শায়খ ওযায়ের শাম্স (রহঃ)
ড. নূরুল ইসলাম
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 216 বার পঠিত
জন্ম ও পরিচয় : শায়েখ আব্দুর রহমান ১৮৯৪ সনের প্রথমার্ধের কোন একদিনে ইয়ামানের ‘আতামাহ’ প্রদেশের রাজিহ যেলার আল-মুহাক্বারা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এটি ছিল ইয়ামানের অন্যতম সম্ভ্রান্ত ও আদর্শ অঞ্চল এবং তাঁর পিতা-মাতা এই অঞ্চলের অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পারিবারিকভাবে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত থাকায় তাদের ‘মু‘আল্লিমী’ নামে অভিহিত করা হয়। তাঁর পিতা ইয়াহইয়া ‘বায়তুর-রীমী’ অঞ্চলে ইমামতি ও শিক্ষকতা করতেন।
শিক্ষাজীবন : শায়েখ আব্দুর রহমান তাঁর গোত্রের একজন আলেমের কাছে কুরআন শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। এরপর তিনি পিতার সাথে বায়তুর রীমী চলে যান এবং পিতার নিকট কুরআন হিফয সম্পন্ন করেন। অতঃপর তিনি হুজারিয়ায় বড় ভাই মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়ার নিকট চলে যান। সেখানে তার বড় ভাই তাকে একটি সরকারী মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। তিনি কিছুদিন কুরআন, তাজবীদের পাশাপাশি গণিত, ইংরেজী, তুর্কি ভাষা ও অন্যান্য শিক্ষা লাভ করেন।
এরপর তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হ’লে তাঁর ভাই তাঁকে একটি বিধবার বাড়িতে স্থানান্তরিত করেন। বিধবার সেবায় আল্লাহর রহমতে তিনি সুস্থতা লাভ করেন। ইতিমধ্যে একদিন তার পিতা তাকে দেখতে আসেন। তখন তিনি তার পড়াশোনার খোঁজ-খবর নেন। তার ব্যাকরণ পড়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি পিতাকে জানান যে, তিনি ব্যাকরণ পড়েননি। কারণ তিনি কোন প্রতিষ্ঠানে বেশিদিন পড়াশোনার সুযোগ পাননি। অতঃপর তার পিতা তাকে ব্যাকরণ শিক্ষার পরামর্শ দিলে তিনি বড় ভাইয়ের নিকট প্রায় দুই সপ্তাহ ‘ইলমুন-নাহু’ পড়েন।
অতঃপর তিনি পুনরায় বায়তুর রীমীতে তাঁর পিতার নিকট ফিরে যান। তখন ব্যাকরণ শিক্ষার প্রতি তার আগ্রহ বেড়ে যায়। তিনি কিছু ব্যাকরণের বই কিনলেন এবং পিতার নিকট পড়তে শুরু করলেন। সেখানে আহমাদ ইবনু মুছলিহ আর-রীমী নামে একজন সহপাঠীর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। তাঁরা দু’জন বেশিরভাগ সময় ব্যাকরণ চর্চা করতেন। এর পাশাপাশি তারা তাফসীর পড়তেন। এর প্রায় এক বছর পরে ইবনু হিশাম রচিত ‘আল-মুগনী’ পড়েন। এসময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ খাতায় নোট করতেন এবং তা বারবার পড়ে মনে রাখার চেষ্টা করতেন। ফলে তিনি নাহুশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
এরপর তিনি নিজ শহরে ফিরে যান। তাঁর পিতা তাঁকে বিশিষ্ট ফক্বীহ ও পন্ডিত আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মু‘আল্লিমীর সান্নিধ্যে থাকার পরামর্শ দিলেন। তাই তিনি সার্বক্ষণিক তার সান্নিধ্যে থেকে ইলমুন নাহু, ইলমুল হাদীছ, ইলমুল ফিক্বহ ও ইলমুল ফারায়েয বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। এরপর তিনি আবার বায়তুর-রীমীতে ফিরে এসে ফারায়েয শাস্ত্রের বিভিন্ন সমস্য সমাধানের জন্য ‘আল-ফাওয়াইদুশ শানশূরিইয়াহ’ গ্রন্থ পাঠে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি নতুন নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করেন। এভাবে ফারায়েযশাস্ত্রে তিনি অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। এসময় তিনি ‘মাকামাতে হারীরী’সহ সাহিত্যের কতিপয় কিতাবও অধ্যয়ন করেন। তিনি কবিতার প্রতি ভীষণ অনুরাগী ছিলেন।,
