উটের মহানুভবতা
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ
১৯৯৫ সালের এক রাতের ঘটনা। একটি বিশাল আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ কানাডিয়ান উপকূলের কাছে উচ্চ গতিতে যাত্রা করছিল। কিছুক্ষণ পর জাহাজের রাডার ডিভাইসগুলি সংকেত দিল, জাহাজের চলার পথে একটি বিশাল বস্ত্ত আছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন ভাবলেন অপর দিক থেকে হয়তো আরেকটি জাহাজ আসছে। তিনি জাহাজ দু’টির সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য জাহাজের রেডিও সেন্টারে ছুটে গেলেন। তিনি সামনে থাকা জাহাজটিকে লক্ষ্য করে কিছু নির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথপোকথন চলল...
ক্যাপ্টেন : আমি আমেরিকান যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেন বলছি। সংঘর্ষ এড়াতে ১৫ ডিগ্রী দক্ষিণে দিক পরিবর্তন করতে হবে। আমি আবার বলছি সংঘর্ষ এড়াতে ১৫ ডিগ্রী দক্ষিণ দিক পরিবর্তন করুন। দ্রুত মোড় নিন।
অন্যদিকের জাহাজ থেকেও তখন আওয়াজ শোনা গেল : এখানে কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ, আপনার অনুরোধটি রাখা সম্ভব নয়। বরং আমরা আপনাকে জাহাজটি ১৮০ ডিগ্রী ঘুরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। দ্রুত আপনার দিক পরিবর্তন করুন।
ক্যাপ্টেন : মানে কি! আমি আপনাকে একটি সংঘর্ষ এড়াতে মাত্র ১৫ ডিগ্রী দক্ষিণে দিক পরিবর্তন করতে বলছি। এটি কেবল আপনাকে করতে বলছি না। আমাদের জাহাজও ১৫ ডিগ্রী উত্তরে মোড় নিবে। যাতে আমাদের সংঘর্ষ না হয় এজন্য বলছি। দ্রুত করুন। হাতে বেশী সময় নেই।
কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ : এটি কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমরা আপনাকে কমপক্ষে ১৩০ ডিগ্রী মোড় পরিবর্তন করার পরামর্শ দিচ্ছি। এখনো সময় আছে। আপনার জাহাজ ঘুরিয়ে নিন।
ক্যাপ্টেন : আপনি সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা না করে তর্ক করছেন। এতে আমরা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হব। আপনি বুঝতে পারছেন না, আমাদের চেয়ে আপনার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ আমরা একটি আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ। আপনি কে?
কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ : আমাদের এটি কোন জাহাজ নয়। এটি একটি ভাসমান তেলক্ষেত্র। আমরা সমুদ্র তলদেশ থেকে তেল উত্তোলন করি। এটি নড়াচড়া করতে পারে না। সাবধান!
কিন্তু এই নিষ্ফল রেডিও সংলাপে সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল এবং তেলক্ষেত্রের সাথে জাহাজটির সংঘর্ষ হয়েছিল। ফলে জাহাজ ও তেলক্ষেত্র উভয়টির সমূহ ক্ষতি সাধন হয়।
এই গল্প থেকে আমরা যে শিক্ষাটি লাভ করি তা হ’ল কারো সাথে যোগাযোগের সময় কেবল আমার কথাটাই তাকে বলা একমাত্র লক্ষ্য নয়। কারণ তার সেটি মান্য করার সুযোগ নাও থাকতে পারে। অথবা তার কাছে এর চেয়ে ভাল পরামর্শ থাকতে পারে। মোবাইল, টেলিফোনে হোক বা সরাসরি কারো সাথে কথা বলার সময় আমাদের লক্ষ্য হ’তে হবে চারটি। ১. অপর ব্যক্তির কথা মনোযোগ সহকারে শোনা ২.তার অবস্থা বুঝার চেষ্টা করা ৩. তারপর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ৪. সবশেষে নিজের কথাটি তাকে বলা। হঠকারিতা করে কেবল নিজের কথা বলে গেলে পুরো অবস্থা বুঝা সম্ভব হয় না। ফলে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে।
আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হ’ল, এমন পরিস্থিতিতে সময় নষ্ট না করে আসল কথাটা আগে বলা। কানাডিয়ান তেলক্ষেত্রের পরিচালক যদি প্রথমেই বলতো, এটি জাহাজ নয়। এটি নড়াচড়া করতে পারে না। তাহ’লে জাহাজের ক্যাপ্টেন সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি এই কথাটি না বলে শুধু নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। যা উভয়ের ধ্বংসের অন্যতম কারণ।
শিক্ষা : গল্পে একটি সংগঠনের নেতা-কর্মী বা কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পারস্পরিক কথোপকথনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা রয়েছে। কখনো উর্ধ্বতন দায়িত্বশীল তার কর্মীদের অবস্থা পর্যালোচনা ছাড়াই একটি নির্দেশ প্রদান করেন। যা বাস্তবায়ন করা কর্মীদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অপরদিকে কর্মীবৃন্দ তাদের অপারগতার কথা সহসা বর্ণনা করতে পারেন না। আবার নির্দেশ পালনেও সক্ষম হন না। ফলস্বরূপ সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আল্লাহ আমাদের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী আচরণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন!
মূল : মুহসিন জববার, অনুবাদ : নাজমুন নাঈম