যে কান্নায় আগুন নেভে [শেষ কিস্তি]

আব্দুল্লাহ 88 বার পঠিত

অধিক কান্নাকাটির জন্য তিরস্কার করায় কান্না : সাঈদ বিন সায়েব বিন ইয়াসার অধিক ক্রন্দনকারী বান্দাদের অন্যতম ছিলেন। একদা এক লোক কান্নার জন্য তাকে তিরস্কার করল। অতঃপর তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘তার উচিত ছিল অক্ষমতা ও অবহেলার জন্য আমাকে তিরস্কার করা। কেননা এ দু’টি আমার উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করেছে’।[1]

জানাযার সাথে যাওয়ার সময় কান্না : ইব্রাহীম বিন আশ‘আছ বলেন, ‘আমরা যখনই ফুযায়েলের সাথে কোন জানাযার উদ্দেশ্যে বের হতাম, তখন তিনি কবরস্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত আমাদেরকে এমনভাবে উপদেশ দিতেন, নছীহত করতেন এবং কান্নাকাটি করতেন, যেন তিনি তার সাথীদেরকে বিদায়ী জানিয়ে পরকালে পাড়ি জমাচ্ছেন’।[2]

প্রতিবেশীর গালমন্দে কান্না : ইবনু মা‘ঈন বলেন, ‘ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল-কাত্তানকে তার প্রতিবেশী গালমন্দ করত। সে এতে (প্রতিবেশীর গালমন্দে) অভ্যস্ত ছিল। আর সে বলত, এ হ’ল খাওযী, তখন আমরা মসজিদে ছিলাম। অতঃপর ইয়াহইয়া কাঁদতে কাঁদতে বললেন, সে সত্য বলেছে। কে আমি, আর কি আমি’? [3]

মৃত্যুর সময় কান্না : মুযানী বলেন, যে অসুস্থতায় শাফেঈ (রহঃ) মারা গিয়েছিলেন সে অসুস্থতার সময় আমি তার নিকট গেলাম। অতঃপর আমি তাকে বললাম, আপনি কিভাবে সকাল করেছেন? তখন তিনি মাথা তুলে বললেন, আমি সকাল করেছি এমন অবস্থায় যেন আমি আমার ভাইদের ছেড়ে পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি এবং আমি আমার মন্দ কর্মসমূহের সাথে সাক্ষাৎ করছি। আর আমি আল্লাহর নিকট উপনিত হচ্ছি এমতাবস্থায় যে, আমি জানিনা আমার আত্মা জান্নাতে যাওয়ার কারণে আমি খুশী হব নাকি আমার আত্মা জাহান্নামে প্রবেশ করায় আমি দুঃখিত হব। অতঃপর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন’।[4]

মু‘আয তার মৃত্যুর সময় কেঁদে কেঁদে বলেছেন, আমি কাঁদছি কেবল দ্বিপ্রহরের তৃষ্ণা, শীতের রাতের ছালাত ও যিকিরের মজলিসে যাওয়ার ব্যাপারে আলেমদের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য। আব্দুর রহমান ইবনুল আসওয়াদ মৃত্যুর সময় কান্নাকটি করেন এবং বলেন, ছালাত এবং ছিয়ামের জন্য তার আফসোস ছিল এবং তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। ইয়াযীদ আর রুক্বাশীও মৃত্যুর সময় কেঁদে কেঁদে বলেছেন, রাতের ছালাতের এবং দিনের ছিয়ামের ব্যাপারে তিনি আমাকে যে ফৎওয়া দিয়েছেন তার জন্যই আমি কান্নাকাটি করছি। হাফেয ইবনু রজব বলেন, যদি একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি নফল আমল ছেড়ে দেওয়ার কারণে লজ্জিত থাকে, তাহ’লে পাপীর অবস্থা কি হবে? [5]

