সত্য বর্জনে যত অযুহাত

নাজমুন নাঈম 158 বার পঠিত

আদম (আঃ) ও তঁার স্ত্রী হাওয়াকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়ার সময় আল্লাহ মানবজাতিকে পুনরায় জান্নাতে ফিরে যাওয়ার পথ বাতলে দিয়েছেন। সাথে সাথে চিরস্থায়ী জাহান্নামীদের বৈশিষ্ট্যও বলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা বললাম, তোমরা সবাই জান্নাত থেকে নেমে যাও। অতঃপর যখন আমার নিকট থেকে তোমাদের কাছে কোন হেদায়াত পেঁŠছাবে, তখন যারা আমার হেদায়াতের অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না। পক্ষান্তরে যারা অবিশ্বাস করবে এবং আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং তারা সেখানে চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৮-৩৯)। এরপর থেকে সব সময় একদল মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়াতের বাণী অনুসরণ করে কল্যাণের পথযাত্রী হয়েছেন। অন্য দল বিভিন্ন অযুহাতে সত্যকে এড়িয়ে তাগুতের অনুসারী হয়েছেন। অত্র প্রবন্ধে আমরা যুগে যুগে হক থেকে বিমুখ কাফের-মুশরিকদের কিছু অযুহাতের উপর আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্ল­াহ।

১. পূর্বপুরুষদের অনুসরণ : মানুষ উত্তরাধিকার সূত্রে পূর্বপুরুষের সম্পদ যেমন প্রাপ্ত হয়, তেমনি রক্ত কণায় তাদের মান-মর্যাদা, চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণের কিছু অংশ ধারণ করে। এটি মানুষের স্বভাবজাত, দোষের কিছু নয়। বিপত্তি বাধে তখনই, যখন মানুষ বাপ-দাদার থেকে প্রাপ্ত এই রীতি-নীতিকে হক-বাতিলের মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করে। যখন তারা বাস্তব প্রয়োজন ও দলীলের আলোকে সেগুলো গ্রহণ, বর্জন ও পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়। অন্যের দলীলকৃত জমি দখলে রেখে বংশপরম্পরায় ভোগ করার মত তারা ভিত্তিহীন প্রচলিত শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কার সমূহকে দ্বীনের বিধান হিসাবে পালন করে। তাদের সামনে কুরআন-হাদীছের দলীল উপস্থাপন করা হ’লে তারা বাপ-দাদার আমলের আলোকে তা বিচার করে এবং অহি-র বিধানের বিপরীত হ’লেও সেটাকেই আকড়ে ধরে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تعَالَوْا إِلَىٰ مَا أَنزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُوا حَسْبنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يعْلَمُونَ شَيئًا وَلَا يهْتَدُونَ- ‘আর যখন তাদের বলা হয়, তোমরা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেদিকে এবং রাসূলের দিকে এস, তখন তারা বলে আমাদের জন্য তাই-ই যথেষ্ট, যার উপরে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কোন জ্ঞান রাখত না বা তারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না’ (মায়েদাহ ৫/১০৪)

মক্কার কুরায়েশরা পূর্বপুরুষদের থেকে চলে আসা মূর্তিপূজা অঁাকড়ে ধরার কারণেই ইসলামের সুমহান আলো থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি রাসূল (ছাঃ)-কে সকল দুঃখ-দুর্দশা থেকে সর্বদা ঢালের মত তঁাকে রক্ষাকারী চাচা আবু ত্বালিবও এই ধেঁাকায় পতিত হয়ে মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আবু ত্বালিবের মৃত্যুকালে আবু জাহল, আব্দু­ল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া প্রমুখ মুশরিক নেতৃবৃন্দ তঁার শিয়রে বসেছিলেন। এ সময় রাসূলুল্ল­াহ (ছাঃ) মৃত্যুপথযাত্রী পরম শ্রদ্ধেয় চাচাকে বললেন,يَا عَمِّ قُلْ لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ كَلِمَةً أَشْهَدُ لَك بِهَا عِنْدَ اللهِ- ‘হে চাচাজী! আপনি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমাটি পাঠ করুন, যাতে আমি তার কারণে আপনার জন্য আল্লাহর নিকটে সাক্ষ্য দান করতে পারি’। জবাবে আবু ত্বালিব বলেন, ‘হে ভাতিজা! যদি আমার পরে তোমার বংশের উপর গালির ভয় না থাকত এবং কুরায়েশরা যদি এটা না ভাবত যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে এটা বলেছি ও তোমাকে খুশী করার জন্য বলেছি, তাহ’লে আমি অবশ্যই ওটা বলতাম’।[1] অতঃপর যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এল, তখন আবু জাহল ও তার সহোদর বৈপিত্রেয় ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া বারবার তঁাকে উত্তেজিত করতে থাকেন এবং বলেন,أَتَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطّلِبِ؟ ‘আপনি কি আব্দুল মুত্ত্বালিবের ধর্ম ত্যাগ করবেন’? জবাবে আবু ত্বালিবের মুখ দিয়ে শেষ বাক্য বেরিয়ে যায়,أَنَا عَلَى مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ- ‘আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের দ্বীনের উপরে (মৃত্যুবরণ করছি)’।[2]

