হাফেয মুখলেছুর রহমান (বগুড়া)

ওমর ফারূক 56 বার পঠিত

[হাফেয মুখলেছুর রহমান (৬৩) বগুড়া যেলার বর্তমান ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর সভাপতি। যৌবনকালে তিনি ‘যুবসংঘ’ ও প্রৌঢ় বয়সে ‘আন্দোলন’-এর প্লাটফর্মে থেকে সাংগঠনিক জীবন-যাপন করে করে যাচ্ছেন। তিনি হিফয বিভাগে কর্মজীবন শুরু করে এই মহান পেশাতে অদ্যবধি নিয়োজিত আছেন। তার এই জীবনঘনিষ্ট সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তাওহীদের ডাক-এর নির্বাহী সম্পাদক- আসাদুল্লাহ আল-গালিব।

তাওহীদের ডাক : আপনি কেমন আছেন?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : আলহামদুলিল্লাহ। আমি ভালো আছি।

তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও পরিবার সম্পর্কে বলুন।

হাফেয মুখলেছুর রহমান : আমার জন্ম বাংলা ১৩৬৭ সনের ১৫ই ফাল্গুন সোমবার ফজরের আযানের পর বগুড়া যেলার গাবতলী থানার কলাকোপা গ্রামে। আমার পিতার নাম হাবীবুর রহমান ও মাতার নাম দৌলতুন নেছা। আমার বয়স যখন ৮/৯ বছর, তখন আমার পিতা সমস্ত জমি-জমা বিক্রি করে দিনাজপুর যেলার বীরগঞ্জ উপযেলার ভোলাপুকুর গ্রামে স্থানান্তরিত হন। আমরা সাত ভাই ও দুই বোন। বর্তমানে আমি স্থায়ীভাবে বগুড়াতে বসবাস করি। আমার দুই পুত্র এবং এক কন্যা রয়েছে।

তাওহীদের ডাক : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে বলুন?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : দিনাজপুরের ভোলাপুকুর গ্রামের ফুরকানিয়া মাদ্রাসায় আমার পড়ালেখা শুরু হয়। মাদ্রাসাটি হিফয শাখা চালু করার জন্য ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপযেলা থেকে একজন হাফেয আনা হয়। হাফেয মুজীব উদ্দীন, ক্বারী গিয়াছুদ্দীন ও আব্দুল খালেক সকল ছাত্রকে একত্রিত করে হিফয বিভাগের জন্য ছাত্র বাছাই শুরু করেন। ক্বারী গিয়াছুদ্দীন প্রথমেই আমাকে বলেন, ‘মোখলেছ, তুমি দাঁড়াও। অতঃপর ২৮-৩০ জন ছাত্রের মধ্য থেকে আমাদের ১৫ জনকে বাছাই করা হ’ল।

সময়টি সম্ভবত ১৯৭৫ সাল। শিক্ষকগণের নিকট থেকে পবিত্র কুরআন হিফযের ফযীলত সম্পর্কে হৃদয় নিংড়ানো আলোচনা শুনে আমরা অত্যন্ত মুগ্ধ হই। প্রথমে হাফেয ছাহেব আমাদের নাযেরা পড়া শোনেন। যখন আমি সাত পারা সবক মুখস্থ করেছিলাম, তখন আমার ভাই আমাকে বগুড়ার সন্ধ্যাবাড়ি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে ১১ পারা পর্যন্ত পড়ার পর আমি রংপুর পীরগাছার অন্তর্গত আল-কুরআন হাফেযিয়া মাদ্রাসায় যাই। সেখানে হাফেয আবুল কাসেম ছাহেবের কাছে হিফয সম্পন্ন করি।

হাফেয মুখলেছুর রহমান (বগুড়া)

এরপর ১৯৭৯ সালে আমি বগুড়া গাবতলী থানার বাগবাড়ী আলিয়া মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হই। সেখানে দুইবার প্রমোশন পেয়ে ১৯৮৪ সালে দাখিল, ১৯৮৬ সালে আলিম এবং শাহজাহানপুর থানার অন্তর্গত খোট্টাপাড়া ফাযিল মাদ্রাসা থেকে ফাযিল পাস করি। সবশেষে বগুড়া শেরপুর কামিল মাদ্রাসায় হাদীছ বিভাগ থেকে কামিল পাস করি।

তাওহীদের ডাক : শিক্ষকতা পেশা কিভাবে আসলেন?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : ১৯৯০ সালে কামিল পরীক্ষা পর আমি গাইবান্ধা যেলার গোবিন্দগঞ্জ থানার ফুলবাড়ী শিহাবুদ্দীন সুন্নী ছাহেবের মাদ্রাসায় নাহু ও ছরফ শেখার জন্য ভর্তি হই। কামিলের ফলাফল প্রকাশের পর, আমি বগুড়া শহরের ফতেহ আলী মাদ্রাসায় চলে আসি। তখন মাদ্রাসাটিতে হাফেয লুৎফর রহমান (বর্তমান নওদাপাড়া মারকাযের হিফয বিভাগের প্রধান) শিক্ষকতা করতেন। আমি তাকে বললাম, ভাই, ‘আমি হিফয বিভাগে চাকুরি করতে চাই’। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমাদের এখানে একজন হাফেযের প্রয়োজন আছে’। এ কথা শুনে আমি খুব খুশি হলাম। তিনি কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে আমাকে নিয়োগ দিলেন। সেখান থেকেই আমার শিক্ষকতা শুরু হয়।

এরপর ১৯৯১ সালের ৪ঠা জানুয়ারী নশিপুরের গোলাম রববানী ও আব্দুর রউফ ভাই আমার কাছে এসে বললেন, ভাই! আমরা একটি মাদ্রাসা করতে চাই, তোমাকে যেতে হবে। আমি তাদের বাড়ীতে আট বছর লজিং ছিলাম। তাই তাদের কথা ফেলতে পারলাম না। এরপর পিতা-মাতার অনুমতি নিয়ে ১৯৯১ সালের ৫ই জানুয়ারী শিক্ষক হিসাবে সেখানে যোগ দিই। যখন মাদ্রাসার ঘর নির্মাণ করা হয়, তখন আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যার মাদ্রাসার নাম রাখেন নশিপুর তাহফীযুল কুরআন মহিলা মাদ্রাসা। পরবর্তীতে সেখানে বালক শাখাও চালু করা হয় এবং নামকরণ করা হয় আল-মারকাযুল ইসলামী, নশিপুর, বগুড়া।

তাওহীদের ডাক : আপনি কিভাবে ‘যুবসংঘে’র সন্ধান পেয়েছিলেন?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : ১৯৮৩ সালে আমার লজিং বাড়ীতে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ভাই ‘যুবসংঘে’র কোন এক দাওয়াতী প্রোগ্রামে এসেছিলেন। তাঁর দাওয়াতেই আমি ‘যুবসংঘে’র ফরম পূরণ করি। সেখান থেকেই ‘যুবসংঘে’র সাথে আমার দাওয়াতী সফর শুরু হয়।

তাওহীদের ডাক : ‘যুবসংঘে’র প্লাটফর্মে থেকে আপনার দাওয়াতী কোন স্মৃতি মনে পড়ে কি?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : আমরা মূলত মাযহাবী ছিলাম। ১৯৮০ সালে ইবনে ফযল ছাহেবের বক্তব্য শুনে ‘আহলেহাদীছ’ হই। এক সময় জমঈয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলাম। পরবর্তীতে ‘যুবসংঘে’র সদস্য হই। যা আমার নিকট ছিল এক অন্য রকম অনুভূতি। এলাকায় একমাত্র আমি ‘আহলেহাদীছ’ হওয়ায় সব সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় থাকতাম। ‘যুবসংঘে’র দাওয়াতী কাজ শুরু করার পর আমার ছয় ভাই এবং প্রতিবেশীসহ মোট ১৭টি পরিবার আহলেহাদীছ হন। আলহামদুলিল্লাহ! এটি আমার সবচেয়ে আনন্দের বিষয় যে, যারা এক সময় আমার শত্রু ছিল, তারা এখন আমার বন্ধু হয়েছেন।

১৯৮৫ সালে দিনাজপুরে আমার গ্রামের বাড়িতে আমাকে দিয়ে একটি মাহফিল হয়। সেই মাহফিলে আমি মাযহাব, পীর-মুরীদ, এবং শবেবরাতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেই। আমার বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে হানিফ নামের এক ব্যক্তি রেগে আমাকে জবাইয়ের ঘোষণা দেন। হানিফ ভাই আমার কথাগুলো কাহারোল থানার শিতলাই ফাযিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমূদুল্লাহ ছাহেবকে জানালে তিনি বলেন, আমাদের আসল ইসলাম তাদের কাছেই আছে। এই কথা শুনে হানিফ ভাই পরদিন বাড়িতে এসে আমার হাত ধরে আহলেহাদীছ হয়ে যান। এটি আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের দিন ছিল।

তাওহীদের ডাক : আপনার আহলেহাদীছ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট কী ছিল? অন্যান্য ইসলামী সংগঠনের সাথে তফাৎটা কি?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : অন্যান্য ইসলামী সংগঠন ও মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের নেতৃত্বে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র মাঝে অনেক তফাৎ রয়েছে। যা আলোচনা সাপেক্ষ। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কুরআন ও হাদীছ সেভাবে বোঝার চেষ্টা করে, যেভাবে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ছাহাবারে কেরাম ও সালাফে ছালেহীন দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। তারা আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে। তারা সমাজ সংস্কার করতে চায় নবী-রাসূলদের আদর্শের আলোকে; মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত কোন মতবাদ ও ইজমের ভিত্তিতে নয়। সেজন্য আমি গর্বের সাথে বলি- আমি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র একজন কর্মী। আর অন্যান্য ইসলামী সংগঠন মুখে মুখে অনেক কিছু দাবী করলেও তাদের কর্মকান্ড ও কর্মনীতি বিশুদ্ধ ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতরাং দ্বিচারী বৈশিষ্ট্যের কোন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

তাওহীদের ডাক :আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার প্রথম পরিচয় হয় কিভাবে?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : সম্ভবত ১৯৮৩ সালে বাগবাড়ী ফাযিল মাদ্রাসার বাৎসরিক মাহফিলের জন্য আমীরে জামা‘আত ও মাওলানা দুর্রুল হুদা আইয়ুবী ছাহেবকে দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ আমাকে দেন। প্রথমে আমি রাজশাহীর সাধুর মোড়ে অবস্থিত স্যারের বাসায় যাই। সেদিনই আমি প্রথমবার স্যারকে দেখি। তাঁর মাথার মাঝখানে সিথি ছিল। আমীরে জামা‘আত আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কী? কোথা থেকে এসেছ? আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, মাদ্রাসার মাহফিলের জন্য বগুড়া নশিপুর থেকে গোলাম রাববানী ভাই আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি দাওয়াত গ্রহণ করলেন। আমাকে নাশতা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কোথায় যাবে? আমি বললাম, ‘মাওলানা দুর্রুল হুদা আইয়ুবী ছাহেবের বাড়িতে। তিনি আবার জানতে চাইলেন, ‘তার বাড়ির ঠিকানা তোমার জানা আছে? আমি তখন পকেটে হাত দিয়ে কাগজে লেখা ঠিকানা বের করার চেষ্টা করছিলাম। তিনি মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, ‘আগে থেকেই ঠিকানা মুখস্থ রাখা উচিত’। আমি তখনই বুঝেছিলাম, আমীরে জামা‘আতের মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতা আছে।

তাওহীদের ডাক : বগুড়া যেলা ‘আন্দোলনে’র সাবেক সভাপতি আব্দুর রহীম ছাহেবের বর্তমান অবস্থা কি?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে সাবেক সভাপতি আব্দুর রহীম ভাই বর্তমানে গাযীপুর কাশিমপুর কারাগারে আছেন। আমি তার সঙ্গে কয়েকবার দেখা করতে গিয়েছি এবং বেশ কয়েকবার ফোনে যোগাযোগ হয়েছে। কারাগারে থেকেও তিনি ধৈর্যের সঙ্গে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে তার কাছে কেউ গেলেই সর্বপ্রথম আমীরে জামা‘আতের খোঁজ-খবর জানতে চান। বিনা অপরাধে কারাগারের প্রকোষ্ঠে থেকেও যে কর্মী তার আমীরের চিন্তা করে, এমন কর্মীর শূন্যতা সবসময়ই অনুভব হয়। তার কথা স্মরণ হলেই হৃদয় কাঁপুনি দিয়ে দু’চোখ বেয়ে কান্না চলে আসে। যা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। আমরা অতি শীঘ্রই তার মুক্তি কামনা করি।

তাওহীদের ডাক : ২০০৫ সালে আমীরে জামা‘আতের গ্রেফতারের সংবাদ কিভাবে পেয়েছিলেন এবং আপনাদের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল।

হাফেয মুখলেছুর রহমান : তাবলীগী ইজতেমার জন্য টাকা সংগ্রহ করতে আমরা বাগবাড়ী বাজারে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি এসে বললেন, ‘এইবার তো আপনাদের তাবলীগী ইজতেমা হচ্ছে না’। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? তিনি বললেন, ‘আপনি জানেন না? গালিব ছাহেব গতকাল গ্রেফতার হয়েছেন’। আব্দুর রহীম ভাইয়ের আহবানে আমরা পরামর্শ বৈঠক করলাম। অতন্দ্র প্রহরীর মত আব্দুর রহীম ভাই স্যারের মুক্তির জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করলেন। আমরা তাঁরই নেতৃত্বে কাজ করতে থাকলাম। ঐ সময়গুলি একটু অবসর পেলেই প্রাণ খুলে আল্লাহর কাছে দো‘আ করতাম, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের আমীরে জামা‘আতকে যালিমের যুলুম থেকে নিরাপদ রাখুন।

তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আত বগুড়া কারাগারে থাকাকালীন স্যারের সাথে আপনারা কিভাবে সাক্ষাৎ করতেন?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : স্যার বগুড়া কারাগারে থাকা অবস্থায় কেসের তারিখগুলিতে যে কোন মূল্যে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য যেতাম। আমীরে জামা‘আতকে একপলক দেখার জন্য আমরা এই দিনের অপেক্ষায় থাকতাম। শাজাহানপুর উপজেলার লক্ষ্মীকোলা গ্রামে যাত্রা প্যান্ডেলে হামলায় নিহত শফীকুল ইসলামের পিতা বাদী হাবীবুর রহমান এবং সিএনজি চালক শফীকুল এই দু’জনই সাক্ষী ছিলেন। কোর্টে হাজিরার তারিখে আমি এ দু’জনকে কোর্টে নিয়ে যেতাম। যেহেতু আমি লক্ষ্মীকোলা ঈদগাহ মাঠে ইমামতি করতাম এবং নিহত শফীকুুলের পিতার নাম আমার পিতার নামে হওয়ায় আমি তাকে ‘বাবজী’ বলে সম্বোধন করতাম।

বাদী হাবীবুর রহমান বলতেন, ‘আমার ছেলেকে নিষেধ করা সত্ত্বেও সে যাত্রা দেখতে গিয়ে মারা গেছে। আমি তো কাউকে দোষারোপ করিনি। শফীকুুল আমার ছেলে হওয়ায় পুলিশ আমাকে বাদী করেছে। আমি একজন পাকিস্তানী নিপীড়িত ব্যক্তি। আমি আগেই শুনেছিলাম যে, গালিব ছাহেব একজন উচ্চশিক্ষিত ভালো আলেম এবং আহলেহাদীছ সংগঠনের আমীর। তাকে কেন সরকার আমার ছেলের হত্যার আসামী করল, তা আমাকে অবাক করে। আল্লাহ পাক গালিব ছাহেবকে মুক্তি দান করুন’।

হাজিরার দিনে আমরা আগেভাগে কোর্টে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আসামি বহনের গাড়ি এলে আমরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতাম। একবুক আশা নিয়ে স্যারে মুক্তির সুসংবাদের আশা করতাম। অতঃপর হাজিরা শেষে স্যারকে বিদায় জানিয়ে ভগ্ন হৃদয় নিয়ে আমরা যার যার মতো চলে যেতাম। আমীরে জামা‘আতকে এক নযর দেখার জন্য হাজিরার দিন আশ-পাশের যেলা থেকেও অনেক মানুষ আদালতে হাযির হ’ত।

তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আত কারামুক্তির জন্য আব্দুর রহীম ছাহেবের নেতৃত্বকে আপনারা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : আব্দুর রহীম ভাই ছিলেন বগুড়া যেলার এক অনন্য সংগঠক। আমীরে জামা‘আত কারাবন্দী থাকাকালীন আমি তখন সহ-সভাপতি ছিলাম। সেই সময় দেখেছি আব্দুর রহীম ভাই অনেক চেষ্টা করেছেন। কোন উকিলের হাতে কেসটি দিলে তা ভালোভাবে তদারকি হবে, তা নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত থাকতেন এবং এজন্য অনেক দৌঁড়-ঝাপ করতেন। অনেকেই কেসটি নিতে চাচিছলেন না। অবশেষে রোমান এবং আবুবকর নামে দুইজন উকিল নিয়োগ করা হয়। আব্দুর রহীম ভাই এদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন এবং যাবতীয় কাজ তিনিই পরিচালনা করতেন। আমরা তার সাথে থাকতাম।

তাওহীদের ডাক : বগুড়া যেলায় আমীরে জামা‘আতের হাত তাওহীদ ট্রাষ্ট কর্তৃক যে সমাজ কল্যাণের কাজ হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

হাফেয মুখলেছুর রহমান : বগুড়া যেলায় আমীরে জামা‘আতের হাত দিয়ে তাওহীদ ট্রাস্টের মাধ্যমে অনেক সামাজিক হয়েছে। যেমন আল-মারকাযুল ইসলামী, নশিপুরে ৬৫ শতাংশ জমির উপর নির্মিত বিশাল ভবন। এই মারকাযের সূচনা হয়েছিল ১৯৯১ সালে ‘তাহফীযুল কুরআন মহিলা মাদ্রাসা’ নামে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে বগুড়ায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য আমীরে জামা‘আতের পক্ষ থেকে একটি বাজেট বরাদ্দ করা হয়। এ উদ্দেশ্যে আনছার আলী মাস্টার চাইলেন বৃ-কুষ্টিয়ার জন্য এবং আব্দুর রহীম ভাই চাইলেন গাবতলীর জন্য। সেই সময় গোলাম রাববানী ভাই নশিপুরে মাদ্রাসাটি স্থাপনের জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন। অবশেষে নশিপুরেই মাদ্রাসা স্থাপনের অনুমোদন মেলে এবং পরে সেখানে ভবন নির্মাণ শুরু হয়। যা বর্তমানে ৮ বিঘা জমির উপর একটি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে।

এছাড়াও বগুড়া যেলার ৯টি উপযেলায় অনেক মসজিদ হয়েছে এর মধ্যে ৪৬টি মসজিদের ঠিকানা আমার ডায়েরীতে আছে। সেগুলি হ’ল বগুড়া সদর উপজেলায় ৩টি; শেরপুর উপযেলায় ৭টি, শাহজাহানপুর উপযেলায় ৬টি; সোনাতলা উপযেলায় ৩টি; শিবগঞ্জ উপযেলায় ৬টি; দুপচাঁচিয়া উপজেলায় ৪টি; সারিয়াকান্দি উপযেলায় ১টি; গাবতলী উপযেলায় ১২টি; ধুনট উপযেলায় ৪টি।

তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার কোন বিশেষ স্মৃতি আছে কি?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : আমীরে জামা‘আতের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাতটাই আমার সবচেয়ে স্মরণীয় দিন মনে হয়। তাছাড়া ২০২৩ সালের ২৮শে অক্টোবর যেলা সম্মেলনের দিন আমাদের একটি ভুলের কারণে আমরা কয়েকজন আমীরে জামা‘আতের বকুনি খেয়েছিলাম। দিনটির কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। তবে সেটি আমাদের জন্য একটি বিরাট শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, যা আমি আমার জন্য একটি নে’মত মনে করি।

তাওহীদের ডাক : দাওয়াতী ময়দানে বিশেষ কোন উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনার স্মৃতি আছে কি?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : আমাদের বাসস্থান থেকে ১০ মাইল দূরত্বের মধ্যেও আমরা দল বেঁধে ওয়ায শুনতে যেতাম। তখন আমাদের একটি ওয়ায শোনার দল ছিল। গোলাম রববানী, আব্দুল লতীফ, কুরবান, জাবেদ আলী, মুকুল, ইখতিয়ারসহ আরও কয়েকজন মিলে বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ নিতাম। যেমন নগর ফাযিল মাদ্রাসা কনফারেন্স, শাহনগর কনফারেন্স, ডেমাজানী কনফারেন্স, গাবতলী পাইলট হাই স্কুল মাঠ, বাগানবাড়ী ফাযিল মাদ্রাসা, তরফ সরতাজ ফাযিল মাদ্রাসাসহ আরও বিভিন্ন স্থানে।

তখনকার উল্লেখযোগ্য বক্তারা ছিলেন মাওলানা আব্দুল্লাহ ইবনে ফযল, আব্দুল্লাহ বিন কাজেম, আবু তাহের বর্ধমানী, আব্দুস সাত্তার ত্রিশালী, দুর্রুল হুদা আইয়ুবী, আব্দুন নূর সালাফী, আবু তাহের নাছিরাবাদী, মাওলানা আব্দুর রঊফ ছাহেব এবং আব্দুর রহমান প্রমুখ।

এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হ’ল বিলচাপরী মাদ্রাসায় ‘মুনাজাত ও দুই আযান’ নিয়ে বাহাস হয়েছিল মাওলানা আব্দুর রঊফ ও আব্দুল্লাহ বিন কাজেম ছাহেবের মধ্যে। পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা চলছিল। এক পর্যায়ে মুনাজাত জায়েয করার জন্য ইবনে কাজেম বলেন, ‘যদি একাধিক ব্যক্তি মিলে একটি ছহীহ হাদীছ প্রমাণ করে, তাহ’লে তা গ্রহণযোগ্য হবে। উত্তরে মাওলানা আব্দুর রঊফ ছাহেব রসিকতার সুরে বলেছিলেন, ‘তাহ’লে তো পাঁচজন অন্ধ মিলে একটি ভালো চোখ তৈরি হবে!

তখন উপস্থিতদের মধ্যে হইচই শুরু হয়ে যায়। সবাই বাহাস ভুলে হাসির রোলে পড়ে যায়। এটি ছিল একটি হাস্যকর ও স্মরণীয় ঘটনা।

তাওহীদের ডাক: দাওয়াতী জীবনে আপনার এমন কোন অভিজ্ঞতা আছে কি যা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : দাওয়াতী জীবনে আমি দেখেছি আমাদের সমাজে অনেক ভালো ডাক্তার, ভালো ইঞ্জিনিয়ার, ভালো আলেম, ভালো বক্তা, ভালো মাস্টার আছেন, কিন্তু ভালো মানুষের বিস্তর অভাব। ভালো রাজনীতিবিদও আছেন, তবে ভালো মানুষের অভাব রয়েছে। অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী আমল করার লোকের অভাব খুবই প্রকট আকার ধারণ করেছে। কথার পেছনে অনেক সত্য লুকিয়ে থাকে, যা বলা যায় না। সমাজে ভালো মানুষ হতে হলে আমানতদারিতা, ওয়াদা পালন, সহনশীলতা, নিঃস্বার্থপরতা, সত্যবাদিতা, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং পারিবারিক সহযোগিতার মনোভাব ইত্যাদি গুণাবলী অর্জন করা প্রয়োজন। তবেই একজন ভালো মানুষ হওয়া সম্ভব।

তাওহীদের ডাক : যুবসমাজের জন্য যদি কিছু নছীহত করতেন।

হাফেয মুখলেছুর রহমান : যুবকরা সমাজের চালিকাশক্তি। যুবকরা যে দিকে যায়, সমাজও সেই দিকে আগায়। কথারও একটি মাপ আছে; তাই আমাদের মাপ-জোখ করে কথা বলতে হবে। মুখের কথা বা ভাষা দিয়ে মানুষের মনে শান্তি আনা সম্ভব। আবার মুখের কথার কারণেও কারো ক্ষতি হ’তে পারে। আমাদের যুবকদের মাঝে অনেক সময় কথার ভুল বোঝাবুঝির কারণে কর্মীদের মাঝে অশান্তি সৃষ্টি হয়, যার ফলে কর্মীরা একে অপর থেকে দূরে চলে যায়। একশো শতাংশ কর্মী পাওয়া মুশকিল। কিন্তু যারা আছেন, তাদের দিয়ে কাজ চালাতে হবে। আন্তরিকতা এবং মৃদু ভাষায় মানুষের সাথে কথা বলতে হবে, যাতে কেউ হারিয়ে না যায়। কর্মীদের মনোবল অক্ষুন্ন রাখতে হবে এবং কেউ যেন চলে না যায়, সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।

আরেকটি ব্যাপার হ’ল যুবসমাজকে প্রচুর পড়াশোনা ও অধ্যবসয় করতে হবে। কেননা দাওয়াতের ময়দানে জ্ঞানার্জনের চেয়ে নিজেকে প্রকাশ করার একটি মনোভাব যুবসমাজের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। সুতরাং যুবকদের প্রতি আমার নছীহত থাকবে যে, তারা যেন অযথা সময় অপচয় না করে এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রচুর পড়াশোনা করে। ইবাদত-বন্দেগীতে অলসতা না করে। কেননা আল্লাহর একনিষ্ঠ ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে দাওয়াতের এক অপূর্ব শক্তি তৈরী হয়। আর ইবাদতে দুর্বল ও অলস হ’লে দাওয়াতী কাজে বরকত লাভ করা সম্ভব হয় না। সুতরাং নিজের আমলী যিন্দেগী সুন্দর করার পাশাপশি আমীরে জামা‘আত প্রণীত ও হাদীছ ফাউন্ডেশন প্রকাশিত বইপত্র পড়তে হবে। তারপর অর্জিত জ্ঞানটুকু নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করত তা সমাজের বুকে ছড়িয়ে দিতে হবে।

তাওহীদের ডাক : ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে কি?

হাফেয মুখলেছুর রহমান : যত বেশি পড়া হবে, তত বেশি শেখা যাবে। দ্বি-মাসিক তাওহীদের ডাক পত্রিকার আর্টিকেলগুলো সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এতে রয়েছে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, যা থেকে ইমাম বা খতীব ছাহেবগণ বেশ উপকৃত হবেন। এতে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার রয়েছে, যা থেকে অনেক অজানা বিষয় জানা যায়। এতে সংগঠন সংবাদ, সাধারণ জ্ঞান ও কুইজও রয়েছে, যা পড়লে যুবক ও সোনামণিরা উৎসাহিত হয়। আমি মহান আল্লাহর কাছে ‘যুবসংঘে’র মুখপত্র ‘তাওহীদর ডাক’-এর ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও কবুলিয়াত কামনা করছি।

তাওহীদের ডাক : মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

হাফেয মুখলেছুর রহমান : আমি আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এর মাধ্যমে দূর অতীতের অনেক অজানা স্মৃতি ও তথ্য রোমন্থন হ’ল। জাযাকুমুল্লাহু খায়রান।



আরও