মৃত্যুর সময় আমলের স্বল্পতার কারণে কান্না : আবু হুরায়রা (রাঃ) তার অসুস্থ অবস্থায় খুব কান্নাকাটি করছিলেন। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, কিসে আপনাকে কাঁদাচ্ছে? তিনি বললেন,أَمَا إِنِّي لَا أَبْكِىْ عَلَى دُنْيَاكُمْ هَذِهِ, وَلَكِنِّيْ أَبْكِيْ عَلَى بُعْدِ سَفَرِيْ, وَقِلَّةِ زَادِيْ, وَإِنِّيْ أَمْسَيْتُ فِيْ صَعُوْدٍ مُهْبَطَةٍ عَلَى جَنَّةٍ وّنَارٍ, وَلَا أَدْرِيْ إِلَى أَيِّهِمَا يُؤْخَذُ بِيْ ‘জেনে রাখ! আমি তোমাদের এই দুনিয়ার লোভে কাঁদছি না। বরং আমি কাঁদছি দীর্ঘ সফর শেষে (পরকালীন) পাথেয় স্বল্পতার কারণে। আর আমি এমন স্থানে সন্ধ্যা করেছি যার অবতরণস্থল জান্নাতে এবং জাহান্নামে। কিন্তু আমি জানি না, এ দু’য়ের মধ্যে কোনটিতে আমাকে নেওয়া হবে’।[6]

আমের বিন ক্বায়েস অসুস্থ অবস্থায় কাঁদছিলেন। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, কিসে আপনাকে কাঁদাচ্ছে? তিনি উত্তর দিলেন, আমার কি এমন হয়েছে যে আমি কাঁদব না? আমার থেকে কান্নার অধিক হকদার কে আছে? আল্লাহর শপথ! আমি দুনিয়ার লোভে কান্নাকাটি করি না। আর মৃত্যুর ভয়েও আমি কাঁদি না। বরং আমি দুনিয়াবী জীবনের সফর শেষে আখিরাতের পাথেয় স্বল্পতার কারণে কান্নাকাটি করি। আমি জান্নাত ও জাহান্নামের উত্থান-পতনের মাঝে উপনীত হয়েছি। কিন্তু আমি জানিনা, এ দু’টির কোনটিতে আমি যাব’।[7]

কামারের কাজ দেখে কান্না : মাতার আল-ওয়াররক বলেছেন, হুমামাহ ও হাযম ইবনু হাইয়ান সকালবেলা কামারের চুলার পাশ দিয়ে যাতায়াত করতেন। এসময় তারা লোহার দিকে তাকিয়ে দেখতেন, কিভাবে তাতে ফুঁক দেওয়া হয়। তখন তারা সেখানে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করতেন এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন’।[8]

ইলমহীন ব্যক্তির কাছে ফৎওয়া চাওয়ার কারণে কান্না : জনৈক ব্যক্তি রাবী‘আ বিন আব্দুর রহমানের কাছে প্রবেশ করে তাঁকে ক্রন্দনরত অবস্থায় পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কান্নার কারণ কী? অতঃপর তাঁর প্রচন্ড কান্নায় আতঙ্কিত হয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনার উপর কি কোনো বিপদ এসেছে? তিনি বললেন,لَا، وَلَكِنِ اسْتُفْتِيَ مَنْ لَا عِلْمَ لَهُ وَظَهَرَ فِي الْإِسْلَامِ أَمْرٌ عَظِيمٌ ‘না। তবে এমন লোকদের নিকট ফৎওয়া জানতে চাওয়া হচ্ছে, যাদের কোনো জ্ঞান নেই এবং এটি ইসলামে একটি বড় বিপদ রূপে দেখা দিয়েছে’। রাবী‘আ আরো বললেন,وَلَبَعْضُ مَنْ يُفْتِي هَا هُنَا أَحَقُّ بِالسَّجْنِ مِنَ السُّرَّاقِ ‘এখানে এমন কিছু লোক ফতোয়া দিচ্ছে, যারা চোরদের চেয়ে বেশি কারাগারে থাকার জন্য উপযুক্ত’।[9]

