যালেমদের মর্মান্তিক পরিণতি [শেষ কিস্তি]

ইহসান ইলাহী যহীর 4 বার পঠিত

যালেমদের শেষ পরিণতি : প্রত্যেক জিনিস যার শুরু আছে, তার শেষ আছে। তেমনি প্রত্যেক শাসনকালের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। মেয়াদ শেষে পরিসমাপ্তি ঘটেমেএই সমাপ্তি কখনো মসৃণ হয়, কখনো হয় বেদনা বিধুর। যালেমদের উপর আল্লাহর শাস্তিও কখনো ধীরে ধীরে আসে। কখনো বা মহাগযব রূপে হঠাৎ আপতিত হয়। মহান আল্লাহ যালেমদের যুলুমের বিনিময়ে মর্মন্তুদ শাস্তি প্রদান করেন।

মাযলূম মুমিনদের ব্যাপারে যালেম শত্রুদের চিন্তা-ভাবনা কি? যে কোন পরিস্থিতিই মুমিনদের জন্য উত্তম। হয়তো গাযী। না হয় শহীদ। আমৃত্যু তারা আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করে যাবে। আর যারা ইসলামী শরী‘আহ থেকে বিমুখ হয়ে বহু দূরে সরে গিয়েছে, তাদের ব্যাপারে মুমিনদের দৃষ্টিভঙ্গি কি? হয়তো আল্লাহ তাদের নিজ ক্ষমতাবলে শাস্তি দিবেন, যেভাবে তিনি পূর্ববর্তী যালেমদের ধ্বংস করেছেন। নতুবা মুমিনদের হাতেই তাদের উদ্ধত ও হঠকারী আচরণের জন্য শাস্তি ভোগ করাবেন।

নিশ্চয়ই আল্লাহ যুগে যুগে একক কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধ বহু যালেমকে সমূলে ধ্বংস করেছেন। আল্লাহ বলেন,وَعَادًا وَّثَمُودَ وَقَدْ تَّبَيَّنَ لَكُمْ مِّنْ مَّسَاكِنِهِمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيلِ وَكَانُوا مُسْتَبْصِرِينَ- وَقَارُونَ وَفِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَلَقَدْ جَآءَهُمْ مُّوسَى بِالْبَيِّنَاتِ فَاسْتَكْبَرُوا فِي الْأَرْضِ وَمَا كَانُوا سَابِقِينَ- فَكُلاَّ أَخَذْنَا بِذَنْبِهِ فَمِنْهُمْ مَنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِبًا وَّمِنْهُمْ مَّنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُمْ مَّنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُمْ مَّنْ أَغْرَقْنَا وَمَا كَانَ اللهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِنْ كَانُوآ أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ- ‘আর আমরা ‘আদ ও ছামূদ জাতিকে ধ্বংস করেছি। তাদের পরিত্যক্ত বাড়ী সমূহ তোমাদের জন্য এর সুস্পষ্ট প্রমাণ। তাদের অপকর্মগুলিকে শয়তান তাদের নিকট শোভনীয় করেছিল। অতঃপর তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দিয়েছিল। অথচ তারা ছিল বিচক্ষণ ব্যক্তি’। ‘আর (আমরা ধ্বংস করেছি) ক্বারূণ, ফেরাঊন ও হামানকে। মূসা তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন সমূহ নিয়ে এসেছিল। তখন তারা যমীনে দম্ভ করতে থাকে। কিন্তু তারা (আমাদের শাস্তিকে) অতিক্রম করতে পারেনি’। ‘অতঃপর তাদের প্রত্যেককে আমরা তাদের পাপের কারণে পাকড়াও করেছিলাম। ফলে তাদের কারু প্রতি আমরা প্রেরণ করেছিলাম প্রবল শিলাঝড়। কাউকে পাকড়াও করেছে প্রচন্ড নিনাদ। কাউকে আমরা ধ্বসিয়ে দিয়েছি ভূগর্ভে। কাউকে ডুবিয়ে মেরেছি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তাদের প্রতি যুলুম করেননি। বরং তারাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল’ (‘আনকাবূত ২৯/৩৮-৪০)

আল্লাহ যে সকল যালেমদেরকে সমন্বিতভাবে ধ্বংস করেছেন, তাদের মধ্যে ছিল ‘আদ ও ছামূদ জাতির লোকজন। ছিল কারূন, ফেরাঊন ও হামান। তাদের করুণ পরিণতি এবং ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর ‘আদ সম্প্রদায়! তারা পৃথিবীতে অযথা দম্ভ করেছিল এবং বলেছিল, আমাদের চাইতে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে? অথচ তারা কি বুঝে না যে, আল্লাহ যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। এরপরেও তারা আমাদের আয়াত সমূহকে অস্বীকার করত’ (ফুছছিলাত ৪১/১৫)

যালেম ফেরাঊন ও তার দলের অত্যাচার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَإِذْ نَجَّيْنَاكُمْ مِّنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ يُذَبِّحُونَ أَبْنَآءَكُمْ وَيَسْتَحْيُونَ نِسَآءَكُمْ وَفِي ذَلِكُمْ بَلَآءٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ عَظِيمٌ- ‘আর (স্মরণ কর) যখন আমরা তোমাদেরকে ফেরাঊনের লোকদের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম। যারা তোমাদের নির্মমভাবে শাস্তি দিত। তারা তোমাদের পুত্র সন্তানদের যবহ করত ও কন্যা সন্তানদের জীবিত রাখত। বস্ত্ততঃ এর মধ্যে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে ছিল এক মহা পরীক্ষা’ (বাক্বারাহ ২/৪৯)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, كَدَأْبِ آلِ فِرْعَوْنَ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا فَأَخَذَهُمُ اللهُ بِذُنُوبِهِمْ وَاللهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ- ‘যেমন কওমে ফেরাঊন ও তাদের পূর্বেকার লোকদের অবস্থা; তারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করেছিল। অতঃপর আল্লাহ তাদের পাপাচার সমূহের কারণে তাদের পাকড়াও করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা’ (আলে ইমরান ৩/১১)

এটিই হচ্ছে অত্যাচারী শাসকের অন্যায় প্রভাব-কর্তৃত্ব ও হিংস্রতার শেষ পরিণতি। যুগে যুগে বিভিন্ন ভূখন্ডে ফেরাঊনের মত যালেম শাসকদের আবির্ভাব হয়েছে। তারা চেয়েছেন জনগণের রক্ত চুষে ক্ষমতার মসনদে সমাসীন থাকবেন। কিন্তু কোন যালেমই চিরস্থায়ী হ’তে পারেনি। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করেছেন। আর আখেরাতে জাহান্নামের লেলিহান আগুনের শাস্তি তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছেই। যালেমরা শ্রেষ্ঠত্ব চায় ও মুমিনদের ইচ্ছাকে দমিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ফেরাঊনরা যা চায় আল্লাহ তা চান না। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আল্লাহর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।

অত্যাচারী শাসক ক্বিয়ামতের দিন শৃংখলিত অবস্থায় উত্থিত হবে : ক্বিয়ামত ভয়ংকর এক বিভীষিকাময় দিবসের নাম। যার সম্মুখীন হ’তে হবে প্রত্যেক মানুষকে। সেদিনের লাঞ্ছনা আর অপদস্ততা হবে চূড়ান্ত পর্যায়ের। শাসক শ্রেণীর জন্য এ দিনটি হবে বড়ই ভয়ানক। শাসক মাত্রই সেদিন শৃঙ্খলিত অবস্থায় উত্থিত হবেন। মহাবিচারের পর হয়তো নাযাত পাবেন অথবা মর্মন্তুদ আযাবে নিপতিত হবেন। হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَا مِنْ أَمِيرِ عَشَرَةٍ إِلاَّ يُؤْتَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَغْلُولاً حَتَّى يُفَكَّ عَنْهُ الْعَدْلُ، أَوْ يُوبِقَهُ الْجَوْرُ- ‘যে ব্যক্তি দশ জন মানুষেরও শাসক নিযুক্ত হয়েছে। ক্বিয়ামতের দিন সে শৃঙ্খলিত অবস্থায় উত্থিত হবে। অতঃপর তার ন্যায়পরায়ণতা তাকে আযাব থেকে রক্ষা করবে অথবা তার যুলুম তাকে ধ্বংস করবে’।[1]

