ব্যর্থতাই সফলতার মূলমন্ত্র
নাজমুন নাঈম
ওয়ালেস জনসন আমেরিকার মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যের এডিনবার্গের একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ফলে পড়াশোনার জন্য তিনি তেমন সুযোগ পাননি। ছোট বেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন কারখানায় নামমাত্র পারিশ্রমিকে কাজ শুরু করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি সুতা তৈরীর কারখানায়তুলা বাছাইয়ের কাজ করে জীবনের প্রথম উপার্জন শুরু করেন। অতঃপর কিশোর বয়সে তিনি একটি কাঠের কারখানায়কাজ নেন এবং ছুতারের (কাঠমিস্ত্রির) কাজ শিখেন। কারখানার মূল কাজ ছিল কাঠের বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরী করা। যৌবনের শুরুর বছরগুলো তিনি ঐ কারখানাতেই কাটিয়েছেন।
দরিদ্র পরিবারের সাধারণ ছেলেদের মত তিনিও ছিলেন পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু। কিছু দিনের মধ্যে তিনি কারখানার সকল কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন। ইতিমধ্যে তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং কারখানা থেকে প্রাপ্ত বেতনে তার সংসার ভালোভাবেই চলছিল।একদিন সকালে কারখানার মালিক তাকে বললেন, তোমাকে কারখানা থেকে বরখাস্ত করা হ’ল। তুমি এখান থেকে চলে যাও। আর কখনো ফিরে আসবে না। যে ওয়ার্কশপে তিনি বহু বছর ধরে বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করেছেন, হঠাৎ সেখান থেকে বরখাস্ত হওয়ায় তিনি ভীষণ কষ্ট পানএবং হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন।
কারখানা থেকে বেরিয়ে জনসন বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করেন। তিনি আনমনা হয়ে রাস্তায় চলছিলেন আর তার মনে ভেসে উঠছিলকারখানার কঠোর পরিশ্রমেরচিত্রগুলি। তিনি অনুভব করছিলেন, তার সকল পরিশ্রম এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। তার সামনে ছোটবেলার কষ্টকর দিনগুলিই আবার হাতছানি দিচ্ছিল। কারণ কারখানা থেকে প্রাপ্ত মজুরি ছাড়া তার এবং তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের কোন উপায় ছিল না। জীবিকার একমাত্র দ্বার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি গভীর সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পতিত পাল ছেড়া নৌকার নাবিকের ন্যায় দিশেহারা হয়ে পড়েন। আচমকা সব আশার আলো নিভে গিয়ে অমানিশার ঘোর অন্ধকার তাকে গ্রাস করল।
ওয়ালেস জনসন শারীরিকভাবে যেমন পরিশ্রমী, মানসিকভাবে তেমনই শান্ত ছিলেন। তিনি নিজের অবস্থা পর্যালোচনা করে বুঝতে পারলেন, তার কাছে এখন একটি ছোট বাড়ি আর কাঠের কারখানায় কাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নেই। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে তাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তাই রাস্তায় চলতে চলতেই তিনি তার কর্তব্য স্থির করলেন। তিনি প্রথমে বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীকে ঘটনাটি বললেন।তার স্ত্রী তাকে বলল, আমরা এখন কী করব?তিনি বললেন, আমরা যে ছোট বাড়িটিতে থাকি তা বন্ধক রাখব এবং নির্মাণ পেশায় কাজ করব।
তার প্রথম প্রকল্প ছিল দু’টি ছোট কাঠের বাড়ি তৈরী করা। তিনি তার বাড়ির বন্ধকী থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও কারখানায় অর্জিত দক্ষতা ও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে একাজে বিনিয়োগ করলেন। তিনি সেই ছোট বাড়ি দু’টি ভালো মূল্যে বিক্রি করতে পেরেছিলেন। এরপর তিনি বাড়ি নির্মাণের সংখ্যা বাড়াতে শুরু করলেন এবং তাতে নতুন নতুন ডিজাইন যুক্ত করলেন। সততা ওকঠোর পরিশ্রমের ফলে তার ছোট ছোট প্রকল্পগুলি বহুগুণ বেড়ে যায় এবং তিনি ছোট বাড়ি নির্মাণ শিল্পে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তার পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসে এবং মাত্র পাঁচ বছর নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে তিনি কোটিপতি হয়ে যান।
এই ওয়ালেস জনসনই হ’লেন বিখ্যাত হোটেল চেইন হোলিডে ইন (Holiday Inn)-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৮ সালে মৃত্যুর পূর্বে তিনি সারা বিশ্বে অগণিত হোটেল এবং হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি তার আত্মজীবনীতেলিখেছেন, যদি আমি জানতাম আমাকে বরখাস্ত করা কারখানার সেই মালিকএখন কোথায় থাকেন, তাহ’লে আমি তাকে অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জানাতাম। তিনি আমার ও আমার পরিবারের জন্য উত্তম কাজটিই করেছিলেন। কিন্তুআমি তা বুঝতে পারিনি। এখন আমি বুঝতে পারি যে, আল্লাহ আমার এবং আমার পরিবারের জন্য একটি ভালো পথ খুলে দিতে চেয়েছিলেন।এজন্য আমার সামনে একটি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
শিক্ষা :আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যইতোমরা এমন বহু কিছু অপসন্দ কর, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার বহু কিছু পসন্দ কর, যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। বস্ত্তত আল্লাহ সবকিছু জানেন, কিন্তু তোমরা জানো না’ (বাক্বারাহ ২/২১৬)। এজন্য জীবনের কোন ব্যর্থতায় ভাববেন না যে, আপনার জীবন একবারে শেষ হয়ে গেছে। হ’তে পারে সেটাই আপনার জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। শুধু শান্ত মাথায় পরিস্থিতি মুল্যায়ন করুন। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আগামী দিনের জন্য একটি সুন্দর পরিকল্পনা করুন। সততার সাথে পরিশ্রম করে গেলে আল্লাহ তার প্রতিদান দিবেন ইনশাআল্লাহ।
বান্দার রিযিক নির্ধারিত। যা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আবার কেউ চাইলে তার থেকে অতিরিক্ত উপার্জনও করতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বান্দার রিযিক তাকে সেভাবে খুঁজে বেড়ায় যেভাবে মৃত্যু তাকে খুঁজে বেড়ায়’(বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান হা/১১৯১; মিশকাত হা/৫৩১২)। তাই কোন পরিস্থিতিতে হতাশ না হয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে নতুন পরিকল্পনা করা উচিত। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন।-আমীন।
মূল : মুহসিন জববার, অনুবাদ : নাজমুন নাঈম