কিছুদিন পর তাঁর ভাই সাক্ষাৎ করতে আসলে তিনি সকল বিষয়ে আব্দুর রহমানের গভীর পান্ডিত্য লক্ষ্য করে মুগ্ধ হন। পরে হুজারিয়ায় ফিরে গিয়ে বড় ভাই তাকে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু সেখানে তিনি কিছু ফিক্বহের মজলিসে অংশগ্রহণ ব্যতীত তেমন কিছু অর্জনের সুযোগ পাননি। ফলে কিছুদিনের মধ্যে তিনি নিজ শহর আতামাহতে ফিরে আসেন। অতঃপর তিনি বিচারক সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ ইবনু আলী আর-রাযীর তাযকিয়াহ নিয়ে দক্ষিণ হায়দ্রাবাদের জামি‘আ ওছমানিয়ার হাদীছ বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে তিনি শায়েখ আব্দুল কাদীর মুহাম্মাদ ছিদ্দীকী আল-কাদিরীর নিকট হাদীছ অধ্যয়ন করেন এবং কুতুবে সিত্তাহ ও মুয়াত্তা ইমাম মালেক বর্ণনার ইজাযাহ লাভ করেন।
শায়েখ আব্দুল কাদীর মুহাম্মাদ ছিদ্দীকী তাঁর সম্পর্কে বলেন, সম্মানিত ভাই, বিজ্ঞ পন্ডিত আব্দুর রহমান ইবনু ইয়াহইয়া আল-মু‘আল্লিমী ইয়ামনী আমাকে ছহীহ বুখারী এবং ছহীহ মুসলিমের শুরু থেকে পাঠ করে শোনান এবং তিনি আমার কাছ থেকে যা বর্ণনা করার ইজাযাহ প্রার্থনা করেন। আমি তাকে উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী, বিশস্ত, জ্ঞানী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে করি। অতএব আমি তাকে স্বীকৃত শর্ত অনুসারে আমার নিকট থেকে ছহীহ বুখারী, ছহীহ মুসলিম, জামে‘ তিরমিযী, সুনান আবুদাঊদ, সুনান ইবনু মাজাহ, সুনান নাসাঈ ও মুয়াত্ত্বা ইমাম মালেক বর্ণনা করার অনুমতি দান করলাম।
কর্মজীবন : শায়েখ আব্দুর রহমান আল-মু‘আল্লিমী ১৩২৯ হিজরিতে সঊদী আরবের জীযান শহরে গমন করেন এবং তৎকালীন ‘আসীরের আমির সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আল-ইদ্রীসীর নিকট উপস্থিত হন। তিনি তাকে প্রধান বিচারক হিসাবে নিয়োগ করেন এবং তার ন্যায়বিচার ও ধর্মপরায়ণতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে শায়খুল ইসলাম উপাধিতে ভূষিত করেন। এখানে তিনি বিচার বিভাগের পাশাপাশি ছিলেন শিক্ষকতাও করতেন। ১৩৪১ হিজরিতে আল-ইদ্রীসী মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।
অতঃপর তিনি নিজ দেশ ইয়ামানে ফিরে আসেন এবং এডেন উপসাগরবর্তী এডেন শহরে এক বছর শিক্ষকতা ও দ্বীনী দাওয়াত প্রচার করেন। অতঃপর তিনি ভারত গমন করেন এবং হায়দ্রাবাদের জামি‘আ ওছমানিয়ায় হাদীছ, সাহিত্য ও ইতিহাস সংক্রান্ত বইয়ের প্রুফরিডার হিসাবে যোগদান করেন।
হায়দ্রাবাদে কিছুদিন অবস্থান করে তিনি মক্কায় গমন করেন। ১৩৭২ হিজরীর রবীউল আউয়াল তিনি মসজিদুল হারামের লাইব্রেরীর দায়িত্বশীল নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি লাইব্রেরীর শিক্ষক, গবেষক এবং ছাত্রদের নিষ্ঠার সাথে সহযোগিতা করে তিনি সকলের প্রশংসা লাভ করেন।
