বিশুদ্ধ আক্বীদা : গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
শরীফুল ইসলাম মাদানী 138 বার পঠিত
তৃতীয় দলীল : আব্দুর রহমান ইবনু আব্দুল ক্বারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি ওমর (রাঃ)-এর সাথে রামাযানের এক রাতে মসজিদের দিকে বের হলাম। আর মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে ছালাত আদায় করছিল। কেউ একাকী ছালাত আদায় করছিল আবার কেউ কয়েকজনকে সাথে নিয়ে ছালাত আদায় করছিল। ওমর (রাঃ) বললেন, আমি মনে করি যে, আমি যদি এই লোকগুলিকে একজন ক্বারী (ইমাম)-এর পেছনে একত্রিত করে দেই, তবে তা উত্তম হবে। এরপরে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উবাই ইবনু কা‘বের পেছনে সকলকে একত্রিত করে দিলেন। তারপর অন্য এক রাতে আমি ওমর (রাঃ)-এর সাথে বের হ’লাম। তখন লোকেরা তাদের ইমামের সাথে ছালাত আদায় করছিল। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ ‘কতই না সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা’! তোমরা রাতে যে অংশে ঘুমিয়ে থাক তা রাতের ঐ অংশ অপেক্ষা উত্তম যে অংশে তোমরা ছালাত আদায় কর। এর দ্বারা তিনি শেষ রাত বুঝিয়েছেন। কেননা লোকেরা তখন রাতের প্রথম অংশে ছালাত আদায় করত’।[1]
জবাব : প্রথমত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ- ‘নিশ্চয়ই সকল প্রকার বিদ‘আত ভ্রষ্টতা’।[2] অতএব এর বিপরীতে অন্য কারো বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি নবী (ছাঃ)-এর পরে উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ আবুবকর (রাঃ), ওমর (রাঃ), ওছমান (রাঃ) ও আলী (রাঃ)-এর উক্তিও নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ- ‘অতএব যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সাবধান হৌক যে, যেন সতর্ক হয় যে, ফিৎনা তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা মর্মন্তুদ শাস্তি তাদের উপর আপতিত হবে’ (নূর ২৪/৬৩)।
ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন,أَتَدْرِيْ مَا الْفِتْنَةُ؟ اَلْفِتْنَةُ الشِّرْكُ لَعَلَّهُ إِذَا رَدَّ بَعْضَ قَوْلِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَقَعَ فِيْ قَلْبِهِ شَيْءٌ مِنَ الزَّيْغِ فَيُهْلِكُ- ‘তুমি কি জানো ফিৎনা কি? ফিৎনা হ’ল শিরক। কেউ যখন রাসূল (ছাঃ)-এর কোন হাদীছ প্রত্যাখ্যান করে, তখন তার হৃদয়ে ভ্রষ্টতা উৎপন্ন হয়। ফলে সে ধ্বংস হয়ে যায়’।[3]
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,يُوْشِكُ أَنْ تُنْزَلَ عَلَيْكُمْ حِجَارَةً مِنَ السَّمَاءِ أَقُوْلُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَتَقُوْلُوْنَ قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ وَعُمَرُ- ‘আশংকা হয় যে, আকাশ থেকে তোমাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করা হবে। আমি বলছি যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আর তোমরা বলছ, আবুবকর ও ওমর (রাঃ) বলেছেন’।[4]
দ্বিতীয়ত আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে, আমীরুল মুমিনীন ওমর (রাঃ) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর বাণীকে সম্মান করার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক দৃঢ় ছিলেন। তিনি আল্লাহর নাযিলকৃত দন্ডবিধি সম্পর্কে অবগতির ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিলেন। এমনকি তিনি আল্লাহর বাণীর নিকট আত্মসমপর্ণকারী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। সুতরাং ওমর (রাঃ)-এর ক্ষেত্রে একথা বলা অনুচিত যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণীর বিরোধিতা করে কোন বিদ‘আত সম্পর্কে বলবেন, نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ (এটা উত্তম বিদ‘আত)? অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেই রামাযান মাসে ক্বিয়ামুল লাইল জামা‘আতবদ্ধভাবে আদায় করেছেন। হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে এক রাত্রিতে (তারাবীহ) ছালাত আদায় করলেন। তাঁর সাথে কিছু মানুষও ছালাত আদায় করল। অতঃপর পরবর্তী দিনও তিনি তারাবীহর ছালাত আদায় করলেন। এতে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেল। অতঃপর ৩য় বা ৪র্থ রাত্রিতে লোকেরা সমবেত হ’ল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের নিকট বের হ’লেন না। সকাল বেলায় তিনি বললেন, তোমরা যা করেছ আমি তা প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু আমি তোমাদের উপর ফরয হয়ে যাওয়ার আশংকা করছিলাম। কারণ (ফরয হয়ে গেলে) তোমরা তা পালন করতে অক্ষম হবে। এছাড়া অন্য কোন কারণ আমাকে তোমাদের নিকট বের হ’তে বাধা দেয়নি’।[5]
অত্র হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ওমর (রাঃ) জামা‘আতবদ্ধভাবে তারাবীহর ছালাত আরম্ভ করেননি। বরং তা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত। তিনি তারাবীহর ছালাত তিন দিন জামা‘আতের সাথে আদায় করার পরে উম্মতের উপর তা ফরয হওয়ার আশংকায় জামা‘আত ত্যাগ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে যেহেতু তা ফরয হওয়ার আশংকা দূরীভূত হয়েছে, সেহেতু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অনুমোদিত সেই সুন্নাতকেই ওমর (রাঃ) কেবল পুনর্জীবিত করেছিলেন মাত্র।
তৃতীয়ত ওমর (রাঃ) জামা‘আতবদ্ধভাবে তারাবীহর ছালাতকে বিদ‘আত বলেছিলেন আভিধানিক অর্থে। কেননা আবুবকর (রাঃ)-এর যামানায় ও ওমর (রাঃ)-এর প্রথম যামানায় তারাবীহর ছালাত জামা‘আতবদ্ধভাবে আদায় হ’ত না। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর ফরয হওয়ার আশংকায় ত্যাগকৃত জামা‘আতবদ্ধভাবে তারাবীহর ছালাত আদায়ের সুন্নাতকে পুনর্জীবিত করেছিলেন বলেই আভিধানিক অর্থে এটাকে বিদ‘আত বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে বিদ‘আত বলে আখ্যায়িত করলেও পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অবশ্যই বিদ‘আত নয়।
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন,قَوْلُ عُمَرَ نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ فَأَكْثَرُ مَا فِيْهِ تَسْمِيَةُ عُمَرَ تِلْكَ بِدْعَةً مَعَ حُسْنِهَا، وَهَذِهِ تَسْمِيَةٌ لُغَوِيَّةٌ، لاَ تَسْمِيَةٌ شَرْعِيَّةٌ. وَذَلِكَ أَنَّ الْبِدْعَةَ فِيْ اللُّغَةِ تَعُمُّ كُلَّ مَا فُعِلَ اِبْتِداءً مِنْ غَيْرِ مِثَالٍ سَابِقٍ، وَأَمَّا الْبِدْعَةُ الشَّرْعِيَّةُ : فَمَا لَمْ يَدُلَّ عَلَيْهِ دَلِيْلٌ شَرْعِيٌّ- ‘ওমর (রাঃ)-এর উক্তি, ‘এটা উত্তম বিদ‘আত’ বলার মধ্যে বেশীর বেশী এতটুকু আছে যে, তিনি সেটাকে বিদ‘আতে হাসানাহ হিসাবে নামকরণ করেছেন। এই নামকরণ আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে; পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। আভিধানিক দৃষ্টিতে বিদ‘আত ঐ সকল নতুন সৃষ্টিকে বোঝায়, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। আর পারিভাষিক দৃষ্টিতে বিদ‘আত হ’ল, যা শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয়’।[6]
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘বিদ‘আত দুই প্রকার। পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ‘আত। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী ‘নিশ্চয়ই সকল নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত এবং সকল প্রকার বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’। আর আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ‘আত হয়। যেমন- আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) লোকদেরকে তারাবীহর ছালাতের জন্য একত্রিত করেন এবং সর্বদা এ আমল করার জন্য উৎসাহিত করে বলেন, ‘এটা কতই না সুন্দর বিদ‘আত’।[7]
চতুর্থ দলীল : বর্তমান পৃথিবীতে এমন কিছু নতুন বিষয় রয়েছে যা মুসলিম সমাজ গ্রহণ করেছে এবং তার উপর আমল করছে। অথচ সেগুলো রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে পরিচিত ছিল না। যেমন মাদ্রাসা নির্মাণ, গ্রন্থ রচনা প্রভৃতি। এগুলিকে মুসলিম সমাজ উত্তম কাজ হিসাবে গণ্য করেছে ও তার উপর আমল করছে এবং তারা এগুলোকে। যদি ইসলামী শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানাহর কোন অস্তিত্ব না থাকে তাহ’লে উল্লিখিত ভালো কাজগুলো বাতিল হয়ে যাবে।
জবাব : প্রকৃতপক্ষে এগুলো বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং এটা শরী‘আতসম্মত কাজের একটা মাধ্যম মাত্র। আর মাধ্যম সমূহ স্থান ও কালের আবর্তনে ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই মাধ্যমগুলোর বিধান উদ্দেশ্যগুলোর বিধানের আওতাভুক্ত হয়। কাজেই শরী‘আতসম্মত বিষয়ের মাধ্যমগুলো বৈধ এবং শরী‘আত বিরোধী মাধ্যমগুলো অবৈধ। যেমন- আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَسُبُّواْ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ فَيَسُبُّواْ اللهَ عَدْواً بِغَيْرِ عِلْمٍ- ‘আল্লাহকে ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিবে’ (আন‘আম ৬/১০৮)। মুশরিকদের ইলাহসমূহকে গালি দেওয়া সীমালংঘন নয়, বরং সত্য ও উপযুক্ত। কিন্তু আল্লাহকে গালি দেওয়া সীমালংঘন ও যুলুম। কিন্তু মুশরিকদের ইলাহকে গালি দেওয়ার মত প্রশংসিত কাজ যখন আল্লাহকে গালি দেওয়ার মত ঘৃণিত কাজের কারণ হয়ে গেল, তখন সেটা (বিধর্মীদের উপাস্যকে গালি দেয়া) হারাম ও নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
অনুরূপভাবে ছুরি একটি ধারালো অস্ত্র, যা দ্বারা মানুষ হত্যা করা যায় এবং কুরবানীর পশুও যবেহ করা যায়। এক্ষণে যদি ছুরি তৈরী করা হয় মানুষ হত্যার উদ্দেশ্যে তাহ’লে ছুরি তৈরী করা হারাম। আর যদি তা কুরবানীর পশু যবেহ করার উদ্দেশ্যে হয়, তাহ’লে তা বৈধ।
অতএব মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও গ্রন্থ রচনা যদিও শাব্দিক অর্থে বিদ‘আত যা রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় ছিল না, কিন্তু এটা শারঈ জ্ঞান চর্চার একটা মাধ্যম মাত্র। আর মাধ্যম সমূহের জন্য উদ্দেশ্য সমূহের বিধান প্রযোজ্য। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি হারাম জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য মাদ্রাসা বা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, তবে তার ভবন নির্মাণও হারাম সাব্যস্ত হবে। আর যদি কেউ দ্বীনী জ্ঞান শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তবে তার ভবন নির্মাণ বৈধ বা শরী‘আতসম্মত হবে। কিন্তু এটাকে বিদ‘আতে হাসানাহ বলার কোন অবকাশ নেই। কেননা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা সরাসরি কোন ইবাদত নয়; বরং এটা আল্লাহর ইবাদত সম্পর্কে জ্ঞান লাভের একটি মাধ্যম মাত্র।
