অধ্যাপক দুর্রুল হুদা
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 277 বার পঠিত
[মাহফূযুর রহমান (৬২) জয়পুরহাট সদরের পলিকাদোয়া গ্রামে ১৯৬২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক। তিনি ১৯৮২ সালে জয়পুরহাট যেলা ‘যুবসংঘে’-র প্রথম আহবায়ক ও ১৯৮৪ সালে প্রথম সভাপতি এবং ১৯৮৯ সালে ‘যুবসংঘে’-র কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য মনোনীত হন। অতঃপর ১৯৯৪ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ গঠিত হলে তিনি অত্র যেলার প্রথম সভাপতি মনোনীত হন। বর্তমানে তিনি ‘আন্দোলনে’র কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য ও যেলা ‘আন্দোলনে’র প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ‘যুবসংঘে’-র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মুহাম্মাদ আবুল কালাম (জয়পুরহাট)।
তাওহীদের ডাক : আপনি কেমন আছেন?
মাহফূযুর রহমান : আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
তাওহীদের ডাক : আপনি কিভাবে ‘যুবসংঘে’র সন্ধান পান এবং কিভাবে এই সংগঠনে যুক্ত হন?
মাহফূযুর রহমান : ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে আমরা পলিকাদোয়ায় একটি হাফেযিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। উক্ত মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলের জন্য স্যারের একটি তারিখ নিতে রাজশাহীতে যাই। তিনি শর্ত দিলেন যে, কমপক্ষে ৫জন যুবককে উপস্থিত করতে হবে যারা ‘যুবসংঘ’ করবে। নির্ধারিত দিনে স্যার আসলেন এবং মাহফিল শেষে সকলের পরামর্শক্রমে আমাকে ‘আহবায়ক’ করে জয়পুরহাট যেলা ‘যুবসংঘে’র একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করে দিলেন। এভাবেই ‘যুবসংঘে’র সাথে আমার পথ চলা শুরু হয়।
তাওহীদের ডাক :আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের সাথে আপনার প্রথম পরিচয় কিভাবে হয়?
তাওহীদের ডাক : প্রথম দিকে আপনাদের দাওয়াতী কাজ কেমন ছিল?
মাহফূযুর রহমান : আহবায়ক কমিটি গঠনের পর আমাদের গতি বেড়ে যায়। অতঃপর আমরা ‘যুবসংঘে’র প্রথম শাখা গঠন করি ‘আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠী’র সাবেক প্রধান মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলামের জন্মস্থান কোমরগ্রাম। মাওলানা মুহাম্মাদ আতাউর রহমানকে সভাপতি ও মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলামকে অর্থ সম্পাদক করে ‘যুবসংঘে’র একটি শাখা গঠন করি। এরপর ৭ দিনের মধ্যে আরও ৪টি শাখা গঠিত হয়। পরের সপ্তাহে জয়পুরহাট-সদর, আক্কেলপুর, কালাই, ক্ষেতলাল ও পাঁচবিবি এই ৫ থানায় ১টি করে শাখা গঠিত হয়। আমরা জুম‘আর দিনে দুই আযান, ফরয ছালাত শেষে দলবদ্ধ মুনাজাত, সাহারীর আযান না দেওয়া, জানাযার পর হাত তুলে সম্মিলিত মুনাজাত, মৃত্যুর দিনে বা ৩য় দিনে বা ১০ বা ৪০ দিনে মাইয়েতের বাড়ীতে জাঁকজমক সহকারে ‘খানা’র আয়োজন সহ নানাবিধ শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমীরে জামা‘আতের নির্দেশনা অনুযায়ী দাওয়াতী কাজ করতাম। ফলে মসজিদ থেকে চায়ের স্টল পর্যন্ত সর্বত্র ‘যুবসংঘ’কে নিয়ে আলোচনা শুরু হ’ল।
অতঃপর ১৯৮৪ সালে ‘যুবসংঘে’র তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ভাই জয়পুরহাটে আসেন। তিনি ঐ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের বি.এ সম্মানের ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে যিনি ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। জয়পুরহাট সদরের কোমরগ্রাম জামে মসজিদে প্রোগ্রাম হয়। সেখানে সকলের পরামর্শক্রমে নবগঠিত জয়পুরহাট যেলা ‘যুবসংঘে’র সভাপতি হিসাবে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। শফীকুল ইসলাম ভাইকে প্রচার সম্পাদক করা হয়। এরপর ১৯৮৯ সালে আমি ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য মনোনীত হয়েছিলাম।
তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি আছে কি?
