অশ্লীলতার নানামুখ : প্রতিরোধ কীভাবে?
মুহাম্মাদ আবু হুরায়রা ছিফাত
মুহাম্মাদ তোফায়েল আহমাদ 155 বার পঠিত
ভূমিকা : বর্তমান যুগে প্রযুক্তির যত উন্নতি হয়েছে, ততই প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছে ভয়াবহতার দিকে। এখন আমাদের অন্যতম সঙ্গী হল ফোন। পড়াশোনা অথবা কাজ মোবাইল ছাড়া যেন চলেই না। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই হাত চলে যায় মুঠোফোনের দিকে। ফেসবুক বা ইউটিউবে নজর রাখা কিংবা জুমকলে অফিসের জরুরী মিটিং বা হোয়াটসঅ্যাপে বাচ্চার স্কুলের সিলেবাস দেখা সবেতেই চাই মোবাইল ফোন। দিনের বেশীর ভাগ সময়টাই কেটে যায় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে। বড়রা তো বটেই, শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রেও এই একই দৃশ্য। তবে অতিরিক্ত মোবাইল দেখার ঝোঁকই হ’তে পারে কাল। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমের ফলে তৈরী হচ্ছে চোখের একটি বিশেষ রোগ যাকে বলা হয় ‘মায়োপিয়া’। মোবাইল, ল্যাপটপ অথবা ট্যাব, এই স্ক্রিন টাইমের আধিক্য সব থেকে বেশী দেখা গেছে মহামারীর পর থেকে। টিভি দেখার পাশাপাশি মুঠো ফোনে অতিরিক্ত সময়ে অতিবাহিত করার ফলে ধীরে ধীরে সকলের দৃষ্টি শক্তি কমতে শুরু করেছে। ন্যাশনাল লাইব্রেরী অফ মেডিসিনের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী জানা গেছে, ‘২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হবেন’ (দৈনিক ইনকিলাব, ১০ই জুন ২০২৪)।
মায়োপিয়া উপসর্গ : ১. দূরের কোনও জিনিস একেবারে ঝাপসা দেখা। ২. দূরের কোনও জিনিসকে স্পষ্ট দেখার জন্য চোখের পাতাগুলিকে কাছাকাছি নিয়ে আসা। ৩. সারাক্ষণ মাথাব্যথা করা। ৪. চোখে যন্ত্রণা।
মায়োপিয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদরে মতামত :
১. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল আই কেয়ার কর্মসূচীর ডেপুটি প্রগ্রাম ম্যানেজার ডা. শহীদুল ইসলাম বলেন, গত ২০ বছরে দেশে অন্ধত্বের হার ৩৫ শতাংশ কমেছে। কিন্তু চশমা ব্যবহার করার মতো দৃষ্টির সমস্যা বাড়ছে। তার কারণ, আমাদের ঘরোয়া কাজ বেশী হচ্ছে, বাইরে যাওয়া কমেছে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের পরিমাণ বেশী বাড়ছে। চশমা ব্যবহারকারী রোগীর সংখ্যা শুধু বাংলাদেশেই না, সারা বিশ্বে বাড়ছে’ (দৈনিক যুগান্তর ৯ই ডিসেম্বর ২০২১)।
২. ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের একদল গবেষক জানান, ঢাকার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থীর চোখে সমস্যা রয়েছে। হাসপাতালের শিশু চক্ষুরোগ ও স্কুইন্ট বিভাগের প্রধান মুহাম্মাদ মোস্তফার নেতৃত্বে দলটি ঢাকার ১৯টি স্কুলের ছয় হাযার ৪০১ শিক্ষার্থীর চোখ পরীক্ষা করেন। এর মধ্যে তারা আড়াই হাযারের বেশী শিক্ষার্থীর চোখে ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন। চিকিৎসকরা তাদের চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীরা নার্সারি থেকে দশম শ্রেণীতে পড়ে’ (দৈনিক ইনকিলাব ১৩ ই অক্টোবর ২০২২)।
৩. দেশের নামকরা চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ আই হসপিটালের চিকিৎসক কাযী ছাবিবর আনোয়ার বলেন, কক্সবাজারে একটি আই ক্যাম্পে আমরা ৯০০ শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৩ জনের, মানে দশমিক ১৪ শতাংশের চোখে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা পেয়েছিলাম। আর ঢাকায় আমার চেম্বারে যত শিশু-কিশোরদের চোখ পরীক্ষা করি, তার প্রায় ৭০ শতাংশ এ রোগে ভুগছে। তিনি বলেন, শিশু-কিশোরদের স্ক্রিনে সময় কাটানোর দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনা দরকার। নচেৎ ডিভাইস আসক্তিতে তাদের চোখের অসুখ বাড়বে’ (প্রথম আলো ২০শে মে ২০১৬)।
