বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ-এর বার্ষিক ক্যালেন্ডার ২০২৪ পরিচিতি
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 6 বার পঠিত
[ইউরোপে ইসলামের আগমন ও বিকাশ ইসলামের ইতিহাসের একটি গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়। মুসলিম শাসনের স্বর্ণযুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল মুসলমানদের ইউরোপ বিজয়। আধুনিক স্পেন, পর্তুগাল, সাইপ্রাস, বলকান অঞ্চলসহ ইউরোপের একটা বড় অংশ মুসলমানরা শত শত বছর ধরে শাসন করেছিল এবং বিশ্ব সভ্যতার এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছিল। কালের আবর্তে এসব দেশ একসময় খৃষ্টানদের করতলগত হয়েছে। হারিয়ে গেছে ইউরোপে ইসলামের বর্ণাঢ্য পদচারণা। মুসলমানদের সেই হারানো ইতিহাসকে তরুণ প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই সাজানো হয়েছে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর বার্ষিক ক্যালেন্ডার ২০২৫।]
১. স্পেনে ইসলাম :
৭১১ খৃষ্টাব্দের ২৬শে মে। প্রাচীন আইবেরিয়ান উপদ্বীপ রাষ্ট্র স্পেন তথা আন্দালুস বিজয়ের মাধ্যমে রোমান সভ্যতার কেন্দ্রভূমি ইউরোপ মহাদেশে ইসলাম ও মুসলিম শাসনের ভিত্তি প্রোথিত হয়। উমাইয়া খলীফার তরুণ বীর সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ (মৃ. ৭২০ খৃ.) নৌবহর নিয়ে মরক্কো থেকে আফ্রিকা ও ইউরোপকে পৃথককারী জিব্রাল্টার (জাবালুত তারিক) প্রণালী অতিক্রম করে স্পেন জয় করেন। ফলে মুসলমানদের জন্য ইউরোপের দুয়ার উন্মুক্ত হয়। দলে দলে লোকজন ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। ইসলামী সাম্রাজ্য স্পেন ছাড়িয়ে ফ্রান্সে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষায় উত্তরে পীরেনীজ পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। কৃষ্ণসাগর ও ক্যাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী ককেশাস অঞ্চল, বাইজেন্টাইন কনস্টান্টিনোপল, বলকান অঞ্চল, ভূমধ্যসাগরীয় সিসিলী ও সাইপ্রাস দ্বীপ, রোডস দ্বীপ এবং আইবেরিয়া (স্পেন ও পর্তুগাল) সহ ইউরোপ মহাদেশের এ অঞ্চলসমূহে মুসলমানদের শত শত বছর গৌরবময় শাসন ছিল।
স্পেনে মুসলমানগণ ৭১১ থেকে ১৪৯২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৭০০ বছরের অধিককাল শাসন করেছেন। কিন্তু শাসকদের দুর্বলতা, পারস্পরিক কলহ, হিংসা-বিদ্বেষ, বিলাস-ব্যাসন এবং ক্ষমতা হারানো খৃষ্টান ক্রুসেডারদের ঐক্যবদ্ধ আক্রমণের ফলে স্পেনে ইসলামী সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। মুসলমানদের বিজিত ভূমি থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে বিতাড়িত করা হয়। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর অসভ্যতা জর্জরিত সমাজকে মুসলমানরা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, চিকিৎসা ও নৈপুণ্যশৈলীতে নির্মিত স্থাপত্যে বাগদাদের পাশাপাশি স্পেনকে করে তুলেছিল দীপ্তিময়। মুসলমানদের সেই ঐশ্বর্যমন্ডিত সোনালী ইতিহাসকে মুছে ফেলার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে খৃষ্টানরা। কর্ডোভায় প্রতিষ্ঠিত অনিন্দ্যসুন্দর কর্ডোভা জামে মসজিদকে গির্জায় পরিণত করে, মসজিদ সংলগ্ন কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয়, গ্রানাডার সাবিকা পাহাড়ে অবস্থিত আল-হামরা প্রাসাদ ধ্বংস করে এবং গ্রন্থাগারগুলোতে সংরক্ষিত লক্ষ লক্ষ দুর্লভ পান্ডুলিপি ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাদি আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়। বিভিন্ন প্রাসাদের আরবী লিপি, পাথরে খোদাইকৃত আরবী শিলালিপি এমনকি কারুশিল্পের সামান্যতম নিদর্শনাদিও ধ্বংস করতে ছাড়েনি তারা। মর্মন্তুদ নির্যাতন আর নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞের পরেও ইসলামী সভ্যতার বহু প্রাচীন নিদর্শন আজ অবধি স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে মাথা উঁচু করে দঁাড়িয়ে আছে।