মাহফূযুর রহমান : হ্যাঁ অনেক আছে। তবে এখানে কয়েকটি উল্লেখ করতে চাই। যেমন- (১) ‘যুবসংঘে’র যেলা কর্মপরিষদের মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে প্রায় প্রতি মাসেই জয়পুরহাট থেকে ট্রেন যোগে রাজশাহীতে এসে আমি প্রথমে স্যারের সাধুর মোড়ের ভাড়া বাসায় যেতাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্যারের কখনও আসতে দেরি হ’লে আমি পার্শ্ববর্তী মসজিদে অপেক্ষা করতাম। স্যারের সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি আমাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে খাওয়াতেন। ফেরার সময় তিনি ‘যুবসংঘে’র পরিচিতি, ভর্তি ফরম ও কিছু লিফলেট দিয়ে যেলায় ভালোভাবে কাজ করার পরামর্শ দিতেন।
(২) ১৯৯০ সালের শেষ দিকের একটি ঘটনা। বিকাল পাঁচটায় জয়পুরহাট থেকে ট্রেন যোগে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। স্যারের সাধুর মোড়ের বাসায় এসে শুনি, তিনি আর এখানে নেই। চক্রান্তের শিকার হয়ে তিনি ২০শে ডিসেম্বর রাজশাহী কোর্টের পাশে হড়গ্রামের একটি ভাড়া বাসায় চলে গেছেন। যার দোতলায় তিনি থাকেন। রাত ২-টার দিকে স্যারের বাসার খোঁজ পেলাম। এরপর দরজায় গিয়ে সালাম দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খুলে দিয়ে স্যার বললেন, এত রাত্রে কিভাবে আসলে? খানাপিনা করেছ কি? বললাম, খাইনি। তিনি বললেন, তুমি কি রান্না করতে পার? বললাম, ভাত-ভর্তা রান্না করতে পারি। তারপর ভিতরে গিয়ে রান্না ও খাওয়া সেরে স্যারের বাইরের লাইব্রেরী ঘরে ম্যাটের উপর ঘুমিয়ে গেলাম। এই অবস্থা স্যারের সাধুর মোড়ের বাসায় প্রায়ই হ’ত। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে ট্রেনের সময় অনুযায়ী রাত্রি ১২-টার পরে ৮/১০ জন করে ভর্তিচ্ছু ছাত্র ও অভিভাবক স্যারের বাসায় যেয়ে ভিড় করত। সাদুড়িয়ার আব্দুল ওয়াদূদ একদিন আমার মত এরূপ নিজে রান্না করে ভাত-ভর্তা করে খেয়েছিল। পরের দিন ছিল শুক্রবার। ফজর ছালাত মসজিদে গিয়ে স্যারের সাথে জামা‘আতে আদায় করলাম। ঐ দিনই ছিল হড়গ্রামে স্যারের প্রথম খুৎবা। তাঁর খুৎবা শুনে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি বললেন, এই মসজিদের মিম্বর থেকে আজই প্রথম ‘আহলেহাদীছ’ নাম উচ্চারণ করে খুৎবা শুনলাম। এর আগে কেউ এখানে ‘আহলেহাদীছ’ নাম উচ্চারণ করেনি। কারণ মসজিদের ইমাম ছিল ‘শিবির’ কর্মী। কমিটি ছিল নামকে ওয়াস্তে আহলেহাদীছ এবং নানা রাজনৈতিক দলের কর্মী।
(৩) স্যার জয়পুরহাটের সম্মেলনে এলেন। তখন শহর থেকে কাঁচা রাস্তায় কোমরগ্রাম যেতে হ’ত। কোমরগ্রাম বড় কবরস্থানের দক্ষিণ-পূর্ব পার্শে রাস্তায় ছিল বড় একটা ‘হাবড়’। সেখানে গিয়ে হাঁটু-কাদা মাড়াতে হ’ত। স্যার আমাদের বললেন, এই ১৫/২০ হাত হাবড় কি তোমরা নিজেরা স্বেচ্ছাশ্রমে ভরাট করতে পার না? বললাম, প্রতি বারই ইলেকশনের সময় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীরা এই হাবড় ভরাটের প্রতিশ্রুতি দেয়। মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও আর কোন খোঁজ-খবর থাকে না। স্যারের কথা মতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এবং ‘যুবসংঘে’র ছেলেরা ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে এসে এক রাতেই হাবড় ভরাট করে দিলাম। পরদিন সকালে যারাই এ রাস্তা দিয়ে শহরে গিয়েছে, তারাই শত মুখে ‘যুবসংঘে’র প্রশংসা করেছে। এতে আমরা বুঝি, স্যার কেবল ধর্ম সংস্কারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মূলত একজন সচেতন সমাজ সংস্কারক।
(৪) এক সম্মেলনে এসে স্যারকে নিয়ে আমরা কোমরগ্রামের ভিতর ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। সরু পথে রিক্সা চলে না। এক পর্যায়ে আমরা শফীকুল ভাইয়ের আববার মুদি দোকানের পাশে হাযির হ’লাম। স্যার হাত বাড়িয়ে শফীকুলের আববার সঙ্গে মুছাফাহা করলেন। পুরা দোকানের দিকে এক নযর তাকিয়ে বললেন, বিড়ি-তামাক-সিগারেট বিক্রি করেন কি? উনি বললেন, না। স্যার বললেন, এই দোকানে যেন ইসলামে অনুমোদিত নয়, এমন কোন বস্ত্ত ক্রয়-বিক্রয় না হয়। স্যারের এই কথাগুলি অন্যান্য দোকানদারদের কাছেও পৌঁছে যায় এবং তারাও তা আমল করে।
(৫) এক সম্মেলনে এসে স্যারকে নিয়ে আমরা পায়ে হেঁটে সম্মেলন স্থলে যাচ্ছি। গ্রামের ভিতর দিয়ে বেশ ঘোরা রাস্তা। স্যার বললেন, সম্মেলন স্থল কোন দিকে? আমরা আঙ্গুলের ইশারায় বললাম, গ্রামের নীচে ধানক্ষেতে। যা এখান থেকে দেখা যায়। স্যার বললেন, চলো ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাই। যেমন কথা তেমন কাজ। উনি ধানক্ষেতে নেমে পড়লেন এবং সোজা আড়াআড়ি ধান কাটার গোঁজ মাড়িয়ে সরাসরি সম্মেলন স্থলে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর ওযূ করে স্টেজে উঠলেন। তাঁর এই সরলতা আমাদেরকে মুগ্ধ করল।
(৬) জামালগঞ্জের খেজুরতলীর আব্দুর রহমান আমাদের সংগঠনে ছিল। হঠাৎ জানা গেল সে শুববানের যেলা সভাপতির পদ পেয়েছে। সে নাকি সম্মেলনে আসার পথে রাস্তায় স্যারকে বাধা দিবে। তখন হাফিযার ভাইয়ের নেতৃত্বে ‘যুবংসঘে’র বিশাল হোন্ডা মিছিল নিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। আমীরে জামা‘আত কথাগুলি শুনলেন। অতঃপর বললেন, সোজা খেজুরতলী মসজিদে চলো এবং ওকে ও তার তার বাবাকে ডেকে নিয়ে এসো। আমরা সেটাই করলাম। ওদেরকে সামনে হাযির করলাম। তারা এতই ভীত হয়েছিল যে, সামনে আসার পর সালাম-মুছাফাহা এবং আপ্যায়ন ছাড়া তাদের মুখে অন্য কোন কথাই ছিল না। আমীরে জামা‘আতের এই সম্মুখ মোকাবিলার সাহস দেখে আমরা বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম।
(৭) একবার যেলা সম্মেলনের ঘটনা। স্যারের জন্য আমরা জয়পুরহাট সার্কিট হাউসে একটি রুম বরাদ্দ চেয়ে দরখাস্ত করি। কিন্তু কুচক্রীদের কারণে প্রশাসন রুম বরাদ্দ দিতে গড়িমসি করে। তখন এনডিসি-র দায়িত্বে আসা জনৈক তরুণ অফিসার ডিসি ছাহেবকে বলেন, স্যার! আমি ও আমার স্ত্রী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানীর শিক্ষার্থী ছিলাম। স্যার একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ। তার কর্মীরা কোনরূপ হৈ-হাঙ্গামা করেন না। আমার অনুরোধ, আপনি একটির স্থলে দু’টি কক্ষ দিয়ে দিন। যাতে স্যারের সঙ্গীরা সেখানে থাকতে পারে। ডিসি ছাহেব সেটাই করলেন।
তাওহীদের ডাক : আপনার বন্ধুবর বগুড়ার আইয়ূব আলী সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
মাহফূযুর রহমান : সে আগে ‘আইয়ূব ডাকাত’ নামে পরিচিত ছিল। বগুড়ার কোন এক মাহফিলে সে স্যারের বক্তৃতা শুনে উদ্বুদ্ধ হয়। অতঃপর মাহফিলে শেষে সে স্যারের কাছে চলে আসে। তার পরিচয় জানতে পেরে স্যার তাকে আদর করে বলেন, তুমি পাপকর্ম ছেড়ে দাও এবং তওবা কর। তাতে তোমার পিছনের সকল গোনাহ মাফ হয়ে যাবে’। সে তাই করল এবং পূর্বের পাপকর্ম ছেড়ে দিল। অতঃপর সে নিয়মিত ছালাত আদায় শুরু করল। এরপর ‘যুবসংঘে’ যোগ দিল। নিজ গ্রাম পরাণবাড়িয়ার জামে মসজিদে ফরয ছালাতান্তে সম্মিলিত মুনাজাতের বিরুদ্ধে সে কথা বলতে শুরু করে। এতে মসজিদের ইমাম ক্ষিপ্ত হন। তিনি গ্রামের প্রভাবশালী কিছু লোককে ক্ষেপিয়ে তুলেন। একদিন তিনি মুনাজাত না করার অপরাধে কিছু মুছল্লীকে নিয়ে তাকে মারধর শুরু করেন। আইয়ূব প্রথমে নীরবে সহ্য করে। এরপরেও মারতে থাকলে সে হুংকার দিয়ে বলে উঠে, আমি আইয়ূব ডাকাত। আমি ভালো হয়েছি বলে তোমরা আমাকে মারতে পারছ। যখন আমি ডাকাত ছিলাম তখন তোমরা আমাকে দ্বীনের পথে দাওয়াত দাওনি। আমি এখন ৫ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতে পড়ছি। আর এখন তোমরা আমাকে মারছ বিদ‘আতী মুনাজাত না করার জন্য। সাবধান! আর এক পা এগোবে না’। তখন সবাই চুপ হয়ে যায়। সে এখনও বেঁচে আছে। তবে বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে গেছে। কিছু দিন আগেও তার সাথে আমার কথা হয়েছে।
তাওহীদের ডাক : শফীকুল ইসলামের প্রকৃত নাম কি এটাই ছিল? তার গান ছেড়ে দেওয়া এবং ‘জাগরণী’ শিল্পী হওয়া সম্পর্কে যদি কিছু জানাতেন?