বর্তমান যুগেও অনেকে পূর্বপুরুষদের প্রচলিত সুন্নাতকে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের উপরে অগ্রাধিকার দিয়ে পালন করে। তারা হাল চাষের সময় বাপ-দাদা থেকে প্রাপ্ত গরুর লাঙলের পরিবর্তে আধুনিক ট্রাক্টর ব্যবহার করলেও ছালাতের পর দুই হাত তুলে মোনাজাতের সুন্নাতকে (?) পরিত্যাগ করতে পারেন না। এক সময় মানুষ কলেরা হলে পানি খেতে নিষেধ করত। তাদের ধারণা ছিল, এতে শরীরে রোগের প্রকোপ বাড়বে। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের কল্যাণে বাপ-দাদার সেই ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে কলেরা রোগীকে অধিক পানি পানের পরামর্শ দেওয়া হয়। অথচ মৃত্যুর পর প্রচলিত মীলাদ মাহফিল, কুলখানী, চেহলাম ও চল্লি­শার মত স্পষ্ট বিদ‘আতকে পরিহার করতে পারি না। যা মৃতের কবরে ছওয়াব পেঁŠছানোর পরিবর্তে কেবল গোনাহই বৃদ্ধি করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের পূর্বপুরুষ যদি কোন ভুল করে থাকেন, তা বুঝতে পারার পর পরিহার করার দায়িত্ব আমাদের। তাদের ভুলকে শুদ্ধ প্রমাণের পরিবর্তে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা যরূরী।

মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে আদম (আঃ) অবতরণের পরই আমরা আল্লাহর নিকট আহাদে আলাস্ত বা তার দাসত্ব করার অঙ্গীকার করেছি। এক্ষণে পূর্বপুরুষদের উপরে দায় চাপিয়ে মুক্তি লাভের কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন,أَنْ تقُولُوْا يوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ، أَوْ تقُولُوْا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِّن بعْدِهِمْ أَفتهْلِكُنَا بِمَا فعَلَ الْمُبْطِلُونَ، وَكَذَلِكَ نفَصِّلُ الآيَاتِ وَلَعَلَّهُمْ يرْجِعُونَ- ‘(আমি পৃথিবীতে আবাদ করার আগেভাগে তোমাদের অঙ্গীকার এজন্যেই নিয়েছি) যাতে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন একথা বলতে না পার যে, (তাওহীদ ও ইবাদতের) এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না’। ‘অথবা একথা বলতে না পার যে, শিরকের প্রথা তো আমাদের পূর্বে আমাদের বাপ-দাদারা চালু করেছিল। আমরা হ’লাম তাদের পরবর্তী বংশধর। তাহ’লে সেই বাতিলপন্থীরা যে কাজ করেছে, তার জন্য কি আপনি আমাদের ধ্বংস করবেন’? আল্লাহ বলেন, ‘বস্ত্ততঃ এভাবে আমরা (আদিকালে ঘটিত) বিষয়সমূহ সবিস্তারে বর্ণনা করলাম, যাতে তারা (অর্থাৎ অবিশ্বাসীরা আমার পথে) ফিরে আসে’ (আ‘রাফ ৭/১৭২-১৭৪)

২. আলেমদের অন্ধ অনুকরণ : যুগে যুগে পথহারা মানব সমাজকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে সেই ধারা বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর নবীদের উত্তরাধিকারী হিসাবে আলেমগণ এই গুরু দায়িত্ব পালন করছেন। তবে তাদের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা কখনোই নবীদের সমপর্যায় নয়। তারা নবীদের ন্যায় নিষ্পাপ ও বিনা বাক্যে অনুসরণীয় নন। বরং তাদের সকল কথা অহি-র বিধানের মানদন্ডে যাচাই করতে হবে। অন্যথায় বনু ইস্রাঈলের ন্যায় বিপথগামী হ’তে হবে।

