‘জি স্যার’ সংস্কৃতির অবসান চাই
আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক
আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক 4 বার পঠিত
একজন রাজনীতিবিদের গল্প আমরা অনেকেই জানি। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সে কেন এত দলবদল করে। তার নির্লিপ্ত উত্তর, আমি তো একটাই দল করি, সরকারী দল। এখন সরকার পরিবর্তন হ’লে আমি কী করব? আমাদের প্রশাসন বা রাজনৈতিক অঙ্গন টইটুম্বুর হয়ে আছে এমন অসংখ্য দুধের মাছিতে। যারা বাতাসের দোলার সাথে তাল মিলিয়ে দিক পরিবর্তন করতে অত্যন্ত পটু। একটি দল ক্ষমতাসীন হলেই সিজনাল সমর্থকদের হিল্লোল বয়ে যায়, মহড়া চলে নির্লজ্জ চাটুকারিতার।
সম্প্রতি পতিত স্বৈ^রাচার সরকারের দেশত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপ ফঁাস হয়। কথোপকথনে তার এক কর্মীকে মাত্র কয়েক মিনিটে ১৫৩ বার ‘জ্বী আপা’ ‘হ্যঁা আপা’ বলতে শোনা যায়। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু তার ‘পলিসিমেকারস জার্নাল : ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি’ নামক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে লিখেছেন, ভারতে মিনিটে ১৬ বার স্যার শোনার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। অর্থাৎ একজন কর্মকর্তা তার উর্ধ্বতনের সাথে কথা বলতে গেলে প্রতি মিনিটের প্রায় ১৩ সেকেন্ড সময় ব্যয় করে স্যার বলাতে। বারবার এমন স্যার, ম্যাডাম বা আপা সম্বোধন মূলত দীর্ঘদিনের তোষামোদী সংস্কৃতির ফল। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশগুলোতে স্বীয় কর্তৃত্ব এবং প্রভুত্ব যাহির করতে ‘স্যার’ শব্দের প্রচলন ঘটায়। ইংরেজরা চলে গেছে। কিন্ত তাদের কুচকানো ভ্রু এখনো রয়ে গেছে। ‘সাহেব ও মোসাহেব’ কবিতায় কাজী নজরুল এদেশে তোষামোদের দৃশ্য চিত্রায়িত করেছেন এভাবে- সাহেব কহেন, ‘চমৎকার! সে চমৎকার!’ মোসাহেব বলে, ‘চমৎকার সে হতেই হবে যে! হুজুরের মতে অমত কার?’ সাহেব কহেন, ‘কী চমৎকার, বলতেই দাও, আহা হা!’ মোসাহেব বলে, ‘হুজুরের কথা শুনেই বুঝেছি, বাহাহা বাহাহা বাহাহা!’
এই তোষামোদী শ্রেণীর চাটুকারিতার কারণে উচ্চপদস্থ নেতা-নেতৃদেরও জ্বী স্যার শোনার ঔপনিবেশিক মানসিকতা শক্ত ভিত লাভ করে। আমাদের উপযেলার ইউএনও হিসেবে একবার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অগ্রজ শাপলা আপা (ছদ্মনাম)। একদিন শুনতে পেলাম, শাপলা আপা বিরাট হুলস্থুল কান্ড বাধিয়ে বসে আছেন। স্থানীয় একজন মুরববী নাকি তাকে স্যার না বলে বইন বা আপা বলে সম্বোধন করেছেন। ফলে তিনি বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে হুঙ্কার দিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার সুখ্যাতি লাভ করেছেন। পবিত্র কুরআনে নিজেকে নিয়ে ফ্যাসিনেশনে ভুগতে নিষেধ করে বলা হয়েছে,فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى ‘অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। তিনি সর্বাধিক অবগত কে আল্লাহকে ভয় করে’ (নাজম ৫৩/৩২)।
সরকারী আমলাদের স্যার সম্বোধন করতে হবে এমন আইন পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই। উন্নত বিশ্বের নাগরিকরা আমলাদের নাম ধরে সম্বোধন করে থাকেন। কিন্তু আমাদের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের এই দেশে আমলাদের স্যার ডেকে ফেনা তুলেও নাগাল পাওয়া যেখানে দুষ্কর, সেখানে তাদের নাম ধরে ডাকা অবশ্যই বিলাসিতা।
মন্ত্রী-আমলাদের সম্বোধন দেখলে মনে হয়, জ্বী হুজুর, আজ্ঞে মহারাজ, অবশ্যই স্যার বলাই যেন তাদের প্রধান দায়িত্ব। নেতার সকল কথায় হ্যঁা-সূচক সম্মতি দেওয়ার জন্যই যেন তাকে মাস শেষে বেতন দেওয়া হয়। এই চাটুকারি স্বভাব ইসলামী ও নৈতিক চেতনার বিরোধী। যা নেতাকে আত্মম্ভরি ও অহংকারী করে তোলে। তিনি তখন ভালো-মন্দ বিবেচনার উর্ধ্বে নিজের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেন। আর তাদের হঠকারি সিদ্ধান্তের ফলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়।
