মানবিক সত্তা ও জৈবিক সত্তার দ্বৈরথ

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 154 বার পঠিত

একই মানুষের মাঝে দুই ধরনের আচরণ লক্ষ্য করে আমরা অনেক সময় হতবাক হই। সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হই যখন দেখি একজন আপাদমস্তক ভালো মানুষ এমন কাজ করে বসেছেন, যা তার দৃশ্যমান আচার-আচরণের সাথে মোটেও সামঞ্জস্যশীল নয়। এতদিন ধরে যাকে একভাবে চিনতাম, তার মাঝে হঠাৎ ভিন্ন মানুষ আবিষ্কার করে যারপরনেই বিস্ময় পেয়ে বসে। প্রতারিত বোধ হয়। তখন আতিপাতি ভেবেও দৈনন্দিন হিসাব-নিকাশ মেলাতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমরা বলে বসি, মানুষটা এমন হয়ে গেল কেন! ইনিই কি সেই নিত্য চেনা মানুষটি! আর সেটা যখন হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতকতা, মুনাফিকী আর গাদ্দারীর মত অপরাধের পর্যায়ে, তখন তা ধারণ করে ভিন্ন এক মাত্রা।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাইপোলার ডিজওর্ডার বা দ্বিপ্রান্তিক ব্যাধি নামে পরিচিত একটি মানসিক রোগ রয়েছে, যার ফলে সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ হঠাৎ হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভিন্নমুখী আচরণ করে। ভারসাম্যহীনতা ও স্ববিরোধিতার চরম অবস্থার কারণে একে বাইপোলার বা দুই মেরুর আচরণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তবে মানসিক রোগের বাইরে মানুষের মধ্যে সৃষ্টিগতভাবেই রয়েছে দুই ধরনের সত্তার বসবাস। একটি হল মানবসত্তা, অপরটি তার জীবসত্তা।

জীবসত্তা হ’ল তাই যা নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করেছে। অন্যান্য সকল প্রাণীর মত প্রতিটি মানুষ খাওয়া, ঘুম ও জৈবিক সাধারণ চাহিদাগুলো পূরণকে জীবনের দৈনন্দিন অপরিহার্য কর্ম হিসাবে গণ্য করে। আর মানবসত্ত্বা হ’ল সেই সত্তা যা তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে মানুষ হিসাবে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। এই দু’টি সত্তা প্রতিটি মানুষের মধ্যে সহাবস্থান করলেও মূলত তা দু’টি পরস্পর বিপরীতমুখী ধারা তৈরী করে, যা থেকেই সৃষ্টি হয় মানুষের মাঝে দ্বৈরথ এবং দ্বিচারিতা। একজন মানুষ একদিকে যেমন তার মনুষ্যত্বের কারণে বিবেকবান, সহানুভূতিশীল, নীতিবান; অন্যদিকে সেই একই মানুষ ভিন্ন মঞ্চে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পাশবিকতার কারণে লোভী, স্বার্থপর, প্রবৃত্তিপরায়ণ। এই দুই সত্তার চিরন্তন দ্বন্দ্ব একজন মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া এক মহা পরীক্ষার নাম, যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে তার ব্যক্তিত্ব, নির্ধারিত হয় তার গন্তব্য।

প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই দ্বিমুখী স্রোত রয়েছে। এই স্রোতকে যে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, যে জৈবিক সত্তাকে দমন করে মানবিক সত্তাকে উর্ধ্বে রাখতে পেরেছে সে-ই দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার পথে অগ্রগামী হয়েছে। আর যে নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে জৈবিক সত্তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, মানবিক সত্তার প্রতি অযত্নশীল হয়েছে, মানবিকতার আহবানকে উপেক্ষা করে পাশবিকতার দিকে ধাবিত হয়েছে; সে নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে ব্যর্থদের কাতারভুক্ত হবে। এদিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি সফলকাম, যে ব্যক্তি নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করল। আর ধ্বংস হ’ল সে যে তাকে কলুষিত করল (শামস ৯-১০)

মানুষকে পরীক্ষার জন্যই আল্লাহ মানুষের মধ্যে মানবিক বৈশিষ্ট্যের সাথে পাশবিক বৈশিষ্ট্যও দিয়েছেন। মানুষ যখন সত্য, ন্যায় ও নৈতিকতাকে প্রাধান্য দেয়, তখন মানবিকতায় পরিশুদ্ধ হয়। আর যদি সে লোভ, ক্রোধ, হিংসা, ঈর্ষা, প্রতিশোধপরায়ণতা, লালসা ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, তখন তার মন ও মনন কলুষিত হয়, সে অমানুষ হয়ে ওঠে এবং তার মাধ্যমে সমাজে অশান্তি, অন্যায় ও অবিচার ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই মানুষের প্রবৃত্তি মানুষকে খারাপ কাজের নির্দেশ দেয় (ইউসুফ ৫৩)। যারা এই আহবানে সাড়া দেয় তারা কখনও পশুর চেয়েও অধমে পরিণত হয়। তিনি বলেন, তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট (আ‘রাফ ১৭৯)

