ইলমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইহসান ইলাহী যহীর 511 বার পঠিত
উপস্থাপনা : যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায়-সীমালংঘন, যুলুম-অত্যাচারের পরিসমাপ্তি ঘটানো। মানবজাতির প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ন্যায় ও ইনছাফ ভিত্তিক নিয়ম-নীতি প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য ইসলাম সর্বক্ষেত্রে যুলুম-অবিচার থেকে দূরে থাকার জন্য গুরুত্বারোপ করেছে সবিশেষভাবে। অথচ অত্যাচারীরা অন্যায়-অবিচারের মাধ্যমে তাদের মতের বিরোধীদের সমূলে উৎখাত করতে চায়। তথাপি সত্যান্বেষীদের ন্যায়ের পক্ষে লড়ে যেতে হয় অত্যাচারীর খড়গের নীচে থেকেই। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দেখা মিলে নতুন সূর্যের। বিজয় আসে সত্যের। যারা সত্যান্বেষীদের উপর যুলুম-অবিচার করে তাদের সাময়িক আস্ফালন, কর্তৃত্ব হয়তো তাদের আত্মতৃপ্তিতে ভোগায়। লক্ষণীয় যে, যালেমের পক্ষে যতই লোকবল থাকুক না কেন, যত মানুষই তাকে সাহায্য করুক না কেন তার পরাজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। কারণ আল্লাহ তার পক্ষে নেই। সে যা কিছু অর্জন দেখতে পায় সেগুলো সাময়িক। যারা যুলুম করে, এমন কাউকে মহান আল্লাহ অতীতে ছাড় দেননি, তার শেকড় যতই শক্ত হোক। ফেরাঊন ও নমরূদ তাদের শক্তির দাম্ভিকতায় নিজেদের রব বলে দাবী করেছে। স্বীয় ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য এবং তার পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের সকল নবজাতক ছেলে সন্তানদের হত্যা করেছে। কিন্তু এতকিছুর পরও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। বর্তমান সময়েও আমরা একটি যালেম গোষ্ঠির পতন দেখেছি। যা ছিল তাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। নিম্নে যুলুম সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।
যুলুম কি? : যুলুম (الظُّلم) আরবী শব্দ। এর অর্থ হ’ল নির্যাতন, বৈষম্য, অবিচার, অনাচার, দূরাচার। সাধারণত অন্যায়ভাবে কাউকে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বা যেকোনো পন্থায় অবিচার বা নির্যাতন করাকে ‘যুলুম’ বলে। যুলুম একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাধি। বর্তমানে এটি সর্বত্র ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। অন্যায়ভাবে কারু জান, মাল ও ইয্যত নষ্ট করার নামও হ’ল যুলুম। যে যুলুম করে তাকে বলা হয় ‘যালেম’ বা নির্যাতনকারী। আর যার উপর যুলুম করা হয় তাকে বলে ‘মাযলূম’ বা নির্যাতিত।
যুলুমে সহায়তা নয় : যুলুম যেমন অপরাধ, যুলুমে কোনভাবে সাহায্য করাও সমান অপরাধ। এমনকি যুলুম সমর্থন করাও গুরুতর অপরাধ। কেউ নিজে যুলুম না করেও যদি যুলুমের সমর্থন করে, যুলুমের পক্ষে বলে বা লেখে কিংবা সাক্ষ্য দেয়, সেও আল্লাহর দরবারে যালেম হিসাবে গণ্য হবে এবং তার হাশর যালেমদের সাথেই হবে। যুলুমের সহযোগী ও সমর্থকদের পরিণতিও জাহান্নাম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَرْكَنُوآ إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللهِ مِنْ أَوْلِيَآءَ ثُمَّ لاَ تُنْصَرُونَ- ‘আর তোমরা যালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না। তাহ’লে তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে। বস্ত্তত আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু নেই। অতঃপর তোমরা কোনরূপ সাহায্য প্রাপ্ত হবে না’ (হূদ ১১/১১৩)। আর হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ أَعَانَ ظَالِمًا لِيُدْحِضَ بِبَاطِلِهِ حَقًّا، فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ ذِمَّةُ اللهِ وَرَسُوْلِهِ- ‘যে ব্যক্তি মিথ্যার মাধ্যমে সত্যকে খন্ডন করে কোন যালেমকে সাহায্য করে, তার উপর থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দায়িত্ব উঠে যায়’।[1]