আদী বিন হাতেম বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এলাম, তখন আমার গলায় স্বর্ণ (বা রৌপ্যের) ক্রুশ ঝুলানো ছিল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমার গলা থেকে ঐ মূর্তিটা ফেলে দাও। এ সময় তিনি সূরা তওবাহর ৩১ আয়াতটি পাঠ করছিলেন। যেখানে বলা হয়েছে,اتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ ‘ইহূদী-নাছারাগণ আল্লাহ্কে ছেড়ে তাদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে’ (তওবা ৯/৩১)। তখন আমি বললাম, لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ ‘আমরা ওদের ইবাদত করি না’। রাসূল (ছাঃ) বললেন,أَلَيْسَ يُحَرِّمُوْنَ مَا أَحلَّ اللهُ فَتُحَرِّمُونَهُ وَيُحِلُّونَ مَا حرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّونَهُ؟ ‘তোমরা কি ঐসব বস্ত্তকে হারাম করো না, যা আল্লাহ হালাল করেছেন? অতঃপর লোকেরাও তা হারাম করে? তোমরা কি ঐসব বস্তকে হালাল করো না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন? অতঃপর লোকেরাও তা হালাল করে? ‘আদী বললেন, হ্যঁা। রাসূল (ছাঃ) বললেন, فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘এটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।[3]

উক্ত হাদীছের ও কুরআনী আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) ও যাহহাক বলেন,لَمْ يَأْمُرُوهُمْ أَنْ يَسْجُدُوا لَهُمْ، وَلَكِنْ أَمَرُوهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ، فَأَطَاعُوهُمْ، فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَلِكَ أَرْبَابًا- ‘ইহূদী-নাছারাদের সমাজনেতা ও ধর্মনেতাগণ তাদেরকে সিজদা করার আদেশ দেননি। বরং তারা তাদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার কাজে নির্দেশ দিতেন এবং তারা তা মান্য করত। সেকারণ আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ হিসাবে অভিহিত করেছেন’।[4] ইহূদী-নাছারা ধর্মনেতাদের এই অপকর্ম বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মাদীকে আলেমদের অন্ধ অনুকরণ থেকে সতর্ক করেছেন।

দুনিয়ালোভী ইহূদী পন্ডিতদের কর্মকান্ড বর্ণনা করে অন্যত্র আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ كَثِيرًا مِنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا ينْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللهِ فبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ- ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই বহু (ইহূদী) আলেম ও (নাছারা) দরবেশ মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে এবং লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। বস্ত্তত যারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করে, অথচ তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে তুমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিভোগের সুসংবাদ দাও’ (তওবা ৯/৩৪)

ইহূদী-নাছারাদের থেকে নযর ফিরিয়ে উম্মতে মুহাম্মাদীর দিকে তাকালেও আমরা অনুরূপ চিত্র দেখতে পাব। বর্তমান যুগেও একদল দুনিয়ালোভী আলেম ইহূদী পন্ডিতদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তারা মীলাদ মাহফিল, কুরআন ও কালেমাখানী, শবেবরাত, চল্লিশা, হাদিয়া ইত্যাদির নামে শুধু মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করেন। কখনো নিজ পকেট থেকে একটি টাকা বের করে কাউকে দেন না। নিজেদের এই রোজগারের পথ চালু রাখতে তারা কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা এমনকি বিকৃত করতেও কুন্ঠাবোধ করেন না। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাবধান করে বলেছেন,إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يرْفَعَ الْعِلْمُ وَيَثبُتَ الْجَهْلُ ‘ক্বিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে এবং মানুষের মাঝে অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করবে’।[5] তিনি আরো বলেন,إِنَّ اللهَ لَا يقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا ينتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ وَلَكِنْ يقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ حَتَّى إِذَا لَمْ يبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا فَسُئِلُوا فَأَفْتوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا- ‘আল্লাহ তা‘আলা মানুষের অন্তর থেকে ইলমকে টেনে বের করবেন না। বরং আলেমদের উঠিয়ে নেওয়ার (মৃত্যুর) মাধ্যমে ইলম উঠিয়ে নিবেন। এমনকি যখন কোন আলেম অবশিষ্ট থাকবেনা তখন লোকেরা মূর্খদেরকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করবে। তাদেরকে কোন মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে, তারা বিনা ইলমেই ফৎওয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরা গোমরাহ হবে এবং মানুষদেরকেও গোমরাহ করবে’।[6]