পঞ্চম দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় কুরআন লিপিবদ্ধ ছিল না। ছাহাবায়ে কেরাম তাঁর মৃত্যুর পরে কুরআন জমা করেছেন এবং লিপিবদ্ধ করেছেন। আর নিশ্চয়ই এটা উত্তম কাজ যা রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে করা হয়েছে। যদি ইসলামী শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানাহ বৈধ না হ’ত, তাহ’লে কুরআনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত।
জবাব : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশেই কুরআন লিপিবদ্ধ হয়েছিল। তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে পাথর, খেজুর পাতা, হাড্ডি ইত্যাদিতে সংরক্ষিত ছিল। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কোন সূরার মধ্যে কম-বেশী হওয়ার আশংকায় একত্রে জমা করার নির্দেশ দেননি। তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে অহী নাযিলের আশংকা দূর হয়ে গেছে। সাথে সাথে কুরআন জমা করার প্রতিবন্ধকতাও দূরীভূত হয়েছে। এছাড়াও ইয়ামামার যুদ্ধে বহু সংখ্যক কুরআনের হাফেয শাহাদতবরণ করেছিলেন। এভাবে কুরআনের হাফেয শাহাদতবরণ করলে কুরআনের কিছু আয়াত হাদীছ হারিয়ে যেতে পারে এই আশংকায় ছাহাবায়ে কেরাম ঐক্যমতের ভিত্তিতে কুরআন সংকলন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, যা ইজমায়ে ছাহাবা হিসাবে পরিগণিত। আর ইজমায়ে ছাহাবা একটি অকাট্য দলীল।
যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়ামামার যুদ্ধে বহু লোক শহীদ হওয়ার পর আবুবকর (রাঃ) আমাকে ডেকে পাঠালেন। এ সময় ওমর (রাঃ) তাঁর নিকটে উপস্থিত ছিলেন। আবুবকর (রাঃ) বললেন, ওমর আমার কাছে এসে বলেছেন, ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদদের মধ্যে ক্বারীদের (হাফেয) সংখ্যা অনেক। আমি আশংকা করছি, এভাবে যদি ক্বারীগণ শহীদ হয়ে যান, তাহ’লে কুরআনের বহু অংশ হারিয়ে যাবে। অতএব আমি মনে করি যে, আপনি কুরআন সংকলনের নির্দেশ দিন। উত্তরে আমি ওমরকে বললাম, যে কাজ রাসূল (ছাঃ) করেননি সে কাজ তুমি কিভাবে করবে? জবাবে ওমর বললেন, আল্লাহর কসম! এটা একটি উত্তম কাজ। ওমর এ কথা বার বার বলতে থাকলে অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা এ কাজের জন্য আমার বক্ষকে প্রশস্ত করে দিলেন এবং এ ব্যাপারে ওমর যা ভালো মনে করলেন আমিও তা ভালো মনে করলাম। যায়েদ বলেন, তখন আবুবকর (রাঃ) আমাকে বললেন, তুমি একজন বুদ্ধিমান যুবক। তোমার ব্যাপারে আমার কোন সংশয় নেই। তদুপরি তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর অহী লেখক ছিলে। সুতরাং তুমি কুরআন মাজীদের অংশগুলিকে অনুসন্ধান করে একত্রিত কর। আল্লাহর শপথ! তারা যদি আমাকে একটি পর্বত এক স্থান থেকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিতেন, তাহ’লেও তা আমার কাছে কুরআন সংকলনের নির্দেশের চেয়ে কঠিন মনে হ’ত না। আমি বললাম, যে কাজ রাসূল (ছাঃ) করেননি সে কাজ আপনারা কিভাবে করবেন? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এটি একটি কল্যাণকর কাজ। এ কথাটি আবুবকর (রাঃ) বার বার আমার কাছে বলতে থাকলেন। অবশেষে আল্লাহ এ কাজের জন্য আমার বক্ষকে উন্মোচন করে দিলেন, যেমন উন্মোচন করেছিলেন আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর বক্ষকে। এরপর আমি কুরআন অনুসন্ধানের কাজে লেগে গেলাম এবং খেজুর পাতা, প্রস্তরখন্ড এবং মানুষের বক্ষ থেকে আমি তা সংগ্রহ করতে থাকলাম...।[8]