শায়খের রচিত গ্রন্থসমূহ : তার রচিত প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল :
(১) ত্বলী‘আতুত তানকীল বিমা ফী তা’নীবিল কাউছারী মিনাল আবাত্বীল।
(২) রিসালাতুন ফী মাক্বামে ইব্রাহীম ওয়া হাল ইয়াজূযু তা’খীরুহূ।
(৩) আল-আনওয়ারুল কা-শিফাহ বিমা ফী কিতাবি আযওয়া’ ‘আলাস-সুন্নাতি মিনাল যিলাল ওয়াত-তাযলীল ওয়াল-মুজাযাফাহ।
(৪) মুহাযারাতু ফী কুতুবির রিজাল ওয়া আহমিইয়াতুহা।
তার মৃত্যুর পর অপ্রকাশিত কিছু পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে। তম্মধ্যে : (১) ইগাছাতুল ওলামা মিন ত্ব‘নি ছাহিবিল ওয়ারিছাহ ফিল ইসলাম। (২) কিতাবুল ইবাদাত। (৩) আহকামুল কিযব।
এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে লিখিত বেনামী প্রবন্ধ, কবিতা ও চিঠিপত্র পাওয়া গেছে। নিজে লেখালেখির পাশাপাশি তিনি অসংখ্য কিতাবের তাহক্বীক, তা‘লীক ও তাছহীহ করেছেন।
সমসাময়িক আলেমদের মন্তব্য : শায়েখ আব্দুর রহমান আল-মু‘আল্লিমী তার সমসাময়িক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের নিকট অত্যন্ত প্রশংসিত ছিলেন। যেমন :
(১) শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনু ইব্রাহীম আল-শায়েখ তাঁকে একজন বিজ্ঞ আলেম ও নবীর হাদীছের রক্ষক হিসাবে অভিহিত করেছেন।
(২) শায়েখ বকর আবু যায়েদ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘মুহাক্কিক আলেম হিসাবে তিনি এক স্বর্ণযুগ কাটিয়েছেন’।
(৩) মিশরীয় লাইব্রেরীর পান্ডুলিপির তত্ত্বাবধায়ক শায়েখ ফুয়াদ আস-সাইয়্যেদ বলেছেন, ‘আমি মক্কার পবিত্র মসজিদে হজের সময় লাইব্রেরীতে যেতাম পান্ডুলিপি দেখতে এবং লাইব্রেরীর পরিচালক শায়েখ সুলায়মান আছ-ছানী‘কে দেখতে। এসময় শায়েখ আব্দুর রহমান আল-মু‘আল্লিমী মাঝে মাঝে আমাদের কাছে এসে যমযমের পানি দিতেন। একদিন আমি শায়েখ সুলায়মান আছ-ছানী‘কে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তিনি কি আপনাকে প্রতিদিন যমযমের পানি পান করান না! শায়েখ ফুয়াদ বলেন, যদিও আমি তার গভীর জ্ঞান ও বিচক্ষণতার ব্যাপারে অবগত ছিলাম, তবু আমি তার অসাধারণ বিনয় ও নম্রতা দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম’।
(৪) শায়েখ মুহাম্মাদ বাহজাত আল-বিতার বলেছেন, ‘আমি যতবার মক্কার লাইব্রেরীতে প্রবেশ করেছি ততবার তাঁকে সতর্ক ও জ্ঞানার্জনে লিপ্ত দেখেছি। আসলে প্রচেষ্টার দ্বারা অসম্ভবও সম্ভব হয়’।
(৫) এছাড়া শায়েখ আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির, শায়েখ মুহাম্মাদ আব্দুর রায্যাক হামযাহ, শায়েখ মুহাম্মাদ হামীদ আল-ফাক্বী এবং শায়েখ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
মৃত্যু : শায়েখ আব্দুর রহমান আল-মু‘আল্লিমী ২৬ মে ১৯৬৬ বৃহস্পতিবার মক্কার মাসজিদুল হারামে ফজর ছালাত আদায় করে লাইব্রেরীতে নিজ কক্ষে ফিরে যান। সেখানে নিজ বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বুকের উপর বই নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। মাসজিদুল হারামে তাঁর জানাযার ছালাতে খ্যাতনামা আলেমগণসহ অনেক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। আল্লাহ তাঁর সৎআমলসমূহ কবুল করুন ও জান্নাতে উচ্চ মাক্বাম দান করুন।-আমীন!