পরহেযগারিতা
মুহাম্মাদ হাফীযুর রহমান
আরিফুল ইসলাম বিন আনিছুর রহমান 181 বার পঠিত
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ)-এর স্ত্রী রাঈতা (রাঃ) নিজের হাতে তৈরি জিনিস বিক্রি করে উপার্জন করতেন। তার সমস্ত উপার্জন পরিবারের পেছনে ব্যয় হওয়ায় তিনি ছাদাক্বা করতে পারতেন না। সেজন্য তিনি তিনি আফসোস করতেন। একদিন তিনি রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যা উপার্জন করি, তার সবই আমার পরিবারের জন্য ব্যয় হওয়ায় আমি ছাদাক্বা করতে পারি না। এজন্য কি আমি ছওয়াব পাব? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উত্তর দিলেন, পরিবারের জন্য ব্যয় করেও তুমি ছাদাক্বার ছওয়াব পাবে’।[1] এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পুরুষ ছাহাবীদের একই নছীহত রয়েছে। তিনি বলেন, ‘কোন মুসলিম যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার পরিবারের পেছনে ব্যয় করে, সেটাও তার জন্য ছাদাক্বা হবে’।[2]
ইসলামের স্বর্ণযুগে সমাজের প্রায় ৮০ ভাগ নারী ঘরে অবস্থান করতেন। ঘরে অবস্থান করায় তারা হীনমন্যতায় ভুগতেন না। বরং একজন মুজাহিদের মা, একজন মুজাহিদকে গর্ভে ধারণ করায় গর্ববোধ করতেন। প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ইমামগণের প্রত্যেকের বাবা খুব ছোট বয়সে অথবা জন্মের আগেই ইন্তেকাল করেন। তাদেরকে যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম হিসাবে গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর ছিলেন তাদের মা।
ইমাম মালেকের মা তাকে শিখিয়ে দেন কার কাছে গিয়ে ইলম অর্জন করতে হবে। মাত্র বিশ বছর বয়সে বিধবা হওয়া ফাতেমা বিনতু আব্দুল্লাহ জীবনে আর বিয়ে না করে সন্তানকে একজন আলেম বানাবেন, এটাকেই ক্যারিয়ার হিসাবে নেন। দুই বছরের কোলের শিশুকে নিয়ে ফিলিস্তীন থেকে মক্কায় যান। যাতে করে শ্রেষ্ঠ আলেমদের কাছ থেকে ছেলে ইলম শিখতে পারে। ছেলের লেখালেখীর জন্য সরকারী অফিস থেকে খাতাপত্র যোগাড় করে দেন। ছেলের শিক্ষকদের বেতনের টাকা যোগাড় করার জন্য কাজ করেন। সারাবিশ্ব এখন তাকে এক নামে চিনে ইমাম শাফেঈ (রহঃ) নামে।
দৃষ্টিশক্তি হারানো ছেলের দৃষ্টিশক্তি লাভের জন্য এক মা তাহাজ্জুদে আল্লাহর নিকট কান্না জড়িত দো‘আর ফলে আল্লাহ তাঁর ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। সেই ছেলেটির নাম শুনেনি এমন প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম হয়তো কমই আছে। সেই ছেলেটি হলেন ইমাম বুখারী (রহঃ)। কলিজার টুকরো ছেলের হত্যাকারী যালেম হাজ্জাজের সামনে আসমা বিনতে আবু বকরের ছুরির মতো ধারালো কথাগুলো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে।
ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক প্রসিদ্ধ আলেম আছেন যারা জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে মহিলাদের নিকট থেকেও উপকৃত হয়েছেন। যেমন ইমাম মালেক (রহঃ)-এর একজন প্রসিদ্ধ শিক্ষিকা ছিলেন ‘আমরাহ বিনতে আব্দুর রহমান। ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর একজন শিক্ষিকা ছিলেন নাফিসা বিনতে হাসান। ইবনু ‘আসাকির (রহঃ) ৮০ জনেরও বেশি মহিলার কাছ থেকে হাদীছ শিক্ষা লাভ করেন। ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ) তিনজন মহিলার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করেছিলেন। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানীর (রহঃ) শিক্ষিকা ছিলেন আয়েশা বিনতু আব্দুল হাদী। বিখ্যাত তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ) কোনো প্রশ্নের উত্তরে দ্বিধাগ্রস্ত হলে বোন হাফসা বিনতু সীরীনের পরামর্শ নিতে।
ইসলামের স্বর্ণযুগে স্ত্রীর বা মায়ের ভূমিকা পালন করা গর্বিত ৮০% নারীর পাশাপাশি আরো ২০% নারী ছিলেন যারা নিজেরাই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ইসলামের সোনালী সময়গুলিতে নারী শিক্ষার গুরুত্ব এবং তাদের অবদান ছিল অপরিসীম। তখনকার সময়ে ছহীহ বুখারীর কপি ছিল একটি দুর্লভ গ্রন্থ। যার একটি কপি কারিমা বিনতে আহমাদের কাছে ছিল। তিনি সেখান থেকে তাঁর ছাত্রদের পড়াতেন। বুখারীর কোনো হাদীছের মূল টেক্সট যাচাই করতে হলে তার কাছেই যেতে হ’ত। এই উদাহরণটি ইসলামের স্বর্ণযুগে জ্ঞানের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এক কথায় হাদীছ শেখা আর শেখানোর ক্ষেত্রে নারীদের কৃতিত্বের কথাগুলো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। তারা কেউই পর্দার বাইরে গিয়ে ইলম শিখেননি, ইলম শেখাননি। ফেৎনার ভয়ে এই ২০% নারী ইলম অর্জন থেকে বিরত থাকেননি। বরং তাঁদের কাছ থেকে যারা ইলম সংগ্রহ করেছেন, তাঁদের সেই সব ছাত্রদেরকে আমরা ইমাম-আলেম বলে সম্মান করি।
ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, ওলামায়ে কেরামের কারো পক্ষ থেকে এমন কথা পাওয়া যায় না যে, তিনি কোনো নারীর বর্ণনাকে নারী হবার কারণে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমন বহু হাদীছ রয়েছে যা একজন নারী বর্ণনা করেছেন আর গোটা উম্মত তা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। ইলমে হাদীছে যার সামান্যতম জ্ঞান রয়েছে একথা অস্বীকার করতে পারবেন না।
এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, কিন্তু বর্তমান সময়ের ফেমিনিস্টদের বাড়াবাড়ি এবং অপর পক্ষে এক শ্রেণীর ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধত্বের কারণে এই ঘটনাগুলো প্রায়শ উপেক্ষিত থাকে। অথচ কুরআন-হাদীছের টেক্সট আর সমাজের মেজোরিটি (৮০%) নারীদের উদাহরণ দেখিয়ে বাকি ২০% কে ঘরের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়নি। প্রয়োজনে পথ দেখানো হয়েছে, তাদেরকে সহযোগিতা করে কষ্ট কমানো হয়েছে। নারী বলে তাদেরকে অবহেলা করা হয়নি। তাদের ইলম অর্জন এবং শিক্ষাদানে বাধা দেওয়া হয়নি।
নারীদের জন্য আলাদা উদ্যোগ না নিয়ে তাদেরকে শুধু ঘরের দিকে ঠেলে দেওয়া একটি পরাজিত মানসিকতা ছাড়া কিছু নয়। দেশে এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে ফিৎনার আশঙ্কা নেই। যে সেক্টরে নারীদের জন্য ফিৎনা থাকতে পারে, সেখানে পুরুষদের জন্যও তেমনি ফিৎনা আছে। একটি মেয়ে যদি ভালো কোনো মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হ’তে চায়, তাকে ফিৎনার আশঙ্কায় আটকানো হয়, কিন্তু ছেলেকে সেখানে ভর্তি করা হয়। যে স্থানটি মেয়েদের জন্য ফিৎনা, তা কি ছেলেদের জন্যও ফিৎনা নয়?
জাল হাদীছের ফযীলত শুনে ছেলেকে চীনে পাঠানো হয় বিদ্যা অর্জনের জন্য, অথচ নারীদের ফিৎনার আশঙ্কায় মসজিদে তালা লাগানো হয়। ফিৎনার নামে যে বৈষম্য চলছে, সে বিষয়ে কোনো দৃষ্টি নেই। হ্যাঁ ফিৎনাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তবে মেয়েকে কেন ফিৎনার নামে আটকে রাখা হচ্ছে? তাদেরকে ইসলামের মৌলিক জ্ঞান অর্জন পর্যন্ত করতে দেওয়া হচ্ছে না। তাহ’লে এলাহী জ্ঞান ছাড়া একজন নারী কিভাবে মহিয়সী নারী হবেন?
অন্যদিকে নারী যদি শিখতে চায়, পড়তে চায়, সেই দায়িত্বটাকে পুরুষকে নিতে হবে। পুরুষ অর্থাৎ বাবা, ভাই যেন সেই সুযোগটা করে দেয়। নারীকে সুশিক্ষায় গড়ে তুললে হবে। ইসলামের প্রাপ্য অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা ও তাদের অন্যান্য অধিকারগুলোও তাদের হাতে তুলে দিন। সেটা আপনার দেওয়া গিফট না। বরং এটা তাদের প্রাপ্য। কারণ একজন আদর্শবান মা-ই পারেন একজন আদর্শবান সন্তান গড়ে তুলতে।
চিকিৎসা সেবায় নারীদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক যুদ্ধে নারীদের নিয়ে যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ আছে। যারা আহতদের সেবা-যত্নে নিযুক্ত থাকতেন। বর্তমান সময়ে মা-বোন, স্ত্রীর অপারেশনের জন্য অনেকেই একজন মহিলা ডাক্তার খুঁজে। কিন্তু একটা মেয়েকে ডাক্তার বানানোর জন্য সম্পূর্ণ পৃথক মহিলা মেডিকেল কলেজ চালুর উদ্যোগ কেউ নেয়না। যা প্রতিষ্ঠা পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হ’তে পারে।
বড় আশ্চর্যের বিষয় হ’ল নারীদের অধিকার আদায়ের নামে সমাজে কিছু নারীবাদী আছে। তাদের নোংরা যুক্তি শুনলে কথা বলার আর আগ্রহ থাকে না। তারা বলে একটা ছেলে যদি স্বাধীনভাবে বাড়ীর বাইরে ঘোরাফেরা করতে পারে তাহ’লে একটা মেয়ে কেনো পারবে না? নারীবাদীরা নারী আধিকারের নামে তাদেরকে রাস্তায় নামিয়ে এনেছে। ফলে একজন নারী ইসলামের নির্দেশনা উপেক্ষা করে তার রক্ষাকবচ বাবা-ভাই বা স্বামীকে ছাড়াই বাড়ীর বাইরে যাচ্ছে। ফলে ধর্ষণসহ নানাবিধ নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছে। কিন্তু এর দায় কে নেবে?
নারীরা যখন অধিকারের নামে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছে, তখন পুরুষদের বেকারত্ব বেড়েছে। সন্তানরা মায়ের যত্ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক সময় সন্তানদের সময় কাটানোর জন্য তাদের হাতে মরণঘাতি মোবাইল তুলে দিচ্ছে। অনেক পরিবারে মা-বাবা দু’জনেই চাকুরিজীবী হওয়ায় সন্তানদের কাজের বুয়ার কাছে রেখে কর্মক্ষেত্রে বেরিয়ে পড়ছেন। দেখতে দেখতে একদিন সন্তানরা মাদকাসক্ত কিংবা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ফলে ঐশী রহমানের মত পিতা-মাতাকে হত্যা করতে তাদের হৃদয় কাঁপে না। এমন অসংখ্য মা-বাবার আদর ছাড়াই বেড়ে ওঠা সন্তানরা বখাটে ছেলেদের সাথে মেশার সুযোগ পাচ্ছে। একথা অনস্বীকার্য যে, বখাটে সন্তানের জননী কখনই মহিয়সী মা হ’তে পারে না।
উল্লেখ্য যে, ‘পুরুষ তার পরিবারের অভিভাবক (কর্তা), তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’। অন্যদিকে নারীকে বলা হয়েছে- ‘নারী তার স্বামীর সংসারের কর্ত্রী। তাকে তার অধীনস্থদের (সন্তান) সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’।[3] ইসলামে পরিবারের খাওয়ানোর দায়িত্ব দিয়েছে পুরুষকে, ঘরের দায়িত্ব দিয়েছে নারীকে। আরেকটা হাদীছে এসেছে- নারী যদি সময়মতো ছালাত পড়ে, ছিয়াম রাখে, লজ্জাস্থানের হেফাযত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, তাহ’লে সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে’।[4]
মহিয়সী নারী হ’তে গেলে এলাহী বিধানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যশীলা হ’তে হবে। যে কোন পরিস্থিতিতে এলাহী বিধানের ফায়ছালা মেনে নিতে হবে। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বনু দীনার গোত্রের এক মহিলা। যিনি তার স্বামী, ভাই ও পিতার শাহাদাতের খবর শুনানো হ’লে তিনি ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেন ও তাদের জন্য ইস্তিগফার করেন। তবে রাসূল (ছাঃ) বেঁচে আছে কি না সে বিষয়ে জানার তার ঐকান্ত প্রচেষ্টা। এভাবে নারীরা যদি সার্বিক জীবনে ইসলামকে প্রাধান্য দিত তাহ’লে পারিবারিক অনেক সমস্যাকে আলিঙ্গন করতে পারত। এর ফলে সামান্য প্রাপ্তিটুকুতেই অনাবিল প্রশান্তি খুঁজে পেত।
ইতিহাসের পাতায় এমন অনেক সম্ভ্রান্ত স্বামীহারা নারী আছেন, যারা সন্তানদের নিয়েই বাকী জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। সন্তানদের আদর্শিক যোগ্য করে গড়ে তোলাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। ফলে বিশ্বখ্যাত মনীষীদের মা হওয়ার বদৌলতে তারা ইতিহাসের পাতায় মহিয়সী নারীর মর্যাদায় উন্নীত হ’তে পেরেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সমাজের দ্বীন সচেতন মাদেরকে প্রকৃত অর্থে মহিয়সী নারী হওয়ার তাওফীক দান করুন।- আমীন!
আরিফুল ইসলাম বিন আনিছুর রহমান
[প্রিন্সিপাল, বেংহাড়ী মৌলভীপাড়া দারুস সালাম ক্বওমী মাদ্রাসা, ফুলতলা হাট, বোদা, পঞ্চগড়]
[1]. মুসনাদে আহমাদ হা/ ৩/৬৬০-৬৬১।
[2]. বুখারী হা/৪০০৬।
[3]. বুখারী হা/২৪০৯, মুসলিম হা/১৮২৯; মিশকাত হা/৩৬৮৫।
[4]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৬৬১; মিশকাত হা/৩২৫৪।