আমার বন্ধু ফাহিম
আরীফ মাহমুদ, আটলান্টা, জর্জিয়া
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 158 বার পঠিত
কাশিমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহাম্মাদ আব্দুল হামীদ। ছাত্ররা সামনে থেকে তাকে হামীদ স্যার বলেই সম্বোধন করে। কিন্তু আড়ালে ডাকে মিষ্টি স্যার। এলাকাবাসীর কাছেও মিষ্টি স্যার নামে বেশ পরিচিত। স্যার অবশ্য তাতে রাগ করেন না। বরং উপভোগ করেন বলেই মনে হয়। রাস্তায় বন্ধুবর কেউ যদি মিষ্টি হামীদ বলে ডেকে ওঠেন, তিনি তাতে বিরক্ত হন না। সরস গলায় বলেন, শুধু মিষ্টি ডাকলে হবে! মিষ্টি খাওয়াতেও তো হবে।
এই নামকরণের কারণ তার অতি মিষ্টিপ্রিয়তা। মিষ্টির লোভ তিনি কখনোই সামলাতে পারেন না। রসগোল্লার কথা বলতেই তার জিহবায় রস চলে আসে। ছানা জিলাপী দেখলেই চোখ ছানা বড়া হয়ে যায়। সন্দেশের কথা ভাবতেই নেচে ওঠে তার মন। এছাড়া দই, চমচম, জিলাপী, রসমালাই কোনটাই তার অপ্রিয় নয়।
আজ থেকে চবিবশ বছর আগে এই স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন আব্দুল হামীদ স্যার। যোগদানের পরদিন স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের মিষ্টিমুখ করানোর জন্য নিয়ে আসেন চার কেজি রসগোল্লা। তখন স্কুলের শিক্ষক মাত্র ৮ জন। সাথে একজন অফিস সহকারী, একজন পিয়ন আর একজন গার্ড মিলে মোট ১১ জন। সবাইকে ৩টা করে রসগোল্লা দেওয়া হ’ল। পিয়ন আছগার আলী, গার্ড হায়দার আলী আর দুইজন শিক্ষক কেবল নিজেদের ভাগ শেষ করেছেন। বাকীরা দুই পিস গলধঃকরণ করেই নিবৃত্ত হয়েছেন। তখনো এক প্যাকেট রসগোল্লা মুখবন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে।
হেড স্যার বললেন, হামীদ ছাহেব! এই প্যাকেট আর খুলে কাজ নেই। আপনি বাড়িতে নিয়ে যান। ছেলে-মেয়েরা খাবে। হামীদ স্যার বললেন, বাড়ীর জন্য দুই কেজি নিয়েছি স্যার। এগুলো আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি, স্কুলের বাইরে যাবে না। কিন্তু উপস্থিত কারো আর একটা রসগোল্লা মুখে দেওয়ার অবস্থা নেই। অবস্থা দেখে একগাল হেসে আব্দুল হামীদ স্যার নিজেই রসগোল্লার প্যাকেট খুলে বসলেন। শিক্ষকগণ টেবিলের চারিদিকে বসে তার কান্ড দেখছেন। টেবিলের একপাশে কাপ-পিরিচ হাতে দাঁড়িয়ে আছে পিয়ন আছগার আলী। সবাইকে সামনে রেখে একে একে বাইশটি সরস রসগোল্লা পেটে চালান করলেন।
সেদিনই শিক্ষকদের থেকে ছাত্র হয়ে এলাকাবাসীর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে মিষ্টি স্যারের নাম। কাশিমপুর বাজারে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তারাও কম-বেশী জেনে গেছেন। স্কুলের হেড স্যারের কল্যাণে এক সপ্তাহের মাথায় উপযেলা শিক্ষা অফিসেও বিষয়টা জানাজানি হয়েছে। এতে অবশ্য মিষ্টি স্যারের লাভই হয়েছে। যে কোন দাওয়াতে তার জন্য আলাদা করে মিষ্টি তুলে রাখা হয়। স্কুলের কোন অনুষ্ঠানে বা ছাত্রের ভালো ফলাফলে মিষ্টির ব্যবস্থা হলে সবাই যেখানে এক-দুই পিস পায়, সেখানে আব্দুল হামীদ স্যারের জন্য কমপক্ষে পাঁচ-সাত পিস বরাদ্দ থাকে। উপযেলা অফিসে গেলে অফিসার মহোদয় মিষ্টি আনার ব্যবস্থা করেন। নিজে দুই-এক পিস মুখে দেন। আর আমাদের মিষ্টি স্যারের খাওয়া দেখে চোখ জুড়ান।
