনমাফিক কদর করে। অন্যথায় অপ্রয়োজনীয় বস্ত্ত হিসাবে নর্দমায় পড়ে থাকতে হয়। আগামীকালের জন্য নিজেকে গড়ে তোলার আজকেই সময়। আগামীকাল অভিযোগ ও অজুহাত শোনার জন্য কেউ বসে থাকবে না। সুতরাং হে আমার মাদ্রাসা পড়ুয়া ভাই! আমাদের সামনে খুব কঠিন সময় আসছে। সে সময়ের জন্য যদি আমরা নিজেদের যোগ্য করে তুলতে না পারি তবে বেলা শেষে কয়েক ডজন সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে। কেউ আমাদেরকে মূল্যায়ন করবে না।
তাই প্রিয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ভাইরা এস! পড়াশোনায় রাত জাগি। জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করি। নিজেকে বক্তা, লেখক, শিক্ষক, ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক ইত্যাদি হিসাবে দুনিয়ার সামনে উপস্থাপন করি। প্রমাণ করে দেই, আমরা নির্জীব নই! অপ্রয়োজনীয় জড়বস্ত্ত নই!আমরা সমাজের প্রয়োজনে আছি। আমাদেরকে সমাজের প্রয়োজন আছে। আমাদেরকে বাদ দিয়ে সমাজ নয়; সমাজ বাদ দিয়ে আমরা নই। আর এভাবেই একদিনমাদ্রাসার একেকটি ফুল একেকটি বাগানের শোভা হবে। একেকটি মাথা একেকটি সমাজের আলোর মিনার হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!
সারওয়ার মিছবাহ