নিঃস্ব পদ্মার অব্যক্ত হাহাকার ও আমার মতিভ্রম
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
কথায় আছে, পরিশ্রমে ধন আনে আর পূণ্যে আনে সুখ। আলস্যে দারিদ্রতা আনে, আর পাপে আনে দুখ। কথাটির বাস্তবতা এই গল্পে বিদ্যমান!
গল্পটি গুলিস্তানের রিক্সাচালক এক বালকের।সদরঘাটের দিকে মুখ করে যাত্রীর অপেক্ষায় রিক্সার উপরে বসে ছিল। আমি রিক্সার সামনে আসতেই বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করল, স্যার যাবেন? তার পরিশ্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ যাব।
ছেলেটি ঐ ভর-দুপুরে সদরঘাট ছাড়া আর কোথাও যাবেনা। আর আমার গন্তব্য বাসাবো, মানে একেবারেই উল্টো পথ। কিন্তু ছেলেটির চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হল এ সাধারণ দশ জন রিক্সাওয়ালার মতো না। তাই ওর যাত্রী হওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। আসলে ওর জীবনের গল্প শোনার প্রবল ইচ্ছাটা সংবরণ করতে পারলাম না। রিক্সায় চড়ে বললাম, চল সদরঘাট। মনে মনে ভাবলাম সদরঘাটওযাইনি অনেক বছর। শেষ বার গিয়েছিলাম প্রায় ১০ বছর আগে।
রিক্সায় চড়ে ওর সাথে নানা রকমের কথা হ’ল। ঢাকার বাইরে কোন এক যেলায় ওর বাড়ী। সদ্য এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে রিক্সা চালাতে ঢাকায় এসেছে। রিক্সা চালিয়ে টাকা-পয়সা জমিয়ে কলেজে ভর্তি হবে। ওর বাবা নেই, মা অন্যের বাসা-বাড়ীতে কাজ করে সংসার চালায়। বাড়িতে একটি ছোট বোনও আছে। কথা বলতে বলতে সদরঘাট পৌঁছে গেলাম। ঐ সময়ে ভাড়া ৬০ বা ৭০ টাকা হবে হয়তো। আমি ওকে পাঁচশ টাকার একটি নোট দিয়ে বললাম, রেখে দাও। কিন্তু সে রাখবেনা।তাই বললাম, তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা কর, টার্মিনালে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছি, কাজ করে তোমাকে নিয়েই গুলিস্তান যাব।আমি টার্মিনালে গিয়ে কিছু লঞ্চ আর মানুষের যাতায়াত দেখে ফিরে আসলাম।
তখন দুপুর দুইটা বাজে। ওকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলাম খাওয়ার জন্য।ও রেস্টুরেন্টে খেতে চাচ্ছিল না। অনেক জোরাজুরি করার পর খেল। তারপর আবার রওনা দিলাম গুলিস্তানের দিকে। ততক্ষণে ওর সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা তৈরী হয়েছে। কথায় কথায় আমাকে বলল, স্যার জানেন! আমি ভালো ছাত্র না বলে অনেকেই তাচ্ছিল্য করে বলে, এত লেখাপড়ার দরকার নাই। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিস, অনেক হয়েছ। আর পড়ে করে কি করবি!
আমিও জিজ্ঞেস করলাম, লেখাপড়া করে তুমি কী করতে চাও? উত্তরে সে বলল, আমি বড় চাকরীর আশায় লেখাপড়া করছি না স্যার। পড়ালেখা করা আমার একটা শখ বলতে পারেন।প্রয়োজনে সারাজীবন রিক্সা চালাব, মাঠে কাজ করব। তবুও আমি এমএ পাশ করতে চাই।
আমি মনে মনে বললাম, তুমি তো এখনই যে শিক্ষা অর্জন অর্জন করেছ তা এমএ পাশ করেও অনেকে অর্জন করতে পারেনা। দেশের অনেক এমএ ডিগ্রীধারীর তোমার থেকে শেখার আছে। কিন্তু মুখ ফুটে কথাগুলো বলতে পারলাম না। পাছে যদি সে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। গুলিস্তান এসে ফুসলিয়ে টিএসসিতে নিয়ে এলাম। টিএসসিতে কিছুক্ষণ থেকে এলিফ্যান্ট রোড হয়ে বাসাবো এসে ওকে এক হাযার টাকার দু’টা নোট দিয়ে বললাম, এটা রেখে দাও।
ছেলেটি টাকাটা হাতে না নিয়েই আমাকে বলল, স্যার, আপনি মনে হয় বিদেশে থেকে দেশের দর-দাম ভুলে গেছেন। আমার ভাড়া তো একহাযার টাকাও হবেনা।আমি বললাম, কিচ্ছু ভুলি নাই। তোমাকে আমি ছোট ভাই হিসাবে দিলাম, রেখে দাও। কিন্তু সে ভাড়ার অতিরিক্ত এক টাকাও নিবেনা।আমি একটু জোর করাতে আমাকে বলল, স্যার, আমি সুস্থ মানুষ। কাজ করে টাকা কামাতে পারি। প্রতিদিন রিক্সা চালিয়ে ভালোই রোজগার করি এবং এতে আমি খুশী। এর চেয়ে বেশী টাকা আমার দরকার নেই। তাছাড়া আমি কারো সাহায্য নিয়ে বড় হ’তে চাইনা। সে সমস্ত ভাড়া হিসাব করে প্রাপ্য টাকা নিয়ে বাকীটা আমাকে ফেরত দিল।
টাকা ফিরিয়ে দেওয়াতে আমার আত্মসম্মানে বোধ হয় একটু খোঁচা লাগছিল। তাই আমি টাকাটা রাখতে আরো একবার অনুরোধ করলাম। তখন ছেলেটি বলল, আপনি এমন করবেন এটা আগে জানলে আপনাকে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো জানাতাম না। বাবা মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, কখনও নিজের কষ্ট দেখিয়ে মানুষের থেকে বাড়তি সুবিধা নিবে না। মনে রেখ, মানুষের সততার চেয়ে কোন বড় শক্তি বা সম্পদ হয় না। কথাটা বলে ছেলেটি রিক্সা ঘুরিয়ে আবার গুলিস্তানের দিকে চলে গেল।
আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম এসএসসি পরীক্ষার্থী একটি ছেলে যে মনুষ্যত্ব অর্জন করেছে দেশের এমএ ডিগ্রীধারীরা যদি তা অর্জন করতে পারত, তাহ’লে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে উঠত। প্রকৃতপক্ষে ডিগ্রী কখনো মনুষ্যত্বের মাপকাঠি হ’তে পারে না। মানুষ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় না-পরিবার থেকেই সততা, আদর্শ ও মনুষ্যত্বের শিক্ষা গ্রহণ করে।
[সত্য ঘটনা অবলম্বনে]
আব্দুল কাদের
[লেখক : ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]