আখেরাতে যালেমরা হবে নিঃস্ব-হতদরিদ্র : যারা মানুষের উপর যুলুম করেছে, মানুষের হক নষ্ট করেছে, অন্যায়ভাবে মানুষকে আঘাত করেছে, কাউকে গালি দিয়েছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে মানুষের মাল-সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, মানুষের রক্ত প্রবাহিত করেছে বা কাউকে প্রহার করেছে, তারা আখেরাতে হবে নিঃস্ব-হতদরিদ্র। কারণ ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের দুনিয়ার জীবনের ভাল আমলের মাধ্যমে তাদের দ্বারা অত্যাচারিত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করে দিবেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন ছাহাবীদের জিজ্ঞাসা করে বললেন,أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ قَالُوا الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لاَّ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ فَقَالَ إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِى يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِى قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُّقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِى النَّارِ- ‘তোমরা কি জানো চূড়ান্ত নিঃস্ব কে? সবাই বলল, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যার কোন টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ নেই। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যে ক্বিয়ামতের দিন দুনিয়া থেকে ছালাত-ছিয়াম-যাকাত ইত্যাদি আদায় করে আসবে। সেই সাথে ঐ সকল ব্যক্তিরাও আসবে, যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছে, কারু উপরে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারু সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করেছে, কাউকে প্রহার করেছে কিংবা কাউকে হত্যা করেছে। তখন ঐ সকল পাওনাদারকে যালেমের নেকী থেকে পরিশোধ করা হবে। এভাবে পরিশোধ করতে করতে যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তখন ঐ সকল লোকদের পাপসমূহ এই যালেম ব্যক্তির উপর চাপানো হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[2]

দুনিয়ার জীবনে যে ব্যক্তি যুলুম করে মানুষের ধন-সম্পদ হাতিয়ে নিবে, মানুষের কোন কিছু জোর করে দখল করে নেবে, ক্বিয়ামতের দিন সাত তবক যমীন ঐ যালেমের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَخَذَ شِبْرًا مِنَ الأَرْضِ ظُلْمًا طُوِّقَهُ إِلَى سَبْعِ أَرَضِينَ- ‘যে ব্যক্তি যুলুম করে কারও এক বিঘত পরিমাণ জমি অন্যায়ভাবে দখল করে নেয়, ক্বিয়ামত দিবসে সাত স্তর যমীন তার গলায় বেড়ী বানিয়ে দেওয়া হবে’।[3] অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,مَنْ أَخَذَ مِنَ الأَرْضِ شَيْئًا بِغَيْرِ حَقِّهِ خُسِفَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَى سَبْعِ أَرَضِينَ- ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারো কাছ থেকে যমীনের কোন অংশ দখল করে নেয়, ক্বিয়ামতের দিন সাত স্তর যমীন তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে’।[4]

যালেমরা আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত : যালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। যারা সমাজের মানুষের উপরে যুলুম করে এবং আল্লাহর দ্বীনের কর্মীদের উপরে অত্যাচার করে, তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না এবং আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমাও করবেন না। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ- ‘সীমালংঘনকারীদের কোন সাহায্যকারী নেই’।[5] অন্যত্র তিনি বলেন, وَالظَّالِمُونَ مَا لَهُم مِّن وَّلِيٍّ وَّلاَ نَصِيرٍ- ‘আর যালেমদের কোন বন্ধু নেই বা কোন সাহায্যকারী নেই’ (শূরা ৪২/৮)

যালেমদেরকে আল্লাহ হেদায়াত দেন না। যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার-ফয়ছালা করে না, বরং আল্লাহর নির্দেশ ও বিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আল্লাহর দ্বীনের পথে যারা কাজ করে, তাদের উপরে অন্যায়ভাবে অত্যাচার-অবিচার করে তারা যালেম। আর আল্লাহ এসকল যালেমদেরকে হেদায়াত দান করেন না। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَاللهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ- ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮; আলে ইমরান ৩/৮৬)

আল্লাহর ভালবাসা হ’তে বঞ্চিত : আল্লাহ বলেন,وَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَيُوَفِّيهِمْ أُجُورَهُمْ وَاللهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ- ‘পক্ষান্তরে যারা বিশ্বাসী হয়েছে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করেছে, তিনি তাদের প্রাপ্য পূর্ণভাবে প্রদান করবেন। বস্ত্তত আল্লাহ যালেমদের ভালবাসেন না’ (আলে ইমরান ৩/৫৭)। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ- ‘নিশ্চয়ই তিনি অত্যাচারীদের ভালবাসেন না’ (শূরা ৪২/৪০)