অত্যাচার-অবিচারের মুখোমুখি অবস্থান থেকেই সত্যের বিজয় আসে। এটাই সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম। তাই ক্ষমতা থাকলে যুলুমকে থামিয়ে দিতে সর্বস্ব শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। তা সম্ভব না হ’লে মুখে প্রতিবাদ করতে হবে, তাও সম্ভব না হলে অন্তরে যালেম ও তার যুলুমকে অপসন্দ করতে হবে, অন্তর থেকে ঘৃণা করতে হবে। কোনভাবেই যুলুমের সহযোগী হওয়া যাবে না এবং সমর্থনের মাধ্যমে তাদের দোসরও হওয়া যাবে না।
যালেমদের মর্মান্তিক পরিণতি : সারা বিশে^ বর্তমানে নানা ধরনের যুলুম ব্যাপকতা লাভ করেছে। যালেমের অত্যাচার-অবিচারে দুর্বল, অসহায়রা নির্যাতিত-নিপীড়িত হচ্ছে। জনজীবন হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ, দুর্বিষহ ও দুঃসহ। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিত্তবানরা দরিদ্র শ্রেণীকে, ক্ষমতাশীলরা নিরীহ ও সাধারণ মানুষের প্রতি অন্যায় ও হিংসার বশবর্তী হয়ে শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়নের স্টীম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণ তাদের নায্য অধিকার, ন্যায়-বিচার, সমতা, বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি হ’তে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। তবে মনে রাখা আবশ্যক যে, যুলুমকারীর পরিণাম অত্যন্ত মর্মান্তিক। যালেমকে আল্লাহ বরদাশত করেন না। অপর মানুষের উপর যুলুম-নির্যাতন করে যালেমরা তাদের ধ্বংস ডেকে আনে। যালেমের বিচার শুধু ক্বিয়ামতের দিন হবে না, বরং দুনিয়া থেকেই আল্লাহ তাদের যুলুমের বদলা নেওয়া শুরু করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ ذَنْبٍ أَجْدَرُ أَنْ يُعَجِّلَ اللهُ لِصَاحِبِهِ العُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الآخِرَةِ مِنَ البَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ- ‘দু’টি পাপের শাস্তি আল্লাহ দুনিয়াতে প্রদান করেন। সেই সাথে আখেরাতের আযাবও রয়েছে। এগুলি হ’ল যুলুম-সীমালংঘন ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি’।[2]
কুরআনের দীপ্ত ঘোষণা হ’ল, وَلَقَدْ أَهْلَكْنَا الْقُرُونَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَمَّا ظَلَمُوا، ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের পূর্বের বহু জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি যখন তারা সীমালংঘন করেছিল’ (ইউনুস ১০/১৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ لَيُمْلِي لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যালেমকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে তাদেরকে এমনভাবে পাকড়াও করেন যে, আর তারা পলায়নের সুযোগ পায় না’। রাবী বলেন, অতঃপর তিনি তেলাওয়াত করেন, وَكَذَالِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ- ‘আর এরূপই হয়ে থাকে তোমার পালনকর্তার পাকড়াও, যখন তিনি কোন পাপিষ্ঠ জনপদকে পাকড়াও করেন। নিশ্চয়ই তাঁর পাকড়াও অতীব যন্ত্রণাদায়ক ও অত্যন্ত কঠোর’ (হূদ ১১/১০২)।[3]