মানবীয় সত্তার এই দ্বৈরথের কারণেই মানুষ সদা পরিবর্তনশীল। একসময় ভালো তো আরেক সময় মন্দ। প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ ফিতরাতের উপর সৃষ্টি করেছেন বলে সে স্বভাবসুলভ মানবিক বিবেক নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু দিনে দিনে পারিপার্শ্বিকতা তার মধ্যে পাশবিক সত্তার উন্মেষ ঘটায়। একসময় সেই পাশবিক সত্তা যখন তার মানবিক সত্তার উপর বিজয়ী হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন চলে আসে। ফলে যে মানুষটা কিনা সর্বদা অন্যের দুঃখে দুখী হ’ত, অন্যের ব্যথায় কষ্ট পেত, সেও একদিন হয়ে ওঠে হায়নার মত হিংস্র। যে মানুষটা নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যকে বাঁচাবার পণ করেছিল, সময়ের বিবর্তনে সেও হয়ে ওঠে একজন প্রতিশোধপরায়ণ, বিকারগ্রস্ত নিষ্ঠুর জান্তবে। যে মানুষটা দু’দিন আগেও ছিল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের সহযোদ্ধা, স্বার্থের কলুষ দ্বন্দ্বে সে একদিন পরিণত হয় আপাদমস্তক ভিন্ন এক অচেনা মানুষে। যার সাথে ছিল গলায় গলায় মিল, আজ যেন তার ছায়া মাড়ানোও দুষ্কর। মানুষের এই নিন্দিত পরিবর্তন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থায়ী হয়ে যায়। খুব সীমিত হ’লেও কখনও কেউবা অনুশোচনার তাপে তওবার পথে ফিরে আসে। এভাবেই এগিয়ে চলে জগতের চিরন্তন এই দ্বৈরথ।

একজন আদর্শবান মানুষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হ’ল নিজের ভেতরকার জৈবিক সত্তার বিপরীতে মানবিক সত্তাকে বিজয়ী করার সাধনা। আর এই লড়াইয়ে তার জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হ’ল আল্লাহভীতি। এই ভয়ের বর্মই তার জন্যে প্রকৃত রক্ষাকবচ। কেননা প্রবৃত্তির মূল চালিকাশক্তি হ’ল শয়তান। যার আল্লাহভীতি নেই তার পক্ষে শয়তানী শক্তির মোকাবিলা করা অসম্ভব। এজন্য আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় সর্বোত্তম সম্বল হ’ল তাকওয়া। অতএব হে বিবেকসম্পন্নগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর’ (বাক্বারাহ ১৯৭)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, তার জন্যই রয়েছে জান্নাত (নাযিআত ৪০-৪১)। অতঃপর প্রয়োজন রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শের যথাযথ অনুসরণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনাদর্শকে সামনে রাখতে পারাই কুপ্রবৃত্তির ধ্বংসকারিতা থেকে বাঁচার শ্রেষ্ঠতম উপায় (নূর ৫৪)

সেই সাথে মানবিক গুণাবলীর অনুশীলন করতে হবে। ধৈর্য, সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ক্ষমা, দয়া, দান, সৎআমল, ভাল মানুষের সঙ্গ প্রভৃতির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করতে হবে ভেতরের মানবিক সত্তাকে জাগ্রত রাখার। অপরদিকে হারাম, অন্যায়, মিথ্যা, খেয়ানত, ভোগ, লালসা, পাপাচার, যিদ, ইগো, অহংকার ইত্যাদির কলুষতা ও কালিমা থেকে আত্মাকে পবিত্র রাখার চেষ্টা করে যেতে হবে অবিরাম। 

প্রিয় পাঠক, মানুষের মধ্যকার এই মানবীয় ও জৈবিক সত্তার দ্বৈরথ কোনদিন শেষ হবার নয়। তাক্বওয়া ও ইত্তিবার হাতিয়ারকে সাথে রেখে মানবিক গুণাবলীর অব্যাহত অনুশীলনই পারে আমাদের মনুষত্বকে সমুন্নত রাখতে। প্রবৃত্তির লালসা দমন করতে পারার মধ্যেই রয়েছে মানবীয় সত্তার স্বার্থক বিকাশ। এভাবে পাশবিক সত্তার উপর মানবিক সত্তাকে বিজয়ী করাই হোক আমাদের নিত্যকার সাধনা। এক্ষেত্রে কোনরূপ শিথিলতা বা অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে শয়তান যেন আমাদের চিন্তায়, মননে, কর্মজগতে জেঁকে বসতে না পারে, আমাদের মনুষত্বকে হরণ করতে না পারে। সে ব্যাপারে সদা সচেতন ও জাগ্রত থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন! আমীন!



আরও