যে কান্নায় আগুন নেভে (২য় কিস্তি)

আব্দুল্লাহ 312 বার পঠিত

কুরআন পাঠের সময় কান্না : কুরআন তেলাওয়াতের সময় কবরের আযাব, ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা, জাহান্নামের শাস্তি ইত্যাদি বর্ণনা আসলে ছাহাবী, তাবেঈসহ সালাফদের অনেকে কেঁদে ফেলতেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল :

(১) ইয়াহইয়া ইবনু ফুযায়েল আল-উনায়সী হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, যারা মুহাম্মাদ ইবনু মুনকির হ’তে বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে কাউকে আমি বলতে শুনেছি যে, এক রাতে তিনি ছালাত আদায় করছিলেন। হঠাৎ তিনি ক্রন্দন করতে লাগলেন এবং তার কান্না তীব্র থেকে তীব্রতর হ’ল। এমনকি তার পরিবার ভয় পেয়ে গেল। তারা তাকে কান্নার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু তিনি তীব্র কান্নার কারণে কিছুই বলতে পারলেন না। বরং তার কান্না অব্যাহতভাবে চলতে থাকল। অতঃপর তারা তাকে ইবনু হাযেমের কাছে প্রেরণ করলেন। ইবনু হাযেম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিসে আপনাকে কাঁদিয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, একটি আয়াত। ইবনু হাযম বললেন, কি সে আয়াত? তিনি বললেন, আল্লাহ বলেন, وَبَدَا لَهُمْ مِنَ اللهِ مَا لَمْ يَكُونُوا يَحْتَسِبُونَ- ‘অথচ সেদিন আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাদের জন্য এমন শাস্তি প্রকাশিত হবে, যা তারা কল্পনাও করেনি’ (যুমার ৩৯/৪৭)। অতঃপর ইবনু হাযমও তার সাথে কাঁদতে লাগলেন। এমনকি তাদের কান্না খুবই তীব্র হ’ল’।[1]

(২) একদা আমর ইবনু উতবাহ ছালাতে দাঁড়ালেন। অতঃপর তিনি ক্বিরাআত পড়তে পড়তে এই আয়াতে পৌঁছালেন,وَأَنْذِرْهُمْ يَوْمَ الْآزِفَةِ إِذِ الْقُلُوبُ لَدَى الْحَنَاجِرِ كَاظِمِيْنَ مَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ حَمِيْمٍ وَلَا شَفِيْعٍ يُطَاعُ- ‘তুমি তাদেরকে আসন্ন (ক্বিয়ামত) দিবস সম্পর্কে সতর্ক করে দাও। যেদিন দম বন্ধ হয়ে প্রাণসমূহ ওষ্ঠাগত হবে। যেদিন যালেমদের কোন বন্ধু থাকবে না বা কোন সুফারিশকারী থাকবেনা, যা কবুল করা হবে’ (গাফের ৪০/১৮)। তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে ক্বিরাআত বন্ধ করে দিলেন এবং বসে পড়লেন। অতপর আবার দাঁড়ালেন এবং ক্বিরাআত শুরু করলেন। অতঃপর আবার বসে পড়লেন। এভাবে সকাল হয়ে গেল’।[2]

(৩) ক্বাসেম ইবনু মা‘আন হ’তে বর্ণিত, আবু হানীফা এক রাতে ছালাতে দাঁড়িয়ে এই আয়াতটি বারবার পড়ছিলেন, بَلِ إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَنَهَرٍ- ‘নিশ্চয়ই মুত্তাক্বীরা থাকবে জান্নাতে ও নদী সমূহের মাঝে’ (ক্বামার ৫৪/৪৬)। অতঃপর তিনি ফজর পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করেছিলেন’।[3]

(৪) আহমাদ ইবনু সাহল আল-হারী বলেন, একদিন আমি বকর ইবনু কুতায়বা ইবনু আব্দুল্লাহর পাশে ছিলাম। আমি এশার ছালাতের পর চলে আসলাম। তখন তিনি এই আয়াত পড়ছিলেন,يَادَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ- ‘হে দাঊদ! আমরা তোমাকে পৃথিবীতে শাসক নিযুক্ত করেছি। অতএব তুমি লোকদের মধ্যে ন্যায়বিচার কর। এ বিষয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এ কারণে যে, তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে’ (ছেয়াদ ৩৮/২৬)। অতঃপর সাহরীর সময় আমি তার নিকট গেলাম। তখনও তিনি ঐ আয়াতই পাঠ করছিলেন এবং কাঁদছিলেন। আমি বুঝতে পারলাম তিনি রাতের প্রথমাংশ থেকে কেবল এই আয়াতই পড়েছেন’।[4]

(৫) ইবনু ওমর সূরা মুতাফফিফীন তেলাওয়াত করতে করতে এই আয়াত পাঠ করলেন,يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ- ‘যেদিন মানুষ দন্ডায়মান হবে বিশ্বপালকের সম্মুখে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/৬)। অতঃপর তিনি প্রচন্ড কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং ক্বিরাআত পাঠ হ’তে বিরত থাকলেন’।[5]

(৬) ইবনু ওমরের মুক্তদাস নাফে‘ বলেন, ইবনু ওমর সূরা বাক্বারাহ শেষের এই আয়াত দু’টি কখনো ক্রন্দন ব্যতীত পড়েননি,لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللهُ فَيَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ- ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর। আর তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে, তা তোমরা প্রকাশ কর বা গোপন কর, তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহ তার হিসাব নিবেন। অতঃপর তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন ও যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন। বস্ত্তত আল্লাহ সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাশালী’ (বাক্বারাহ ২/২৮৪)। অতঃপর তিনি বলেন, অবশ্যই এই হিসাব খুবই কঠিন’।[6]

(৭) ওমর ইবনু আব্দুল আযীয এক রাত্রে ছালাতে সূরা লাইল পাঠ করছিলেন। অতঃপর তিনি এই আয়াতে পৌঁছালেন। আল্লাহ বলেন, فَأَنْذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظَّى ‘অতএব আমি তোমাদেরকে প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে ভয় প্রদর্শন করছি’ (লাইল ৯২/১৪)। তখন তিনি কেঁদে ফেললেন। কিন্তু এই আয়াতকে অতিক্রম করতে পারছিলেন না। অতঃপর তিনি সূরাটি শুরু থেকে আবার পড়তে লাগলেন এবং এই আয়াতে পৌঁছালেন। কিন্তু তিনি এই আয়াতটি আবারও অতিক্রম করতে পারলেন না। এরূপ দুই অথবা তিনবার করলেন। তখন তিনি এই সূরা ব্যতীত অন্য আরেকটি সূরা পড়লেন’।[7]

(৮) আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর ঠান্ডা পানি পান করলেন এবং খুব কান্নাকাটি করলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হ’ল, কিসে আপনাকে কাঁদিয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, আমি আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত স্মরণ করছি। আল্লাহ বলেন,وَحِيْلَ بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ مَا يَشْتَهُوْنَ كَمَا فُعِلَ بِأَشْيَاعِهِمْ مِنْ قَبْلُ إِنَّهُمْ كَانُوْا فِيْ شَكٍّ مُرِيْبٍ- ‘তাদের ও তাদের (দুনিয়ায় ফিরে যাওয়ার) আকাংখার মধ্যে পর্দা পড়ে গেছে। যেমন ইতিপূর্বে তাদের সমগোত্রীয় (কাফেরদের) ক্ষেত্রে করা হয়েছে। তারা ছিল ভ্রান্তিকর সন্দেহের মধ্যে নিমজ্জিত’ (সাবা ৩৪/৫৪)। তখন আমি জানতে পারলাম যে, জাহান্নামীরা কোন কিছুর কামনা করবে না। তাদের কামনা হবে কেবল ঠান্ডা পানির। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَنَادَى أَصْحَابُ النَّارِ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَنْ أَفِيْضُوْا عَلَيْنَا مِنَ الْمَاءِ أَوْ مِمَّا رَزَقَكُمُ اللهُ قَالُوْا إِنَّ اللهَ حَرَّمَهُمَا عَلَى الْكَافِرِيْنَ- ‘আর জাহান্নামবাসীরা জান্নাতবাসীদের ডেকে বলবে, আমাদের উপর কিছু পানি ঢেলে দাও অথবা আল্লাহ তোমাদের যেসব রিযিক দিয়েছেন, তা থেকে কিছু দাও। তারা বলবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ এ দুই বস্ত্ত কাফিরদের উপর হারাম করেছেন’ (আ‘রাফ ৭/৫০)[8]

(৯) মালেক ইবনু দিনার এই আয়াতটি পাঠ করলেন,لَوْ أَنْزَلْنَا هَذَا الْقُرْآنَ عَلَى جَبَلٍ لَرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُتَصَدِّعًا مِنْ خَشْيَةِ اللهِ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ- ‘যদি এই কুরআন আমরা কোন পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম, তাহলে অবশ্যই তুমি তাকে আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ হ’তে দেখতে। আর আমরা এইসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্য বর্ণনা করি যাতে তারা চিন্তা করে’ (হাশর ৫৯/২১)। অতঃপর তিনি কাঁদলেন এবং বললেন, আমি তোমাদেরকে শপথ করে বলছি যে, এই কুরআন পাঠ করে কোন বান্দা মুমিন হ’তে পারবে না, যদি কুরআন তার অন্তরে আঘাত না হানে’।[9]