রাতের ছালাতে কান্না : হাসান ইবনু আহমাদ আল-মুযাক্কী বলেন, একবার আবু ইমরান আল-জুয়াইনী আমাদের বাসায় আসলেন। আর তিনি রাত্রি জাগরণ করে ছালাত আদায় করতেন এবং দীর্ঘক্ষণ কান্নাকাটি করতেন’।[10]

আযানের সময় কান্না : ওছায়মীন (রহঃ) বলেছেন, অধিক ক্রন্দনকারীগণ সাধারণ মানুষের চেয়ে ব্যতিক্রম হয়। তাদের কেউ কেউ তো বেশি কান্নাকাটি করে যে, তার সামনে ক্ষুদ্রতর কোন বিষয় উপস্থাপন করা হ’লেও কেঁদে ফেলে। একজন মুয়াযযিনের কথা আমার স্মরণ আছে, তিনি যখনأَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، বলতেন, তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়তেন। এমনকি আযান শেষ করতে পারতেন না। অন্যদিকে কিছু মানুষ খুবই কম কান্নাকাটি করে। এমন কি তাদেরকে উপদেশ দেওয়া হ’লেও কাঁদে না। তিনি আরো বলেছেন,لَا شَكَّ أَنَّ الْبُكَاءَ دَلِيْلٌ عَلَى لَيِّنِ الْقَلْبِ فِيْ الْغَالِبِ ‘এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ক্রন্দন করা অধিকাংশ সময় কোমল হৃদয়ের প্রতি ঈঙ্গিত করে’।

সালাফদের জীবনী পাঠের সময় কান্না : শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়ার সীরাত পড়ার সময় ক্রন্দন করা আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল আযীয আল-হাদলাকفَوَائِدُ مِنْ مَجَالِسِ شَيْخِنَا بَكَرِ بْنِ عَبْدُاللهِ أَبُوْ زَيْدِ শিরোনামে এক প্রবন্ধে বলেছেন, শায়খ বকর ইবনু আব্দুল্লাহ কোন এক রাত্রে আমাকে বললেন, শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর জীবনী পড়ার সময় বিধ্বস্ত অবস্থায় যদি তুমি আমাকে দেখতে! শায়খের জীবনের তীব্র প্রভাবে পরাজিত হয়ে আমার দু’চোখ কিভাবে বিগলিত ধারায় অশ্রু প্রবাহিত করে। হ্যাঁ! এটাই তো জীবন। আর আমরা তাদের থেকে কত দূরে...![11]

শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ)-এর কান্নার দৃষ্টান্ত : শায়খ বিন বায (রহঃ) প্রায়ই ইমামতি করার সময় কান্নায় ভেঙে পড়তেন, তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেন। কুরআন তেলাওয়াত শুনলে তিনি প্রায়ই কেঁদে ফেলতেন, তেলাওয়াতকারী যেই হোন বা তার তেলাওয়াত সুন্দর হোক বা না হোক। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ পাঠ বা শ্রবণ করলে কান্নায় আপ্লুত হতেন। কুরআন বা সুন্নাহর মহত্ত্বের বিষয়ে আলোচনা শুনলে তিনি প্রচুর কান্নাকাটি করতেন। কোন কোন দেশে মুসলমানরা যে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে সেগুলোর খবর শুনলে তিনি ক্রন্দন করতেন। কোন বিখ্যাত আলেম ইসলামের কোন মৌলিক বিষয়ে দৃঢ় থাকায় কষ্টপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কেউ মারা গেলে তিনি প্রচুর কাঁদতেন। ইফকের ঘটনা অথবা (তাবুক যুদ্ধ থেকে) পিছিয়ে পড়া তিন ব্যক্তির ঘটনা শুনে তিনি প্রায়ই কাঁদতেন।