মাহফূযুর রহমান : শফীকুল ভাইয়ের পূর্ব নাম ছিল শফীউল আলম। স্যার তার নাম পাল্টিয়ে শফীকুল ইসলাম করেন। তিনি আনছার বাহিনীতে চাকুরী করতেন এবং সফীপুর (গাযীপুর) আনছার একাডেমীর বিশেষ অনুষ্ঠান সমূহে গান গাইতেন। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে পলিকাদোয়া হাফেযিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলের এক পর্যায়ে আমি শফীকুল ভাইকে স্যারের কাছে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেই এবং তার দরাজ কণ্ঠ সম্পর্কে জানাই। স্যার শফীকুল ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে মুগ্ধ হয়ে নাম জানতে চাইলেন। নাম শুনে স্যার বললেন, এ নাম চলবে না। আজ থেকে তোমার নাম ‘শফীকুল ইসলাম’। অতঃপর স্যার তাকে নছীহত করলেন, ‘শফীকুল! আল্লাহ তোমাকে সুন্দর কণ্ঠের যে নে‘মত দিয়েছেন, তা দিয়ে তুমি জান্নাত খরীদ করতে পার’। শফীকুল ভাই ওয়াদা করেন ও বলেন, ‘স্যার! আজ থেকে শফীকুল আর গান গাইবে না’। স্যার বললেন, ‘গান’ শব্দ বাতিল। এখন থেকে সমাজ জাগিয়ে তোলার জন্য তুমি ‘জাগরণী’ গাইবে’। কবিতা লিখবে ও আমাকে দেখিয়ে নিবে। তারপর তাতে সুর দিয়ে আমাকে শুনাবে। বিভিন্ন সম্মেলনে আমার সাথে যাবে’। সেই ১৯৮২ সাল থেকে ২০১৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৩৩ বছরের মধ্যে আমি আর কোনদিন তার কন্ঠে ‘গান’ শুনিনি।
উল্লেখ্য যে, বগুড়া যেলার মেন্দীপুর-চাকলা সালাফিইয়া মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে আলোচনারত অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃপর বগুড়া ‘শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে’ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঐ রাতেই মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন। মাহফিলে তিনি ‘কত ইসলামী দল ঘুরছে বাংলার পরে ও প্রাণবন্ধুরে’ জাগরণীটি গেয়েছিলেন, যা জাগরণী বইয়ের সর্বশেষ সংস্করণে যুক্ত করা হয়েছে। তার জানাযায় মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ইমামতি করেন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সহ মেহেরপুর, পাবনা, নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, গাইবান্ধা বগুড়া সহ বিভিন্ন যেলা থেকে ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র দায়িত্বশীল ও কর্মী সহ হাযার হাযার মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন জয়পুরহাট যেলা ‘যুবসংঘে’র সভাপতি ও বর্তমান কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মুহাম্মাদ আবুল কালামের বাড়িতে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ রাতের খাবার গ্রহণ করেন।
তাওহীদের ডাক : শফীকুল ভাইয়ের সাথে আপনার অন্য কোন স্মৃতি আছে কি?