যালেমদের দুর্ভোগ : দুনিয়ার জীবনই মানুষের শেষ জীবন নয়, মৃত্যুর পরে আরও একটা পরকালীন জীবন আছে। সেখানেই আল্লাহর কাছে দুনিয়ার এই জীবনের সকল কর্মকান্ডের হিসাব দিতে হবে। এই বিশ্বাসটা যালেমদের অন্তরে থাকে না বিধায় তারা মনে করে, তাদেরকে কেউ পাকড়াও করতে পারবে না। অথচ তাদের যুলুমের কারণে সীমাহীন শাস্তি ভোগ করতে হবে। এই যুলুমের পরিণাম যে কত ভয়াবহ হবে, পবিত্র কুরআনের বর্ণনা পড়লে হৃদয় শিহরিত হয়, অন্তর বিগলিত হয়। যারা অন্যায়ভাবে মানুষের উপর যুলুম করবে তাদের দুর্ভোগ অনিবার্য। মহান আল্লাহ বলেন,قَالُوا يَاوَيْلَنَا إِنَّا كُنَّا ظَالِمِينَ- ‘তারা বলল, হায় দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো নিশ্চিতভাবে যালেম ছিলাম’ (আম্বিয়া ২১/১৪)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,فَاخْتَلَفَ الْأَحْزَابُ مِنْ بَيْنِهِمْ فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْ عَذَابِ يَوْمٍ أَلِيمٍ- ‘অতঃপর তাদের কয়েকটি দল মতভেদ করল। সুতরাং যালেমদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক দিবসের শাস্তির দুর্ভোগ’ (যুখরুফ ৪৩/৬৫)

যালেমদের স্থায়ী ও মন্দ শাস্তি : পরকালীন জীবনে প্রত্যেক যালেম শাস্তির সম্মুখীন হবে। তারা শাস্তি থেকে কখনই রেহায় পাবে না। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,وَقِيلَ لِلظَّالِمِينَ ذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْسِبُونَ- ‘আর যালেমদের বলা হবে, তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করো’ (যুমার ৩৯/২৪)। আর যালেমদের এই শাস্তি হবে স্থায়ী। মহান আল্লাহ বলেন,فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ خَالِدَيْنِ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ ‘অতঃপর উভয়ের পরিণতি হবে এই যে, তারা উভয়ে জাহান্নামে থাকবে চিরকাল। আর এটাই হ’ল যালেমদের কর্মফল’ (হাশর ৫৯/১৭)

আর পরকালীন জীবনে যালেমদের জন্য মন্দ শাস্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহ আরো বলেন,إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا وَإِنْ يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَاءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَاءَتْ مُرْتَفَقًا- ‘আমরা সীমালংঘনকারীদের জন্য আগুন প্রস্ত্তত করে রেখেছি। যার বেষ্টনী তাদেরকে ঘিরে রাখবে। তারা পানি চাইলে তাদেরকে গলিত ধাতুর ন্যায় পানীয় (পঁুজ-রক্ত) দেয়া হবে। যা তাদের মুখমন্ডল ঝলসে দেবে। কতই না নিকৃষ্ট পানীয় এবং কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল’ (কাহফ ১৮/২৯)

যালেমদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি : যালেমদেরকে যে শাস্তি দেওয়া হবে তা হবে অত্যধিক যন্ত্রণাদায়ক। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ- ‘নিশ্চয়ই যালেমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (ইব্রাহীম ১৪/২২; শূরা ৪২/২১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا السَّبِيلُ عَلَى الَّذِينَ يَظْلِمُونَ النَّاسَ وَيَبْغُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ- ‘অভিযোগ তো কেবল তাদেরই বিরুদ্ধে, যারা মানুষের উপর যুলুম করে এবং জনপদে অন্যায়ভাবে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (শূরা ৪২/৪২)

ক্বিয়ামতের দিন যালেমদের ভীত-সন্ত্রস্ততা : যারা যুলুমকারী তারা ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট পাকড়াও হওয়ার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে। আল্লাহ বলেন,تَرَى الظَّالِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا كَسَبُوا وَهُوَ وَاقِعٌ بِهِمْ ‘তুমি যালেমদের সদা সন্ত্রস্ত দেখবে তাদের কৃতকর্মের কারণে। আর সেটি (শাস্তি) তাদের উপর আপতিত হবেই’ (শূরা ৪২/২২)

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,وَلَوْ أَنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لَافْتَدَوْا بِهِ مِنْ سُوءِ الْعَذَابِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَبَدَا لَهُمْ مِنَ اللهِ مَا لَمْ يَكُونُوا يَحْتَسِبُونَ- ‘আর যদি যালেমদের নিকট পৃথিবীর সকল সম্পদ থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরও থাকে, তথাপি তারা ক্বিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি হ’তে বঁাচার জন্য মুক্তিপণ হিসাবে তা অবশ্যই দিয়ে দিবে। অথচ সেদিন আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাদের জন্য এমন শাস্তি প্রকাশিত হবে, যা তারা কল্পনাও করেনি’ (যুমার ৩৯/৪৭)