দ্বিতীয়ত আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ ‘এটা (কুরআন) সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই’ (ক্বিয়ামাহ্ ৭৫/১৭)। সুতরাং তিনিই ছাহাবায়ে কেরামের অন্তরে কুরআন সংকলনের প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি জাগ্রত করার মাধ্যমে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন।
তৃতীয়ত কুরআন জমা করার মাধ্যমে নতুন কোন ইবাদতের জন্ম দেওয়া হয়নি; বরং তা সংকলনের মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতির নিকটে আল্লাহর বিধান সহজভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাথে সাথে তা সংরক্ষণের পথকে দৃঢ় এবং মুখস্থ করার পথকে সুগম করা হয়েছে। অতএব কুরআন সংকলনের মত প্রশংসনীয় কাজকে বিদ‘আতে হাসানাহ বৈধতার দলীল পেশ করা মূর্খতা বৈ কিছুই নয়।
ষষ্ঠ দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় জুম‘আর একটি আযানই প্রচলিত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে ওছমান (রাঃ) সর্বপ্রথম দ্বিতীয় আযান চালু করেন। ইসলামী শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানাহ বৈধ না হ’লে ওছমান (রাঃ)-এর মত বিশিষ্ট ছাহাবী দ্বিতীয় আযান চালু করতেন না।
জবাব : যুহরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি সায়েব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবুবকর এবং ওমর (রাঃ)-এর যুগে জুম‘আর দিন ইমাম যখন মিম্বারের উপর বসতেন তখন প্রথম আযান দেওয়া হ’ত। অতঃপর যখন ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি জুম‘আর দ্বিতীয় আযানের নির্দেশ দেন। ‘যাওরা’ নামক স্থান থেকে এই আযান দেওয়া হয়। পরে এ আযানের সিলসিলা চলতে থাকে’।[9]
উল্লিখিত হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবুবকর (রাঃ), ওমর (রাঃ)-এর যামানায় এবং ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের প্রথম দিকেও জুম‘আর আযান একটিই ছিল। তারপর ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে মসজিদে নববীর অনতিদূরে ‘যাওরা’ নামক বাজারে মানুষ ব্যস্ত থাকত। তদানীন্তনকালে মাইক এবং ঘড়ি না থাকার কারণে মানুষ আযান শুনতে পেত না এবং জুম‘আর ছালাতের সময় বুঝতে পারত না। এহেন প্রেক্ষাপটে ওছমান (রাঃ) একই সময়ে উক্ত বাজারে অতিরিক্ত একটি আযান দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে মানুষ জুম‘আর সময় বুঝতে পারে। তবে বর্তমানে মাইক, ঘড়িসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে; ফলে আযান শোনা ও ছালাতের সময় বুঝতে পারার প্রতিবন্ধকতাও দূর হয়েছে। সাথে সাথে জুম‘আর অতিরিক্ত আযানের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে গেছে। কেননা ওছমান (রাঃ) কর্তৃক চালুকৃত উক্ত আযান যদি সকল মসজিদের জন্য অপরিহার্য হ’ত তাহ’লে তিনি নিজেই সকল মসজিদে জুম‘আর অতিরিক্ত আযান চালু করতেন। অথচ তিনি শুধুমাত্র ‘যাওরা’ বাজারেই উক্ত আযান চালু করেছিলেন; কোন মসজিদে চালু করেননি। ওছমান (রাঃ)-এর মৃত্যুর পরে আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালেও অন্য কোথাও উক্ত আযান চালু ছিল না। এমনকি মক্কাতেও নয়। অতএব ওছমান (রাঃ)-এর উক্ত নির্দেশ কখনোই সর্ব যুগের সকল মসজিদে জুম‘আর অতিরিক্ত আযান বৈধ হওয়ার দলীল হ’তে পারে না।