আমরা ইসলামের ইতিহাসে লক্ষ্য করলে এমন অনেক ঘটনা দেখতে পাই, যেখানে ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর মতের বিরোধিতা করেন। অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ছাহাবীদের সে মতের পক্ষেই আয়াত নাযিল হয়। বদরের যুদ্ধে বিরোধী পক্ষের ৭০ জন বন্দী হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় পেঁŠছার পর এদের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য সকলকে নিয়ে পরামর্শে বসলেন। ওমর (রাঃ) বললেন, এদের সবাইকে হত্যা করা হউক। রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে লোক সকল! আল্লাহ এদের উপর তোমাদের বিজয়ী করেছেন। অথচ গতকাল এরা তোমাদের ভাই ছিল। ওমর (রাঃ) দঁাড়িয়ে পুনরায় তঁার আগের মত প্রকাশ করলেন। রাসূল (ছাঃ) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন আবুবকর (রাঃ) দঁাড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা মনে করি এদের মার্জনা করা হউক এবং বিনিময়ে মুক্তিপণ নেওয়া হৌক। এতে রাসূল (ছাঃ)-এর কালো মুখ উজ্জ্বল হ’ল এবং তাদেরকে ফিদইয়ার বিনিময়ে মুক্তি দিলেন (আহমাদ, মুসলিম, ইবনু কাছীর)।
এর পরদিন ওমর (রাঃ)-এর পরামর্শের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে আয়াত নাযিল হয়। আল্লাহ বলেন,مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُونَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الْأَرْضِ تُرِيدُونَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللَّهُ يُرِيدُ الْآخِرَةَ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ- لَوْلَا كِتَابٌ مِنَ اللَّهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ- ‘কোন নবীর পক্ষে বন্দীদের আটকে রাখা শোভনীয় নয়, যতক্ষণ না জনপদে শত্রু নির্মূল হয়। তোমরা দুনিয়ার সম্পদ কামনা কর। আর আল্লাহ চান আখেরাত। আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়। যদি (গণীমত ও মুক্তিপণ গ্রহণ তোমাদের জন্য হালাল হওয়ার ব্যাপারে) পূর্বেই লিখিত না থাকত, তাহলে (ফিদইয়া স্বরূপ) তোমরা যা নিয়েছ, সেজন্য তোমাদের উপর ভয়ংকর শাস্তি আপতিত হ’ত’ (আনফাল ৮/৬৭-৬৮)। এরূপ অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যা নেতার সকল কথায় জ্বী হুজুর বলার পরিবর্তে সুচিন্তিত মতামত প্রদানের ইঙ্গিত বহন করে।
অর্থনীতির ভাষায় চাহিদা ও জোগানের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কোন পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী জোগান বেশী হলে তার মূল্য কমে যায়। বর্তমানে দেশের আমলা এবং মন্ত্রী-আমলাদের নিকট চাটুকারিতার প্রবল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হ’ল, তাদের চাহিদার চেয়ে জোগান অনেক বেশী। তাই উনারা প্রায় ফ্রীতেই চাটুকারিতা পেয়ে যান। ফলে স্যার শব্দটি আগের মতো গুরুত্ব ও অর্থ বহন করে না।
নেতার কানের কাছে চায়ে চিনি কম হবে নাকি বেশী হবে, সেটা জিজ্ঞেস করার সময় কৌশলে ছবি তুলে ফেইসবুকে পোস্ট দিতে হবে ‘নেতার সাথে একান্ত আলাপচারিতা! আর নেতারাও ভক্তের এমন গদগদ ভক্তিতে আহ্লাদিত হয়ে যান। অথচ পবিত্র কুরআনে মুনাফিক নেতাদের সম্পর্কে সতর্ক করে বলা হয়েছে,لَا تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَفْرَحُوْنَ بِمَا أَتَوْا وَيُحِبُّوْنَ أَنْ يُحْمَدُوْا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوْا فَلَا تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِنَ الْعَذَابِ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ- ‘যেসব লোকেরা তাদের কৃতকর্মে খুশী হয় এবং তারা যা করেনি, এমন কাজে প্রশংসা পেতে চায়, তুমি ভেব না যে, তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। বস্ত্তত তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১৮৮)।