(১০) হাসান ইফতার করার জন্য এক কলস পানি নিয়ে আসলেন। অতঃপর যখন তিনি সেটা মুখের কাছে নিলেন তখন কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, আমি জাহান্নামীদের আকাঙ্খার কথা স্মরণ করছি। আল্লাহ বলেন,وَنَادَى أَصْحَابُ النَّارِ أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَنْ أَفِيْضُوْا عَلَيْنَا مِنَ الْمَاءِ أَوْ مِمَّا رَزَقَكُمُ اللهُ قَالُوْا إِنَّ اللهَ حَرَّمَهُمَا عَلَى الْكَافِرِيْنَ- ‘আর জাহান্নামবাসীরা জান্নাতবাসীদের ডেকে বলবে, আমাদের উপর কিছু পানি ঢেলে দাও অথবা আল্লাহ তোমাদের যেসব রিযিক দিয়েছেন, তা থেকে কিছু দাও। তারা বলবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ এ দুই বস্ত্ত অবিশ্বাসীদের উপর হারাম করেছেন’ (আ‘রাফ’ ৭/৫০)[10]

(১১) একদিন আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা কাঁদছিলেন। তখন তার স্ত্রীও কাঁদতে লাগলেন। তিনি তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, কিসে তোমাকে কাঁদিয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি আপনাকে কান্না করতে দেখেছি। তাই আমিও কাঁদছি। তখন তিনি বললেন, আমি এই আয়াতটি স্মরণ করে কাঁদছি,وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا- ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে সেখানে পৌঁছবে না। এটা তোমার পালনকর্তার অমোঘ সিদ্ধান্ত’ (মারইয়াম ১৯/৭১)। আর আমি জানি না যে, আমি সেখানে প্রবেশ করা হ’তে মুক্তি পাব কি না।[11]

(১২) আব্দুল্লাহ ইবনু আবী মুলাইকা হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি মক্কা থেকে মদীনা সফরে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর সাহচর্য পেয়েছি। অতঃপর যখন তিনি মদীনায় পৌঁছলেন তখন রাতের কিছু অংশে ক্বিয়াম করলেন। আবু আইয়ূব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তার ক্বিরাআত কেমন ছিল? তিনি উত্তর দিলেন, ইবনু আববাস খুবই ধীরে সুস্থে এই আয়াতটি পাঠ করলেন,وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنْتَ مِنْهُ تَحِيدُ- ‘আর মৃত্যু যন্ত্রণা আসবেই সুনিশ্চিতভাবে। যা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াতে’ (ক্বফ ৫০/১৯)। এরপর ফুঁফাতে লাগলেন’।[12]

(১৩) আয়েশা (রাঃ)-কে পাঠ করেন,وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا- ‘আর তোমরা নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করবে। প্রাচীন জাহেলী যুগের ন্যায় সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না। তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হও। হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে’ (আহযাব ৩৩/৩৩)। অতঃপর আয়েশা (রাঃ) কাঁদতে কাঁদতে তার উড়না ভিজিয়ে ফেললেন’।[13]

(১৩) বশীর হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, এক রাত্রে আমি রবী‘ বিন খুছাইম-এর নিকট থাকার জন্য মনস্থ করলাম। যখন তিনি রাত্রে ছালাতে দাঁড়ালেন। তখন তিনি এই আয়াতটি পড়ছিলেন,أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَنْ نَجْعَلَهُمْ كَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ- ‘যারা পাপসমূহ অর্জন করে, তারা কি ভেবেছে যে, আমরা তাদের বাঁচা ও মরাকে তাদের সমান গণ্য করব, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মাদি সম্পাদন করে? কতই না মন্দ সিদ্ধান্ত তারা নিয়ে থাকত’ (জাছিয়াহ ৪৫/২১)। অতঃপর তিনি রাত্রে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সকাল করে ফেললেন। তথাপিও অধিক কান্নার কারণে তিনি এই আয়াতটিকে অতিক্রম করে অন্য আয়াতে যেতে পারেননি’।[14]