যুলুমে ত্বরান্বিত হয় পতন : যালেমরা অপর মানুষের উপর অন্যায় বা অবিচার করে নিজের ও সমাজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে ত্বরিৎ গতিতে। বিপদাপদ ও বিশৃঙ্খলায় নিপতিত হওয়ার অন্যতম একটিমাত্র কারণ হ’ল যুলুম। সেকারণ আল্লাহ সবাইকে এহেন ন্যাক্কারজনক আচরণ থেকে নিষেধ করেছেন। এমনকি নিজের জন্যও আল্লাহ এটিকে হারাম করেছেন। হাদীছে কুদসীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেন,يَا عِبَادِي إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوا، ‘হে আমার বান্দারা, নিশ্চয়ই আমি নিজের উপর যুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা পরস্পরের উপর যুলুম করো না’।[4]
মানুষের অধিকার হরণ করা ও তাদের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা অনেক বড় ধরনের যুলুম। এই ধরনের অন্যায়ের কারণে শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে এক সময় যালিম বা অন্যায়কারীর জীবনে নেমে আসে নানা বিপদ-আপদ। যারা মানুষের উপর যুলুম করে এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ يُعَذِّبُ الَّذِينَ يُعَذِّبُونَ فِي الدُّنْيَا- ‘নিশ্চয়ই যারা মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়, মহান আল্লাহ তাদের শাস্তি প্রদান করবেন’ (মুসলিম হা/২৬১৩)।
আল্লাহর কাছে মাযলূমের বদদো‘আ দ্রুততম সময়ে পৌঁছে : যুলুমের কারণে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে, শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। পরিণতিতে একসময় যালেমের জীবনে নেমে আসে নানান ধরনের আযাব-গযব। মাযলূমের দো‘আ কখনো ব্যর্থ হয় না। অত্যাচারিত ব্যক্তির অন্তরের আকুতি মহান আল্লাহর কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে যায়। তাই মাযলূমের অশ্রুফোঁটা ও হৃদয়বিদারী অভিশাপ যালেমের পতনের অন্যতম কারণ। মাযলূমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর তরফ হ’তে যালেমদের উপর নেমে আসে কঠিন আযাব। তাদের অধঃপতন ও পদস্খলন ত্বরান্বিত হয়। যুলুমের পরিণতি দুনিয়াতে ভোগ করতে হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মু‘আয (রাঃ)-কে ইয়ামনে গভর্ণর হিসাবে প্রেরণ করেন, তখন তাকে উপদেশ দিয়ে বলেন,وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ- ‘তুমি মাযলূমের বদ দো‘আর ব্যাপারে সতর্ক থেকো; কেননা মহান আল্লাহ ও মাযলূমের মধ্যে কোন পর্দা থাকে না’।[5]
যালেমরা দুনিয়াতে লাঞ্ছিত হয় : আল্লাহ যালেমদেরকে তাদের অপকর্মের পরিণামে দুনিয়াতে লাঞ্ছিত, অপদস্থ ও অপমানিত করে থাকেন। এটা আল্লাহর অমোঘ নিয়ম। যুগে যুগে বিভিন্ন যালেম সম্প্রদায় ও অত্যাচারীদেরকে আল্লাহ লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করেছেন। আল্লাহ বলেন, وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِرُسُلِهِمْ لَنُخْرِجَنَّكُمْ مِنْ أَرْضِنَآ أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا فَأَوْحَى إِلَيْهِمْ رَبُّهُمْ لَنُهْلِكَنَّ الظَّالِمِينَ- ‘আর কাফেররা তাদের রাসূলদের বলেছিল, অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বের করে দেব, অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসবে। তখন তাদের নিকট তাদের প্রতিপালক অহি করলেন যে, আমরা অবশ্যই যালেমদের ধ্বংস করে দেব’ (ইব্রাহীম ১৪/১৩)।