৪. জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা বলেছেন, মাসে হাসপাতালটিতে গড়ে ৩ হাযার ৭০০ শিশু-কিশোর আসে। এদের ৭০ শতাংশ দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না। বেসরকারী হাসপাতাল বাংলাদেশ আই হসপিটালের তথ্যও একই। এই হাসপাতালেও চিকিৎসা নিতে আসা ৭০ শতাংশ শিশু-কিশোর একই রোগে ভুগছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। ২০১৩ সালে ল্যানসেট এশিয়ায় ক্ষীণদৃষ্টিতে ভোগা শিশু-কিশোরদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ ছেপেছিল। ওই প্রবন্ধের লেখক ও গবেষক অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইয়ান জি মরগ্যানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, এশিয়ার দেশগুলোয় গত ৪০ বছরে ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিন গুণ হয়েছে। ১৯৫৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০ বছর বয়সী তরুণদের ১৮ শতাংশ ক্ষীণদৃষ্টিতে ভুগত, ২০১১ সালে এই সংখ্যা ৯৬ শতাংশে দাঁড়ায়। হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানে এই সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ (প্রথম আলো, ২০শে মে ২০১৬)।
৫. দেশের প্রথিতযশা চক্ষু বিশেষজ্ঞ নিয়ায আব্দুর রহমান শিশু-কিশোরদের চোখে সমস্যার কারণ হিসাবে বলেন, স্ক্রিনের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে তাদের চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পায় না। অক্ষিগোলকের আকৃতি যখন স্বাভাবিক থাকে, তখন প্রথমেই আলো গিয়ে পড়ে মানুষের চোখের মণিতে (কর্নিয়া)। সেখান থেকে মণির ভেতরের আরও কালো যে অংশ, সেই নয়নতারা (পিউপিল) ও লেন্স হয়ে আলো অক্ষিপটে (রেটিনা) পৌঁছায়। অক্ষিপটের কোষগুলো উদ্দীপিত হয়ে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠালে তবেই মানুষ দেখতে পায়। লম্বা সময় চোখের খুব সামনে রেখে শিশু-কিশোররা যখন কম্পিউটার, ট্যাব বা মুঠোফোনে গেমস খেলে, তখন চোখ বিশ্রাম পায় না। চোখের মাংসপেশিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। এ কারণে তাদের চোখ আর চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পায় না (প্রথম আলো ২০শে মে ২০১৬)।
কীভাবে এই রোগের ঝুঁকি এড়াবেন : দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের পর্দায় (স্ক্রিন) তাকিয়ে থাকলে দেখা দিতে পারে চোখের সমস্যা। ফলে চোখের ওপর থেকে বাড়তি চাপ কমাতে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হ’ল ‘স্ক্রিন টাইম’-এ লাগাম টেনে ধরা। কিন্তু কাজের প্রয়োজনে স্ক্রিন যাঁদের সর্বক্ষণের সঙ্গী, তাদের জন্য প্রয়োজন স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত চোখের ব্যায়াম করা। তন্মধ্যে (১) বড়দের ক্ষেত্রে কাজের সূত্রে ৮ ঘণ্টা ও প্রয়োজনে ১ ঘণ্টার বেশী স্ক্রিন টাইম না রাখা। (২) রাতে ঘুমোনোর এক ঘণ্টা আগে মোবাইল, টিভি কিংবা ট্যাবের দিকে না তাকানো। (৩) ঘন ঘন চোখের পলক ফেলা। (৪) ২০-২০-২০ নিয়ম মেনে চলা। অর্থাৎ টানা ২০ মিনিট কম্পিউটার বা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ২০ ফিট দূরে থাকা কোনও জিনিসের দিকে অন্তত ২০ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকা। (৫) কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখ বন্ধ করে চোখের মণি চারদিকে ঘোরান। ঘাড় ব্যথা করলে যেমন ঘাড় ঘুরিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করা হয়, ঠিক তেমন। (৬) কিছুক্ষণ পরপর চোখে পানি দেওয়া।
উপসংহার : দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ তরুণ তাদের স্মার্টফোনের ওপর এতোটাই নির্ভরশীল যে এটি আসক্তির মতো হয়ে গেছে। এদের মধ্যে অনেকে প্রযুক্তিকে আভিজাত্যের লক্ষণ মনে করেন। অথচ ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার যেমন মানুষের মেজাজেও দারুণভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সময় থাকতেই আমাদেরকে পার্থিব জীবনে সুস্থ্য দেহ-মন গঠন এবং অপব্যবহারের কারণে পরকালীন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য মোবাইল ফোনের আসক্তি থেকে নিজেকে উত্তরণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন।-আমীন!