২. পর্তুগালে ইসলাম :
উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল ঘেঁষে গড়ে উঠা পর্তুগাল মুসলমানদের হারানো ঐতিহাসিক রাষ্ট্র আন্দালুসের অংশ ছিল। বর্তমান পর্তুগিজ ভূমির বড় একটি অংশ তখন পশ্চিম আন্দালুসিয়ার অন্তর্গত ছিল। স্পেনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পর্তুগাল মুসলিম শাসনাধীন হয়। উমাইয়া খলীফা ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক (মৃ. ৭১৫ খৃ.)-এর গভর্নর, বিচক্ষণ সমরকুশলী এবং মরক্কো বিজেতা মূসা বিন নুসায়ের (মৃ. ৭১৬ খৃ.) সর্বপ্রথম পর্তুগালে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। অতঃপর টানা সাত শতাধিক বছর শাসন করার পর ইউরোপের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে ১৪২৯ খৃষ্টাব্দে এ দেশে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে এবং মুসলিমরা দেশত্যাগে বাধ্য হয়। ৭০০ বছরে গড়ে উঠা ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ ইউরোপীয়রা পুরোপুরি মুছে ফেলে। বহুদিন পর ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলিমরা পুনরায় পর্তুগালে ফিরে আসতে শুরু করে। ফলে মুসলিম শাসন অবসানের ৫৫৬ বছর পর ১৯৮৫ সালে রাজধানী লিসবনে মুসলমানদের জন্য নির্মিত হয় প্রথম মসজিদ। বর্তমানে সেখানে ৬৫ হাযারের কিছু বেশী মুসলমান বসবাস করে।
৩. সাইপ্রাসে ইসলাম :
ইউরোপ মহাদেশের ছোট্ট একটি দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাস। এটি ভূমধ্যসাগরের দ্বীপগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। সাইপ্রাসের পশ্চিমে গ্রীস, পূর্বে লেবানন, সিরিয়া ও ফিলিস্তীন, উত্তরে তুরস্ক এবং দক্ষিণে মিসর অবস্থিত। ক্ষুদ্র আয়তনের এই দেশটি মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত। যার চতুর্দিকে সমুদ্রের নীলাভ স্বচ্ছ পানিরাশি, বিস্তৃত সৈকত, পাহাড়-পর্বত আর মনোহর চিরহরিৎ বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত দেশটিকে অনন্য মহিমায় সুশোভিত করেছে। তৃতীয় খলীফা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর যামানার সিরীয় গভর্নর হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) সাইপ্রাসে নৌ অভিযান প্রেরণ করেন। আব্দুল্ললাহ ইবনে কায়স (রাঃ)-এর নেতৃত্বে গঠিত নৌবাহিনীতে আবুদ্দারদা (রাঃ), আবু যর গিফারী, উবাদাহ বিন ছামিত এবং তঁার স্ত্রী উম্মে হারাম বিনতে মিলহান (রাঃ) প্রমুখের ন্যায় বিশিষ্ট ছাহাবীগণ শামিল ছিলেন। সাইপ্রাস তখন বাইজেন্টাইনদের অধীনস্থ।
২৮ হিজরী তথা ৬৪৮ খৃষ্টাব্দে মুসলিম নৌবাহিনী সাইপ্রাসে আক্রমণ করলে বাইজেন্টাইনদের সাহায্য না পেয়ে দ্বীপের বাসিন্দারা মুসলমানদের সাথে সন্ধি চুক্তি করে। এভাবেই ইসলামী সাম্রাজ্য সর্বপ্রথম ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য বিস্তার করে। অতঃপর উমাইয়া শাসকগণ সাইপ্রাসকে তাদের খেলাফতের রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। একটা সময় ইউরোপীয়রা নৌশক্তি অর্জন করলে মুসলমানরা ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ হারায়। ফলে ধীরে ধীরে সাইপ্রাসসহ ভূমধ্যসাগর খৃষ্টানদের দখলে চলে যায়। ১৫৭১ খৃষ্টাব্দে ওছমানীয় খেলাফতকালে এটি পুনরায় খৃষ্টানদের কাছ থেকে মুসলমানদের অধিকারে আসে এবং ওছমানীয়রা ৩০০ বছর সাইপ্রাস শাসন করেন। ওছমানীয়দের হাত ঘুরে দ্বীপটি ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে চলে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে।