(ক) পৃথিবীতে মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম সবচেয়ে বড় যুলুমটি করেছিল আদম (আঃ)-এর ছোট ছেলে কাবিল। নিজের কুরবানী আল্লাহর দরবারে কবুল না হওয়ায় যিদ ও একগুঁয়েমির বশবর্তী হয়ে বড় ভাই হাবিলকে হত্যা করেছিল। আল্লাহ দুনিয়ায় তাকে নিঃসঙ্গতা ও হয়রানী-পেরেশানীর শাস্তি দিয়েছিলেন। আর পরকালের জন্য তো জাহান্নামের শাস্তি নির্ধারণ করেই রেখেছেন (মায়েদাহ ৫/২৭-৩১)। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, لَيْسَ مِنْ نَفْسٍ تُقْتَلُ ظُلْمًا، إِلاَّ كَانَ عَلَى ابْنِ آدَمَ الأَوَّلِ كِفْلٌ مِنْهَا لِأَنَّهُ أَوَّلُ مَنْ سَنَّ القَتْلَ أَوَّلاً- ‘কোন ব্যক্তি যখন অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে, তখন তার পাপের একটি অংশ আদমের প্রথম পুত্রের উপর বর্তায়। কেননা সেই সর্বপ্রথম হত্যার প্রচলন ঘটিয়েছিল’।[6]
(খ) ইরাকের অত্যাচারী বাদশাহ নমরূদ যুলুম করেছিল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর উপর। নিজেকে সে প্রভুু দাবী করে চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল। তার কথা অমান্য করার কারণে সে ইব্রাহীম (আঃ)-কে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল। আল্লাহ তাকে লোকবল সহ মশা দ্বারা ধ্বংস করেন। পরকালে তো শাস্তি আছেই। আল্লাহ বলেন,قَالَ أَفَتَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللهِ مَا لاَ يَنْفَعُكُمْ شَيْئًا وَّلاَ يَضُرُّكُمْ- أُفٍّ لَّكُمْ وَلِمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللهِ أَفَلاَ تَعْقِلُونَ- قَالُوا حَرِّقُوهُ وَانْصُرُوا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ فَاعِلِينَ- قُلْنَا يَانَارُ كُونِي بَرْدًا وَّسَلاَمًا عَلَى إِبْرَاهِيمَ- وَأَرَادُوا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَخْسَرِينَ- ‘সে বলল, এর পরেও কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর পূজা করবে, যা তোমাদের কোন উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না?’। ‘ধিক তোমাদের জন্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের পূজা কর তাদের জন্য! তোমরা কি কিছুই বুঝ না?’। ‘তারা বলল, তোমরা একে পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’। ‘আমরা বললাম, হে আগুন! তুমি ইব্রাহীমের উপর ঠান্ডা ও শান্তিদায়ক হয়ে যাও’। ‘তারা ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে চক্রান্তের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আমরা তাদেরকে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৬৬-৭০)।
(গ) পৃথিবীর এক নিকৃষ্ট অত্যাচারী নাফরমান বাদশাহর নাম ফেরাঊন। সে নিজেকে বড় প্রভু দাবি করেছিল। নিজের ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে বনী ইস্রাঈলের অসংখ্য ছেলে শিশুকে হত্যা করেছিল।