মাহফূযুর রহমান : (১) ১৯৯১ সালের ২৫ ও ২৬শে এপ্রিল রাজশাহী মহানগরীর নওদাপাড়ায় অনুষ্ঠিত ‘যুবসংঘে’র ২য় জাতীয় সম্মেলন ও তাবলীগী ইজতেমার পরেই মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের প্রস্তাবক্রমে ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভায় ‘আল-হেরা শিল্পীগোষ্ঠী’ নামটি সানন্দে গৃহীত হয়। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে ইসলামী কবিতা সমূহ রচনা ও তাতে সুর দিয়ে সমাজকে জাগিয়ে তোলার মহতী কামনা নিয়ে আল্লাহ পাকের সর্বশেষ অহি-র প্রথম অবতরণস্থল ঐতিহাসিক ‘হেরা’ গুহার নামানুসারে আহলেহাদীছ তরুণ শিল্পীদের এই সংগঠনকে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ‘আল-হেরা শিল্পীগোষ্ঠী’ নামকরণ করেন।
(২) ১৯৯৪ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর জাতীয় সংগঠন হিসাবে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আবির্ভাব ঘটলে শফীকুল ভাই জয়পুরহাট যেলা ‘আন্দোলন’-এর প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন। অতঃপর তিনি অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর ৬ দিন পূর্বে টাকা-পয়সা হিসাব করে ৩৬,১০০ (ছত্রিশ হাযার একশ’) টাকা তার কাছে রয়েছে বলে আমাকে জানান। মৃত্যুর একদিন পর আমি, তৎকালীন যেলা ‘যুবসংঘে’র সভাপতি ও বর্তমান ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মুহাম্মাদ আবুল কালাম, শফীকুল ভাইয়ের বড় ছেলেসহ আরও কয়েকজন তার রেখে যাওয়া সংগঠনের টাকা রাখার প্লাস্টিক বয়ম থেকে টাকা বের করি। গুণে দেখা গেল হিসাব মতো উক্ত টাকাই রয়েছে। একটি টাকাও কম-বেশী নেই। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
তাওহীদের ডাক : ‘আন্দোলনে’র কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদকজনাব হাফীযুর রহমান কিভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন? তার সাংগঠনিক তৎপরতা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।
মাহফূযুর রহমান : মাওলানা হাফীযুর রহমান ভাই ছিলেন খুব ভালো মানুষ ও নিবেদিত প্রাণ কর্মী। তিনি ‘জমঈয়তে আহলেহাদীসে’র দায়িত্ব পালন করতেন। আমাদের দাওয়াতে তিনি ‘যুবসংঘে’র সাথে সম্পৃক্ত হন। ২০০৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী স্যারের গ্রেফতারের পর তিনি স্যারের মুক্তির জন্য আদালত সমূহে দৌড়-ঝাপ করতেন। তিনি ‘আন্দোলনে’র কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক ছিলেন। মামলা পরিচালনার মূল দায়িত্ব তিনিই পালন করতেন। হাফীযুর রহমান ভাইয়ের এই আইনী তৎপরতা কুচক্রীদের নযরে পড়ে। ফলে তাদের ষড়যন্ত্রে জয়পুরহাটের পুলিশ প্রশাসনকে দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হুলিয়া বা গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে পত্রিকায় গ্রেফতারী পরোয়ানা দেখে তৎক্ষণাৎ হার্ট ফেল করে ২০০৫ সালের ২২শে নভেম্বর শনিবার দিবাগত রাত্রে ‘আন্দোলনে’র বংশাল অফিসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন।
তাওহীদের ডাক : তাওহীদ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠিত কালাই কমপ্লেক্সের বর্তমান অবস্থা কি?
মাহফূযুর রহমান : আমীরে জামা‘আতের নির্দেশনায় ১৯৯৩ হ’তে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ক্ষেতলাল থানার অন্তর্গত কৃষ্ণনগর মৌজার বটতলী বাজারের পূর্ব পার্শ্বস্থ তালতলীতে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার সূদুর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে আমীরে জামা‘আত ১৮ বিঘা ২৩ শতক জমি ক্রয় করেন এবং কোমরগ্রামে জয়পুরহাট বগুড়া মহাসড়কের উত্তর পার্শ্বে ২৪ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার দলীল নং ১৯৪৬। অতঃপর হাফীযুর ভাইয়ের দায়িত্বে তিনি কালাই থানার পার্শ্বে ‘কালাই কমপ্লেক্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। জমির পরিমান ২০ শতাংশ। দলীল নং ৩০৭৬। যেখানে ৪৫টি দোকান ও ছাদের