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার লাল সূর্যটি অস্তমিত হওয়ার পর থেকে প্রায় তিনশ বছর যাবৎ আমরা এই গোলামী ও তোষামোদীর মানসিক চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার সুবাদে সিনিয়রদের প্রাপ্ত সম্মান প্রদান করতে বা ‘স্যার’ বলে ডাকা দোষের কিছু না। কিন্তু এই জ্বী স্যারের ব্যবহার সীমিত করতে হবে। অতিরিক্ত স্যার ডাকা বা শোনার আকুলতা এক ধরনের অসুস্থতা। বলা হয় ‘চাটুকারিতা চুইংগামের মত’। এটাকে উপভোগ করা যায়, তবে গিলতে নেই। চাটুকারিতা সুগন্ধির মতো- এটার সুঘ্রাণ নেয়া চলে, কিন্তু গলধঃকরণ করতে নেই। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُعْجِبُكَ قَوْلُهُ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيُشْهِدُ اللَّهَ عَلَى مَا فِي قَلْبِهِ وَهُوَ أَلَدُّ الْخِصَامِ- ‘জাগতিক জীবনে একদল মানুষের কথা আপনাকে মুগ্ধ করবে এবং অন্তরের কথার ব্যাপারে তারা আল্লাহকে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করে। প্রকৃতপক্ষে সে হচ্ছে ভীষণ ঝগড়াটে ব্যক্তি’ (বাক্বারাহ ২/২০৪)।
তাছাড়া এজাতীয় তোষামোদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর সুস্পষ্ট নীতি হ’ল, ‘মুখোমুখি প্রশংসা করা ও নেওয়া হ’তে দূরে থাক, কারণ তা যবেহ’।[1]
আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অপর হাদীছে এসেছে,سَمِعَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم رَجُلًا يُثْنِيْ عَلَى رَجُلٍ وَيُطْرِيْهِ فِيْ مَدْحِهِ فَقَالَ أَهْلَكْتُمْ أَوْ قَطَعْتُمْ ظَهَرَ الرَّجُلِ, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তির প্রশংসা করতে শুনে বলেন, ‘তোমরা তাকে ধ্বংস করে দিলে বা তোমরা তার মেরুদন্ড ভেঙে ফেললে’।[2] এ কারণে ছাহাবীরাও রাসূল (ছাঃ)-এর আশেপাশে চাটুকারদের ভিড়তে দিতেন না।
আবু মা‘মার (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, কোনো একদিন এক ব্যক্তি দঁাড়িয়ে কোনো এক প্রশাসকের সামনেই তার প্রশংসা করতে শুরু করে। এতে মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) তার মুখমন্ডলে ধুলাবালি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং বলেন, أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ نَحْثُوَ فِيْ وُجُوْهِ المَدَّاحِيْنَ التُّرَابَ- ‘রাসূল (ছাঃ) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন চাটুকারের মুখে ধুলাবালি নিক্ষেপ করি’ (তিরমিযী হা/২৩৯৩)। আর রাসূল (ছাঃ)-এর এ কথাও স্মরণীয় যে, وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ، لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ ‘কর্মে যে পিছিয়ে পড়ে, বংশ মর্যাদা তাকে টেনে তুলতে পারেনা’ (মুসলিম হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/২০৪)।
আধিপত্য বিস্তারে ‘আমি সঠিক’ ও ‘আমিই সকলের চেয়ে উৎকৃষ্ট’ এই কূপমন্ডুকতা, মানুষের একধরনের মোহ। তোষামোদকারীরা প্রভুর এই প্রয়োজনটি মেটায়। সকল প্রাণীর মাঝে কুকুর যে মানুষের গৃহাভ্যন্তরে এতখানি ঠাঁই পেয়েছে, তার বড় কারণ কুকুরের অতুলনীয় প্রভুভক্তি। সুতরা আসুন সততা, ন্যায়পরায়নতা এবং আমানতদারিতার মাধ্যমে মানব মাঝারে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা যশ- খ্যাতির জন্য অসাধু পন্থা কোনোভাবেই কাম্য না।
-আব্দুল্লাহ আল মুছাদ্দিক
বিএসএস (সম্মান) এমএসএস, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]
[1]. ইবনে মাজাহ ৩৭৪৩; ‘প্রশংসা বা চাটুকারিতা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. বুখারী হা/২৬৬৩; মুসলিম হা/৩০০১; আহমাদ ১৯৭০৭।