(১৪) ইব্রাহীম ইবনু আশ‘আস বলেন, এক রাত্রে ফুযায়েলকে আমি সূরা মুহাম্মাদ পড়ে কান্না করতে শুনলাম। তিনি এই আয়াতটি বারবার পড়ছিলেন, وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا- ‘আর তোমরা নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করবে। প্রাচীন জাহেলী যুগের ন্যায় সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না। তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হও। হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩১)। এবং বলতে লাগলেন,إِنَّكَ إِنْ بَلَوْتَ أَخْبَارَنَا هَتَكَتْ أَسْتَارَنَا إِنَّكَ إِنْ بَلَوْتَ أَخْبَارَنَا فَضَحْتَنَا ‘(হে আল্লাহ!) যদি আপনি আমাদের অবস্থা যাচাই করেন তবে আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন এবং আমাদের পর্দা ফাঁস করবেন। যদি আপনি আমদের অবস্থা যাচাই করে তবে আপনি আমাদেরকে ধ্বংস করবেন এবং আমাদেরকে শাস্তি দিবেন’।[15]

আল্লাহর ভয়ে কান্না : আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ غَفُورٌ- ‘বস্ত্তত আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল’ (ফাত্বির ৩৫/২৮)। আল্লাহর ভয়ে সালাফদের কান্না এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। যেমন (১) কাব আল-আখবার বলতেন, আল্লাহর ভয়ে এক বিন্দু অশ্রু আমার নিকট আমার ওযন সমপরিমাণ স্বর্ণ ছাদাক্বাহ করা অপেক্ষা উত্তম’।[16]

(২) আব্দুল্লাহ ইবনে দিনার হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনু ওমরের সাথে মক্কার উদ্দেশ্যে বের হলাম। পথিমধ্যে আমরা যাত্রা বিরতি করলাম। তখন আমাদের নিকটে পাহাড় থেকে একজন রাখাল আসলে তিনি তাকে বললেন, তুমি কি রাখাল? সে উত্তর দিল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমার কাছে একটি ছাগল বিক্রি করে দাও। সে উত্তর দিল, আমি তো ক্রীতদাস। তিনি বললেন, তুমি তোমার মালিককে বলবে যে, একটি ছাগল বাঘে খেয়ে ফেলেছে। তখন সে বলল, তাহ’লে আল্লাহ কোথায়? (আল্লাহ কি দেখছেন না?) ইবনু ওমর তার কথা পুনরাবৃত্তি করে বললেন, আল্লাহ কোথায়! অতঃপর তিনি কাঁদতে লাগলেন এবং পরবর্তীকালে তাকে (ক্রীতদাস রাখাল) ক্রয় করে মুক্ত করে দিলেন।[17]

(৩) আহমাদ ইবনু ক্বাসেম বলেন, আমি সুফিয়ান ছাওরীর সাথী ও খাদেম মুজিব ইবনু মুসা আল-ইস্পাহানীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি মক্কাতে সুফিয়ান ছাওরীর নিকটে ছিলাম। তিনি প্রচুর কান্নাকাটি করতেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার এই কান্না কি পাপের ভয়ে? অতঃপর তিনি কোষ থেকে একটি কাটা নিয়ে সেটিকে নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমার পাপ আমার নিকট এর চেয়ে সহজ। বরং আমি তাওহীদকে পরিবর্তন করে ফেলার ভয় করি’।[18]

[ক্রমশ]

আব্দুল্লাহ

[লেখক : ২য় বর্ষ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।]


[1]. শামসুদ্দীন যাহবী, তারীখুল ইসলাম, ৮/২৫৮।

[2]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৬/৪০১; হিলইয়াতুল আওলিয়া ৪/১৫৮।

[3]. যাহবী, তারীখুল ইসলাম, ৫/২৯৩; হিলইয়াতুল আওলিয়া ৪/১৫৭।

[4]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১২/৬০০।

[5]. আয-যুহদু লি আহমাদ ইবনু হাম্বল ১/১৫।

[6]. হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/৩০৫।

[7]. তাফসীর ইবনু রজব ১/৬৪০।

[8]. শু‘আবুল ঈমান হা/৪২৯৪।

[9]. হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/৩৭৮।

[10]. হিলইয়াতুল আওলিয়া ৬/১৮৯।

[11]. তাফসীর ইবনু রজব ১/৬৬৬।

[12]. হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/৩২৭।

[13]. হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/৪৮।

[14]. হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/১১২।

[15]. হিলইয়াতুল আওলিয়া ৮/১১১।

[16]. খুতাব ওয়া দরূসু শায়খ আব্দুর রহীম আত-ত্বহহান ১৫২/৩১।

[17]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৪/৩১০।

[18]. শু‘আবুল ঈমান হা/৮৩৯।



বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও