উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভার : অভিভাবকদের দায়িত্ব নাকি অনুগ্রহ

সারোয়ার মিছবাহ 159 বার পঠিত

ভূমিকা : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন ছেলের পড়ালেখা শেষ করে চাকুরী পেতে তার বয়স হয় প্রায় ৩০ বছর। যা উম্মতে মুহাম্মাদীর স্বাভাবিক এক জীবনের অর্ধেক। এই অর্ধেক জীবন ছেলের পূর্ণ দেখাশোনা করেন পিতা-মাতা। আর সন্তান যখন কর্মক্ষম হয়ে ওঠে, তখনই ঘনিয়ে আসে পিতা-মাতার বিদায় বেলা। ফলে অবসর সময় আর পার করা হয়ে ওঠে না। অথচ বাবারা জানেন, সন্তানকে এই দীর্ঘ মেয়াদী পড়ালেখা শেষ করাতে হয়তো তার জীবনের পশ্চিমাকাশ রক্তিম বর্ণ ধারণ করবে। তবুও তারা সন্তানকে সাপোর্ট দিয়ে যান।

শৈশব থেকেই যারা পড়ালেখার সাথে নেই তাদের জীবনের চিত্রটা একটু ভিন্ন। তারা ১৫-২০ বছরের মধ্যে বিয়ে করে সংসারের হাল ধরে। খুব সকালেই কাজে চলে যায়। সন্ধ্যায় বাজার-সদাই নিয়ে বাড়িতে ফিরে। বাবা দু’দিন কাজ না করলেও সংসার থেমে থাকে না। এটা বাবার জন্য বেশ বড় পাওয়া। গড় প্রায় ৬০ বছরের একটি জীবনে ১৫/২০ বছর এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ। এটাকে অনেক লম্বা সময় হিসাবেই উপস্থাপন করা যায়। সন্তানকে লেখাপড়া না করানোর ফলে একজন বাবা তাকে সহযোগী হিসাবে প্রায় ১০-১৫ বছর বেশী পাবেন। অনেক আগেই সংসারের মূল দায়িত্ব ছেড়ে অবসর পাবেন।

এই দুইটা জীবনধারাকে তুলনা করলে ফলাফল অনেকটা এমন দাঁড়ায়, হাল-যামানায় জীবন উপভোগ করার জন্য সন্তানকে লেখাপড়া না করানোই ভাল। লেখাপড়া না করালে তারা অল্প বয়সেই উপার্জন শিখবে। তাদেরকে সংসার বুঝিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, বাবা শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরীব যাই হৌন, সন্তান লেখাপড়া করবে না, এটা যেন তারা মানতেই পারেন না। এখানে এসে বাবারা যেন লাভ-লোকসান একটু কমই বুঝেন। সন্তানের ভবিষ্যতের কাছে তারা সবকিছুকেই তুচ্ছ করে ফেলেন।

আমি আজ চিন্তার দাবী রাখব সে সকল ছাত্রের প্রতি, যাদের বাবা-মা তাদের কাছে সেবা গ্রহণ না করে লেখাপড়া করাচ্ছেন। পরিবারের হাল ধরার বয়সে উপনীত হবার পরেও অকপটে তাদের সকল প্রয়োজন পূরণ করে যাচ্ছেন। তাদের উপার্জন গ্রহণ না করে তাদের পেছনেই টাকা ব্যয় বলেন, ‘সংসার নিয়ে ভাবার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি লেখাপড়া করে যাও। বাকি সব আমি দেখছি’। এই ছাত্ররা কি জানে, তাদের পিতা-মাতারা কত বড় স্বপ্ন বুকে ধারণ করে দিন-রাত এই ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছেন! নিজেদের সুখ আর অবসরকে বিসর্জন দিয়ে আমৃত্যু খেটে যাচ্ছেন!

আমি তাদের প্রশ্ন করতে চাই, ৩০-এর অধিক বছর স্বপ্ন দেখার পরে যদি পিতা-মাতার সেই স্বপ্ন সজোরে আছড়ে পড়া কাঁচের মত টুকরো টুকরো হয়ে যায়, তবে স্বপ্ন ভাঙতে এত দীর্ঘ অপেক্ষা কেন? পিতা-মাতাকে এত ত্যাগ স্বীকার করানোর কি প্রয়োজন? আজই ভেঙ্গে ফেলুন সেই স্বপ্ন! আজই বাবাকে ফিরে আসতে বলুন সন্তানকে গড়ে তোলার সংগ্রামী জীবন থেকে!

অক্ষরজ্ঞানহীন অনেক বাবা-মা জানেন না, আমাদের ছেলে কেমন লেখাপড়া করছে। তারা বোঝেন না, এভাবে লেখাপড়া করলে সন্তানের ভবিষ্যৎ কী। তারা শুধু কষ্টার্জিত টাকা সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে বলতে পারেন, ‘বাবা! মন দিয়ে লেখাপড়া কর’। এরচেয়ে বেশী কোন পরামর্শও দেয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। তারা আশায় থাকেন, এত কষ্ট করে লেখাপড়া করাচ্ছি, ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। আমি সেসমস্ত ছেলেদের প্রশ্ন করতে চাই, ৩০ বছর পরে যখন আপনার বাবা জানতে পারবেন, তার স্বপ্নের মহানায়ক ছেলে এতদিন কোন লেখাপড়াই করেনি, তখন তার মনের অবস্থা কেমন হবে? তিনি কি এতবড় ধাক্কা সামলাতে পারবেন? এটা কখনো আপনার চিন্তা হয়? দেখুন! তিনি হয়ত সেদিন আপনাকে কিছুই বলবেন না। তবে এতটুকু জেনে রাখুন, তার অন্তরফাটা কষ্ট থেকে সৃষ্ট বদদো‘আ আপনার বাকি জীবনের অশান্তির জন্য যথেষ্ট হবে।

ছেলে-মেয়ের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্বের সীমারেখা : ইসলাম একজন পিতাকে ছেলে বালেগ হওয়া পর্যন্ত তার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছে। ছেলে সাবালক হয়ে যাওয়ার পরে সন্তানকে দেখাশোনার দায়িত্ব পিতা-মাতার নয়। তখন পিতা-মাতাকেই দেখাশোনার দায়িত্ব সন্তানের কাঁধে এসে পড়ে। তবুও আমরা দেখি, সাবালক হওয়ার পরেও প্রায় ১৫ বছর পিতা-মাতাই সন্তানের দেখভাল করেন। এই বাড়তি যে দায়িত্ব তারা পালন করে থাকেন সেটা নিতান্তই অনুগ্রহ। বাবারা চাইলে ১৫ বছর বয়স থেকেই সন্তানকে নিজের সহযোগী হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। তাকে বলতে পারেন, ‘তোমাকে জন্ম দিয়েছি। বড় করেছি। এখন তুমি আমাদের দেখাশোনা কর। অর্থ উপার্জন কর। আমাদের খাদ্য ও বস্ত্রের ব্যবস্থা কর’। তবে এমন বাবা-মা আমরা বেশী দেখি না। আমরা এমন বাবা-মা অহরহ দেখেছি, যারা সন্তানকে একটু বড় বানানোর আশায় নিজেদের জীবনের সর্বস্ব সুখ বিসর্জন দিতে দেন।

আমরা দেখেছি, আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ‘আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী’তে প্রতি বছর জানুয়ারীতে ভর্তিযুদ্ধের দৃশ্য। এমনও অভিভাবককে আমরা কান্না করতে দেখেছি, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন। অথচ সন্তানের মেধাহীনতার কারণে তার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। তিনি যখন তার স্বপ্নগুলোর কথা বলেন, তখন তার ছেলে পাশে দাঁড়িয়ে হয়ত তার কথাগুলো ওযন করতে না পারলেও আমরা বুঝি। তার বাবা যে কাজটি করছেন এটা তার দায়িত্ব নাকি অনুগ্রহ! পক্ষান্তরে একজন নিম্ন আয়ের অভিভাবকের ছেলে যখন ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতকার্য হয়, তখন সে অভিভাবক বাড়ীতে গিয়ে হয়ত তার স্ত্রীকে বলেন, ‘আল্লাহ তো ভর্তির জন্য কবুল করলেন! বেতনের ব্যবস্থাও হয়ত তিনিই করবেন। আল্লাহর ওপর ভরসা করে ভর্তি করেই দিয়ে আসি’। ঠিক যেমন আমার আববু বলেছিলেন। তখন বুঝিনি, এটা তাঁর দায়িত্ব না, অনুগ্রহ। তবে এখন বুঝি। তাই আমরা অভিভাবকের স্বপ্ন পূরণের সঙ্গী হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।

বাবাদের ত্যাগের উদাহরণ হিসাবে আমার নিজের জীবনের অনেকগুলো স্মৃতির ধূসর চিরকুট রয়েছে। শুধু আমার নয়, সবার জীবনেই রয়েছে। পার্থক্য শুধু কারো কাছে সেগুলো অমূল্য, আবার কারো কাছে মূল্যহীন। আমি যখন কুল্লিয়া প্রথম বর্ষে পড়ি, তখন আমার অসুস্থতার কারণে বার্ষিক পরীক্ষাগুলো মাদ্রাসায় থেকে দেওয়া সম্ভব হয়নি। মাদ্রাসা থেকে আমার বাসা ৪৫ কি.মি দূরে হওয়ায় শীতের সকালে বাস ধরে পরীক্ষার আগে মাদ্রাসায় পৌঁছানোও অনিশ্চিত ছিল। তখন আববু আমাকে প্রতিদিন সকালে মোটরসাইকেলে মাদ্রাসায় দিয়ে যেতেন। ডিসেম্বরের কনকনে শীতের সকালে আববুর পেছনে বসে মাদ্রাসা পর্যন্ত আসতে আমার কাঁপুনি ধরে যেত। আমি যুবক হলেও তিনি তো চল্লিশোর্ধ মানুষ। তার কেমন কষ্ট হওয়ার কথা! অথচ তিনি আমাকে মাদ্রাসার গেটে নামিয়ে দিয়েই ফিরে যেতেন। আমি বলতাম, ‘আববু! আপনার তো ঠান্ডা লেগে যাবে! একটু বসে যান’। তিনি বলতেন, ‘না! কোন সমস্যা হবে না’। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে ৬০/৭০ কি.মি. বেগে ড্রাইভ করলে হয়ত আমার হাত ঠান্ডায় অবশ হয়ে যেত। শীতে শরীর কাঁপতে কাঁপতে হয়ত কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেত। তবে দেখেছি, একজন চল্লিশোর্ধ বাবার হাত ঠান্ডায় অবশ হয় না। জমে যায় না। তাঁর শরীরে কাঁপুনি ধরে না। আমি বাবা নই। আমি হয়ত বুঝব না, বাবারা এত বীরপুরুষ হন কিভাবে!

আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি বাবাই নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যতের ব্যাপারে অকল্পনীয় শক্তিশালী। তাঁরা সন্তানের কোন সাহায্য ছাড়াই বার্ধক্য অতিবাহিত করতে পারেন। তবে ‘সন্তান মানুষ হবে না’ এটা তাঁরা মানতে পারেন না। এমনও অভিভাবক আছেন, যারা রিকশা চালিয়ে বা দিনমজুরী করে সংসার পরিচালনা করেন। যাদের দৈনিক রোজগার ৫০০ টাকার বেশী নয়। যাদের জীবনে শখ-আহ্লাদ বলে কিছুই নেই। যারা ছেঁড়া স্যান্ডেল পরিবর্তন না করে সেলাই করান। নতুন একটা জামা না কিনে ছেঁড়া জামাটাই জোড়াতালি দেন। তবে এতটুকু জানি, সন্তানকে বড় করার যে স্বপ্ন তারা বুকে লালন করেন, তা মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও উঁচু। সীসাঢালা প্রাচীরের চেয়েও স্থায়ী ও সুস্থির। সুতরাং কোন সন্তান যদি মনে করে, পিতা-মাতার এই অনুগ্রহ নষ্ট করার জন্য তার কোনোই শাস্তি হবে না! তবে অবশ্যই সে ভুলের মধ্যে রয়েছে।

দায়িত্ব ও অনুগ্রহের মূল্যায়ন : অভিভাবকগণের দিকে তাকালে যেমন অসীম আগ্রহ চোখে পড়ে, তেমনই ছাত্রদের দিকে তাকালে অন্তরে আঘাত করে তাদের অতি অবহেলার কারণে। হেসে-খেলে, ঘুমিয়ে জীবন অতিবাহিত করা ছাত্রদের ভিড়ে বাবা-মায়ের কষ্ট বোঝা মেহনতি ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম। অভিভাবক ছেলের বেতনের জোগাতে রোদ-বৃষ্টি, অসুস্থতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করলেও তার সন্তান মিথ্যা অসুস্থতার অভিনয় করে ক্লাস ফাঁকি দেয়। প্রাইভেটে কিংবা বই কেনার দোহায় দিয়ে টাকা দাবী করে। বাবা ভাবে, ‘টাকাটা যদি দিতে না পারি, হয়ত আমার ছেলে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে যাবে’। ফলে বাবা ধার-কর্য করে হ’লেও টাকা এনে সন্তানের হাতে দেন। বাবা বাড়ির দিকে রওনা দিতেই সন্তান ফূর্তিতে মেতে ওঠে। বন্ধু বান্ধব নিয়ে ভুরিভোজের আয়োজন করে। খাবারের পদের আধিক্য নিয়ে একে অপরের ওপর গর্ব করে। যেন সে বাদশাহর ছেলে। ছিহ্! তাদের কি একবারও মনে পড়ে না, ‘আমার বাবা-মা এখন বাড়ীতে কী খাচ্ছেন’! আমরা এমনও ছাত্র দেখেছি, যার স্মার্ট ফোনের দাম তার বাবার রিকশার দামের চেয়েও বেশী। একজোড়া জুতার দাম তার মায়ের সারা বছরের কাপড়ের বাজেটের চেয়েও বেশী।

এই গাফেলদের ভীড়ে আমরা মেহনতী ছাত্রও পেয়েছি যারা রাত দুইটায় উঠে পড়ালেখা করে। প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য না থাকায় পড়া বুঝিয়ে নিতে বিভিন্ন শিক্ষক ও বড়ভাইয়ের কাছে যায়। আমরা তাদের পায়ে ক্ষয় হয়ে যাওয়া জুতা দেখেছি। ঠিক যেমন তার বাবার পায়ে দেখা যায়। আমরা তাদের সেলাই করা পাঞ্জাবি দেখেছি। ঠিক যেমন তার বাবার গায়ে দেখা যায়। আমরা তার বাবার যতটুকু আগ্রহী দেখেছি, তাকেও পড়ালেখায় তেমনই মনোযোগী পেয়েছি। তাদেরকে শরীরে জ্বর নিয়ে ক্লাসে উপস্থিত হ’তে দেখেছি। যেমন তাদের বাবারা জ্বরকে তুচ্ছ করে তাদের বেতন জোগাড় করে। তাদেরকে খাবারের ব্যক্তিগত মেন্যু সেট করতে না দেখলেও পরীক্ষায় প্রথম হ’তে দেখেছি।

উপসংহার : প্রিয় শিক্ষার্থীরা! আমরা আপনার আবেগকে আক্রমণ করছি না। কারণ, আবেগ কখনো স্থায়ী হয় না। আমরা আপনার স্থায়ী পরিবর্তন কামনা করছি। আমরা আপনাকে ভাবতে বলছি। আপনার বাবার সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ খেয়াল করতে বলছি। এই মুহুর্তে আপনার সেবা পাওয়ার অধিকার আপনার বাবার ছিল। সেই অধিকার থেকে আপনি তাকে কেন বঞ্চিত করছেন? এই বঞ্চিত হওয়ার প্রতিদানে আপনি তাকে কী দেবেন? এই দীর্ঘ ত্যাগের যাত্রা শেষে যদি আপনি তার মুখে হাসি ফোটাতে না পারেন, তবে আপনার অস্তিত্বের কী দাম থাকল? আপনি কেমন সন্তানের পরিচয় দিলেন? সুতরাং আমাদের কথায় যদি আপনার হারানো বোধশক্তি ফিরে আসে তবেই আপনার বাবার দায়িত্ব ও অনুগ্রহ সার্থক হবে ইনশাআল্লাহ।

সারোয়ার মিছবাহ

লেখক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী



বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
আরও