আলেপ্পো থেকে দামেশক : নতুন দিগন্তে সিরিয়া

ওমর ফারূক 67 বার পঠিত

সিরিয়ায় এখন উচ্ছ্বাস আর নতুন দিনের আশার স্রোত বইছে। প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ বাসিন্দার এ দেশে সুন্নী মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শাসন ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে শী‘আ সম্প্রদায়ের আসাদ পরিবারের হাতে কুক্ষিগত ছিল। ৮ই ডিসেম্বর ২০২৪ বিদ্রোহী যোদ্ধারা রাজধানী দামেশকে প্রবেশ করলে বাশার আল-আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। এর-মধ্য দিয়ে কেবল তার দুই দশকের শাসনেরই নয়, বরং বাবা-ছেলে মিলে আসাদ পরিবারের টানা ৫৩ বছরের শাসনামলের সমাপ্তি ঘটে। বাশার আল-আসাদের পতন মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। 

আসাদ সরকারের নিষ্ঠুরতার কাহিনী : সিরিয়ায় গত ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের সময় বাশার আল-আসাদের বাহিনীর হাতে লাখো মানুষ নিহত হয়েছেন। ‘সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসে’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের মার্চ মাসে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সরকারী বাহিনী প্রায় ১২ লাখ মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। অসংখ্য মানুষ এখনও নিখোঁজ।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কারাগারগুলোতে বন্দীদের ওপর চালানো হয়েছে ভয়াবহ নির্যাতন। এসব নির্যাতনের মধ্যে ছিল শারীরিক সহিংসতা, মানসিক নিপীড়ন এবং যৌন হয়রানি। বন্দীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হ’ত। তাদের জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা, ছোট কক্ষে একাকী রাখা ছাড়াও বিভিন্ন নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে শারীরিক নির্যাতন চালানো হ’ত। নির্যাতনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বন্দীদের শরীরে ফুটন্ত পানি ঢালা, ডুবিয়ে শ্বাসরোধ করা, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, পোড়া নাইলন ব্যাগ শরীরে প্রয়োগ, সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া, আঙুল, চুলের গোড়া এবং কানের মতো সংবেদনশীল অংশ পোড়ানো, প্লায়ার্স দিয়ে নখ তুলে ফেলা, জোর করে চুল উপড়ে ফেলা এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে অঙ্গহানি।

আসাদ সরকারের কুখ্যাত কারাগারগুলোর মধ্যে সেদনায়া, মেজ্জেহ, দামেশকের কাবুন, হোমসের আল-বালুন এবং তাদমর কারাগার বিশেষভাবে আলোচিত। গত ৯ই ডিসেম্বর সেদনায়া কারাগার থেকে বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার পর মাত্র দুই দিনের মধ্যেই হাযারো সিরিয়ান নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে সেখানে ভিড় জমায়।

হাসপাতালে আনা কিছু মৃতদেহের ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে মুজতাহিদ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের কর্মী নায়েফ হাসান বলেন, ‘মৃতদেহগুলো পোড়া, নির্যাতনের চিহ্ন এবং বুলেটের ক্ষতসহ ভয়ংকর অবস্থায় ছিল। বেশিরভাগই নির্মম নির্যাতনের কারণে প্রাণ হারিয়েছে’।

এছাড়া রাজধানী দামেশক থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে আল-কুতায়ফাহ এলাকায় একটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে অন্তত এক লাখ মানুষকে পুঁতে রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক অজানা গণকবরের অস্তিত্ব রয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মৃত্যুর হাতছানি থেকে ফেরা বন্দী জীবনের ভয়াবহ কিছু স্মৃতি : সিরিয়ার কারাগারগুলো বাশার আল-আসাদের শাসনের এক মর্মন্তুদ নির্মমতার প্রতীক। সেখানে বন্দীদের ওপর চালানো অমানবিক নির্যাতনের স্মৃতি মুক্তি পাওয়া অনেকের মনে গভীর ক্ষত হিসাবে থেকে গেছে। (১) হালা নামের এক বন্দী বলেন, ‘কারাগারে আমার পরিচয় নম্বর ছিল ১১০০। দিনের আলো কখনো দেখব, তা কল্পনাও করিনি। আজও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে আমি মুক্ত। মুক্তির দিনটির কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, সেদিনের আনন্দ ছিল সীমাহীন। আমরা চিৎকার করে তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম’। পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার অনুভূতিও গভীর আবেগে তিনি বর্ণনা করেন, ‘যখন পরিবারের কাছে ফিরলাম, মনে হ’ল যেন নতুন করে জন্ম নিয়েছি। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়’।

(২) ৪৯ বছর বয়সী ছাফী আল-ইয়াসীন আলেপ্পোর এক কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বলেন, ‘আজকের দিনটি আমার জীবনের নতুন শুরু। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে প্রথমবার জন্মেছি। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়’। তবে তিনি কারাগারের বিভীষিকা ভুলতে পারেননি। কারাগারের স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, ‘আমি এক রক্তাক্ত বৃদ্ধ বন্দীকে দেখেছিলাম। সেই দৃশ্য আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলতে পারব না’।

(৩) ২০১৭ সালে ‘সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন’ অভিযোগে মেহেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারের অপেক্ষায় সিরিয়ার কারাগারে তিনি কাটান দীর্ঘ সাত বছর। মেহের বলেন, ‘মনে হ’ত, কর্তৃপক্ষ আমাকে ভুলে গেছে। আমি আর মানুষ নই, শুধু একটি নম্বর’। কারাগারের নির্মমতার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘প্রতিটি মুহূর্তে মনে হতো মৃত্যু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। এমন নির্যাতন কোনো পশুও সহ্য করতে পারত না’।

তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক মুহূর্তটি ছিল, যখন তিনি দামেশকের কুখ্যাত মেজ্জেহ কারাগারে এক প্রিয়জনের মুখোমুখি হন। মেহের বলেন, ‘একদিন একটি বাসে নতুন কিছু বন্দীকে কারাগারে আনা হয় এবং তাদের মধ্যে কয়েকজনকে আমার সেলে রাখা হয়। একজন বন্দীকে দেখে আমার শ্যালকের মতো মনে হয়েছিল। প্রথমে আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবলাম, এটি আয়মান হ’তে পারে না। কারণ তার পা তো কাটা ছিল না। তবে সন্দেহ দূর করার জন্য আমি কাছে গিয়ে দেখলাম, পা হারানো ব্যক্তি তার মানসিক স্থিতিও হারিয়ে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত তার শরীরে একটি বিশেষ চিহ্ন দেখে আমি নিশ্চিত হই, এটি আমার সেই শ্যালক’। সিরিয়ার কুখ্যাত সেদনায়া কারাগারের নির্যাতন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া দু’জন বন্দী নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন।

১২ দিনের অপ্রতিরোধ্য অভিযান :২৭শে নভেম্বর : হায়াত তাহরীর আশ-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বাধীন সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী আকস্মিকভাবে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখলের অভিযান শুরু করে। সরকারি বাহিনী বিদ্রোহীদের সামনে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। একের পর এক এলাকা ছেড়ে তারা পিছু হটতে থাকে। ৩০শে নভেম্বর : বিদ্রোহীরা কোনো যুদ্ধ ছাড়াই আলেপ্পোর অর্ধেক অঞ্চল দখল করে নেয়। এমনকি একটি গুলিও চালানোর প্রয়োজন হয়নি। ১লা ডিসেম্বর : আলেপ্পো দখলের পর বিদ্রোহীরা মধ্যাঞ্চলের শহর হামার দিকে অগ্রসর হয়। উল্লেখ্য যে, আলেপ্পো থেকে রাজধানী দামেশকের দূরত্ব প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার, যার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ শহর হামা অবস্থিত। ৪ঠা ডিসেম্বর : রাতের অাঁধারে বিদ্রোহীরা হামায় প্রবেশ করলে শহরের বিভিন্ন সড়কে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তাদের তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়। একাধিক দিক থেকে বিদ্রোহীরা হামায় আক্রমণ চালায়। ৫ই ডিসেম্বর : বিদ্রোহীরা সিরিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম শহর হামার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। ৬ই ডিসেম্বর : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবিলম্বে তাদের নাগরিকদের সিরিয়া ত্যাগের নির্দেশ জারি করে। ৭ই ডিসেম্বর : রাজধানী দামেশকের আশপাশের শহরগুলো দখলের পর বিদ্রোহীরা সরাসরি দামেশকের ওপর অভিযান শুরু করে। এর একদিন আগেই তারা ইস্রাঈলের সীমান্তবর্তী কুইনেত্রা শহর দখল করে। ৮ই ডিসেম্বর : বিদ্রোহীরা সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমসের দখল নেয়। এরপর তারা ঘোষণা করে, দামেশক দখলই তাদের পরবর্তী লক্ষ্য। জানা যায়, বিদ্রোহীদের শহরে প্রবেশের আগেই বাশার আল-আসাদ ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে দামেশক ত্যাগ করেন। আর এভাবেই ১২ দিনের অপ্রতিরোধ্য অভিযান শেষ হয়।

সিরীয় জনসমর্থন : সিরিয়ার সাধারণ জনগণের একটি বৃহৎ অংশ ভাবাদর্শগতভাবে ‘এইচটিএসে’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং বাশার আল-আসাদ ও তার অনুসারীদের ঘোর বিরোধী। ‘এইচটিএস’ একটি সালাফী মতাদর্শে বিশ্বাসী গোষ্ঠী। তথাপি তারা আসাদ সরকার কর্তৃক ব্যাপক যুলুম-নির্যাতনে অতিষ্ট ছিলেন। তাই আলেপ্পোর পতনের পর স্থানীয় জনগণ বিদ্রোহীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে রাস্তায় নেমে উল্লাস প্রকাশ করে। একই রকম দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে হোমস এবং সর্বশেষ দামেশকেও।

প্রতিশোধ ছেড়ে শান্তির পথে বিদ্রোহীরা : বিদ্রোহীরা বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। ‘এইচটিএস’ নেতা আহমাদ আল-শারা আল-জোলানি সরকারি প্রতিষ্ঠান দখলে না নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ গাযী আল-জালালীর তত্ত্বাবধানে রেখে আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা অন্ধকার অতীতের পাতা উল্টে নতুন ভবিষ্যতের জন্য একটি উজ্জ্বল দিগন্ত উন্মোচন করছি। মুক্ত সিরিয়া এখন সব ভ্রাতৃপ্রতিম ও মিত্রদেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থের ভিত্তিতে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। ‘এইচটিএস’ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় গঠনমূলক ভূমিকা পালনের অঙ্গীকার করছে। আসাদের অত্যাচারের কারণে যেসব সিরীয় নাগরিক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের ধর্ম বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে দেশে ফিরে আসার অধিকার থাকবে। তাদের নিজস্ব ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেওয়া হবে’। এই ঘোষণা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ঐক্য, ন্যায্যতা এবং একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ সমাজ গঠনের দৃঢ় অঙ্গীকার প্রদর্শন করে।

জনমনে আশার আলো : ইতিমধ্যেই আল-জোলানি জনমনে আশার আলো জ্বালিয়েছেন। গত জানুয়ারীতে ইদলীব অঞ্চলে আল-জোলানি প্রশাসন একটি সামাজিক আচরণবিধি আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছিল। জনজীবনে কঠোর নিয়মকানুন আরোপের উদ্দেশ্যে ১২৮টি ধারা সংবলিত এই আইন তৈরি করা হয়। এতে মদ বিক্রি ও সেবন নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া স্কুলে মেয়েদের জন্য ইসলামী পোশাক বাধ্যতামূলক, জনসমাগম স্থলে নারী-পুরুষের একসঙ্গে চলাফেরা ও কফি শপে জনপ্রিয় হুক্কা-ধূমপান, ক্যাসিনো নিষিদ্ধ করা হয়। আইনটি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। আল-জোলানি এই আইনকে সমর্থন জানালেও জোরাজুরি না করে দাওয়াহর মাধ্যমে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, ‘যদি আমরা ভয় দেখিয়ে মানুষকে ইসলামী জীবনযাপনে বাধ্য করি, তারা আমাদের সামনে মুসলিম হওয়ার ভান করবে এবং অনুপস্থিতিতে ঈমান ত্যাগ করবে’।

ইদলীব শাসনামলে আল-জোলানি তার দলের কার্যক্রম নিয়ে গর্বিত ছিলেন। তার নেতৃত্বে গোষ্ঠীটি কর আদায়, বাজেট ব্যবস্থাপনা, যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ এবং যরূরী সেবা নিশ্চিত করতে সফল হয়। পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকে শুরু করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানোর কাজ দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন। এই সাফল্যের অভিজ্ঞতা তিনি পুরো সিরিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আসাদ মস্কোয় পালিয়ে যাওয়ার পর আল-জোলানি কার্যত সিরিয়ার নতুন শাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার পরিকল্পনা সুস্পষ্ট এবং তিনি নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী। তিনি ইসলামপন্থী জনতুষ্টির রাজনীতি থেকে সরে এসে সিরিয়াকে একটি সফল রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে চান।

আসাদের পতনের পর আল-জোলানি ‘সিএনএন’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘তরুণ বয়সে তিনি আল-কায়েদায় যোগ দিয়েছিলেন। তবে সেটি ছিল তার অপ্রাপ্ত বয়স্কতার ভুল’। আল-জোলানি যখন সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন, তার পেছনে দু’টি পতাকা ছিল একটি সিরিয়ার বিপ্লবের প্রতীক এবং অন্যটি তার দলের জিহাদী পতাকা। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হলে শারা ও তার সহযোগীরা দ্রুত জিহাদী পতাকা সরিয়ে শুধু বিপ্লবের পতাকাটি রেখে দেন। এর মাধ্যমে তারা জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার বার্তা দেন।

আল-জোলানির পরিচয় : আবু মুহাম্মদ আল-জোলানির প্রকৃত নাম আহমাদ হুসাইন আশ-শারা। তিনি খোলাফায়ে রাশেদীনের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর বংশধর বলে ধারণা করা হয়। ১৯৮২ সালে তিনি সাঊদী আরবের রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তার বাবা পেট্রোলিয়াম প্রকৌশলী হিসাবে সেখানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তাদের পরিবার সিরিয়ায় ফিরে গিয়ে দামেশকের অদূরে বসতি স্থাপন করে।

দামেশকে থাকাকালীন সময় জোলানির কর্মকান্ড সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ২০০৩ সালে তিনি সিরিয়া থেকে ইরাক গিয়ে আল-কায়েদায় যোগ দেন। একই বছরে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালায়। জোলানি তখন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং এই সময় থেকেই তার নাম পরিচিতি পেতে শুরু করে।

২০০৬ সালে জোলানি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং পাঁচ বছর বন্দী থাকেন। এদিকে ২০১১ সালে সিরিয়ায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হলে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ তা দমনে সহিংসপন্থা অবলম্বন করেন, যার ফলে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় জোলানি মুক্তি পান এবং তার নেতৃত্বে সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ‘আন-নুছরা ফ্রন্ট’ নামে পরিচিত। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে, বিশেষত ইদলীবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

প্রথম দিকে জোলানি ইরাকের আইএস প্রধান আবুবকর আল-বাগদাদীর সঙ্গে কাজ করলেও ২০১৩ সালে তিনি আকস্মিকভাবে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং সিরিয়ায় তৎপরতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে ‘আইএসআইএল’ ও ‘আন-নুছরা ফ্রন্ট’কে নিজেদের সঙ্গে একীভূত করার চেষ্টা চালায়, যার ফলে আইএসআইএলের উত্থান ঘটে। জোলানি এই পরিবর্তন প্রত্যাখ্যান করে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে জোলানির মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি আল-কায়েদার ‘বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রকল্প’ থেকে সরে এসে নিজের গোষ্ঠীর তৎপরতাকে সিরিয়ার সীমানার ভেতর সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিবর্তনের ফলে জোলানির গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন থেকে একটি জাতীয় মুক্তিকামী গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়।

এইচটিএস-এর উত্থান : ২০১৬ সালের জুলাই মাসে বাশার আল-আসাদ সরকারের আলেপ্পো দখল করার পর বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ইদলীবে চলে যায়। একই বছরে জোলানি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন এবং আন-নুসরা ফ্রন্ট বিলুপ্ত করেন। এরপর তিনি একটি নতুন সংগঠন, জাবহাতু ফাতহিশ শাম- جبهة فتح الشام প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের শুরুর দিকে বিদ্রোহীদের ছোট ছোট বিভিন্ন গোষ্ঠী ও নিজের প্রতিষ্ঠিত জাবহাতু ফাতহিশ শামকে একত্রিত করে জোলানি هيئة تحرير الشام-হায়আতু তাহরীরিশ শাম (এইচটিএস) গঠন করেন।

এইচটিএস-এর লক্ষ্য : ‘এইচটিএসে’র ঘোষিত লক্ষ্যই ছিল বাশার আল-আসাদের স্বৈরাচারী শাসন থেকে সিরিয়াকে মুক্ত করা। আর সিরিয়ায় ইরানের সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করা এবং ‘ইসলামী আইন’ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা।

ভূরাজনৈতিক স্বার্থ : শী‘আ রাষ্ট্র ইরান শী‘আ আসাদ পরিবারকে ভূরাজনৈতিক কারণ ছাড়াও মতাদর্শিক কারণে দীর্ঘ দিন সহযোগিতা করে গেছে। এ বিজয় ইরানের জন্য একটি বিশাল আঘাত। এখন ইরান লেবাননে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিজবুল্লাহর কাছে স্থলপথে পৌঁছানোর সুযোগ পাবে না। আর রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থান দৃঢ় রাখার জন্য সিরিয়ার নতুন সরকারের সাথেও সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করবে। সিরিয়ায় যুদ্ধের কারণে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সিরীয় শরণার্থীদের নিয়ে চাপে আছে। যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায় এসব শরণার্থী এখন স্বেচ্ছায় তাদের দেশে ফেরত যাবেন। আর উদ্বেগের বিষয় হ’ল, যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র ব্যবসার জন্য ইস্রাঈল সমর্থনপুষ্ট কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসকে (এসডিএফ) সহযোগিতা চালিয়ে যাবে। সর্বোপরি বিদ্রোহীরা একটি স্থিতিশীল সিরিয়া গড়তে পারলে তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া ৩৫ লাখ সিরীয় শরণার্থী দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। এতে তুরস্কের কাঁধ থেকে অনেক বড় বোঝা নেমে যাবে।

উপসংহার : যালেম শাসক বাশার আল-আসাদ দেশ থেকে পালানোর ফলে সিরিয়া এখন মুক্ত। এর মধ্য দিয়ে একটি অন্ধকার যুগের সমাপ্তি হয়েছে। আর সূচনা হয়েছে একটি নতুন যুগের। সব মিলিয়ে কাবুলের মত দামেশক যেভাবে রক্তপাতহীনভাবে আসাদের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয়েছে, তা একটি নতুন দৃষ্টান্ত। এটি পুরো অঞ্চলের এবং এর বাইরের দেশগুলোর জন্য স্বস্তির বার্তা নিয়ে আসবে। তবে এ পরিবর্তন শুধু সিরিয়া নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও কৌশলগত মানচিত্রকেই নতুনভাবে চিত্রিত করতে পারে।

[শিক্ষার্থী, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]



আরও