দ্বীনের বিধি-বিধান সহজ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 19 বার পঠিত

আল-কুরআনুল কারীম :

1- يُرِيْدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ-

(১) ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান, কঠিন চান না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)

2- وَإِنْ كَانَ ذُو عُسْرَةٍ فَنَظِرَةٌ إِلَى مَيْسَرَةٍ-

(২) ‘তবে যদি (ঋণ গ্রহীতা) অভাবগ্রস্ত হয়, তাহ’লে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত অবকাশ দাও’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)

3- لَقَدْ تَابَ اللهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ الْعُسْرَةِ

(৩) ‘নিশ্চিতভাবে আল্লাহ দয়াশীল হয়েছেন নবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনছারদের প্রতি, যারা দুঃসময়ে তার অনুসারী হয়েছিল’ (তওবা ৯/১১৭)

4- لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللهُ لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا سَيَجْعَلُ اللهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُسْرًا-

(৪) ‘সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে। কিন্তু যার রিযিক সীমিত, সে আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন, তা থেকে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, তার অতিরিক্ত বোঝা কাউকে চাপান না। সত্বর আল্লাহ কষ্টের পর সহজ করে দিবেন’ (তালাক ৬৫/৭)

5- إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّى- فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى- وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى- فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى- وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى- وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى-

(৫) ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রচেষ্টা বিভিন্নমুখী। অতঃপর যে ব্যক্তি দান করে ও আল্লাহভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্য বলে বিশ্বাস করে। অচিরেই আমরা তাকে সরল পথের জন্য সহজ করে দেব। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করে ও বেপরোয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে অচিরেই আমরা তাকে কঠিন পথের জন্য সহজ করে দেব’ (লায়েল ৯২/৪-১০)

6- فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا- إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا

(৬) ‘অতঃপর নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’ (শরহ ৯৪/৫-৬)

7- لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ،

(৭) ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজে বাধ্য করেন না। তার জন্য পুণ্যফল সেটাই, যা সে উপার্জন করে এবং তার উপর পাপের ফল সেটাই, যা সে অর্জন করে’ (বাক্বারাহ ২/২৮৬)

8- وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا-

(৮) ‘বস্ত্তত যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য কর্ম সহজ করে দেন’ (তালাক ৬৫/৪)

হাদীছের বাণী :

9- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَامَ أَعْرَابِيٌّ، فَبَالَ فِي الْمَسْجِدِ، فَتَنَاوَلَهُ النَّاسُ فَقَالَ لَهُمُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: دَعُوهُ وَهَرِيقُوا عَلَى بَوْلِهِ سَجْلًا مِنْ مَاءٍ أَوْ ذَنُوبًا مِنْ مَاءٍ فَإِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِينَ، وَلَمْ تُبْعَثُوا مُعَسِّرِينَ-

(৯) আবূ হুরাইয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, এক বেদুঈন মসজিদের ভিতরে প্রস্রাব করে দিল। একারণে লোকেরা তাকে ধমক দেওয়ার জন্য উঠে দঁাড়াল। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘ওকে ছেড়ে দাও এবং প্রস্রাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কেননা তোমাদেরকে সহজ নীতি অবলম্বন করার জন্য পাঠানো হয়েছে, কঠোর নীতি অবলম্বন করার জন্য পাঠানো হয়নি’।[1]

10- عَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَسِّرُوا وَلَا تُعَسِّرُوا وَسَكِّنُوا وَلَا تُنَفِّرُوا-

(১০) আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মানুষের সাথে উদার ব্যবহার করো, কঠোরতা পরিহার করো, তাদেরকে সান্ত্বনা দাও এবং ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়ো না’[2]

11- عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اللَّهُمَّ مَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِي شَيْئًا فَشَقَّ عَلَيْهِمْ فَاشْقُقْ عَلَيْهِ وَمَنْ وَلِيَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِي شَيْئًا فَرَفَقَ بِهِمْ فَارْفُقْ بِهِ-

(১১) আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! যে ব্যক্তিকে আমার উম্মতের শাসক (দায়িত্বশীল) নিযুক্ত করা হয় এবং সে যদি তাদের ওপর এমন কিছু চাপিয়ে দেয় যা তাদের জন্য বিপদ ও কষ্টের কারণ হয়, তবে তুমিও তার ওপর অনুরূপ চাপিয়ে দাও। আর যে ব্যক্তিকে আমার উম্মাতের ওপর শাসক নিযুক্ত করা হয় এবং সে তাদের সাথে নম্র ও উত্তম আচরণ করে, তুমিও তার সাথে অনুরূপ নম্রতা প্রদর্শন করো’।[3]

12- عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا نَعَسَ أَحَدُكُمْ وَهُوَ يُصَلِّي فَلْيَرْقُدْ حَتَّى يَذْهَبَ عَنْهُ النَّوْمُ - فَإِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا صَلَّى وَهُوَ نَاعِسٌ لَا يَدْرِي لَعَلَّهُ يَسْتَغْفِرُ فَيَسُبَّ نَفْسَهُ-

(১২) আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ ছালাতের মধ্যে তন্দ্রাভিভূত হবে, তখন সে যেন নিদ্রা যায়, যতক্ষণ না তার নিদ্রার চাপ দূর হয়ে যায়। কারণ, যখন কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে ছালাত পড়বে, তখন সে খুব সম্ভবত ক্ষমা প্রার্থনা করতে গিয়ে নিজেকে গালি দিতে লাগবে’।[4]

13- عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ إِنَّ الدِّيْنَ يُسْرٌ، وَلَنْ يُشَادَّ الدِّينَ أَحَدٌ إِلاَّ غَلَبَهُ، فَسَدِّدُوْا وَقَارِبُوْا وَأَبْشِرُوْا،

(১৩) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ। কিন্তু যে লোক দ্বীনকে কঠিন করে তুলে, দ্বীন তাকে পরাভূত করে দেয়। অতএব দীনের ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বন ও সাধ্য অনুযায়ী আমল কর (নিজকে ও অন্যকে) শুভ সংবাদ দাও...’।[5]

14- عَنْ أَنَسٍ رضى الله عنه قَالَ وَاصَلَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آخِرَ الشَّهْرِ وَوَاصَلَ أُنَاسٌ مِنَ النَّاسِ فَبَلَغَ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَقَالَ- لَوْ مُدَّ بِىَ الشَّهْرُ لَوَاصَلْتُ وِصَالاً يَدَعُ الْمُتَعَمِّقُونَ تَعَمُّقَهُمْ إِنِّى لَسْتُ مِثْلَكُمْ، إِنِّى أَظَلُّ يُطْعِمُنِىْ رَبِّى وَيَسْقِيْنِ-

(১৪) আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, (একটি) মাসের শেষাংশে নবী করীম (ছাঃ) বিরতিহীন ছিয়াম রাখলেন এবং আরো কতিপয় লোকও বিরতিহীনভাবে ছিয়াম পালন করতে লাগল। এ সংবাদ নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে পেঁŠছলে তিনি বললেন, যদি আমার এ মাস দীর্ঘায়িত হ’ত, তবুও আমি এভাবে বিরতিহীন ছিয়াম রাখতাম। যাতে অধিক কষ্টকারীরা তাদের কষ্ট করা ছেড়ে দেয়। আমি তো তোমাদের মত নই, আমার প্রতিপালক আমাকে আহার করায় এবং পান করায়’।[6]

(১৫) আনাস (রাঃ) বলেন, তিন ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের বাসায় এলেন। তারা নবী করীম (ছাঃ)-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। অতঃপর যখন তাদেরকে এর সংবাদ দেওয়া হ’ল তখন তারা যেন তা অল্প মনে করলেন এবং বললেন, আমাদের সঙ্গে নবী করীম (ছাঃ)-এর তুলনা কোথায়? তাঁর তো আগের ও পরের সমস্ত গোনাহ মোচন করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তাদের মধ্যে একজন বললেন, আমি সারা জীবন রাতভর ছালাত পড়ব। দ্বিতীয়জন বললেন, আমি সারা জীবন ছিয়াম রাখব, কখনো ছিয়াম ছাড়ব না। তৃতীয়জন বললেন, আমি নারী থেকে দূরে থাকব, কখনও বিয়েই করব না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের নিকট এলেন এবং বললেন, أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا؟ أَمَا وَاللهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي তোমরা এই এই কথা বলেছ? শোনো! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে বেশী আল্লাহ্কে ভয় করি, তার ভয় অন্তরে তোমাদের চেয়ে বেশী রাখি। কিন্তু আমি (নফল) ছিয়াম রাখি আবার ছেড়েও দিই, ছালাত পড়ি এবং নিদ্রাও যাই। আর আমি নারীদের বিয়ে করেছি। সুতরাং যে আমার সুন্নাত হ’তে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার দলভুক্ত নয়’।[7]

মনীষীদের বক্তব্য :

১. ইবনু আববাস (রাঃ)-কে একবার ছফরে ছিয়াম পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, সহজ ও কঠিন দু’টি বিষয়ের মধ্যে আল্লাহ তোমার জন্য যেটা সহজ করেছেন সেটা গ্রহণ করো’।[8]

২. হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, কেউ যেন দ্বীনী কাজে গভীরতা অবলম্বন না করে এবং নম্রতা পরিহার না করে। যদি না সে অপারগ ও পরাজিত হয়’।[9]

৩. ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, শারঈ পন্ডিতগণ সাধারণভাবে আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা নিষেধ করেছেন’।[10]

৪. ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, দুই স্বস্তির মাঝে রয়েছে কষ্ট। হয় দুনিয়ায় শীঘ্রই মুক্তি লাভ হবে অথবা বিলম্বে আখেরাতে ছওয়াব লাভ হবে।[11]

সারবস্ত্ত :

১. একজন ব্যক্তির হৃদয়ে ঈমানের আলো যত বৃদ্ধি পায়, দ্বীন পালন তার জন্য তত সহজ হয়ে যায়। ২. আল্লাহ বান্দার জন্য তঁার বিধানসমূহ সহজ করেছেন। ৩. মধ্যমপন্থা অর্থ শিথিলতা নয়, বরং সঠিক পন্থা। ৪. আল্লাহ আমাদেরকে সহজাত দৃষ্টিভঙ্গিতে দ্বীন পালন করতে বলেছেন এবং অতি বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা থেকে মুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে দ্বীন পালন করতে বান্দা অপারগ না হয়ে যায়।


[1]. বুখারী হা/২২০; মিশকাত হা/৪৯১ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়।

[2]. বুখারী হা/৬১২৫; মুসলিম হা/১৭৩৪; মিশকাত হা/৩৭২৩।

[3]. মুসলিম হা/১৮২৮; মিশকাত হা/৩৬৮৯।

[4]. বুখারী হা/২১২; মুসলিম হা/৭৮৬; মিশকাত হা/১২৪৫।

[5]. বুখারী হা/৩৯; মিশকাত হা/১২৪৬।

[6]. বুখারী হা/৭২৪১; মুসলিম হা/১১১০৪; মিশকাত হা/১৪৫।

[7]. বুখারী হা/৫০৬৩; মুসলিম হা/১৪০১; মিশকাত হা/১৪৫।

[8]. তাফসীর ইবনু জারীর ৩/৪৭৬ পৃ.।

[9]. ফাতহুল বারী ১/১১৭ পৃ.।

[10]. ফাতহুল মাজীদ ২২৭ পৃ.।

[11]. লিসানুল আরব ৫/২৯৩ পৃ.।



আরও