সপ্তম দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের এমন কতগুলি আমলকে স্বীকৃতি দিয়েছেন যা তিনি নিজে করেননি এবং করতেও বলেননি। যেমন- (ক) একদা প্রচন্ড শীতের কারণে আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) অপবিত্র অবস্থায় গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করে ছালাত আদায় করলে রাসূল (ছাঃ) তা স্বীকৃতি দিয়েছেন’।[10] (খ) প্রত্যেক ওযূর পরে বেলাল (রাঃ)-এর দুই রাক‘আত ছালাতকে রাসূল (ছাঃ) স্বীকৃতি দিয়েছেন’।[11] (গ) ছুটে যাওয়া ফজরের পূর্বের দুই রাক‘আত সুন্নাতকে ফরয ছালাতের পরপরই আদায় করাকে রাসূল (ছাঃ) স্বীকৃতি দিয়েছেন। যেমন- ক্বায়েস ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, একদা নবী করীম (ছাঃ) একজন লোককে ফজরের ফরয ছালাতের পর দু‘রাক‘আত ছালাত আদায় করতে দেখে বললেন, ফজরের ছালাত কি দু’বার? তখন লোকটি বলল, আমি ফজরের পূর্বে দু’রাক‘আত পড়িনি। তখন রাসূল (ছাঃ) চুপ হয়ে থাকলেন’।[12]
অতএব ইসলামী শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানাহ বৈধ বলেই রাসূল (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের উল্লিখিত ভালো আমলগুলিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
জবাব : রাসূল (ছাঃ) যেমন ছাহাবায়ে কেরামের কিছু ভালো আমলকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তেমনি তিনি ছাহাবায়ে কেরামের কতগুলি আমলকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, যা তাঁরা উত্তম আমল হিসাবেই গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। যেমন আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা তিন জনের একটি দল রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের বাড়ীতে আসল। তারা রাসূল (ছাঃ)-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। যখন তাদেরকে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জানানো হ’ল তখন তারা এটিকে কম মনে করল। অতঃপর তারা বলল, রাসূল (ছাঃ) কোথায় আর আমরা কোথায়? তাঁর পূর্বের ও পরের সকল পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তারপর তাদের একজন বলল, আমি প্রতি রাত জেগে ছালাত আদায় করব। অপর ব্যক্তি বলল, আমি প্রতিদিন ছিয়াম পালন করব, কখনো ছিয়াম ত্যাগ করব না। অপর ব্যক্তি বলল, আমি নারীর সংশ্রব থেকে দূরে থাকব এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের নিকট আসলেন এবং বললেন, তোমরাই কি তারা, যারা এরূপ এরূপ মন্তব্য করেছ? সাবধান! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের চাইতে আল্লাহকে বেশী ভয় করি এবং আমি সবচেয়ে পরহেযগার। কিন্তু আমি রাত্রের কিছু অংশে (নফল) ছালাত আদায় করি এবং কিছু অংশ ঘুমাই। কোন কোন দিন (নফল) ছিয়াম পালন করি এবং কোন কোন দিন ছিয়াম ত্যাগ করি। আর আমি বিবাহ করেছি। فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ ‘অতএব যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হ’তে বিমুখ হবে (সুন্নাত পরিপন্থী আমল করবে), সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[13]
অত্র হাদীছে উল্লিখিত তিন জন ছাহাবীর কারো উদ্দেশ্যই খারাপ ছিল না। আর ছালাত আদায় করা, ছিয়াম পালন করা অবশ্যই ভালো কাজ। আরেকজন বিবাহ না করে সর্বদা আল্লাহর ইবাদত করতে চেয়েছিল, তারও উদ্দেশ্য ভালো ছিল। অথচ রাসূল (ছাঃ) তাদের উল্লিখিত ভালো আমলগুলিকে স্বীকৃতি দেননি; বরং তাদেরকে সুন্নাত পরিপন্থী আমল হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন এবং উম্মত থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার মত কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