উপর জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা এবং সংগঠনের নেতা-কর্মীদের যাতায়াত ও সমাবেশের কারণে স্থানটি দ্রুত জমজমাট হয়ে পড়ে। এই কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার বরকতে স্থানটি এখন বড় ধরনের একটি শহরে পরিণত হয়েছে। এখানে আরো কয়েকটি নতুন মার্কেট চালু হয়েছে। এখানে প্রতি বছর ‘আন্দোলন’-এর উদ্যোগে স্যারের উপস্থিতিতে বড় বড় ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হ’ত। এলাকা ও আশ-পাশের গ্রামগুলিতে নারী-পুরুষ সকলের মধ্যে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়। সবকিছুতে নেতৃত্ব দিতেন হাফীযুর ভাই এবং আমার নেতৃত্বে ‘যুবসংঘে’র ছেলেরা। কিন্তু তাওহীদ ট্রাস্টের জনৈক কুচক্রী সদস্য স্যারের এই সুন্দর পরিকল্পনা বিনষ্ট করে দেয়।
উল্লেখ্য যে, জয়পুরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের ১৫টি যেলায় বগুড়ার ঐ কুচক্রী তাওহীদ ট্রাস্টের প্রজেক্ট সমূহ দেখা-শুনার দায়িত্বে ছিল। ২০০১ সালে অর্থ কেলেঙ্কারীর দায়ে আমীরে জামা‘আত তাকে সকল দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেন। ফলে ঐ কুচক্রী তাওহীদ ট্রাস্টের আরও কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে তাওহীদ ট্রাস্টের একটি পাল্টা কমিটি গঠন করে এবং ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা আমীরে জামা‘আতকেই বহিষ্কার করে। ফলে জনগণের সম্পদ বাঁচানোর জন্য আমীরে জামা‘আত আদালতের শরণাপন্ন হন। যে মামলা অদ্যাবধি চলমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে জয়পুরহাটেও একটি মামলা হয়। সেটাও চলমান।
মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই ঐ কুচক্রী নিজেদেরকে ট্রাস্টের ভুয়া মালিক দেখিয়ে উত্তরাঞ্চলে ট্রাস্টের সম্পত্তিগুলি আত্মসাৎ, ভোগদখল ও বিক্রি শুরু করে। যার এক শকুনী থাবা তালতলী ও কালাই কমপ্লেক্সের উপরেও পড়ে। সে তালতলীর সম্পত্তিগুলি ৯০ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে। আর সেই হারাম টাকা দিয়ে সে আমীরে জামা‘আতের বিরুদ্ধে আদালতে মিথ্যা মামলা করে। যা আজও চলমান। যেলা ‘যুবসংঘ’ ও ‘আন্দোলন’ উক্ত জমি ও কমপ্লেক্স পুনরুদ্ধারে সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা দ্রুত উত্তম ফলাফলের আশা করছি। আল্লাহ কবুল করুন।-আমীন!
তাওহীদের ডাক : দাওয়াতী জীবনে আপনার কোন অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি আছে কি যা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে?
মাহফূযুর রহমান : (১) ১৯৮৬ সালের কথা। তখন ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় অফিস ছিল রাণীবাজার মাদ্রাসা মসজিদের ৩য় তলার পূর্বপার্শ্বে। সে সময়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয় সংলগ্ন রাণীবাজার আহলেহাদীছ জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন প্রবীণ ক্বারী যাহহাক ছাহেব। ছালাতে তার তেলাওয়াত শুনে আমরা মুগ্ধ হ’তাম। উক্ত মসজিদে ২১ ও ২২শে অক্টোবর ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলন’৮৬ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সুধীদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন ‘জমঈয়তে আহলেহাদীস’-এর সভাপতি ড. আব্দুল বারী। তখন ‘যুবসংঘে’র নাম পরিবর্তন করে ‘শুববান’ করা হবে বলে চক্রান্ত চলছিল। সেদিন উপস্থিত ছিলেন রাবি প্রফেসর ড. আযহারুদ্দীন ছাহেব। ড. বারী ছাহেব ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্যদের নিয়ে ‘যুবসংঘে’র নাম পরিবর্তনের বিষয় চূড়ান্ত করার জন্য মাদ্রাসার একটি কক্ষে মিটিং করেন। সেখানে আমিও ছিলাম। আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে আমরা জানিয়ে দিলাম যে, ‘যুবসংঘ’ নামেই আমরা ময়দানে কাজ করে যাব, অন্য কোন নামে নয়।
উক্ত সম্মেলনে স্যারের তেজোদীপ্ত উদ্বোধনী ভাষণ শুনে সবাই মুগ্ধ হন এবং তা বই আকারে প্রকাশের দাবি করেন। বিশেষ করে রাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর আযহারুদ্দীন জোরালোভাবে দাবী করে বলেন, এই অমূল্য ভাষণ কোন অবস্থাতেই হারিয়ে যাওয়া চলবে না। ভাষণটি ক্যাসেট থেকে নিয়ে তিনি দ্রুত বই আকারে প্রকাশের দাবী জানান। পরবর্তীতে ‘সমাজ বিপ্লবের ধারা’ ও ‘তিনটি মতবাদ’ নামে আলাদা পুস্তক আকারে ‘যুবসংঘে’র পক্ষ থেকে দু’দিনের দু’টি বক্তৃতা প্রকাশিত হয়।
(২) ২২শে ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে জয়পুরহাট যেলার আক্কেলপুর উপযেলার ইসমাঈলপুর গ্রামে কিছু হানাফী ভাই ‘যুবসংঘে’র দাওয়াত কবুল করেন। আমি তাদের দাওয়াতে সেখানে জুম‘আর খুৎবা দিতে যাই। সাড়ে ১২-টায় খুৎবা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে হানাফী ভাইয়েরা এসে বেড়ার এই মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেয় ও মুহাম্মাদ আলী ভাই সহ তার সাথীদের মারধর করে। যাওয়ার সময় বলে যায়, এখানে কোন আহলেহাদীছ মসজিদ চলবে না। তারা আমাকে তাদের হানাফী মসজিদে ছালাত আদায়ের কথা জানালে আমি বললাম, না; তিনজন হলেও আমি এখানে জুম‘আর ছালাত আদায় করব ইনশাআল্লাহ’। পরবর্তীতে স্যারকে এই ঘটনা জানালে তিনি সেখানে পাকা মসজিদ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আমি আহত ভাইদের খোঁজ-খবর নিয়ে তাদেরকে স্যারের মসজিদ নির্মাণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি জানিয়ে আসি। পরবর্তীতে স্যার তাওহীদ ট্রাস্টের মাধ্যমে সুন্দর একটি জামে মসজিদ করে দেন। যা অদ্যাবধি রয়েছে।
(৩) ২০২১ সালের ১লা আগস্ট কেন্দ্র কর্তৃক আমাকে নওগাঁ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা-পূর্ব ও পশ্চিম, রংপুর-পূর্ব ও পশ্চিম এবং বগুড়া এই ৭টি যেলা অডিটের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২৬ আগস্ট অডিটের রিপোর্ট কেন্দ্রে জমা দিতে হবে। আমি ১৫-২২ আগস্ট একাধারে সফর করে উক্ত যেলা সমূহের অডিট সম্পন্ন করি। গাইবান্ধা-পূর্ব যেলা অডিট শেষে ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ভাষা সৈনিক নূরুল ইসলাম প্রধানের বাসায় দেখা করি। তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং ইফতারের জন্য বিরিয়ানী ও কিছু ফলমুল দেন। এগুলো নিয়ে বগুড়া যেলায় গিয়ে আমি ইফতার করি। ২৩শে আগস্ট আমার অডিটকৃত লিখিত প্রতিবেদন জমা দিলে তা মজলিসে আমেলায় সমাদৃত হয়। যা আমীরে জামা‘আতের প্রশিক্ষণের ফল।
(৪) ১৯৮৯ সালের ২১শে জুলাই ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র সাথে ‘জমঈয়তে আহলেহাদীস’ একতরফাভাবে ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা করে। অতঃপর তা তাদের মুখপত্র সাপ্তাহিক আরাফাত পত্রিকায় ৩০/৪৮ ও ৪৯ সংখ্যায় দু’দুবার প্রকাশ করে। এসময় জয়পুরহাট যেলা ‘যুবসংঘে’র পক্ষ থেকে কোমরগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ময়দানে আমীরে জামা‘আতকে প্রধান অতিথি করে যেলা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সম্মেলনকে নস্যাৎ করার জন্য কেন্দ্রীয় জমঈয়তের নির্দেশনা মতে জয়পুরহাট যেলা জমঈয়তের ধনাঢ্য নেতারা তৎপর হয়ে ওঠেন। আমাদের সম্মেলন স্থলের বিপরীতে ঢাকা-জয়পুরহাট মহা সড়কের অপর পারে কোমরগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তারা পাল্টা সম্মেলন আহবান করেন। সদ্য শুববানে যোগ দেওয়া আব্দুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে বক্তা হিসাবে ছিলেন সেসময়ের প্রসিদ্ধ প্রবীণ বাগ্মী মাওলানা আবু তাহের বর্ধমানী (দিনাজপুর), মাওলানা রেযাউল্লাহ বিন মাওলানা ইসমাঈল (কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ) ও সদ্য দলছুট গোলাম কিবরিয়া নূরী (রাজশাহী) সহ অনেকে। বর্ধমানী ছাহেবের নাম শুনে প্রথম দিকে তাদের মঞ্চের সামনে বেশ কিছু লোক জমা হয়েছিল। কিন্তু স্যারের বিরুদ্ধে গীবত শুরু হলে সিংহভাগ শ্রোতা তাদের প্যান্ডেল ছেড়ে আমাদের প্যান্ডেলে চলে আসে। ফলে শ্রোতা না থাকায় এশার পূর্বেই তাদের সম্মেলন সমাপ্ত হয়। পরে বর্ধমানী ছাহেবকে মুরববী হিসাবে সম্মান করে আমরা আমাদের সম্মেলনে আসার দাওয়াত দিলাম। তিনি আসলেন। কিন্তু কি ভেবে পুনরায় চলে গেলেন।