ইলম দিন দিন উঠে যাচ্ছে একথা কেউই অস্বীকার করবেন না। আমাদের সৌভাগ্য যে পূর্বসূরীরা সকল বিষয়ে কম-বেশী কিতাব লিখে গেছেন। যার অধিকাংশ কিতাবেই বন্দী থেকে গেছে। যৎসামান্যই আমরা মস্তিষ্কে ধারণ করতে পেরেছি। বড় শংকার বিষয় হ’ল, এই সামান্য অর্জনটুকুও আল্লাহভীরুতার অভাবে কোন উপকারে আসছে না। এজন্য জনৈক আরবী কবি বলেন,

لوكان للعلم شرف من دون التقى

لكان أشرف خلق الله إبليسُ

‘যদি তাক্বওয়া বিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত,

তবে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হ’ত’।[7]

এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল, আলেমগণ যদি এরূপ সত্য লুকিয়ে রাখেন তাহ’লে সাধারণ মানুষের করণীয় কী? তাদের তো প্রয়োজনীয় মাস‘আলা জানার জন্য তাদের দ্বারস্থ হ’তে হয়। উত্তর হ’ল আল্লাহভীরু ও নির্ভরযোগ্য আলেমের কাছে যান এবং কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীলভিত্তিক ফৎওয়া গ্রহণ করুন।

৩. মানবীয় বুদ্ধিকে অগ্রাধিকার প্রদান : আল্লাহ তা‘আলা তঁার সৃষ্টিকুলের মাঝে কেবল মানুষকেই জ্ঞান-বুদ্ধি ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন। একারণে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার অসীম জ্ঞানের তুলনায় মানুষের জ্ঞান অতি সামান্য। খিযিরের সাথে মূসা (আঃ)-এর নৌকায় ভ্রমণের এক পর্যায়ে একটা কালো চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে খিযির মূসা (আঃ)-কে বললেন,مَا عِلْمُكَ وَعِلْمِي وَعِلْمُ الخَلاَئِقِ فِي عِلْمِ اللهِ إِلَّا مِقْدَارُ مَا غَمَسَ هَذَا العُصْفُورُ مِنْقَارَهُ- ‘আমার ও আপনার এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতের জ্ঞান মিলিতভাবে আল্লাহর জ্ঞানের মুকাবিলায় সমুদ্রের বুক থেকে পাখির চঞ্চুতে উঠানো এক ফেঁাটা পানির সমতুল্য’।[8]

কিন্তু মানুষ কখনো কখনো আল্লাহ প্রদত্ত সামান্য জ্ঞানকে নিজের বিরাট অর্জন মনে করে অহংকারী হয়ে ওঠে। তখন অহি-র বিধানের উপর নিজের যুক্তি ও বুদ্ধিকে প্রাধান্য দেয়। তার মানবীয় ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যখন কোন কিছু অসম্ভব বলে মনে হয় তা অবিশ্বাস করে বসে। যেমন মক্কার কাফের-মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সশরীরে মি‘রাজ গমনকে বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ তখন মক্কা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত ঘোড়া বা উটে যাতায়াতের জন্য দু’মাস সময় লাগত। যা এক রাতেই ভ্রমণ করে মি‘রাজ থেকে ফিরে এসে সকাল বেলা যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লোকদের কাছে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন, তখন সবাই একে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে উড়িয়ে দিল এবং তঁাকে বিভিন্নভাবে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগল। অবশেষে যারা ইতিপূর্বে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ভ্রমণ করেছেন, এমন কিছু অভিজ্ঞ লোক তঁাকে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। সব প্রশ্নের যথাযথ জবাব পেয়ে তারা চুপ হ’ল বটে। কিন্তু তাদের অবিশ্বাসী অন্তর প্রশান্ত হয়নি। পক্ষান্তরে হযরত আবুবকর (রাঃ) একথা শোনামাত্র বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং বলেন, نَعَمْ، إِنِّي لَأُصَدِّقُهُ فِيْمَا هُوَ أَبْعَدُ مِنْ ذَلِكَ، أُصَدِّقُهُ بِخَبَرِ السَّمَاءِ فِي غَدْوَةِ أَوْ رَوْحَةِ. فَلِذَلِكَ سُمِّيَ أَبُو بَكْرٍ الصِّدِّيقَ- ‘আমি তাকে এর চাইতে অনেক বড় বিষয়ে সত্য বলে জানি। আমি সকালে ও সন্ধ্যায় তার নিকটে আগত আসমানী খবরসমূহকে সত্য বলে বিশ্বাস করে থাকি’। এ দিন থেকেই তিনি ‘ছিদ্দীক’ (صِدِّيْق) বা সর্বাধিক সত্যবাদী নামে অভিহিত হ’তে থাকেন’।[9] যুগে যুগে প্রকৃত ঈমানদারগণ আবুবকর (রাঃ)-এর ন্যায় আল্লাহ ও তঁার রাসূলের বাণীকে নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। অন্যদিকে কাফের ও মুনাফিকগণ যুক্তির আড়ালে অহি-র বিধানের অভ্রান্ত সত্যকে চাপা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করেছে।