বৃষ্টি ও পানি প্রার্থনায় কান্না : মূসা বিন নুছায়ের যখন আফ্রিকাতে গেলেন তখন তিনি সেখানকার অধিকাংশ শহর জনশূন্য অবস্থায় পেলেন। সে দেশে তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল। তখন তিনি মানুষদেরকে ছালাত-ছিয়াম আদায় এবং তাদের মধ্যকার বিবাদ মীমাংসা করার জন্য আদেশ দিলেন। অতঃপর তাদেরকে নিয়ে একটি মরুভূমিতে গেলেন। তার সাথে সমস্ত প্রাণীকুলও ছিল। তিনি প্রাণীগুলো এবং সেগুলোর বাচ্চাগুলোকে আলাদা করলেন। অতঃপর হৃদয় বিদারক বুকফাটা কান্নাকাটি শুরু হ’ল। আর এ অবস্থায় তিনি সেখানে অর্ধ দিন পর্যন্ত থাকলেন এবং ছালাত আদায় করলেন ও খুৎবা দিলেন। পরিশেষে তাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ হ’ল এবং তাদেরকে পানি দিয়ে সিক্ত করা হ’ল।

ভুলের সমর্থন দিয়ে পরে তা থেকে ফিরে এসে মন্ত্রীর অনুচরের কান্না : মন্ত্রী ইবনে হুবায়রার নিকটে কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তি প্রত্যেকদিন আছরের পরে হাদীছ পড়তেন। অতঃপর একদিন মালেকী মাযহাবের একজন ফক্বীহ আসলেন। তখন একটি মাস‘আলা উপস্থাপিত হ’লে তিনি (ফক্বীহ) তিনি উপস্থিত সকলের সাথে দ্বিমত পোষণ করলেন এবং (তার মতে) অনড় থাকে। তারপর মন্ত্রী (তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন) তুমি গাধা নাকি! দেখছ না সবাই তোমার মতের বিরোধিতা করছে? পরের দিন মন্ত্রী জনগণের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি এই লোকটির সাথে এমন আচরণ করেছি যা তার প্রাপ্য ছিল না। সে যেন আমাকে সেই কথাগুলো বলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে, যা আমি তাকে গতকাল বলেছি। কেননা আমি তোমাদের মতই (সাধারণ একজন মানুষ)। তখন মজলিসে কান্নার রোল পড়ে গেল এবং ফক্বীহ ব্যক্তিটি ওযর পেশ করে বললেন, বরং আমি ক্ষমা প্রার্থনার বেশী হকদার।[12]

চন্দ্র গ্রহণের সময় মানুষের কান্না : ইবনু ওছায়মীন (রহঃ) বলেছেন, অতীতে যখন চন্দ্রগ্রহণ হ’ত তখন মানুষ প্রচন্ড আতঙ্ক ও ভয় অনুভব করত। তারা বিপুল সংখ্যায় মসজিদে আসত। সেখানে ছালাত আদায় করত এবং ভয়ে কান্নাকাটি করত। এটা আমি নিজে দেখেছি। কিন্তু এখন আপনি এসবের কিছুই দেখতে পাবেন না।

খুতবায় কান্না করা : আব্দুর রহমান ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ তুজবীবী যখন খুতবা দিতেন, তখন নিজে কাঁদতেন এবং অন্যদেরকেও কাঁদাতেন। প্রখ্যাত ওয়ায়েয ইয়াহইয়া ইবনু ঈসা ইবনু হোসাইন মেম্বারে দাঁড়িয়ে কাঁদতেন।

লৌকিকতা ও শ্রুতির ভয়ে কান্না : আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে তার আমলের কথা শোনায়, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা সমস্ত সৃষ্টি জগতকে শুনিয়ে দিবেন। অতঃপর তাকে ছোট করবেন ও লাঞ্চিত করবেন’। আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) বলেন, এসময় আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)-এর দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হ’ল।[13]