ক্বিয়ামতের দিন যালেমদের অনুশোচনা : যালেমরা যখন শাস্তি দেখবে, তখনই তাদের হুঁশ ফিরবে। এমতাবস্থায় তারা দুনিয়ায় ফিরে আসার পথ খুঁজতে থাকবে। কিন্তু তখন আর তাদের ফিরে আসার কোন পথ থাকবে না। মহান আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেন,وَتَرَى الظَّالِمِينَ لَمَّا رَأَوُا الْعَذَابَ يَقُولُونَ هَلْ إِلَى مَرَدٍّ مِنْ سَبِيلٍ- ‘আর যখন যালেমরা আযাব প্রত্যক্ষ করবে, তখন তুমি দেখবে যে তারা বলবে, (দুনিয়ায়) ফিরে যাবার কোন পথ আছে কি?’ (শূরা ৪২/৪৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَالَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً- ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি আমি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম! (ফুরক্বান ২৫/২৭)

আল্লাহ আরো বলেন,وَلاَ تَحْسَبَنَّ اللهَ غَافِلاً عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ لِيَوْمٍ تَشْخَصُ فِيهِ الْأَبْصَارُ- مُهْطِعِينَ مُقْنِعِي رُءُوسِهِمْ لاَ يَرْتَدُّ إِلَيْهِمْ طَرْفُهُمْ وَأَفْئِدَتُهُمْ هَوَآءٌ- وَأَنْذِرِ النَّاسَ يَوْمَ يَأْتِيهِمُ الْعَذَابُ فَيَقُولُ الَّذِينَ ظَلَمُوا رَبَّنَآ أَخِّرْنَآ إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ نُّجِبْ دَعْوَتَكَ وَنَتَّبِعِ الرُّسُلَ أَوَلَمْ تَكُونُوا أَقْسَمْتُمْ مِنْ قَبْلُ مَا لَكُمْ مِنْ زَوَالٍ- ‘তুমি অবশ্যই একথা ভেবো না যে, যালেমরা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে উদাসীন। তবে তিনি তাদেরকে সেদিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, যেদিন তাদের চক্ষুসমূহ বিস্ফারিত হবে’। ‘যেদিন ভীত-বিহবল অবস্থায় তারা দৌড়াতে থাকবে। নিজেদের দিকে দৃষ্টি ফেরাবার অবকাশ তাদের থাকবে না। আর তাদের হৃদয়গুলি হবে শূন্য’। ‘তুমি মানুষকে ঐদিনের ভয় দেখাও, যেদিন তাদের কাছে আযাব এসে যাবে। আর যালেমরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের অল্প কিছু দিন সময় দাও। আমরা তোমার আহবানে সাড়া দেব এবং রাসূলদের অনুসরণ করব। অথচ তোমরা কি ইতিপূর্বে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের দুনিয়া ছেড়ে যেতে হবে না’ (ইব্রাহীম ১৪/৪২-৪৪)

যুলুমের সাহায্যকারী না হওয়া : দিবলোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, যালেমরা ইহ ও পরকালীন উভয় জগতেই আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হবে। সাথে সাথে হক ও বাতিলের পার্থক্য জানার পরও যুলুমে সাহায্যকারী ব্যক্তির জন্যও রয়েছে ধমকবাণী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ أَعَانَ ظَالِمًا بِبَاطِلٍ لِيَدْحَضَ بِبَاطِلِهِ حَقًّا فَقَدْ بَرِئَ مِنْ ذِمَّةَ اللهِ وَذِمَّةِ رَسُولِهِ- ‘যে ব্যক্তি নিজ বাতিলের মাধ্যমে হককে খন্ডন করে কোন যালেমকে সাহায্য করে, সে ব্যক্তির নিকট থেকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দায়িত্ব উঠে যায়’।[6]

