সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিকতা

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 361 বার পঠিত

সময়কে ধারণ করা, সময়ের পাঠ গ্রহণ করা, সময়ের দাবীকে মেটাতে পারা মানুষগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান মানুষ। যাদের একটি কথা, একটি বক্তব্য, একটি লেখনী, একটি সাহসী পদক্ষেপ, এক মুহূর্তের ধৈর্যশীল অবস্থান শুধু তার নিজের নয়, পুরো সমাজের গতিপথ পর্যন্ত বদলে দেয়। রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনীর পরতে পরতে এমন অজস্র ঘটনা বিদ্যমান। পৃথিবীতে যারা সংস্কারক হয়েছেন, যারা যুগের পরিবর্তনের আদর্শ নকীব হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেরই জীবনে এমন ঘটনা কম-বেশী ঘটেছে-চেতনে কিংবা অবচেতনে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসাবে আমরা দেখেছি রংপুরের আবূ সাঈদকে, যার অদম্য সাহস, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় আত্মত্যাগের সদিচ্ছা এক নিমিষে পুরো একটা যুলুমশাহী তখতে তাউস উল্টিয়ে দিল!

আমরা দেখেছি একজন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারুয্যামানকে, যার ধৈর্যশীল অবস্থান কেবল জ্বলন্ত উনুনে পানিই ঢেলে দেয়নি, বরং দেশকে সমূহ গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। নিজ দেশের মানুষের নির্বিচার রক্তপাত ঘটানো কিংবা সেনাশাসন জারি করা নতুবা দেশকে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের মুখে ঠেলে দেওয়ার পরিবর্তে ধৈর্যের সাথে সময়ের সবচেয়ে সঠিক ও সুন্দর পথটিই বেছে নিতে পেরেছিলেন তিনি সেই মুহূর্তে। আর তাতেই তিনি একজন সেনাপ্রধান পরিচয়ের অনেক উর্ধ্বে একজন মূল্যবান মানুষ হয়ে ওঠেন। আর এভাবেই সময়ের দাবী মেটাতে পারা মানুষগুলো সমাজ গড়ার মূল কারিগর হয়ে থাকেন। পরিণত হন দেশ-কালের বাধা মাড়ানো এক বিশ্ব মানব।

এর বিপরীতে সময়ের দাবী বুঝতে ব্যর্থ হ’লে বহু কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এমনকি অনেক সময় অচিন্তনীয় বিপদ নেমে আসে, যা হয়ত কারো কল্পনাকেও হার মানায়। বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলনে মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ-র ভুল সময়ে ‘উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’-বাক্যটি গেঁথে দেয় ভবিষ্যৎ বাংলা রাষ্ট্রের ভিত্তি। অনুরূপভাবে সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বলা অসময়োচিত ‘রাজাকার’ বাক্যটি প্রতাপশালী বিগত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লাঞ্ছনাকর পতনের ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। 

প্রিয় পাঠক, যেকোন দেশ ও সমাজ সংস্কারে মূল প্রভাবক হয়ে থাকেন সেই সমাজের কোন আদর্শবান ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তি সমষ্টিগণ। কিন্তু সেই প্রভাব তারা কিভাবে সমাজের বুকে ছড়িয়ে দেন! হ্যাঁ, তাদের সময়পোযোগী পদক্ষেপ, কালজয়ী চিন্তাধারা এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা সমাজকে সম্মুখপানে অগ্রসর করে। এক্ষেত্রে সমাজ সংস্কারকামীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে চরিত্রটি ফুটে ওঠে তা হ’ল সময়কে পড়তে পারা এবং সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারা। বিগত ৫ই আগস্ট ২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে যাওয়ার যে উপলক্ষ্য হাযির করেছে, তা ছিল এই সময়োচিত পদক্ষেপেরই ফলশ্রুতি।

প্রিয় পাঠক, বর্তমানে আমরা এমন এক যুগসন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছি যখন এদেশের তরুণরা অভূতপূর্বভাবে দেশের হাল ধরেছে। তাদের হাত ধরে এদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখছে স্বাধীনতার হারানো স্বপ্ন ফিরে পাবার। বর্তমান প্রেক্ষাপট আমাদের খুব করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে এমন এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার, যা হবে অতীতের সমস্ত আফসোস ও গ্লানি থেকে মুক্ত। যে স্বপ্ন নিয়ে এদেশের মানুষ ১৮৫৭, ১৯৪৭, ১৯৭১-এ ত্যাগের যে নযরানা পেশ করেছিল, সে স্বপ্ন এবার বাস্তবরূপ পায়। বারবার যেন আমাদের স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়তে না হয়। আমরা যেন অতীতের ফেলে যাওয়া কোন কালো আইনের দাস না হয়ে বলি-এটাই আইন। বরং যতসব কালো আইন, নিয়ম-কানূন বদলানোই হোক আমাদের বিপ্লবের মূলমন্ত্র। সমাজে অসৎ মানুষের ঠাঁই যেন না হয়, যেন অনৈতিকতা প্রশ্রয় না পায়, সততা ও ন্যায়বোধের সর্বাত্মক জাগরণ হয়, সেটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। আর এজন্য প্রয়োজন কিছু বিপ্লবী চেতনার মানুষ, কিছু জনদরদী মানুষ, কিছ এমন মানুষ যারা নিঃস্বার্থভাবে, বুদ্ধিমত্তার সাথে, চেক এ্যান্ড ব্যালান্সের মাধ্যমে সমাজটাকে কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। যারা সময়কে সঠিকভাবে পাঠ করে জাতীয় জীবনে পরিবর্তনের রূপরেখা রচনা করবে।

প্রসঙ্গত আমরা দেখেছি, এদেশের প্রায় আশিভাগ মুসলিম শরী‘আ আইন চায় মর্মে পিউ রিসার্চের দশ বছর পূর্বেকার এক রিপোর্টে প্রকাশ। অথচ এদেশে এখনও পর্যন্ত ইসলামী আইনের পক্ষে কথা বলা মানেই পশ্চাদপদতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা কিংবা মৌলবাদ। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রচলিত বৃটিশ আইন অধিকাংশ স্বয়ং বৃটেনেই কার্যকর নেই, অথচ সেই আইন সুশীল নামধারীদের বদৌলতে মহাপ্রতাপে বেঁচে-বর্তে আছে। এমনকি মানবাধিকারের নামে বিকৃত এলজিবিটিকিউ (সমকামিতা) মতবাদকে সমর্থন করা হচ্ছে। অথচ এসব আইন মোটেই কোন মানবাধিকার রক্ষাকারী আইন নয়। বরং অন্যায়কারীদের বাঁচানো আর বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার মাধ্যমে নিরপরাধের অন্যায্য শাস্তিবিধানই হ’ল এই আইনের বাস্তবতা। সেই সাথে অধিকারের নামে সমাজে অনাচার, অপসংস্কৃতি ও অশালীনতার প্রসার ঘটানো। কিন্তু সে বিষয়ে আমরা সমাজের সচেতন অংশকেও তেমন কথা বলতে দেখি না। তথাকথিত ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠার চেয়ে এদেশের পুরো আইন কাঠামোই যে বদলানো প্রয়োজন সে আওয়ায আমরা কোথাও শুনতে পাই না। এর কারণ এই জনআকাংখ্যাকে বাস্তবে অনূদিত করার মত আদর্শবান মানুষের নিদারুণ অভাব। অতএব একটি মানবিক ও আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য সমাজ সচেতন আদর্শবান মানুষ গঠনই বর্তমান সময়ে আমাদের মূল কাজ।