আব্দুল ওয়াহহাব ইবনু সাকীনাহ ছিলেন প্রকাশ্য বিনয়ী ও অধিক অশ্রু বিসর্জনকারী। তিনি অধিক কান্না করতেন আর তা লুকানোর জন্য ওযর পেশ করে বলতেন, আমার বয়স বেড়ে গেছে, হাড় পাতলা হয়ে গেছে। তাই এখন আমি আমার অশ্রু নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। বস্ত্তত রিয়া তথা লোক দেখানো ইবাদত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি একথা বলতেন’।[14]

পাপের কারণে কান্না : সালেম বিন আবু যু‘দ হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ঈসা ইবনে মারয়াম বলেছেন, তার জন্যই সুসংবাদ, طُوبَى لِمَنْ بَكَى مِنْ ذِكْرِ خَطِيئَتِهِ ‘যে তার পাপের কথা স্মরণ করে কান্নাকাটি করে’।[15] ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) তার ছেলেকে বলেন, يَا بُنَيَّ ابْكِ مِنْ ذِكْرِ خَطِيئَتِكَ ‘হে বৎস! তুমি তোমার পাপকে স্মরণ করে কান্নাকাটি কর’।[16] ফুযায়েল ইবনু আইয়ায বলেন, ‘আল্লাহ সেই ব্যক্তির উপর রহম করেন, যে ভুল করে অতঃপর তার ভুলের জন্য কান্নাকাটি করে’।[17]

অধিক কাঁদতেন যারা : ইবনু ওয়াহহাব বলেন, উমায়রা বিনতে আবী নাজিয়াহ শোকে বিলাপকারীর ন্যায় কান্নাকাটি করতেন। আব্দুল ওয়াহহাব ইবনু আত্বা ও হান্নাদ ইবনুস সারি অধিক ক্রন্দনকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। ফক্বীহ আলী ইবনু হাকিম ইবনু যাহির সমরকান্দী অধিক কান্নার কারণে ক্রন্দনরত আলী নামে পরিচিতি লাভ করেন।

বাক্কার ইবনু কুতাইবা ইবনু আব্দুল্লাহ কুরআন তেলাওয়াতের সময় প্রচুর কাঁদতেন। মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ আল-আনছারী আন্দালুসী ছিলেন নরম হৃদয়ের ও অধিক ক্রন্দনকারী।

ইবনুল জাওযী বলেন, আব্দুল আউয়াল ইবনু ঈসা ইবনু শু‘য়াইব সৎকর্মশীল আলেম, ফক্বীহ, তাহাজ্জুদগুজার, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী এবং ক্রন্দনকারী ছিলেন। আব্দুর রহমান ইবনু মুহাম্মদ ইবনু হাসান ইবনু হিবাতুল্লাহ ইবনু ‘আসাকির প্রচুর ক্রন্দনকারী, দ্রুত অশ্রু বিসর্জনকারী, অত্যধিক বিনয়ী, নিয়মিত তাহাজ্জুদগুজার এবং অধিক রাত্রী জাগরণকারী ছিলেন।

বিবিধ বিষয়াবলী :

কান্না থেকে বঞ্চিত : বিনা প্রমাণে অন্যকে রিয়ার অপবাদ দেওয়ায় কান্নার নে‘মত থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন মাকহূল আশ-শামী। তিনি বলেন, ‘আমি জনৈক ব্যক্তিকে ছালাত আদায় করতে দেখলাম। সে যখনই রুকূ, সিজদা করছিল, তখন কান্নাকাটি করছিল। আমি তাকে অপবাদ দিলাম যে, সে আমাকে দেখানোর জন্য কান্নাকাটি করছে। ফলে আমাকে এক বছর কান্না থেকে বঞ্চিত করা হ’ল’।[18]