অতঃপর ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে ব্রিটিশরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় গ্রীস ও তুরস্ক ভবিষ্যতে সামরিক উদ্যোগ নিতে পারবে এমন এক বিধান রেখে সাইপ্রাসকে স্বাধীনতা প্রদান করে। এই সুযোগে ১৯৭৪ খৃষ্টাব্দে গ্রিক সেনাবাহিনী সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সাইপ্রাসের দক্ষিণাংশ দখল করে নেয় এবং তুরস্কও সেনাবাহিনী মোতায়েন করে উত্তরাঞ্চলের ৩৫ শতাংশ দখল করে নেয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বাফার জোনের মাধ্যমে সাইপ্রাসকে তুরস্ক ও গ্রীসের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। বর্তমানে সাইপ্রাসের তুরস্ক অধিকৃত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে টার্কিশ এবং গ্রীক অধিকৃত খৃষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬৫ শতাংশকেই মূলত সাইপ্রাস বলা হয়।
৪. বুলগেরিয়ায় ইসলাম :
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের ঐতিহাসিক বলকান অঞ্চলের দেশ বুলগেরিয়া মুসলমানদের এক হারানো অতীত। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ যেমন-আলবেনিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরী, কসোভো ও রোমানিয়ায় এক সময় মুসলমানগণ খৃষ্টানদের নাকের ডগায় বসে দাপটের সাথে শাসন করেছে। ওছমানীয় সুলতান প্রথম মুরাদ (মৃ. ১৩৮৯ খৃ.)-এর সময়ে বুলগেরিয়ায় ইসলাম প্রবেশ করে। সুলতান মুরাদ ১৩৬২ খৃষ্টাব্দে দক্ষিণ-পূর্ব বুলগেরিয়ার থ্রেস আক্রমণ করে পূর্ব থ্রেসের অন্তর্গত আদ্রিয়ানোপল বাইজেন্টাইন খৃষ্টান সম্রাটের কাছ থেকে জয় করেন এবং পরবর্তীতে সেটা সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। অতঃপর ১৩৬৩ খৃষ্টাব্দে রাজধানী সোফিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর প্লেলাভদিভ জয় করেন। ফলে রাজধানী বিজয়ের পথ প্রশস্ত হওয়ায় ১৩৮২ খৃষ্টাব্দে সোফিয়া ও বুলগেরিয়ার আশপাশের অঞ্চল ওছমানীয় সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। মুসলমানদের ক্রমাগত দাওয়াতের বদৌলতে অনেক বুলগেরিয়ান নাগরিক ইসলাম গ্রহণ করে।
১৩৯৩ খৃষ্টাব্দে সুলতান প্রথম বায়যীদ (মৃ. ১৪০৩ খৃ.)-এর হাত ধরে সমগ্র বুলগেরিয়া ওছমানীয়দের নিয়ন্ত্রণে আসে। পরবর্তী ৫০০ বছর বুলগেরিয়া ও বলকান অঞ্চলসমূহে ওছমানীয় সুলতানরা কর্তৃত্ব বজায় রাখে। কিন্তু মুসলমানদের ধর্মবিমুখতা, পারস্পরিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং দক্ষ ও শক্তিশালী প্রশাসকের অভাবে অর্জিত বিজয় কেতন অবনমিত হয়ে যায়। ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দের বার্লিন চুক্তির মাধ্যমে বুলগেরিয়ায় মুসলিম শাসন অবসানের সূচনা হয়। ১৯৮৪ খৃষ্টাব্দে কমিউনিস্টদের উত্থান হলে মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৮৯ খৃষ্টাব্দে প্রায় সাড়ে তিন লাখ তুর্কী মুসলিমদের জোরপূর্বক বুলগেরিয়া ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এভাবেই খৃষ্টানদের হাতে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় পাঁচশত বছরের মুসলিম শাসনের ঐতিহ্য। স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রয়ে যায় কয়েকটি মসজিদ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা মাত্র।