[7] অবশেষে মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে বেয়াদবী করে দরিয়ায় সলিল সমাধি হয়েছিল। তার যুলুমের মর্মান্তিক পরিণতি মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন বলেন, وَقَالَ فِرْعَوْنُ يَآأَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرِي فَأَوْقِدْ لِي يَاهَامَانُ عَلَى الطِّينِ فَاجْعَلْ لِي صَرْحًا لَّعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَى إِلَهِ مُوسَى وَإِنِّي لَأَظُنُّهُ مِنَ الْكَاذِبِينَ- وَاسْتَكْبَرَ هُوَ وَجُنُودُهُ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ إِلَيْنَا لاَ يُرْجَعُونَ- فَأَخَذْنَاهُ وَجُنُودَهُ فَنَبَذْنَاهُمْ فِي الْيَمِّ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الظَّالِمِينَ- ‘ফেরাঊন বলল, হে পরিষদবর্গ! আমি তোমাদের অন্য কোন উপাস্য আছে বলে জানিনা। সুতরাং হে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও এবং এমন একটি (সুউচ্চ) প্রাসাদ নির্মাণ কর, যা থেকে আমি মূসার উপাস্যকে উঁকি মেরে দেখতে পারি। আর আমি অবশ্যই তাকে মিথ্যাবাদী বলে মনে করি’। ‘এভাবে ফেরাঊন ও তার বাহিনী অন্যায়ভাবে জনপদে ঔদ্ধত্য দেখাতে লাগল। আর ধারণা করল যে, তারা কখনো আমাদের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না’। ‘ফলে আমরা তাকে ও তার বাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং তাদেরকে সাগরে নিক্ষেপ করলাম। অতএব তুমি দেখ যালেমদের পরিণতি কেমন হয়েছে’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৮-৪০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنْ خَلْفَكَ آيَةً وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ عَنْ آيَاتِنَا لَغَافِلُونَ- ‘আজ আমরা তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তী কালের মানুষের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো। কেননা আমার নিদর্শন সম্পর্কে বহু লোক গাফেল হয়ে থাকে’ (ইউনুস ১০/৯২)।
আজও ফেরাঊনের মমি মিসরের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। পরকালে তার জন্যও অপেক্ষা করছে জাহান্নামের লেলিহান আগুন। নবীযুগের প্রসিদ্ধ যালেম আবু জাহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়বাদের লাঞ্ছনাকর পরিণতির কথা সবারই জানা। যুলুম ও সীমালঙ্ঘনের কারণে দূর অতীতে কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, লূতসহ বহু জাতিকে আল্লাহ সমূলে ধ্বংস করেছেন। আল্লাহ বলেন, অবশ্যই আমি তোমাদের আগে বহু জাতিকে ধ্বংস করেছি, যখন তারা যুলুমে লিপ্ত ছিল (ইউনুস ১০/১৩)। মহান আল্লাহ আমাদের যুলুমের ভয়াবহ পাপ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন!
যালেম কখনোই সফলকাম হয় না : যালেম কখনোই সফলতার মুখ দেখতে পারে না। সাময়িকভাবে সে নিজেকে সফল মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে সে কখনো সফলকাম নয় এবং সে সঠিক পথও পায় না। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয় কিংবা তাঁর আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে, তার চেয়ে বড় যালেম আর কে আছে? নিশ্চয়ই যালেমরা কখনো সফলকাম হয় না’ (আন‘আম ৬/২১)।
আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত : মানুষের উপর অনুগ্রহকারীগণ আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত হন। আর যালেম আল্লাহর রহমত হ’তে বঞ্চিত হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يَرْحَمُ اللهُ مَنْ لاَّ يَرْحَمُ النَّاسَ- ‘আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না, যে মানুষের প্রতি দয়া করে না’।[8] মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِبًا أُولَئِكَ يُعْرَضُونَ عَلَى رَبِّهِمْ وَيَقُولُ الْأَشْهَادُ هَؤُلَآءِ الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى رَبِّهِمْ أَلاَ لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الظَّالِمِينَ- ‘আর ঐ ব্যক্তির চেয়ে বড় যালেম আর কে আছে যে আল্লাহর উপরে মিথ্যারোপ করে? এসব লোককে তাদের পালনকর্তার সম্মুখে পেশ করা হবে। আর তখন সাক্ষীরা বলবে, এরাই তো সেইসব লোক যারা তাদের প্রতিপালকের উপর মিথ্যারোপ করেছিল। মনে রেখ, যালেমদের উপরেই রয়েছে আল্লাহর অভিসম্পাৎ’ (হূদ ১১/১৮)।