যারা অহি-র বিধানকে নিজ বুদ্ধি দিয়ে পরিমাপ করতে চান তাদের জন্য আলী (রাঃ)-এর একটি চমৎকার উদাহরণ রয়েছে। তিনি বলেন,لَوْ كَانَ الدِّينُ بِالرَّأْيِ لَكَانَ أَسْفَلُ الْخُفِّ أَوْلَى بِالْمَسْحِ مِنْ أَعْلَاهُ، وَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صـ يَمْسَحُ عَلَى ظَاهِرِ خُفَّيْهِ- ‘যদি দ্বীন মানুষের যুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত হ’ত তাহ’লে মোজার নিচে মাসাহ করা উপরে মাসাহ করার চেয়ে উত্তম হ’ত। কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মোজাদ্বয়ের উপরে মাসাহ করতে দেখেছি’।[10]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আগুনে রান্না করা বস্ত্ত আহারের পর তোমরা ওযূ কর’। ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, আমরা কি গরম পানি পানের পরও ওযূ করব? তখন থেকে আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, يَا ابْنَ أَخِي، إِذَا سَمِعْتَ عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَدِيثًا فَلَا تَضْرِبْ لَهُ الْأَمْثَالَ- ‘হে আমার ভাতিজা! যখন তোমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কোন হাদীছ শুনবে তখন তার সামনে কোন উদাহরণ পেশ কর না’।[11] আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর শেষোক্ত বক্তব্যটি আমাদের জন্য উত্তম পথনির্দেশক। হাদীছের সামনে যুক্তি পেশ না করে মেনে নেওয়াই প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য। উল্লেখ্য যে, আগুনে রান্না করা বস্ত্ত খাওয়ার পর ওযূ করার বিধানটি পরবর্তীতে রহিত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আমল দ্বারা যা প্রমাণিত।

৪. অধিকাংশ মানুষের রায় গ্রহণ : সত্য বিমুখ মানুষের আরেকটি খেঁাড়া অযুহাত হ’ল অধিকাংশ মানুষের সমর্থন। প্রচলিত কোন আমল যদি কুরআন-হাদীছের দৃষ্টিতে ভুল প্রমাণিত হয়, তখন তারা বলে এতো মানুষ কি ভুল করছে! উত্তর হ’ল হ্যঁা, অধিকাংশ মানুষ ভুল করছে। আল্লাহ বলেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثرَ مَنْ فِيْ الْأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُوْنَ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ مَنْ يَضِلُّ عَنْ سَبِيْلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ- ‘অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সর্বাধিক জ্ঞাত কে তঁার পথ থেকে বিচ্যুৎ হয়েছে এবং তিনিই হেদায়াত প্রাপ্তদের বিষয়ে সর্বাধিক অবগত’ (আন‘আম ৬/১১৬-১১৭)

আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে অধিকাংশের রায়ের কোন মূল্য নেই। শরী‘আতে দু’টি বৈধ বিষয়ের মধ্যে কোনটি গ্রহণযোগ্য হবে, সেবিষয়েই কেবল অধিকাংশ জ্ঞানী ব্যক্তির রায় গ্রাহ্য হবে। কারণ মানুষের সিদ্ধান্ত ধারণা নির্ভর, চাই সে একজনের হোক বা অনেকের বাক্যে। কেবল আল্লাহর বাণীই সত্য। আর অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর বিধান মান্য করে না। আল্লাহ বলেন,لَقَدْ جِئنَاكُمْ بِالْحَقِّ وَلَكِنَّ أَكْثرَكُمْ لِلْحَقِّ كَارِهُونَ- ‘(জাহান্নামীদের আল্লাহ বলবেন,) আমরা (নবীদের মাধ্যমে) তোমাদের নিকট সত্যধর্ম (ইসলাম) নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু তোমাদের অধিকাংশ ছিলে সত্য গ্রহণে অনিচ্ছুক’ (যুখরুফ ৪৩/৭৮)