এশার ছালাতের পর স্যারের আলোচনার সময় আমাদের সম্মেলন লোকে লোকারণ্য। যা অর্ধ রাত্রি পর্যন্ত চলল। পরের দিন সর্বত্র বলাবলি শুরু হ’ল যে, ‘যুবসংঘে’র সম্মেলন কত সুন্দর হ’ল। এরা তো কোন গীবত করল না। শুধু কুরআন-হাদীছের আলোচনা করল। এইসঙ্গে জমঈয়ত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে লোকদের নানা কথা বলতে শোনা গেল।
তাওহীদের ডাক : যুবকদের উদ্দেশ্যে কিছু নছীহত করুন।
মাহফূযুর রহমান : তাদের সকল কাজ হৌক পরকালীন নাজাতের স্বার্থে। বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমলের দ্বারা সার্বিক জীবন গড়ে তুলতে হবে। ভ্রান্ত পথে চলা যুবকদের বিশুদ্ধ আক্বীদায় ফিরিয়ে আনতে হবে। পরবর্তী কর্ণধার হিসাবে ‘যুবসংঘে’র ও ‘সোনামণি’র সদস্য সংখ্যা বাড়াতে হবে। হক-এর উপর টিকে থাকার জন্য স্যারের লেখনী নিয়মিত পড়তে হবে। তাঁর খুৎবা ও ভাষণ সমূহ শুনতে হবে। অন্যান্য ইসলামী বই-পুস্তক অধ্যয়নের পাশাপাশি মাসিক ‘আত-তাহরীক’, দ্বি-মাসিক ‘তাওহীদের ডাক’ ও ‘সোনামণি প্রতিভা’ পড়ার উপদেশ রইল।
তাওহীদের ডাক : পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে কি?
মাহফূযুর রহমান : ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার উপদেষ্টা, সম্পাদকমন্ডলী ও ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমীরে জামা‘আত ১৯৮৫ সালে জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী যৌথ সংখ্যা হিসাবে এই পত্রিকাটি প্রথম বের করেন। কিন্তু ঘরের সর্বোচ্চ নেতার চক্রান্তে সরকারী রেজিষ্ট্রেশন পায়নি। আমীরে জামা‘আত সেদিন সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ এই অনুপ্রেরণা নিয়ে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র ১ম পদযাত্রা শুরু হয় ১৯৭৮ এর ৫ই ফেব্রুয়ারীতে। সাত বৎসর পরে আজ তার অন্যতম স্বপ্ন সফল হলো। তরুণ লেখক-লেখিকাদের অনভ্যস্ত হাতের লেখনী নিয়ে বের হলো ‘তাওহীদের ডাক’। আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূল দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়াই হবে এর মূল লক্ষ্য। ইসলামের নির্ভেজাল সত্য জন সমক্ষে তুলে ধরাই হবে এর প্রতিজ্ঞা’।
দুর্ভাগ্য, সর্বোচ্চ নেতা শত ফুল ফুটতে দিবেন না। তাই ১৯৮৫ সালে ঢাকায় জমঈয়তের কনফারেন্স চলা অবস্থায় তিনি যাত্রাবাড়ী গিয়ে সদ্য প্রকাশিত ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার ব্যানার নামিয়ে দেন। কনফারেন্সে এই পত্রিকা বিক্রি নিষিদ্ধ করেন। সেদিন আমরা যারপর নেই দুঃখিত ও মর্মাহত হয়েছিলাম। আমীরে জামা‘আতের নির্দেশে ‘যুবসংঘে’র সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজ ভাই লিখিতভাবে সর্বোচ্চ নেতা বরাবর প্রতিবাদ লিপি হাতে হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি।
অতঃপর তৎকালীন ইসলামী মূল্যবোধের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২-টায় মারকায থেকে আমীরে জামা‘আত সহ ৪জন কেন্দ্রীয় নেতাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ না করলে এবং ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন পর ২০০৮ সালের ২৮ শে আগস্ট বৃহস্পতিবার কারাগার থেকে যামিনে বেরিয়ে আসার পর ৮ বছর ৮ মাস ২৮ দিন বিভিন্ন আদালতে হাযিরা দেওয়ার ব্যস্ততায় না থাকলে হয়তবা ‘তাওহীদের ডাক’ পুনরায় প্রকাশিত হ’ত। যাইহোক অবশেষে ২০১০ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী থেকে অদ্যাবধি পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে দ্বি-মাসিক হিসাবে প্রকাশিত হচ্ছে। দো‘আ করি এর প্রকাশনা অব্যাহত থাকুক! নতুন নতুন প্রতিভার বিকাশ ঘটুক! পাঠকদের প্রতি আমার আবেদন, এটি নিয়মিত পাঠ করুন। পরকালীন স্বার্থে এর প্রচার ও প্রসারে সহযোগিতা করুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।-আমীন!