সম্মানিত পাঠক! রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে বলে গেছেন, تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ، لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ- ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা সে দু’টিকে অাঁকড়ে ধরে থাকবে ততক্ষণ তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হ’ল, আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত’।[14]
আর সুন্নাত হ’ল, مَا نُقِلَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ أَوْ تَقْرِيْرٍ وَعَلَى مَا جَاءَ عَنِ الصَّحَابَةِ أَو الخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ- ‘নবী করীম (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতি থেকে যা বর্ণিত হয়েছে এবং যা ছাহাবায়ে কেরাম ও খুলাফায়ে রাশেদীনের পক্ষ থেকে এসেছে’।[15]
উপসংহার : অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা করতে বলেছেন ও যা তিনি নিজে করেছেন, তা করা সুন্নাত। আর যা তিনি করতে বলেননি এবং নিজেও করেননি। কিন্তু অন্য কাউকে করতে দেখলে তাকে নিষেধ করেননি, তাঁর এরূপ মৌনসম্মতিও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের পরবর্তী যুগে সৃষ্ট কোন আমলই সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত হবে না; বরং তা সুন্নাত পরিপন্থী আমল হিসাবে গণ্য হবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বর্তমানে বেঁচে নেই যে, তিনি মৌনসম্মতি প্রদান করবেন! সুতরাং সুন্নাত পরিপন্থী কোন আমল ইসলামী শরী‘আতে জায়েয হওয়ার আর কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন-আমীন!
[লেখক : কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]
[1]. বুখারী হা/২০১০, ‘ছিয়াম’ অধ্যায়; মিশকাত হা/১৩০১।
[2]. ইবনু মাজাহ, ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ, হা/৪২।
[3]. ছালেহ আল-উছায়মীন, শরহে রিয়াযুছ ছালেহীন, ১/১৭৯; তাফসীর ইবনে কাছীর ২/৩৪৮; সূরা নিসা ৬৪-৬৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[4]. শরহে রিয়াযুছ ছালেহীন, ১/১৭৯; ইবনু তায়মিয়া, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ২০/২৫০; তাফসীর ইবনে কাছীর ২/৩৪৮ পৃ.; সূরা নিসা ৬৪-৬৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[5]. বুখারী হা/২০১২; মুসলিম হা/৭৬১।
[6]. শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ, ইকতিযাউছ ছিরাতিল মুস্তাক্বীম ২/৯৫ পৃ.।
[7]. তাফসীর ইবনু কাছীর ১/১৬৬ পৃৃৃৃৃঃ; সূরা বাকারার ১১৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[8]. বুখারী হা/৭১৯১।
[9]. বুখারী হা/৯১৬, ‘জুম‘আ’ অধ্যায়; মিশকাত হা/১৪০৪।
[10]. আবুদাউদ হা/৩৩৪, ‘নাপাক অবস্থায় ঠান্ডার আশংকায় তায়াম্মুম করা’ অনুচ্ছেদ, সনদ ছহীহ।
[11]. তিরমিযী হা/৩৬৮৯; মিশকাত হা/১৩২৬; ছহীহ তারগীব হা/২০১।
[12]. আবুদাউদ হা/১২৬৭; ইবনু মাজাহ হা/১১৫৪; মিশকাত হা/১০৪৪, সনদ ছহীহ।
[13]. বুখারী হা/৫০৬৩; মিশকাত হা/১৪৫, ‘কিতাব ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[14]. মুওয়াত্তা মালেক হা/৩৩৩৮, মিশকাত হা/১৮৬, অনুচ্ছেদ ঐ, বঙ্গানুবাদ মিশকাত ১/১৩২ পৃ.; সনদ হাসান।
[15]. আল-মাকাছেদ ইনদাল ইমাম শাতেবী ১/৪৮৩ পৃ.।