কান্নাহীন চোখে কোন কল্যাণ নেই : যে চক্ষু ক্রন্দন করে না, তাতে কোনরূপ কল্যাণ নেই। ছাবেত আল-বুনানী ডাক্তারের কাছে তার চক্ষুদ্বয়ের অসুস্থতার কথা বললে ডাক্তার তাকে বললেন, আপনি একটি অভ্যাস ত্যাগ করলে আপনার চক্ষুদ্বয় সুস্থ হয়ে যাবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সেটা কি? ডাক্তার বললেন, আপনি কান্নাকাটি করবেন না। তখন তিনি বললেন, مَا خَيْرٌ فِيْ عَيْنٍ لَا تَبْكِيْ ‘যে চক্ষু কাঁদে না তাতে কোন কল্যাণ নেই’।

কান্নার প্রভাব : শায়খ ছালেহ আল-গাছূন (রহঃ) সম্পর্কে ড. তারেক আল খুওয়াইতির বলেন, তার পিতার মৃত্যুর পরে তিনি ইয়াতীম ও দরিদ্র অবস্থায় বেড়ে উঠেন এবং তিনি তার মায়ের কোলেই বড় হন। আর তার মা একজন সৎকর্মশীলা নারী ছিলেন। যিনি তাকে খুব সুনদরভাবে লালন পালন করেছেন। শায়খ তার মা সম্পর্কে আমাকে একাধিকবার বলেছেন যে, তিনি একজন দ্বীনদার নারী ছিলেন এবং প্রচুর ছালাত আদায় করতেন। আর রাত যখন তার আবরণ নামিয়ে দিত এবং আঁধার আচ্ছাদিত হতো, তিনি ছালাত অবস্থায় তার মায়ের কান্না শুনতে পেতেন। অতঃপর শায়খ তার মায়ের কল্যাণকামিতা ও দো‘আ দ্বারা প্রভাবিত হন।

কিছু উপদেশ :

কম হাসা এবং বেশী কাঁদা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلاً وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا ‘আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তাহ’লে তোমরা কম কম হাসতে আর বেশি বেশি কাঁদতে’।[19]

ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, এখানে ইলম দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল এমন জ্ঞান, যা আল্লাহর বড়ত্ব এবং পাপীদের উপর আরোপিত তাঁর শাস্তির সাথে সম্পর্কিত হবে (অর্থ্যৎ এই জ্ঞান অর্জন করলে আল্লাহর মহত্ব সম্পর্কে জানা যাবে এবং পাপ ও পাপীদের করুণ অবস্থা তার সামনে পরিস্ফুটিত হবে)। এমন জ্ঞান, যা ধ্বংস, মৃত্যু, কবর এবং ক্বিয়ামতের সময় ভয়াবহতা সম্পর্কিত হবে। আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলেন, তোমরা কাঁদো। আর যদি কাঁদতে না পার, তবে (অন্ততপক্ষে) কান্নার ভান কর।

আল্লাহর ভয়ে কাঁদার জন্য নিজের সাথে লড়াই করা : হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) সূরা মারিয়াম তিলাওয়াত করলেন। অতঃপর সিজদা। আর বললেন, এটা তো কেবল সিজদা মাত্র। কিন্তু কান্না কোথায়? অর্থাৎ তিনি কাঁদতে চান।

কাহতানী তার নূনিয়্যাহতে (অন্তমিলের কবিতা) বলেন,

يَا حَبَّذَا عَيْنَانِ فِيْ غَسَقِ الدُّجَى

مِنْ خَشِيَةِ الرَّحْمَنِ بَاكِيَتَانِ

‘আহ! কী চমৎকার! রাতের আধারে দু’টি চক্ষু

দয়াময় আল্লাহর ভয়ে অবিরাম ঝরায় অশ্রু’।

শায়খা ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, হ্যাঁ এই দু’টি চোখ প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু আমাদের মধ্যে তারা কোথায়, যারা এই গুণে গুণান্বিত হতে চায়! অধিকাংশ মানুষ সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে। আর যখন তারা রাতের অন্ধকারে দন্ডায়মান হয়, তখন কমই কান্না করে। আমাদের এই যুগে, আল্লাহর ভয়ে রাতের অাঁধারে কান্নাকাটি করে এমন দু’চোখ খুব কমই আছে। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে এই অল্প কয়জনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেন।

শয়তানের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা : আল্লাহ বলেন,إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ ‘নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু। অতএব তাকে শত্রু হিসাবেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহবান করে যেন তারা জাহান্নামী হয়’ (ফাত্বির ৩৫/৬)। শয়তান মুমিনদের (প্ররোচনা দিয়ে) প্রতারণা করে, যাতে তার কান্না লৌকিকতা ও শ্রুতিকাতরতায় রূপান্তরিত হয়।

শায়খ বদর বিন নাছির আল-বদর বলেন, কুরআনের বরকত ও কল্যাণ প্রত্যাশী ব্যক্তিকে যেসব উপদেশ দেওয়া হয় সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হ’ল ইখলাছ অর্জন করা ও বেশি বেশি গোপন আমল করা এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কল্যাণের দিকে ধাবিত হওয়া। বিশেষ করে কুরআন পাঠ ও শ্রবণের সময় কান্নাকটি করা কল্যাণ লাভের অন্যতম উপায়।

হাফেয ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কান্না জোরে বা উচ্চ আওয়াজে ছিল না। কিন্তু তার চক্ষুদ্বয় অশ্রু ঝরাতো যেন, সেগুলো অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে। আর তখন তার বুকের কাপুনি শোনা যেত। তার কান্না ছিল আকাঙ্ক্ষা ও ভালবাসার; যার সাথে ভয়-ভীতিও ছিল (অর্থাৎ তার কান্নায় রবের প্রতি ভয় ও আশার সংমিশ্রণ থাকতো)’। [20]

কান্না গোপন করা : মুহাম্মাদ বিন ওয়াসী (রহঃ) বলেন, আমি বুঝতে পারলাম যে তাদের একজন ব্যক্তি সারিতে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার গাল বেয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু তার পাশের লোকটি তা বুঝতে পারেনি। ওমর বিন কায়েস আল-মুলাঈ যখন কাঁদতেন, তখন তিনি তার চেহারাকে দেওয়ালের দিকে ঘুরিয়ে ফেলতেন এবং তার সাথীদেরকে বলতেন এটাতো সর্দি।

ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, ‘হে আদম সন্তান! (এমনভাবে কান্নাকাটি কর) যেন মৃত্যু তোমার উঠানে চলে এসেছে। তোমার এবং তোমার আকাংখার কঠিন পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে। আর তুমি প্রচন্ড ভয় এবং কঠিন বিপদে আপতিত। তোমার কোন পিতা বা সন্তান নেই যে, সেটাকে তোমার থেকে প্রতিহত করবে। আর কোন সরঞ্জাম বা সাথীও নেই, যে তোমাকে তার থেকে পরিত্রাণ দিবে। নেই কোন জাতি গোষ্ঠী কিংবা কোন সু-উচ্চ প্রাসাদ, যা তোমাকে তার থেকে রক্ষা করবে। মনে হচ্ছে মৃত্যু কোন পরিস্থিতিতেই তোমার কাছে আসবে না? মহা সম্মানিত ও মহীয়ান সত্তার কসম! তা অবশ্যই আসবে। অতএব তোমার এখনকার বিনয় ও কান্নাকাটি তোমাকে সেই বিপদ ও লজ্জা থেকে রক্ষা করবে’।[21]

সর্বশেষে আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে আল্লাহর জন্য তার অন্তরকে নরম করে না, তাঁর দিকে ফিরে আসে না, তাঁর ভালোবাসায় বিগলিত হয় না ও তাঁর ভয়ে কান্নাকাটি করে না, সে যেন দুনিয়াতে কিছুক্ষণ উপভোগ করে নেয়। কেননা নিশ্চয়ই তার সামনে রয়েছে মহান শিথিলকারী বিষয় (মৃত্যু)। আর তাকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সকল জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহর নিকটে। অতঃপর সে দেখবে ও জানবে (যা সে করেছে)’।