যুলুমবাজ শাসকের উপর আল্লাহ ক্রুদ্ধ হন : যার ব্যাপারে আল্লাহর ক্রোধের বর্ণনা এসেছে, তার ধ্বংস অনিস্বীকার্য। জাহান্নামের আযাব হতে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই কঠিন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَرْبَعَةٌ يُبْغِضُهُمُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ الْبَيَّاعُ الْحَلاَّفُ وَالْفَقِيرُ الْمُخْتَالُ وَالشَّيْخُ الزَّانِى وَالإِمَامُ الْجَائِرُ- ‘চার শ্রেণীর মানুষের প্রতি আল্লাহ ক্রোধান্বিত হন। মিথ্যা কসমের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী। অহংকারী ফকীর। বৃদ্ধ ব্যভিচারী এবং অত্যাচারী শাসক’।[9] আল্লাহর ক্রোধ এবং গোস্বা থেকে রেহাই পেতে শাসকবর্গের উচিত প্রজা-সাধারণের উপর অত্যাচার পরিহার করা এবং অধীনস্তদের উপর সর্ব প্রকার যুলুম করা থেকে বিরত থাকা। সবার সঙ্গে মানবিক আচরণ করা। শাসকবর্গের মধ্যে এ গুণ না থাকলে সে কখনো আল্লাহর ক্রোধ থেকে নিস্তার পাবে না।
যালেমদের দুনিয়াবী শাস্তি : যারা দ্বীনের বিরুদ্ধাচরণ করবে, আল্লাহর সাথে শিরক করবে, দ্বীনের কর্মীদের ওপরে অত্যাচার-অবিচার করবে, আল্লাহ তাদের দুনিয়াবী জীবনে লাঞ্ছিত-অপমানিত করবেন। আল্লাহ বলেন,وَإِنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا عَذَابًا دُونَ ذَالِكَ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ- ‘নিশ্চয়ই যালেমদের জন্য এছাড়াও শাস্তি রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ তা জানে না’ (তূর ৫২/৪৭)। ইতিপূর্বে যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, তাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করেছিলেন। তাদের সেই স্মৃতি পৃথিবীর বুকে রেখে দিয়েছেন, যা দেখে অনেক মানুষ আজও হেদায়াত পেয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,وَمَكَرُوا مَكْرًا وَّمَكَرْنَا مَكْرًا وَّهُمْ لاَ يَشْعُرُونَ- فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ مَكْرِهِمْ أَنَّا دَمَّرْنَاهُمْ وَقَوْمَهُمْ أَجْمَعِينَ- فَتِلْكَ بُيُوتُهُمْ خَاوِيَةًم بِمَا ظَلَمُوآ إِنَّ فِي ذَالِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَّعْلَمُونَ- ‘তারা ভয়ংকর চক্রান্ত করেছিল এবং আমরাও কৌশল করেছিলাম। অথচ তারা তা বুঝতে পারেনি’। ‘অতএব দেখ তাদের চক্রান্তের পরিণাম কি হয়েছিল। আমরা তাদেরকে ও তাদের সম্প্রদায়ের সকলকে ধ্বংস করে দিয়েছি’। ‘ঐ তো তাদের বাড়ী-ঘর জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে তাদের যুলুমের পরিণামে। এতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে’ (নামল ২৭/৫০-৫২)। তিনি আরও বলেন,فَأَخَذْنَاهُ وَجُنُودَهُ فَنَبَذْنَاهُمْ فِي الْيَمِّ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الظَّالِمِينَ- وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَّدْعُونَ إِلَى النَّارِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ يُنْصَرُونَ- وَأَتْبَعْنَاهُمْ فِي هَذِهِ الدُّنْيَا لَعْنَةً وَّيَوْمَ الْقِيَامَةِ هُمْ مِّنَ الْمَقْبُوحِينَ- ‘ফলে আমরা তাকে ও তার বাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং তাদেরকে সাগরে নিক্ষেপ করলাম। অতএব তুমি দেখ যালেমদের পরিণতি কেমন হয়েছে’। ‘আমরা তাদেরকে নেতা করেছিলাম। অথচ তারা মানুষকে জাহান্নামের দিকে ডাকতো। ফলে ক্বিয়ামতের দিন তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’। ‘এ দুনিয়ায় আমরা তাদের পিছনে অভিসম্পাৎ লাগিয়ে দিয়েছি। আর ক্বিয়ামতের দিন তারা হবে ঘৃণিতদের অন্তর্ভুক্ত’ (ক্বাছাছ ২৮/৪০-৪২)। যুলুমকারী ব্যক্তিরা সীমালঙ্ঘনকারী। এই সীমালঙ্ঘনের অপরাধে আল্লাহ ফেরাঊনকে সদলবলে লোহিত সাগরের পানিতে ডুবিয়ে মেরেছেন।
যালেমদের পরকালীন কঠিন শাস্তি : যারা নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের উপর অত্যাচার করেছে, সমাজের অসহায় মানুষদের উপরে যুলুম করেছে, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করেছে এ সকল যালেমদেরকে আল্লাহ কঠিন শাস্তি দিবেন এবং এদের আযাব কমতি করা হবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَإِذَا رَأَى الَّذِينَ ظَلَمُوا الْعَذَابَ فَلاَ يُخَفَّفُ عَنْهُمْ وَلاَ هُمْ يُنْظَرُونَ- ‘যেদিন যালেমরা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। অতঃপর তাদের থেকে শাস্তি লঘু করা হবে না এবং তাদেরকে কোনরূপ অবকাশ দেওয়া হবে না’ (নাহল ১৬/৮৫)। যে বা যারাই দুর্বল ও ইয়াতীমের সম্পত্তি গ্রাস করবে, জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে কোন মানুষকে হত্যা করবে, কোন নারীকে ধর্ষণ করবে, রাতের অন্ধকারে বিষ প্রয়োগ করে পুকুরের মাছ মেরে ফেলে আর্থিক ক্ষতি করবে ও মানুষের বাড়ী-ঘরে হামলা চালিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করবে, তাদের কাউকে আল্লাহ মাফ করবেন না। বরং তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন শাস্তি। আল্লাহ বলেন,وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍم بَئِيسٍم بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ- ‘অতঃপর যখন তারা ভুলে গেল যা তাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তখন যারা মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করত, তাদেরকে আমরা বাঁচিয়ে নিলাম এবং যারা সীমালংঘন করেছিল, তাদেরকে তাদের অবাধ্যতার কারণে কঠোর শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম’ (আ‘রাফ ৭/১৬৫)।
[ক্রমশ]
ড. ইহসান ইলাহী যহীর
[সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, ঢাকা (দক্ষিণ) ও প্রিন্সিপ্যাল,
মারকাযুস সুন্নাহ আস-সালাফী, পূর্বাচল নতুন শহর, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ]
[1]. সুয়ূত্বী, জামে‘উল আহাদীছ হা/২১৩১৮; আলবানী, ছহীহুল জামে‘ হা/১০২০।
[2]. তিরমিযী হা/২৫১১; ইবনু মাজাহ হা/৪২১১; মিশকাত হা/৪৯৩২।
[3]. বুখারী হা/৪৬৮৬; মুসলিম হা/২৫৮৩; মিশকাত হা/৫১২৪।
[4]. মুসলিম হা/২৫৭৭; মিশকাত হা/২৩২৬।
[5]. বুখারী হা/১৪৯৬, ৪৩৪৭।
[6]. বুখারী হা/৭৩২১, ৬৮৬৭।
[7]. বাক্বারাহ ২/৪৯; ইব্রাহীম ১৪/৬; ক্বাছাছ ২৮/৪।
[8]. বুখারী হা/৭৩৭৬।
[9]. নাসাঈ হা/২৫৭৬; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৫৫৫৮; ছহীহাহ হা/৩৬৩।