শায়খ ছালেহ বিন মুহাম্মাদ আল-লুহাইদান (রহঃ)
যহুরুল ইসলাম
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 4 বার পঠিত
শায়খ আব্দুল হামীদ ইবনু বাদীস (১৮৮৯-১৯৪০) আলজেরিয়ার ইসলামী জাগরণের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব এবং আরব বিশ্বে ধর্মীয় সংস্কার ও পুনর্জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। খ্যাতনামা এই সালাফী বিদ্বান আলজেরিয়ার অধিবাসীদের ইসলামী ও আরব পরিচয়ে জোরদার করে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কাজ করেন। এছাড়া তিনি আলজেরিয়ার মুসলিমদেরকে শিরকী ও বিদআ‘তী সকল ভ্রান্ত বিশ্বাস পরিহার করে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আক্বীদা ও আমল শুদ্ধ করার আহবান জানান।
জন্ম ও পরিচয় : শায়খ আব্দুল হামীদ ইবনু মুছতফা ইবনু মাক্কী ইবনু বাদীস ১৮৮৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর আলজেরিয়ার কনস্ট্যান্টাইন শহরের আন্দালুসীয় বংশোদ্ভূত এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারটি মূলত ইফ্রিকিয়ার ১১ শতকের শাসক জিরিদ রাজবংশ থেকে উদ্ভূত। শায়খের দাদা মাক্কী ইবনু বাদীস (মৃত্যু ১৮৮৯) একজন কাযী ছিলেন। তার পিতা মুহাম্মাদ মুছতফা ছিলেন অতিরিক্ত বিচারপতি এবং ঔপনিবেশিক সংসদের আর্থিক প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য। তঁার মাতাও একটি সম্ভ্রান্ত ধর্মপ্রাণ ও রক্ষণশীল পরিবারের মহিলা ছিলেন।
শিক্ষাজীবন : শায়খ ইবনু বাদীস কনস্ট্যান্টাইনের একটি মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ১৩ বছর বয়সে কুরআন মুখস্থ করেন। এরপর তিনি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন শিক্ষার্জন করে ১৯০৮ সালে তিউনিস ভ্রমণ করেন এবং সেই সময়ের ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র যায়তুনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ইসলামী শরী‘আহ এবং আরবী ভাষা সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন এবং ১৯১২ সালে তিনি উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
এসময় তিনি অনেক আলেমের সান্নিধ্য লাভ করেন, যারা তার ব্যক্তিত্ব এবং ইসলামী জ্ঞান অর্জনের পথে গভীর প্রভাব ফেলেন। বিশেষ করে শায়খ মুহাম্মাদ নাখলীর সান্নিধ্য তাকে পীর পূজার মত ভ্রান্ত ধর্মীয় বিশ্বাস ও তাক্বলীদে শাখছী থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে সচেতন করতে অনুপ্রাণিত করে। শায়খ মুহাম্মাদ তাহের ইবনু আশুরের নিকট তিনি আরবী ভাষার সৌন্দর্য ও মহিমা উপলব্ধি করেন। শায়খ বাশীর সাফার তাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের সমসাময়িক সমস্যা যেমন পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিকতা এবং এর সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলার প্রতি আগ্রহী করে তুলেন।
কর্মজীবন : শায়খ ইবনু বাদীস যায়তুনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে সেখানেই এক বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯১৩ সালে আলজেরিয়ায় ফিরে আসেন এবং কনস্ট্যান্টাইনে বসবাস শুরু করেন। ১৯১৪ সালের শুরুর দিকে তিনি কনস্ট্যান্টাইন শহরের ‘আল-আখযার জামে মসজিদে’ (গ্রীন মসজিদ) শিক্ষাদান শুরু করেন। তিনি আরবী ভাষা ও ইসলামী জ্ঞান শেখানোর জন্য কয়েকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং আলজেরিয়ার জনগণের মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেন।