উপসংহার : আল্লাহর ভয়ে কেঁদে চোখের পানি ফেলতে পারা একটি অন্যতম নে‘মত। যার মাধ্যমে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান লাভ সম্ভব হবে। আর এজন্য রাত্রিকালে একাকী চোখের পানি ফেলে কান্নাকটি করা, গভীরভাবে কুরআন পাঠ ও শ্রবণের সময় কান্নাকটি করা, হাদীছ পঠন ও পাঠদানের সময় কান্নাকাটি করা অফুরন্ত কল্যাণ লাভের অন্যতম উপায় হ’তে পারে। অতএব একজন মানুষের উচিত হ’ল আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক রাখা। অতঃপর যখনই তার আল্লাহর নিদর্শনসমূহ, অনুগ্রহরাজী বা শাস্তির ভয় স্মরণ হবে, তখনই সে ছালাতে, সিজদায় আল্লাহর ভয়ে কান্নাকাটি করবে। আল্লাহ আমাদেরকে কান্নার মাধ্যমে তাঁর শ্রেষ্ঠ বান্দা হওয়ার তাওফীক দান করুন।-আমীন!

[আলোচ্য প্রবন্ধটি ফাহদ বিন আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ আশ-শুয়াইরিখ-এর ‘বুকাউস সালাফিল উম্মাহ’ অবলম্বনে অনূদিত]

[৩য় বর্ষ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]


[1]. তারীখুল ইসলাম ৯/৪০১ পৃ.।

[2]. হিলইয়াতুল আউলিয়া ৮/৮৪ পৃ.; তারীখু দিমাশক্ব, ইবনু আসাকির, ৪৮/৩৯১ পৃ.।

[3]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/৫৮১ পৃ.।

[4]. আস-সুলূক ফী তাবাক্বাতিল ওলামা ওয়াল মুলূক ১/১৫৮ পৃ.।

[5]. লাতায়েফুল মা‘আরিফ, ইবনু রজব, ১/৩০১ পৃ.।

[6]. আয-যুহদ ওয়ার-রাক্বায়েক্ব, ২/৩৮ পৃ.; তারীখু দিমাশক্ব, ইবনু আসাকির, ৬৭/৩৮৩ পৃ.।

[7]. হিলইয়াতুল আউলিয়া ২/৮৮ পৃ.।

[8]. তাফসীর ইবনু রজব ২/৩৪২ পৃ.।

[9]. জামে‘ বায়ানিল ইলম ওয়া ফাযলিহী হা/২৪১০।

[10]. তারীখুল ইসলাম ২৪/১৪০ পৃ.।

[11]. মীরাছুছ ছামতি ওয়াল মালাকূত।

[12]. তারীখুল ইসলাম ৩৮/৩৩১ পৃ.।

[13]. আহমাদ হা/৬৮৩৯; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৬৪০৩।

[14]. হিলইয়াতুল আউলিয়া ৪৩/২৫৪ পৃ.।

[15]. তারীখু দিমাশক্ব, ইবনু আসাকির, ৪৭/৪৩৩ পৃ.।

[16]. কিতাবুয যুহদ, ওয়াকী‘ হা/৩০।

[17]. তারীখুল ইসলাম ১২/১৮৯ পৃ.।

[18]. হিলইয়াতুল আউলিয়া ৫/১৮৪ পৃ.।

[19]. তিরমিযী হা/২৩১২; ইবনু মাজাহ হা/৪১৯০।

[20]. যাদুল মা‘আদ ১/১৭৬ পৃ.।

[21]. বুসতানুল ওয়া‘য়েযীন ওয়া রিয়াযুস সামিঈন ১/১৫০ পৃ.।



আরও