যুলুম থেকে আত্মরক্ষার উপায় : সমাজ ও দেশের অনেকেই ধর্মপ্রাণ হিসাবে দ্বীন-ধর্মে অগ্রগামী হ’লেও অন্যের উপর যুলুম-অত্যাচারে পিছিয়ে নেই। বিশেষ করে সমাজের সহজ-সরল ও নিম্ন শ্রেণীর মানুষের উপর এলিট শ্রেণীর নিষ্পেষণ চলছে দেদারছে। যুলুম থেকে বঁাচার কার্যকরী উপায় হ’ল লোভ-লালসা, সম্পদ ও ক্ষমতার লোভ, হিংসা-বিদ্বেষ ও ক্রোধ থেকে আত্মসংবরণ করা। ধৈর্যশীলতা, জনসেবা, ধর্মীয় সেবা ও পরোপকারমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করা। হালাল ও বৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থে স্বল্প পানাহারে, পোশাক-পরিচ্ছদে সন্তুষ্ট থাকা এবং প্রাপ্ত নে‘মতের উপর আল্লাহর সর্বাধিক প্রশংসা করা। কারু প্রতি যুলুম হ’লে তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। তিনি বলেন,مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لِّأَخِيهِ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَيْءٍ، فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ اليَوْمَ قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُونَ دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ، إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ، وَإِنْ لَّمْ تَكُنْ لَّهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ عَلَيْهِ- ‘যে ব্যক্তি তার কোন ভাইয়ের প্রতি যুলুম করেছে তার সম্মান বা অন্য কোন বিষয়ে, সে যেন আজই তার নিকট থেকে তা মাফ করিয়ে নেয়। সেই দিন আসার পূর্বে, যেদিন তার নিকটে দিরহাম ও দীনার কিছুই থাকবে না। সেদিন যদি তার কোন নেক আমল থাকে, তবে তার যুলুম পরিমাণ নেকী সেখান থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। আর যদি তার কাছে নেকী না থাকে, তবে মাযলূম ব্যক্তির পাপসমূহ তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে’।[7]

উপসংহার : সীমাহীন অত্যাচার-অনাচারে মুক্তির পথ খুঁজে না পেলে আমাদের জন্য আদর্শ হ’তে পারে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ), মূসা (আঃ) ও অন্যান্য নবীদের জীবনী। মূসা (আঃ)-এর স্বজাতির উপর ফেরাঊনের অত্যাচার যখন সব সীমা অতিক্রম করেছিল, কোনভাবেই ফেরাঊনকে দমান করা সম্ভব হচ্ছিল না, সমুদ্রের ওপার থেকেও পাকড়াও করে বনী ইস্রাঈলকে পরাস্ত করবে বলে ঠিক করেছিল, ঠিক তখনি আল্লাহ তাকে এমনভাবে ডুবিয়ে মারলেন যে, তার লাশের সৎকারের জন্যও আশপাশে তার স্বপক্ষের কোন প্রাণী বেঁচে রইল না। আল্লাহ ফেরাঊনের শেষ পরিণতিকে করলেন বিশ্বের অত্যাচারীদের জন্য দারুণ সতর্কবাতা।

ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের উপর মক্কার মুশরিকদের অত্যাচার-অবিচারের সব সীমা অতিক্রমের পরই আল্লাহ হিজরতের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর পর্যায়ক্রমে বদর, ওহোদ, খন্দকসহ বিভিন্ন যুদ্ধে মুশরিকদের সমূলে ধ্বংস করলেন। কারণ তাদের কৃতকর্ম ছিল যুলুম-নির্যাতনে ভরপুর। এসমস্ত ঘটনা প্রবাহে ও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর বিভিন্ন হাদীছের মাধ্যমে যালেমদের করুণ পরিণতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। অতএব সার্বিক জীবনে আমরা যেন যুলুম থেকে বিরত থাকতে পারি, মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন।-আমীন!

[ক্রমশ]

[সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, ঢাকা (দক্ষিণ) ও
প্রিন্সিপ্যাল, মারকাযুস সুন্নাহ আস-সালাফী, পূর্বাচল নতুন শহর, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ]


[1]. দারেমী হা/২৫১৫; মিশকাত হা/৩৬৯৭; ছহীহুত তারগীব হা/২১৯৮।

[2]. মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭।

[3]. বুখারী হা/৩১৯৮; মুসলিম হা/১৬১০; মিশকাত হা/২৯৩৮।

[4]. বুখারী হা/২৪৫৪; মিশকাত হা/২৯৫৮।

[5]. বাক্বারাহ ২/২৭০; আলে ইমরান ৩/১৯২; মায়েদাহ ৫/৭২।

[6]. হাকেম হা/৭০৫০; তাবারাণী কাবীর হা/১১২১৬; ছহীহাহ হা/১০২০।

[7]. বুখারী হা/২৪৪৯; মিশকাত হা/৫১২৬।



আরও