সংগঠন ও সংস্কার : ১৯৩৬ সালে, শায়েখ ইবনু বাদীস ‘আলজেরিয়ান মুসলিম কংগ্রেস’ (CMA) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে পরের বছর গ্রীষ্মে এই কংগ্রেস বিলুপ্ত হয়ে যায়। সে বছরই তিনি ‘আলজেরিয়ান মুসলিম উলামা সমিতি’ নামে আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর লক্ষ্য ছিল অজ্ঞতা ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আলজেরিয়ার জনগণের মুসলিম ও আরব পরিচয়ে পুনরুজ্জীবিত করা। শায়খ ইবনু বাদীস ও তার সংগঠনের কর্মীরা ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ কারী বিভিন্ন ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করার পাশাপাশি আলজেরিয়ান সংস্কৃতিকে ফরাসী অপসংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ছায়ায় বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করার প্রয়াস চালান। তিনি অন্যান্য আলেমদের সাথে নিয়ে আলজেরিয়ান দেশপ্রেমিকদের উপর ফরাসীদের দমন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তঁাকে অন্যদের পক্ষ থেকে ওয়াহ্হাবী ও লা-মাযহাবী গালি দেয়া হলে তিনি তঁার পত্রিকায় স্পষ্টভাষায় জবাব দেন- نحن لسْنَا أصحابَ مذهبٍ جديدٍ وعقيدةٍ جديدة، ولم يأْتِ محمّد بنُ عبد الوهّاب بالجديد، فعقيدتُنا هي عقيدةُ السَّلَف الصّالح، الّتي جاءت في كتاب الله وسُنّة رسوله، وما كان عليه السّلف الصّالح ... আমরা নতুন কোন মাযহাবের প্রবক্তা নই, নতুন কোন আক্বীদার প্রবক্তা নই, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল নতুন কিছু নিয়ে আসেননি। আমাদের আক্বীদা সালাফে ছালেহীনের আক্বীদা, যা কুরআন ও সুন্নাহে বর্ণিত হয়েছে এবং সালাফে ছালেহীন যার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন (মাজাল্লাহ আশ-শিহাব, ৫/৬ সংখ্যা, ৪০-৪২ পৃ.) ।
পত্রিকা প্রকাশ ও সাংবাদিকতা : শায়খ ইবনু বাদীস ১৯২৫ সালে কনস্ট্যানটাইন শহর থেকে ‘আল-মুনতাকিদ’ নামে একটি সমালোচনামূলক ও সংস্কারধর্মী পত্রিকা প্রকাশ করেন। যার লক্ষ্য ছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি ও ইসলামী মূল্যবোধ জাগ্রত করা। এতে তিনি একজন সাংবাদিক হিসাবে নিয়মিত ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডা এবং দখলদার ফরাসীদের সমালোচনা করতেন। ফলে ফরাসী ঔপনিবেশিক প্রশাসনের চাপে ১১টি সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
কিছুদিন পর তিনি একই উদ্দেশ্য নিয়ে ‘আশ-শিহাব’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। যা ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে ঔপনিবেশিক নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘আলজেরিয়ান মুসলিম উলামা সমিতি’ প্রতিষ্ঠার পর এটি সমিতির মুখপাত্র হিসাবে প্রকাশিত হ’ত। ১৯৩৯ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আজও এটি আলজেরিয়ার ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়।
মৃত্যু : দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভুগে ১৯৪০ সালের ১৬ই এপ্রিল মাত্র ৫০ বছর বয়সে শায়েখ ইবনু বাদীস মৃত্যুবরণ করেন। তার জানাযায় এক হাযার নারীসহ মোট আট হাযারের অধিক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে তঁার মৃত্যুর দিনটি আলজেরিয়ায় ‘ইয়াউমুল-ইলম’ তথা শিক্ষা দিবস হিসাবে পালিত হয়। ২০১৯ সালে আলজেরিয়ান বিখ্যাত লেখক আহমাদ মেনুর শায়েখ ইবনু বাদীসের জীবনকে উপজীব্য করে ‘For Both Their Sakes, I Lived’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন।