ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যৌবনকালের ভূমিকা
আব্দুল হালীম বিন ইলিয়াস
কামাল হোসাইন 17 বার পঠিত
জান্নাত লাভে নারী-পুরুষ উভয়েই আল্লাহ কর্তৃক ওয়াদাবদ্ধ : আল্লাহ তা‘আলা নারী পুরুষ সকল মুমিনকেই জান্নাত দেওয়ার ব্যাপারে ওয়াদাবদ্ধ। আল্লাহ বলেন,وَعَدَ اللهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ- ‘মুমিন পুরুষ ও নারীদের প্রতি আল্লাহ জান্নাতের ওয়াদা করেছেন, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে এবং ওয়াদা করেছেন ‘আদন’ নামক জান্নাতের উত্তম বাসস্থান সমূহের। আর আল্লাহর পক্ষ হ’তে সামান্য সন্তুষ্টিই হ’ল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর সেটাই হ’ল মহান সফলতা’ (তওবা ৯/৭২)।
ছওয়াব প্রাপ্তিতে নারী পুরুষ সমান : নারীদের উত্তম জীবন ও জান্নাত লাভের জন্য সৎআমল করতে হবে। আর সৎ আমলের ছওয়াব প্রাপ্তিতে নারী পুরুষ উভয়েই সমান। আল্লাহ বলেন,مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- ‘পুরুষ হৌক বা নারী হৌক মুমিন অবস্থায় যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, আমরা তাকে অবশ্যই পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম অপেক্ষা অধিক উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব’ (নাহল ১৬/৯৭)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,مَنْ عَمِلَ سَيِّئَةً فَلَا يُجْزَى إِلَّا مِثْلَهَا وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ يُرْزَقُونَ فِيهَا بِغَيْرِ حِسَابٍ- ‘যে মন্দকর্ম করবে, সে তার অনুরূপ ফল ব্যতীত পাবেনা। আর যে পুরুষ বা নারী সৎকর্ম করবে মুমিন অবস্থায়, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা সেখানে অপরিমিত রিযিক প্রাপ্ত হবে’ (মুমিন ৪০/৪০)।
তিনি বলেন, فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأُوذُوا فِي سَبِيلِي وَقَاتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ثَوَابًا مِنْ عِنْدِ اللهِ وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الثَّوَابِ- ‘অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের দো‘আ কবুল করলেন এই মর্মে যে, পুরুষ হৌক নারী হৌক আমি তোমাদের কোন কর্মীর কর্মফল বিনষ্ট করব না। তোমরা পরস্পরে এক (অতএব কর্মফলে সবাই সমান)’ (আলে-ইমরান ৩/১৯৫)।
নারীদের এটা স্মরণ করা উচিত যে, আল্লাহ তাদেরকে যে ছাড় দিয়েছেন তা ব্যতিরেকে শরী‘আত লঙ্ঘন করা নিষেধ। তার উপরে শরী‘আতের আরোপিত বিধান না মানার কোন এখতিয়ার কারোরই নেই। আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ- ‘আর আল্লাহ ও তঁার রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে তাদের নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।
সর্বাবস্থায় স্ত্রীর সাথে সৎ ব্যবহার করা : নারীরা সর্বাবস্থায় সম্মানিতা। ইসলাম তাদেরকে মহান মর্যাদা দিয়েছে। কোন ভাবেই স্ত্রীর সাথে মন্দ আচরণ করা যাবে না। কেননা উত্তম মুমিন হওয়ার জন্য অবশ্যই স্ত্রীর নিকট উত্তম হতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَكْمَلُ المُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا، وَخَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِنِسَائِهِمْ- ‘মুমিনদের মধ্যে সবার চেয়ে পূর্ণ মুমিন ঐ ব্যক্তি যে চরিত্রে সবার চেয়ে সুন্দর, আর তাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি, যে নিজের স্ত্রীর জন্য সর্বোত্তম’।[1]
