অপমান ছাড়াই সংশোধন

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 6 বার পঠিত

হঠাৎ একিদন রাস্তায় এক বৃদ্ধের সাথে এক যুবকের দেখা। যুবক একটু আগ বাড়িয়ে গিয়ে সম্বোধন করে বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করল, স্যার! আমাকে চিনতে পারছেন? উত্তরে বৃদ্ধ লোকটি বললেন, না! আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। অতঃপর বৃদ্ধ লোকটি জানতে চাইলেন তুমি কে? যুবক বলল, আমি এক সময় আপনার ছাত্র ছিলাম। ও আচ্ছা! এই বলে সেই বৃদ্ধ লোকটি যুবকের কাছে কুশলাদি জানার পর জিজ্ঞাসা করলেন, এখন তুমি কি করছ? যুবক অত্যন্ত বিনয়ের সাথে উত্তর দিল, আমি একজন শিক্ষক। বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় আছি।

সাবেক ছাত্রের মুখ থেকে পেশায় শিক্ষকতার কথা শুনে বৃদ্ধ শিক্ষক অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, ‘আহা কতই না ভাল, আমার মতো হয়েছ তাহ’লে। হ্যঁা ঠিক! আসলে আমি আপনার মত একজন শিক্ষক হ’তে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করি। তখন সেই যুবক অতীতের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলল, আপনি আমাকে আপনার মতো হ’তে অনুপ্রাণিত করেছেন স্যার। বৃদ্ধ শিক্ষক কিছুটা কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে যুবকের কাছে শিক্ষক হবার পিছনের কারণ জানতে চাইলেন। সেই যুবক তার শিক্ষক হয়ে ওঠার গল্প বলতে গিয়ে বৃদ্ধ শিক্ষককে স্কুলে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা স্মরণ করে দিল।

যুবক তখন বৃদ্ধ শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বলল, মনে আছে স্যার, একদিন আমার এক সহপাঠি বন্ধু একটি নতুন ঘড়ি নিয়ে ক্লাসে এসেছিল। তার ঘাড়িটা এতটাই সুন্দর ছিল যে, আমি আর লোভ সামলাতে পারিনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ঘড়িটা আমার চাই। অতঃপর আমি তার পকেট থেকে ঘড়িটা চুরি করি। কিছুক্ষণ পর আমার সেই বন্ধু তার পকেটে ঘড়ির অনুপস্থিতি টের পেয়ে যায়। এদিক-সেদিক খুঁজে না পেয়ে অবশেষে আপনার কাছে অভিযোগ করে।

তার এই অভিযোগ শুনে আপনি ক্লাসের সকল ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আজ ক্লাস চলাকালীন এই ছাত্রের ঘড়িটি চুরি হয়েছে। যে চুরি করেছ, দয়া করে ঘাড়িটা ফিরিয়ে দাও। আপনার কঠোর বার্তা শুনেও আমি ঘাড়িটা ফেরত দিইনি। কারণ এটি আমার কাছে খুব লোভনীয় ছিল। তারপর দরজা বন্ধ করে আপনি সবাইকে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লাসরুমের ফ্লোরের মধ্যে একটি গোলাকার বৃত্ত তৈরী করতে বললেন। অতঃপর সবাইকে চোখ বন্ধ করতে নির্দেশ দিলেন। এরপর ঘড়ি না পাওয়া পর্যন্ত আপনি এক এক করে আমাদের সবার পকেট খুঁজতে লাগলেন। আমরা সবাই আপনার নির্দেশ মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

আপনি প্রায় অর্ধেকের বেশী জনের পকেট চেক করলেন। একটা সময় আপনি যখন আমার পকেটে হাত দিয়ে ঘড়িটা খুঁজে পেলেন, তখন আমার সমস্ত শরীর কাঁপছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে ঘাড়িটা আমার পকেট পাবার পরও আপনি কিছু বলেননি। শেষ ছাত্র পর্যন্ত সবার পকেট চেক করেছিলেন। সবশেষ আপনি সবাইকে বললেন, ঘড়িটা পাওয়া গেছে। এবার তোমরা সবাই চোখ খুলতে পারো। ঘড়িটা পাবার পর আমার সেই বন্ধুটি আপনার কাছে জানতে চেয়েছিল ঘড়িটা কার পকেটে পাওয়া গিয়েছে? আপনি তাকে বলেছিলেন, ঘড়িটা কার পকেটে পাওয়া গেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং তোমার ঘড়িটা পাওয়া গেছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সেই দিনের ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে আপনি আমার সাথে কোনো কথা বলেননি। এমনকি সে কাজের জন্য আপনি আমাকে তিরস্কারও করেননি। নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য আপনি আমাকে স্কুলের কোনো কামরায় নিয়ে যান নি। সেই ঘটনা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক দিন। অথচ আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে, কৌশল অবলম্বন করে চুরি হওয়া ঘড়িটা উদ্ধার করলেন এবং আমার আত্মসম্মান রক্ষা করলেন। সে ঘটনার পর আমি অনেকদিন অনুশোচনায় ভুগেছি। ক্লাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশ সেদিন চলে গেলেও এর প্রভাব রয়ে যায় আমার মনের মধ্যে। বিবেকের যুদ্ধে বার বার দংশিত হয়েছি।

তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এই সব অনৈতিক কাজ আর কখনো করব না। একজন ভাল মানুষ হব। একজন আদর্শ শিক্ষক হব। সত্যিকার অর্থে মানুষ গড়ার কারিগর হব। আপনার কাছ থেকে সে দিন আমি স্পষ্টভাবে বার্তা পেয়েছিলাম, প্রকৃতপক্ষে কি ধরনের একজন শিক্ষাবিদ হওয়া উচিত। অপমান ছাড়াই মানুষকে সংশোধন করা যায়, সেটা আপনার কাছ থেকে শিখেছি। আপনার উদারতা এবং মহানুভবতা আজ আমাকে শিক্ষকের মর্যাদায় আসীন করেছে। 

সাবেক ছাত্রের আবেগঘন কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে বৃদ্ধ শিক্ষক বললেন, হ্যাঁ সেই ঘটনা আমার খুব ভালো মনে আছে। চুরি হওয়া ঘড়িটা আমি সবার পকেটে খুঁজেছিলাম। কিন্তু আমি তোমাকে মনে রাখিনি। কারণ তোমাদের খেঁাজার আগেই রুমাল দিয়ে আমার চোখও বেঁধে ফেলেছিলাম। ফলে আমি কার পকেট থেকে ঘড়িটি পেয়েছি তা আমি নির্ধারণ করিনি।

শিক্ষা : ছোট-বড় সকলেরই আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। তাই বেত্রাঘাত বা অপমানজনক শাস্তিই সংশোধনের হাতিয়ার নয়। বরং উত্তম কথা, উত্তম পরামর্শ বা উত্তম আচরণের মাধ্যমেই সকলের হৃদয়ে প্রভাব ফেলা যায়। আর এর দ্বারা স্থায়ী সংশোধনও করা যায়।



আরও