সামাজিক সম্পর্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 252 বার পঠিত
আল-কুরআনুল কারীম :
১- الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِينٍ- ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ- ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِنْ رُوحِهِ-
(১) ‘যিনি সকল বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন সুন্দরভাবে এবং মাটি হ’তে মানুষ (আদম) সৃষ্টির সূচনা করেছেন’। ‘অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেছেন তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে’। ‘অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন ও তাতে রূহ ফুঁকে দেন তাঁর নিকট হ’তে’ (সাজদাহ ৩২/৭-৯)।
২- لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ-
(২) ‘অবশ্যই আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম অবয়বে’ (তীন ৯৫/৪)।
৩- يَاأَيُّهَا الْإِنْسَانُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ- الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ- فِي أَيِّ صُورَةٍ مَا شَاءَ رَكَّبَكَ-
(৩) হে মানুষ! কোন্ বস্ত্ত তোমাকে তোমার মহান প্রভু থেকে বিভ্রান্ত করল? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন, অতঃপর সুষম করেছেন। তিনি তোমাকে তেমন আকৃতিতে গঠন করেছেন, যেভাবে তিনি চেয়েছেন’ (ইনফিত্বার ৮২/৬-৮)।
৪- وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا- قَالَ أَرَأَيْتَكَ هَذَا الَّذِي كَرَّمْتَ عَلَيَّ لَئِنْ أَخَّرْتَنِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَأَحْتَنِكَنَّ ذُرِّيَّتَهُ إِلَّا قَلِيلًا-
(৪) ‘আর (স্মরণ কর) যখন আমরা ফেরেশতাদের বলেছিলাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর। তখন সবাই সিজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে বলল, আমি কি তাকে সিজদা করব যাকে আপনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন?’। ‘সে বলল, আপনি তো দেখছেন যে, আপনি একে আমার উপরে মর্যাদা দিয়েছেন! এক্ষণে যদি আপনি আমাকে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দেন, তাহ’লে তার বংশধর সবাইকে আমি পথভ্রষ্ট করে ফেলব কিছু সংখ্যক ব্যতীত’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৬১-৬২)।
৫- وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا-
(৫) ‘আমরা আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দিয়েছি। আর আমরা তাদেরকে পবিত্র রূযী দান করেছি এবং আমরা তাদেরকে আমাদের অনেক সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৭০)।
৬- الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ-
(৬) ‘পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক। এজন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যকে প্রাধান্য দান করেছেন এবং এজন্য যে, তারা (নারীদের ভরণ-পোষণের জন্য) তাদের মাল-সম্পদ হ’তে ব্যয় করে থাকে’ (নিসা ৪/৩৪)।
৭- إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا-
(৭) ‘যদি তোমরা কবীরা গোনাহসমূহ হ’তে বিরত থাক, যা থেকে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, তাহ’লে আমরা তোমাদের (ছগীরা) গোনাহসমূহ মার্জনা করে দেব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে (জান্নাতে) প্রবেশ করাবো’ (নিসা ৪/৩১)।
৮- وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ إِنَّ رَبَّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ-
(৮) ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে দুনিয়ায় প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন এবং তোমাদের একের উপর অন্যের মর্যাদা উন্নত করেছেন। যাতে তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে পরীক্ষা নিতে পারেন। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক দ্রুত শাস্তিদাতা এবং তিনি অবশ্যই ক্ষমাশীল ও দয়াময়’ (আন‘আম ৬/১৬৫)।
৯- فَأَمَّا الْإِنْسَانُ إِذَا مَا ابْتَلَاهُ رَبُّهُ فَأَكْرَمَهُ وَنَعَّمَهُ فَيَقُولُ رَبِّي أَكْرَمَنِ- وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهُ فَيَقُولُ رَبِّي أَهَانَنِ-
(৯) কিন্তু মানুষ এরূপ যে, যখন তার প্রতিপালক তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর তাকে সম্মানিত করেন ও সুখ-সম্পদ দান করেন, তখন সে বলে, আমার প্রভু আমাকে সম্মানিত করেছেন। ‘পক্ষান্তরে যখন তিনি তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তার রূযী সংকুচিত করেন, তখন সে বলে, আমার প্রভু আমাকে হেয় করেছেন’ (ফজর ৮৯/১৫-১৬)।
হাদীছের বাণী :
১০- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُّ النَّاسِ أَكْرَمُ؟ قَالَ: أَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاهُمْ. قَالُوا: لَيْسَ عَنْ هَذَا نَسْأَلُكَ. قَالَ: فَأَكْرَمُ النَّاسِ يُوسُفُ نَبِيُّ اللهِ ابْنُ نَبِيِّ اللهِ ابْنِ خَلِيلِ اللهِ. قَالُوا: لَيْسَ عَنْ هَذَا نَسْأَلُكَ قَالَ: فَعَنْ مَعَادِنِ الْعَرَبِ تَسْأَلُونِي؟ قَالُوا: نَعَمْ. قَالَ: فَخِيَارُكُمْ فِي الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُكُمْ فِي الْإِسْلَامِ إِذَا فَقُهُوا-
(১০) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হ’ল, মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী মুত্তাক্বী। তারা বলল, আমরা তো আপনাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করিনি। তিনি বললেন, তাহ’লে (সবচয়ে সম্মানিত ব্যক্তি) আল্লাহর নবী ইউসুফ, যিনি আললাহর নবী (ইয়াকুব) এর পুত্র, আল্লাহর নবী (ইসহাক)-এর পৌত্র, এবং আল্লাহর খলীল ইব্রাহীম) এর প্রপৌত্র। তারা বলল, আমরা আপনাকে এ সম্বন্ধেও জিজ্ঞাসা করিনি। তিনি বললেন, তাহ’লে কি তোমরা আরবের মূল্যবান গোত্রসমূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছ? জাহেলী যুগে তাদের মধ্যে যারা সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন, ইসলামেও তাঁরা সর্বোত্তম ব্যক্তি যদি তাঁরা ইসলামী জ্ঞানার্জন করেন’।[1]
১১- عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ قَالَ: فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ، فَيَقُولُ أَمِيرُهُمْ: تَعَالَ صَلِّ لَنَا فَيَقُولُ: لَا إِنَّ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ أُمَرَاءُ، تَكْرِمَةَ اللهِ هَذِهِ الْأُمَّةَ-
(১১) জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমার উম্মতের একদল লোক সত্যের উপর দৃঢ় থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে বিজয়ীরূপে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকবে। তিনি বলেন, অতঃপর ঈসা ইবনু মারিয়াম (আঃ) অবতরণ করবেন। সে সময়ের লোকেদের আমীর বা নেতা (ইমাম মাহদী) তাকে বলবেন, আপনি এদিকে আসুন এবং লোকদেরকে ছালাত আদায় করিয়ে দিন। তিনি বলবেন, না; বরং তোমরা একে অপরের ইমাম। আল্লাহ এ উম্মাতকে মর্যাদা দান করেছেন’।[2]
১২- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يُؤْتَى بِالعَبْدِ يَوْمَ القِيَامَةِ فَيَقُولُ اللهُ لَهُ: أَلَمْ أَجْعَلْ لَكَ سَمْعًا وَبَصَرًا وَمَالًا وَوَلَدًا وَسَخَّرْتُ لَكَ الأَنْعَامَ وَالحَرْثَ، وَتَرَكْتُكَ تَرْأَسُ وَتَرْبَعُ فَكُنْتَ تَظُنُّ أَنَّكَ مُلَاقِي يَوْمَكَ هَذَا؟ فَيَقُولُ: لَا فَيَقُولُ لَهُ: اليَوْمَ أَنْسَاكَ كَمَا نَسِيتَنِي-
(১২) আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে উপস্থিত করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলবেন, আমি কি তোমাকে কান-চোখ, সম্পদ-সন্তান, তোমার জন্য চতুষ্পদ জন্তু ও কৃষিকে কি অনুগত করে দেইনি? আর তোমাকে নেতৃত্ব দেয়া ও ভোগ করার সুযোগ দিয়েছি। (এত কিছুর পর) তুমি কি চিন্তা করেছিলে এ দিনে আমার সাথে তোমার সাক্ষাত হবে? রাসূল বলেন, সে বলবে, না। অতঃপর তিনি তাকে বলবেন, আজ আমি তোমাকে ভুলে যাব, যেমন তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছিলে’।[3]
১৩- عَنْ هِشَامٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ: مَرَّ هِشَامُ بْنُ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ عَلَى أُنَاسٍ مِنَ الْأَنْبَاطِ بِالشَّامِ، قَدْ أُقِيمُوا فِي الشَّمْسِ، فَقَالَ: مَا شَأْنُهُمْ؟ قَالُوا: حُبِسُوا فِي الْجِزْيَةِ، فَقَالَ هِشَامٌ: أَشْهَدُ لَسَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: إِنَّ اللهَ يُعَذِّبُ الَّذِينَ يُعَذِّبُونَ النَّاسَ فِي الدُّنْيَا-
(১৩) হিশাম (রাঃ)-এর পিতা হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার হিশাম ইবনু হাকীম ইবনু হিযাম সিরিয়ার কৃষকদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এদের কঠিন রৌদ্রে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। তিনি বললেন, এদের কী হয়েছে? তারা বলল, জিযয়ার জন্যে এদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অতঃপর হিশাম বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাজা দিবেন যারা পৃথিবীতে (অন্যায়ভাবে) মানুষকে সাজা দেয়’।[4]
মনীষীদের বক্তব্য :
১. ইবনু আত্বিয়া (রহঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষকে সমস্ত সৃষ্টি জীবের উপর মর্যাদা দান করেছেন তার জ্ঞানের কারণে। আর জ্ঞান দ্বারা তিনি মানুষকে পরিচিত করেন এবং কথা বলার মাধ্যমে পারস্পরিক বুঝ দান করেন’।[5]
২. ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই ইল্ম তার অধিকারীকে দুনিয়া ও আখেরাতে মর্যাদাবান করে, যা রাজত্ব, সম্পদ বা অন্য কিছু করতে পারে না’।[6]
৩. ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, উচ্চমর্যাদা ও ক্ষমতা লাভের মোহে মানুষের মন যথাসম্ভব পরিপূর্ণ থাকে’।[7]
সারবস্ত্ত : (১) ইসলামে একজন অমুসলিম কিংবা যিম্মীরও মর্যাদা ও অধিকার রয়েছে। যা একজন দায়িত্বশীল মুসলিমকে তা প্রদান করা অত্যাবশ্যকীয়। (২) সম্মান বা মর্যাদার একমাত্র মানদন্ড হচ্ছে তাক্বওয়া। তাক্বওয়াশীল আমলে ছালেহ সম্পাদনকারী ব্যক্তির মর্যাদাই আল্লাহর নিকটে বেশী। (৩) ইসলাম সাম্যের ধর্ম, পরস্পরের মর্যাদা ও গোপনীয়তা রক্ষার ধর্ম। ফলে একে অপরের মর্যাদা রক্ষা করা আবশ্যক। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন।-আমীন!
[1]. বুখারী হা/৩৩৭৪; মুসলিম হা/২৩৭৮; মিশকাত হা/৪৮৯৩।
[2]. মুসলিম হা/১৫৬; মিশকাত হা/৫৫০৭।
[3]. তিরমিযী হা/২৪২৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৯১।
[4]. মুসলিম হা/২৬১৩; মিশকাত হা/৩৫২২।
[5]. বাহরুল মুহীত ৬/৫৮ পৃ.।
[6]. ফাযলুল ইলম ওয়াল ওলামা ৮৬ পৃ.।
[7]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূঊ ফাতাওয়া ৮/২১৮ পৃ.।