নারীদের কোন কথা বা আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিলে সাংসারিক জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠে। তথাপি কেউ যদি তালাক দেওয়ার মনস্থ করে ফেলে, এমনই পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদেরকে স্ত্রীদের কল্যাণকর দিক দেখার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন,وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا- ‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস কর। যদি তোমরা তাদের অপসন্দ কর, (তবে হ’তে পারে) তোমরা এমন বস্ত্তকে অপসন্দ করছ, যার মধ্যে আল্লাহ প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন’ (নিসা ৪/১৯)।
আর রাসূল (ছাঃ) নারীদের প্রতি উপদেশ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,اسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ، فَإِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ، وَإِنَّ أَعْوَجَ شَىْءٍ فِى الضِّلَعِ أَعْلاَهُ، فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ، وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَا- ‘তোমরা নারীদেরকে উত্তম নছীহত প্রদান করবে। কেননা নারী জাতিকে পঁাজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পঁাজরের হাড়গুলোর মধ্যে উপরের হাড়টি বেশী বঁাকা। তুমি যদি তা সোজা করতে যাও, তাহ’লে তা ভেঙ্গে যাবে। আর যদি ছেড়ে দাও, তাহ’লে সব সময় তা বঁাকাই থাকবে। কাজেই নারীদেরকে নছীহত করতে থাক’।[2]
স্ত্রীদের মধ্যকার নে’মত গ্রহণ করা : জাহেলী যুগে স্ত্রী হিসাবে নারীদের কোন মর্যাদা দেওয়া হ’ত না। তাদের নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত করা হ’ত। আর ইসলাম উভয়ের মাঝে দয়া ও ভালবাসা বজায় রাখার কথা বলেছে। আল্লাহ বলেন,وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ- ‘তঁার নিদর্শনাবলীর অন্যতম হ’ল, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হ’তেই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের স্ত্রীদের, যাতে তোমরা তাদের নিকট স্বস্তি লাভ করতে পার। আর তিনি তোমাদের উভয়ের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন ভালোবাসা ও দয়া। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শন সমূহ রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য’ (রূম ৩০/২১)।
নারীদের জন্য খরচ করা : আল্লাহ তা‘আলা নারীদের উপর ব্যয় করার বিষয়ে নিখুঁত একটি নীতিমালা দিয়েছেন। তারা যতদিন ঘর-সংসার করবে, ততদিন তাদের খরচ বহন করতে হবে। অতঃপর ঘর সংসার করা কোন ভাবেই সম্ভব না হলে তাদের দয়া ও অনুগ্রহের সাথে ছেড়ে দিতে হবে। যেমন কুরআনে এসেছে,لَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِنْ طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ مَا لَمْ تَمَسُّوهُنَّ أَوْ تَفْرِضُوا لَهُنَّ فَرِيضَةً وَمَتِّعُوهُنَّ عَلَى الْمُوسِعِ قَدَرُهُ وَعَلَى الْمُقْتِرِ قَدَرُهُ مَتَاعًا بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُحْسِنِينَ ‘যদি তোমরা স্ত্রীদের স্পর্শ করার আগেই অথবা তাদের জন্য মোহর নির্ধারণ না করেই তালাক প্রদান কর, তবে তাতে তোমাদের কোন দোষ নেই। এসময় তোমরা স্ত্রীদের ন্যায়ানুগভাবে কিছু সম্পদ দান করবে। সম্পদশালী ব্যক্তি তার অবস্থা অনুযায়ী এবং দরিদ্র ব্যক্তি তার অবস্থা অনুযায়ী। সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের উপর এটাই কর্তব্য’ (বাক্বারাহ ২/২৩৬)।
সম্পদে নারীদের উত্তরাধিকার : ইসলাম পূর্ব যুগে নারীরা সম্পদের উত্তরাধিকারী হ’ত না। পিতা-মাতা, সন্তান বা কোন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর পর তাদের সম্পদে কোন অংশ থাকত না। তবে ইসলামে নারীদের সেই অধিকার দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا- ‘পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদের অংশ রয়েছে এবং পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের সম্পত্তিতে নারীদের অংশ রয়েছে কম হৌক বা বেশী হৌক। এ অংশ সুনির্ধারিত’ (নিসা ৪/৭)।
নারীদের প্রতি মিথ্যা অপবাদের শাস্তি : যারা সতী-সাধবী নারী তাদের উপর মিথ্যা অপবাদে আল্লাহ কঠোর হুশিয়ারী প্রদান করেছেন এবং ফাসিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً وَلَا تَقْبَلُوا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ- ‘আর যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি (ব্যভিচারের) অপবাদ দেয়। অথচ চারজন (প্রত্যক্ষদর্শী) সাক্ষী হাযির করতে পারে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত কর। আর তোমরা কখনোই তাদের সাক্ষ্য কবুল করবে না। বস্ত্তত এরাই হ’ল পাপাচারী’ (নূর ২৪/৪)।
স্ত্রীদের মোহর ফেরত না নেওয়া ও তাদের প্রতি উদারতা : আল্লাহ বলেন,وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً ‘আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহরানা প্রদান কর ফরয হিসাবে’ (নিসা ৪/৪)। আল্লাহ নারীদের উপর কোন প্রকার কষ্ট দিতে এবং তাদেরকে দেওয়া মোহর ফেরত নিতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছেন। বরং তাদের প্রতি সদয় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا بِبَعْضِ مَا آتَيْتُمُوهُنَّ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর হালাল নয় যে, তোমরা জোর পূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হয়ে যাও। আর তোমরা তাদেরকে (মোহরানা ও অন্যান্য সম্পদ) যা দিয়েছ, তা থেকে কিছু নিয়ে নেওয়ার (কপট) উদ্দেশ্যে (স্বামীদের মৃত্যুর পর) তাদেরকে অন্যত্র বিয়ে করতে বাধা দিয়ো না’ (নিসা ৪/১৯)।
মা হিসাবে নারীর মর্যাদা : আল্লাহর পর পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী সম্মান পাওয়ার হকদার হলেন পিতা-মাতা। আবার পিতা-মাতা উভয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশী হকদার হলেন মা। যেমন হাদীছে এসেছে, جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللهِ- صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ مَنْ أَحَقُّ بِحُسْنِ صَحَابَتِى قَالَ أُمُّكَ. قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ أُمُّكَ، قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ أُمُّكَ، قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ ثُمَّ أَبُوكَ- ‘একটি ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছ থেকে সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশী হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা’।[3]
অন্যত্র এসেছে, এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার নিকট হিজরতের উপর বায়‘আত করছি। আর আমি আমার মাতাপিতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় রেখে এসেছি। তিনি বললেন, ارْجِعْ إِلَيْهِمَا فَأَضْحِكْهُمَا كَمَا أَبْكَيْتَهُمَا- ‘তুমি তাদের কাছে ফিরে যাও এবং তাদেরকে হাসাও যেমন তুমি তাদেরকে কাঁদিয়েছ’।
মাতার পায়ের নীচে জান্নাত : জাহেমাহ আস-সুলামী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এলাম জিহাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পরামর্শ করার জন্য। তিনি আমাকে বললেন, তোমার কি পিতা-মাতা আছে? আমি বললাম, হ্যঁা। তিনি বললেন, الْزَمْهُمَا فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ أَرْجُلِهِمَا ‘তুমি তাদের নিকটে থাক। কেননা জান্নাত রয়েছে তাদের পায়ের নীচে’।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাহেমাহ আস-সুলামী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ডান দিক থেকে ও বাম দিক থেকে দু’বার এসে বলেন, আমি আপনার সাথে জিহাদে যেতে চাই এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাত কামনা করি। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমার মা কি বেঁচে আছেন? তিনি বললেন, হ্যঁা। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ارْجِعْ فَبَرَّهَا ‘ফিরে যাও। তার সাথে সদাচরণ কর’। অবশেষে তৃতীয় বার সম্মুখ থেকে এসে একই আবেদন করেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন তোমার মা কি জীবিত আছেন? তিনি বললেন, হ্যঁা। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,وَيْحَكَ الْزَمْ رِجْلَهَا فَثَمَّ الْجَنَّةُ ‘তোমার ধ্বংস হৌক! তার পায়ের কাছে থাক। সেখানেই জান্নাত’।[5]
খালা-ফুফু হিসাবে মর্যাদা : খালাগণ (সদাচরণের ক্ষেত্রে) মায়ের স্থলাভিষিক্ত (বুখারী হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/৩৩৭৭)। ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো মহাপাপ করে ফেলেছি। আমার জন্য কি ক্ষমার দরজা খোলা আছে? তিনি বললেন, তোমার কি পিতা-মাতা জীবিত আছেন? সে বলল, না। তিনি বললেন, তোমার কি খালা জীবিত আছেন? সে বলল, হ্যঁা। তিনি বললেন, তাহলে তার সাথে সদাচরণ কর। [6]
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ন্যায় সঙ্গত অধিকার : স্বামীর নিকট স্ত্রীর নানাবিধ অধিকার রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ وَاللهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ- ‘স্ত্রীদের জন্য স্বামীদের উপর ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে, যেমন তাদের উপর স্বামীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে। তবে স্ত্রীদের উপর স্বামীদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (বাক্বারাহ ২/২২৮)। একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! স্ত্রীগণ আমাদের উপর কি অধিকার রাখে? উত্তরে তিনি বললেন,أَنْ تُطْعِمَهَا إِذَا طَعِمْتَ وَتَكْسُوَهَا إِذَا اكْتَسَيْتَ وَلاَ تَضْرِبَ الْوَجْهَ وَلاَ تُقَبِّحَ وَلاَ تَهْجُرَ إِلاَّ فِى الْبَيْتِ- ‘তুমি যখন খাও, তখন তাকেও খাওয়াও; তুমি পরলে তাকেও পরিধান করাও, (প্রয়োজনে মারতে হলে) মুখমন্ডলে আঘাত করো না, তাকে গালি দিও না, (প্রয়োজনে তাকে ঘরে বিছানা পৃথক করতে পার), কিন্তু একাকিনী অবস্থায় রাখবে না।[7]
সফরে নারীর নিরাপত্তায় মাহরাম : মাহরাম ছাড়া একজন নারীর একাকী সফর করতে রাসূল (ছাঃ)-এর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এটা নারীর জন্য অপমানজনক নয়, বরং সম্মানজনক। কারণ এতে একজন নারী সার্বিক নিরাপত্তা লাভ করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ، وَلَا تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ، فَقَامَ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ امْرَأَتِي خَرَجَتْ حَاجَّةً، وَإِنِّي اكْتُتِبْتُ فِي غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا، قَالَ: انْطَلِقْ فَحُجَّ مَعَ امْرَأَتِكَ- ‘কোন পুরুষ কোন স্ত্রীলোকের একাকী সঙ্গী হবে না, তবে তার সঙ্গে যদি তার মাহরাম (স্বামী ও যাদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ এমন লোক) থাকে। আর কোন মহিলা যেন তার মাহরাম ব্যতীত একাকী সফরে না যায়। এটি শুনে একজন লোক দঁাড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার সহধর্মিনী হজ্জের জন্য বেরিয়ে গেছে আর আমি অমুক অমুক যুদ্ধের জন্য লিপিবদ্ধ (নির্বাচিত) হয়েছি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি যাও! তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে হজ্জ পালন কর।[8]
অপর এক হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ تُسَافِرَ سَفَرًا فَوْقَ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ فَصَاعِدًا، إِلَّا وَمَعَهَا أَبُوهَا أَوْ أَخُوهَا أَوْ زَوْجُهَا أَوِ ابْنُهَا أَوْ ذُو مَحْرَمٍ مِنْهَا- ‘যে নারী আল্লাহ এবং শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তার জন্য তিন দিন কিংবা এর অধিক সময়ের পথ (একাকী) ভ্রমণ করা বৈধ নয়, যদি না তার সাথে তার পিতা, ভাই, স্বামী ছেলে অথবা কোনো মাহরাম লোক থাকে’।[9]
নারীর তালাক প্রাপ্তিতে অধিকার : একজন নারী স্বামীর চারিত্রিক ত্রুটি, শারীরিক সমস্যা, সাংসারিক ব্যয়ভার বহনে অক্ষমতা ও শারঈ ব্যাপারে অবহেলা বা অবজ্ঞা ইত্যাদি যৌক্তিক ওযরের ক্ষেত্রে মোহরানা ফেরৎ দানের মাধ্যমে স্বামীর নিকট থেকে ‘খোলা’ তালাক নিতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন,...فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيمَا افْتَدَتْ بِهِ ‘এক্ষণে যদি তোমরা ভয় কর যে তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা ঠিক রাখতে পারবেনা, তাহ’লে স্ত্রী যদি কিছু বিনিময় দিয়ে মুক্তি (খোলা) চায়, তবে তা গ্রহণে উভয়ের কোন দোষ নেই’ (বাক্বারাহ ২/২২৯)।
তবে শারঈ ওযর ব্যতীত স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক চাওয়া কাম্য নয়। কোন কারণ ছাড়াই যদি কেউ স্বামীর কাছে তালাক চায়, তাহ’লে সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, أَيُّمَا امْرَأَةٍ سَأَلَتْ زَوْجَهَا طَلَاقًا فِي غَيْرِ مَا بَأْسٍ فَحَرَامٌ عَلَيْهَا رَائِحَةُ الْجَنَّةِ- ‘যে মহিলা তার স্বামীর নিকট থেকে অকারণে তালাক চায়, তার উপর জান্নাতের সুগন্ধিও হারাম হয়ে যাবে’।[10] অন্য বর্ণনায় বিনা কারণে তালাকপ্রার্থী নারীকে মুনাফিক বলা হয়েছে’।[11] সুতরাং অধিকারের অপব্যবহার থেকে সাবধান থাকতে হবে।
বিধবা নারীদের সাহায্যে উৎসাহ প্রদান : একজন বিধবা নারীও যেন অনাহারে না থাকে সে জন্য রাসূল (ছাঃ) তাদের ব্যয় নির্বাহে বিশেষ ফযীলত বর্ণনা করেছেন,السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ كَالسَّاعِي فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأَحْسَبُهُ قَالَ: كَالْقَائِمِ لَا يَفْتُرُ وَكَالصَّائِمِ لَا يُفْطِرُ ‘স্বামীহীনা ও নিঃস্ব-গরীবের ব্যয় নির্বাহের জন্য আয়-রোযগারকারী আল্লাহর পথের মুজাহিদ অথবা রাতে ছালাত আদায়কারী ও দিনে ছিয়াম পালনকারীর সমতুল্য’।[12]
নারীদের মসজিদমুখী করা : ইসলাম পূর্ব যুগে নারীদের ধর্মীয় বিষয়ে জানার কোন অধিকার ছিলনা। কিন্তু ইসলাম নারীদের ইসলামের সামগ্রিক বিষয় জানার জন্য মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। হাদীছে এসেছে, ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ওমর (রাঃ)-এর স্ত্রী (আতিক্বাহ বিনতে যায়েদ) ফজর ও এশার ছালাতের জামা‘আতে মসজিদে যেতেন। তঁাকে বলা হ’ল, আপনি কেন (ছালাতের জন্য) বের হন? অথচ আপনি জানেন যে, ওমর (রাঃ) তা অপসন্দ করেন এবং অপমানজনক মনে করেন। তিনি জবাব দিলেন, তা হ’লে কি কারণে ওমর স্বয়ং আমাকে নিষেধ করছেন না? বলা হ’ল, তঁাকে বাধা দেয় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী,لاَ تَمْنَعُوا إِمَاءَ اللهِ مَسَاجِدَ اللهِ ‘আল্লাহর দাসীদের আল্লাহর মসজিদে যেতে বারণ করো না’।[13]
পোষাকের শালীনতার মাধ্যমে নারীর আত্মরক্ষা : ইসলাম একজন নারীর সার্বিক জীবনে শালীন পোষাক পরিধানের মাধ্যমে তাকে উত্যক্ত ও যৌন নিপীড়ন থেকে নিরাপত্তা দিয়েছে। নারী স্বাধীনতার দোহায় দিয়ে নারীদের উলঙ্গ-অর্ধনগ্ন হয়ে চলার কারণে খোদ বাংলাদেশেই গত চার বছরে প্রতি ৯ ঘণ্টায় একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ শুধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেই দেখা যায় গত চার বছরে বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত দু’জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে।[14] এ থেকে উত্তরণের উপায় মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলে দিয়েছেন,يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللهُ غَفُورًا رَحِيمًا- ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিনদের স্ত্রীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের বড় চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। বস্ত্তত আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আহযাব ৩৩/৫৯)।
নারীর জান্নাত যাওয়ার সহজ ৪টি আমল : একজন নারীর জান্নাতে যাওয়ার জন্য সহজ ৪টি আমল সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,الْمَرْأَةُ إِذَا صَلَّتْ خَمْسَهَا وَصَامَتْ شَهْرَهَا وَأَحْصَنَتْ فَرْجَهَا وَأَطَاعَتْ بَعْلَهَا فَلْتَدْخُلْ مِنْ أَيِّ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ شَاءَتْ- ‘নারী যখন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করে, রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার লজ্জাস্থানের হেফাযত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, সে জান্নাতের যেকোন দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে’। [15]
উপসংহার : একমাত্র ইসলামই নারীর অবস্থান সুসংহত করেছে। তাদেরকে মর্যাদার উচ্চাসনে বসিয়েছে এবং তাদের প্রাপ্ত অধিকার নিশ্চিত করেছে। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক নারীকে সঠিক দ্বীন বুঝে দ্বীন মেনে চলার তাওফীক দান করুন। ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন জীবনে জান্নাত প্রাপ্তির তাওফীক দান করুন।-আমীন!
[1]. তিরমিযী হা/১১৬২; মিশকাত হা/৩২৬৪; ছহীহাহ হা/২৮৪।
[2]. বুখারী হা/৩৩৩১; মুসলিম হা/১৪৬৮; মিশকাত হা/৩২৩৮।
[3]. বুখারী হা/৫৯৭১; মুসলিম হা/২৫৪৮; মিশকাত হা/৪৯১১।
[4]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/২২০২; ছহীহ আত-তারগীব হা/২০৮৫।
[5]. ইবনু মাজাহ হা/২৭৮১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[6]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৩৫; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫০৪, ২৫২৬।
[7]. তিরমিযী হা/১১৬৩; আবু দাউদ হা/২১৪২; ইবনু মাজাহ হা/ মিশকাত হা/৩২৫৯; বুখারী হা/১৯৭৫; মুসলিম হা/১১৫৯; মিশকাত হা/২০৫৪।
[8]. বুখারী হা/১৮৬২; মুসলিম হা/১৩৪১।
[9]. আবু দাউদ হা/১৭২৬; ছহীহ ইবনু হিববান হা/২৭৩৪।
[10]. আবূদাঊদ হা/২২২৬; মিশকাত হা/৩২৭৯; ছহীহুত তারগীব হা/২০১৮।
[11]. তিরমিযী হা/১১৮৬; মিশকাত হা/৩২৯০; ছহীহাহ হা/৬৩২।
[12]. বুখারী হা/৫৩৫৩; মুসলিম হা/২৯৪২; মিশকাত হা/৪৯৫১।
[13]. বুখারী হা/৯০০; মুসলিম হা/৪৪২; আবুদাঊদ হা/৫৬৬।
[14]. দি ডেইলী স্টার বাংলা, ২৫শে নভেম্বর ২০২৪।
[15]. ছহীহুত তারগীব ১৯৩১; মিশকাত হা/৩২৫৪।