মনে রাখা কর্তব্য যে, সময়ের দাবী মেটানোর সক্ষমতা একদিনে তৈরী হয় না। পরিশুদ্ধ অন্তর, মাল ও মর্যাদার লোভহীন নিরেট সততা, সত্য ও কল্যাণের নিরন্তর অভীপ্সা এবং ধৈর্য ও স্থৈর্যের সাথে মধ্যপন্থা অবলম্বনের চর্চা একজন মানুষকে ধাপে ধাপে সমাজ গড়ার জন্য উপযুক্ত করে তোলে। সেই সাথে সময়ের যথাযথ ব্যবহার মানুষকে যুগোপযোগী করে তোলে। এজন্য আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন কালের শপথ করে সূরা নাযিল করেছেন এবং তাতে ঈমানদার ও সৎআমলকারীদের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি সত্যসেবী এবং ধৈর্যশীলদের বিশেষভাবে প্রশংসা করেছেন। কারণ সততা মানুষকে কঠিন সময়ে আদর্শের উপর সুদৃঢ় রাখে, আর ধৈর্য মানুষকে আবেগী ও ভুল সিদ্ধান্ত থেকে রক্ষা করে এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করে।

সুতরাং মেধাবী এবং সচেতন তরুণ ও যুবক ভাইদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, সমাজ সংস্কারের জন্য প্রস্ত্ততি নিতে চাইলে সময়কে গুরুত্ব দেয়া ও সময়কে সঠিকভাবে পাঠ করার জন্য আমাদের উদ্যোগী হ’তে হবে। আমাদের পড়াশোনা, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এদেশ ও সমাজে যদি আমরা ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই, তবে অবশ্যই আমাদেরকে ইখলাছ ও ইস্তিকামাতের নীতিতে বলীয়ান হতে হবে। নববী আদর্শের বাইরে যাবতীয় পথ, মত ও কর্মসূচীকে পদদলিত করার মত নৈতিক বল ও সাহস থাকতে হবে। আদর্শের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখতে হবে। উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া, ঐক্যের আহবান, প্রতিপক্ষের প্রতি সহনশীলতা সবই থাকবে, কিন্তু কোন অবস্থাতেই আপোষকামিতাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। কারণ আদর্শ ও নৈতিকতার গোপন ঘাতক হ’ল আপোষকামিতা, যা আমাদের অলক্ষ্যে আমাদেরকে লক্ষ্যচ্যূত করে দেয়। সুতরাং আসুন বর্তমান সময়টাকে আমরা নে‘মত হিসাবে গ্রহণ করি, ইসলামকে সমাজের বুকে প্রচারের যে চমৎকার উর্বর ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে, তা কাজে লাগাই। আমাদেরকে মানুষের ঘরে ঘরে যেতে হবে, ইসলামের সঠিক বার্তা সর্বত্র পৌঁছে দিতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারে ইসলামের সৌন্দর্য, অনুভব করে রবের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ কেবল ইবাদতে নয়, বরং জীবনে সর্বক্ষেত্রে। এই তাযকিয়া ও তারবিয়াহর কর্মসূচীর মাধ্যমে ইনশাআল্লাহ সমাজকে আমরা সঠিক পথ দেখাতে পারব।

সেই সাথে আমাদেরকে সতর্ক থাকবে হবে যেন আবেগে ভেসে একদিকে খিলাফতের নামে চরমপন্থা, অপরদিকে হেকমতের নামে আপোষকামিতা নামক দুই অন্তর্ঘাতী অস্ত্রের শিকার যেন আমরা না হয়ে যাই। নতুবা সময়ের দাবী মেটাতে আমরা ব্যর্থ হব এবং আমরা বহু মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার নে‘মত থেকে আবার বঞ্চিত হয়ে যাব। আল্লাহ আমাদেরকে দেশ ও সমাজকে ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজানোর তাওফীক দান করুন এবং যাবতীয় অকল্যাণ থেকে হেফাযত করুন। আমীন!



আরও