এছাড়া আল্লাহ কুরআনে বিভিন্ন স্থানে বলেছেন, অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ- ‘তাদের অধিকাংশই জানে না’ (আন‘আম ৬/৩৭, আ‘রাফ ৭/১৩১), - وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَشْكُرُونَ‘তাদের অধিকাংশই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না’ (ইউনুস ১০/৬০, নামল ২৭/৭৩), এছাড়াও আল্লাহ বলেন,بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ- ‘তাদের অধিকাংশই ঈমান আনয়ন করে না’ (বাক্বারাহ ২/১০০)। এজন্য ক্বিয়ামতের দিন আদম (আঃ)-কে উচ্চ আওয়াজে বলা হবে,إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكَ أَنْ تُخْرِجَ مِنْ ذُرِّيَّتِكَ بَعْثًا إِلَى النَّارِ، قَالَ: يَا رَبِّ وَمَا بَعْثُ النَّارِ؟ قَالَ: مِنْ كُلِّ أَلْف تِسْعَ مِائَةٍ وَتِسْعَةً وَتِسْعِينَ- ‘হে আদম! তোমার সন্তানদের মধ্য থেকে একদলকে জাহান্নামের দিকে বের করে দাও। তিনি বলবেন, হে প্রভু! জাহান্নামী দলের সংখ্যা কত হবে? আল্লাহ বলবেন, প্রতি হাযারে ৯৯৯ জন’ (বুখারী হা/৪৭৪১)

প্রিয় পাঠক! অধিকাংশ মানুষের অনুসরণ কখনো সুপথ প্রদর্শন করে না। বরং আল্লাহর অবাধ্য ও সীমলংঘনকারীর সংখ্যা বেশী। ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’ গণতন্ত্রের নামে এই কুফরী মতবাদে যারা বিশ্বাস করেন, তারা স্রেফ আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা করেন ও শিরকে লিপ্ত হন। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত সকল মতবাদ সীমাবদ্ধ, যা যাচাই-বাছাইয়ের দাবী রাখে। আল্লাহর বিধানই একমাত্র চূড়ান্ত সত্য ও সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য।

শেষকথা :

পৃথিবীর সকল মানুষকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ১. আল্লাহর বিধানের অনুসারী ও ২. প্রবৃত্তির পূজারী। এর মধ্যবর্তী একটি দল আল্লাহর বিধানের কিছু অংশ মানে ও কিছু অংশ অমান্য করে। এই সুবিধাবাদী গোষ্ঠীও মূলত দ্বিতীয় দলেরই অন্তর্ভুক্ত। এরা আল্লাহর বিধানের বিপরীতে যত যুক্তিই উপস্থাপন করুক সবই ভিত্তিহীন অমূলক। প্রকৃতপক্ষে সত্য গ্রহণের অনিচ্ছাই এসবের উৎপত্তিস্থল। স্কুল ফঁাকি দেওয়া ছাত্রের মিথ্যা অসুখের অভিনয় যেমন শিক্ষকের বুঝতে বাকী থাকে না, তেমনি এসব অযুহাতের পিছনে প্রকৃত কারণও আল্লাহর নিকট গোপন নয়। তাই আসুন! সকল মিথ্যা, ধেঁাকা ও ফঁাকি পরিহার করে আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করি এবং তঁার রাসূলের সুন্নাতকে অঁাকড়ে ধরি। এতেই আমাদের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন। আমীন!


[1]. ইবনু হিশাম ১/৪১৮।

[2]. আর-রাউযুল উনুফ ২/২২৩।

[3]. তাফসীর ইবনু জারীর হা/১৬৬৩২; তিরমিযী হা/৩০৯৫; ছহীহাহ হা/৩২৯৩; সনদ হাসান।

[4]. তাফসীর ইবনু জারীর (বৈরূত : ১৯৮৬ খৃ. ১০/৮০-৮১; হা/১৬৬৪১।

[5]. বুখারী হা/৫২৩১; মুসলিম হা/২৬৭১।

[6]. বুখারী হা/১০০; মুসলিম হা/২৬৭৩।

[7]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, নবীদের কাহিনী-১, পৃষ্ঠা ১৩।

[8]. বুখারী হা/৪৭২৭।

[9]. হাকেম হা/৪৪০৭, ৩/৬২; ছহীহাহ হা/৩০৬।

[10]. আবুদাঊদ হা/১৬২।

[11]. ইবনু মাজাহ হা/৪৮৫; সনদ হাসান।



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও