আর কতকাল চলবে রোহিঙ্গা নির্যাতন?
ড. নূরুল ইসলাম
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 30 বার পঠিত
৮ই ডিসেম্বর’২৪। সিরিয়ার মানুষ অবশেষে পেল বহুল প্রতীক্ষিত মুক্তির স্বাদ। আরব বসন্তের সূত্র ধরে টানা ১৩ বছরের বেশী সময় ধরে চলমান গৃহযুদ্ধের পর মাত্র ১১ দিনের প্রতিরোধ যুদ্ধে মোড় ঘুরে গেল মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দেশ সিরিয়ার। এর মধ্যে বাশার আল-আসাদের নির্মম শাসন আর যুলুম-নির্যাতনে নিহত হয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী মানুষ তাদের নিজ বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। পার্শ্ববর্তী লেবানন, তুরস্ক, জর্ডানসহ সারা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান শরণার্থী। দেশটির অভ্যন্তরীণ কারাগারগুলো ছিল বিদ্রোহী বন্দীশিবির এবং নির্যাতনকেন্দ্র। আরব বসন্ত পরবর্তী সময়ে দেশটির অস্থিতিশীল অবস্থার সুযোগ নিয়ে একদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ইরান ও রাশিয়া, অপরদিকে ইসরাঈল ও পশ্চিমা দেশগুলো এবং তাদের অংশীজনরা জড়িয়ে পড়ে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থদ্বন্দ্বে। উভয় পক্ষ চলমান সংকটে ফায়দা তুলতে অস্ত্র সরবরাহ করে বিভিন্ন পক্ষের কাছে। লেগে যায় সিরিয়ার ইতিহাসে এক রক্তক্ষয়ী দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে যথারীতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত দাবার ঘুটি হিসাবে ব্যবহার করা হয় ইসলামপন্থীদেরকে। অবশেষে রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনপুষ্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন ঘটে। জিতে যায় পশ্চিমা ও ইসরাঈলী মদদপুষ্ট মিলিশিয়ারা।
বাশার আল-আসাদের এই পতনের মাধ্যমে সিরিয়া থেকে অর্ধশত বছর পর পতন ঘটল সেক্যুলার বাথ পার্টির। অবসান হল শী‘আ মতাবলম্বী শাসনেরও, যারা সংখ্যালঘু হয়েও ইরানের সহায়তায় সংখ্যাগরিষ্ট সুন্নীদের উপর নিপীড়ন চালিয়ে এসেছে বহু বছর ধরে। বাশারের পতনে তাই সিরিয়ার আকাশে বহু বছর পর এসেছে আলোর বার্তা, মুক্তির নতুন নিশান।
তবে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ কতদিন সিরিয়ার আকাশকে কালিমামুক্ত রাখবে তা ভাববার বিষয়। কেননা বাশারের পতনের সাথে সাথেই নিরাপত্তার নামে ইসরাঈলীরা সিরিয়ার অস্ত্রভান্ডারসমূহের উপর নির্বিবাদে হামলা চালানো শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক সকল নীতিমালা লংঘন করে ধ্বংস করে দিচ্ছে সিরিয়ার যাবতীয় সামরিক ব্যবস্থাপনা। মাত্র দুই দিনে সিরিয়ার নৌশক্তিসহ ৮০ ভাগ সামরিক সম্পদ তারা ধ্বংস করে ফেলেছে। রাতারাতি সিরিয়া ও গোলান মালভূমির মধ্যবর্তী বাফার জোন দখল করে সেটাকে জোরপূর্বক ইসরাঈলের চিরদিনের অংশ হিসাবে দাবী করেছে। মুসলমানদের এই মহাশত্রুকে পাশে রেখে সিরিয়া কতদিন শান্তিতে থাকবে, তা ভীষণ অনিশ্চিত। অচিরেই গাযা, পশ্চিম তীরের মত সিরিয়ার প্রতিও যে ইসরাঈল হাত বাড়াতে চাইছে বলে অনুমান করা যায়। অর্থাৎ সিরিয়ার ভবিষ্যত অনেকটাই এখন ইসরাঈলের হাতে।
সিরিয়া কেন্দ্রিক ফিলিস্তীন, জর্ডান ও লেবানন মিলে যে শাম অঞ্চল বিস্তৃত, তাতে শত শত বছর ধরে মুসলিম উম্মাহর এক ঐতিহ্যবাহী অবিচ্ছেদ্য সভ্যতা গড়ে উঠেছে। এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন ইসলামের ইতিহাসের মহান ব্যক্তিত্বগণ। ইমাম শাফেঈ, ইমাম ইবনু কুদামাহ, ইমাম নববী, ইমাম ত্ববারাণী, ইবনু আসাকির, ইবনু খাল্লিকান, ইবনু রজব, ইবনু তায়মিয়া, ইবনুল কাইয়েম, ইবনু কাছীর, শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, ইয বিন আব্দুস সালাম, আধুনিক যুগে শায়খ আলবানী, শায়খ আরনাঊত্বসহ বহু মহামনীষীদের পদচারণায় ধন্য হয়েছে এই শাম। দামেশক, হালাব, হিম্স, হামা প্রভৃতি ইতিহাসখ্যাত শামের শহরগুলো আজও আপন ঐতিহ্যে সমুজ্জ্বল।
শেষ যামানায় শামের গুরুত্ব আরও বাড়বে মর্মে বর্ণিত হাদীছগুলো শামকে সর্বদাই মুসলিম উম্মাহর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়েছে। রাসূল (ছা.) বলেন, ‘ইসলামী বাহিনী শিগগিরই কয়েকটি দলে দলবদ্ধ হবে। একটি দল শামে, একটি ইয়েমেনে ও অন্য একটি ইরাকে। ইবনে হাওয়ালা (রা.) জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি সেই যুগ পাই, তখন আমি কোন দলটিতে যোগদান করব, তা বলে দিন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, عَلَيْكَ بِالشَّامِ، فَإِنَّهَا خِيرَةُ اللَّهِ مِنْ أَرْضِهِ، يَجْتَبِي إِلَيْهَا خِيرَتَهُ مِنْ عِبَادِهِ ‘তুমি শামের বাহিনীতে থাকবে, কেননা তা আল্লাহর পছন্দনীয় ভূমির একটি, সেখানে তিনি তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট বান্দাদের একত্র করবেন’ (আবু দাউদ হা/২৪৮৩, সনদ ছহীহ)। শামের কল্যাণের সাথে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণকেও আল্লাহ যুক্ত করে দিয়েছেন। রাসূল (ছা.) বলেন, ‘যখন শামভূমি ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, তখন তোমাদের মধ্যেও কোনো কল্যাণ থাকবে না। আর আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে, তাদের যারা ক্ষতি করার চেষ্টা করবে, তারা কেয়ামত পর্যন্ত তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারবে না’ (তিরমিযী হা/২১৯২, সনদ ছহীহ)। শামের জন্য তিনবার বরকতের দো‘আ করে রাসূল (ছা.) বলেছেন, اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَأْمِنَا ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের শামে বরকত ঢেলে দিন’ (বুখারী হা৭০৯৪)।
শেষ যামানায় যে মালহামা বা মহাযুদ্ধ হবে, সেই যুদ্ধে মুসলমানদের সেনাছাউনী হবে গূতা নামক একটি শহর, যা শামের সর্বোত্তম শহর দামেশকের নিকটবর্তী হবে (আবূদাউদ হা/৪২৯৮, সনদ ছহীহ)। শেষ যামানায় দাজ্জালের উত্থানও হবে এই এলাকায় এবং পরপরই আসবেন ঈসা (আ.)। রাসূল (ছা.) বলেন, ‘দাজ্জাল ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বের হবে এবং ডানে-বাঁয়ে গোটা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করতে থাকবে। তাই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ঈমানের ওপর অটল থাকবে।’ অতঃপর তিনি বলেন, দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে দাজ্জালের অনিষ্টতার পর আল্লাহ ঈসা ইবনু মারিয়াম (আ.)-কে পাঠাবেন। তিনি দামেশকের পূর্ববর্তী এলাকার শুভ্র মিনারের কাছে আসমান থেকে দুজন ফেরেশতার কাঁধে চড়ে অবতরণ করবেন। তখন তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস যে কাফেরের গায়ে লাগবে, সে মারা যাবে, আর তাঁর দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করবেন, অতঃপর শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৭)।
সুতরাং যতদিন আসবে, أرض المحشر والمنشر (হাশরের ময়দান) হিসাবে শাম বা সিরিয়া হতে থাকবে ইতিহাসের ঘটনাবহুল অধ্যায়। আমরা আশা করি, বাশারের পতনে সিরিয়ার যে নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে, তা যেন হয় ইসলামের নয়া জাগরণের যুগ। ইসরাঈলের কালো থাবা থেকে আল্লাহ যেন তাদেরকে হেফাযতে রাখেন, সেই সাথে সেখানকার ঈমানদার মুসলমানরা যেন বিশুদ্ধ আক্বীদার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে এবং পরস্পর সহনশীলতা বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে নতুন সিরিয়া গড়ার মাধ্যমে মুসলমানদের চিরশত্রু ইসরাঈলী জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে-এটাই আমাদের একান্ত কামনা। আল্লাহ আমাদের প্রত্যাশা কবুল করুন। আমীন!