কিন্তু স্যারের বাড়ির পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্যরকম। বাড়ীর সদস্য বলতে স্ত্রী রাহেলা খাতুন, ছেলে রাহাত আলম, মেয়ে রাইদা। তারা নিজেরা যেমন মিষ্টি খেতে পসন্দ করেন না, তেমনি আব্দুল হামিদ ছাহেবের এই অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়াও তাদের পসন্দ নয়। কোন দাওয়াতের অনুষ্ঠানে সবার সাথে খেতে বসলে দুই-এক পিস মুখে দিয়ে ভদ্রতা রক্ষা করেন। ফলে বছর দুয়েক আগে যখন একবার মিষ্টি স্যার অসুস্থ হ’লে ডাক্তার ছাহেব বললেন, লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে সুগার বেড়েছে, তখন থেকে বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে আসা বন্ধ। রাহেলা খাতুন তো রাত-দিন বকা-ঝকা করেন। তাতে কী আমাদের মিষ্টি স্যারের মিষ্টি খাওয়া থেমে থাকে! স্কুলে, অফিসে বা কারো বাড়িতে মিষ্টির আমন্ত্রণ না পেলে সেদিন সন্ধ্যায় কাশিমপুর বাজারে রসের হাড়ি মিষ্টান্ন ভান্ডারে তার আগমন ফুলের কাছে ভ্রমরের আগমনের ন্যায় নিশ্চিত।
এমন মিষ্টি পাগল আমাদের মিষ্টি স্যার এখন আর মিষ্টি খান না। রসের হাড়ি মিষ্টান্ন ভান্ডারের আশেপাশেও তাকে দেখা যায় না। রাস্তায় মিষ্টি স্যার বলে কেউ ডাক দিলে ফিরে তাকান না। মাথা নিচু করে চলে আসেন। বিষয়টা যারা এক-আধটু আঁচ করতে পেরেছেন, তারা বলাবলি করছেন, কোন কিছু অতিরিক্ত ভালো নয়। এক জিনিস প্রতিদিন খেলে তার প্রতি রূচি নষ্ট হয়ে যায়। যেমন ছোট বাচ্চারা প্রতিদিন ডিম, দুধ খেতে খেতে হাঁপিয়ে ওঠে, আর খেতে চায় না।
এরই মধ্যে একদিন আব্দুল হামীদ স্যারকে উপযেলা শিক্ষা অফিসে যেতে হয়। অফিসার মহোদয় বরাবরের মতো মুচকি হেসে জানতে চান, কেমন আছেন আব্দুল হামীদ ছাহেব? পিয়নকে কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। দু-এক কথা হ’তে হ’তে সামনে মিষ্টির প্লেট হাযির হয়ে যায়। অফিসার মহোদয় বলেন, অনেক দিন আসেন না। নেন মিষ্টি খান। আব্দুল হামীদ স্যার কোন কথা বলতে পারেন না। চুপচাপ বসে থাকেন। আজ আর মিষ্টি দেখে তার জিভে পানি আসে না, চোখের কোণে অশ্রু জমেছে। চোখ মুছে বলেন, স্যার! ছেলেটা ফোন করে বলেছিল, আববা কোথায় আছো? বাড়ীতে থাক। আমি মিষ্টি নিয়ে আসছি। আজ এক সাথে মিষ্টি খাব। একটা সুসংবাদ আছে।
আমি আর ওর মা কতক্ষণ দরজা খুলে অধীর আগ্রহে বসে রইলাম। কিন্তু আমার ছেলেটা আর মিষ্টি নিয়ে এলো না। পাড়া-প্রতিবেশী হইচই করে বাড়িতে নিয়ে এলো তার গুলিবিদ্ধ মরদেহ। মোমবাতি যেমন করে নিভে যাওয়ার আগে একবার দপ করে জ্বলে ওঠে, বুকের আশাগুলো তেমন একবার জেগে উঠে নিরাশার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। এরপর নাকি দেশ থেকে সকল বৈষম্য দূর হয়েছে। সবাই নাকি তাদের অধিকার ফিরে পেয়েছে। আমি তো আমার ছেলের সাথে মিষ্টি খাওয়ার সুযোগ পেলাম না।