আপেক্ষিকতাবাদ ও ইসলাম

আব্দুল মাজীদ 384 বার পঠিত

আগ্রহ, কৌতূহল ও পর্যবেক্ষণের সমন্বয়ে মানব সভ্যতা অসংখ্য বিস্ময়ের আবিষ্কার করেছে। বর্তমানে আধুনিক প্রগতিশীল বৈজ্ঞানিকগণও ক্রমেই চূড়ান্ত সত্যধর্ম ইসলামের নিদর্শনগুলোকে আরও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরছেন। অথচ এই আধুনিক বিজ্ঞানের উত্থান মহানবী (ছাঃ)-এর সময় থেকেই ভিত্তি লাভ করেছে। যদিও সে সময় বিজ্ঞান আজকের মতো বিশ্লেষণাত্মক বা প্রাতিষ্ঠানিক ছিল না। তবু রাসূলের মে‘রাজের ঘটনা, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়া এবং পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির ইঙ্গিতের মতো বিষয়গুলো আধুনিক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ হিসাবে বিবেচিত। পাশাপাশি আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্ট প্রকৃতি নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের আহবান জানানো কুরআনের আয়াতগুলো মুমিন বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করে, যা সোনালী যুগের বিজ্ঞানচর্চার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

আপেক্ষিকতা নিয়ে আলোচনা করা যাক। ইসলামের সাথে কতটা সম্পর্কযুক্ত তত্ত্বটি কিংবা কতটা সাংঘর্ষিক? আলোচনার পূর্বেই কিছু টার্ম ক্লিয়ার করি। আপেক্ষিকতা বলতে আসলে কি বোঝায়? আপেক্ষিক অনেকটা নিরপেক্ষ এর বিপরীত। নিউটনীয় বলবিদ্যা অনুসারে, সময় ব্যতীত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সবকিছুই আপেক্ষিক। অর্থাৎ সময় নিরপেক্ষ, আমার-আপনার সকলের কাছে সময় একই। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র বিবেচনায় সময়ের ভিন্নতা নেই। আরেকটি টার্ম-ডিমেনশন। ডিমেনশন অনুসারে সময় গণনার বিষয়টি একেক জনের জন্য একেক রকম হ’তে পারে। সংক্ষেপে বললে, সময় আপেক্ষিক। একসময় ধারণা ছিল যে, মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানে এবং যেকোনো অবস্থায় সময়ের মান সমান। অর্থাৎ একটি ঘড়ির এক সেকেন্ড বা এক মিনিট সব অবস্থাতেই একই রকম থাকবে। কিন্তু বাস্তবে সময়ের হিসাব অবস্থান, গতি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে আলাদা হ’তে পারে। যেমন, যদি কেউ খুব দ্রুত গতিতে একটি রকেটে ভ্রমণ করে আর অন্যজন পৃথিবীতে স্থির থাকে, তাহ’লে রকেটে থাকা ব্যক্তির জন্য পৃথিবীর তুলনায় সময় ধীরে চলবে। অন্যদিকে পৃথিবীতে স্থির থাকা ব্যক্তির জন্য রকেটে থাকা ব্যক্তির তুলনায় সময় দ্রুত গতিতে চলবে। যে যত দ্রুতগতিতে চলতে পারে, তার ঘড়ি অন্যদের তুলনায় তত ধীরে চলে। সময়ের এই ভিন্নতাকেই বলা হয় সময় আপেক্ষিকতা।

একইভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও সময়ের গতিকে পরিবর্তন করতে সক্ষম। যদি কোনো গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর চেয়ে ৫ গুণ বেশি হয়, তবে ওই গ্রহে সময় পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ৫ গুণ ধীরে চলবে। আবার যদি দুইজন ব্যক্তি একে অপরের থেকে আলাদা স্থানে অবস্থান করেন, যেমন একজন চাঁদে এবং অন্যজন পৃথিবীতে, তবে চাঁদে থাকা ব্যক্তির ঘড়ি পৃথিবীতে থাকা ব্যক্তির তুলনায় দ্রুত চলবে। কারণ চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ বল পৃথিবীর তুলনায় কম। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সময়ের গতিকে প্রভাবিত করে এবং যিনি যতো শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ বলের কাছে থাকবেন, তার ঘড়ি ততো ধীরে চলবে। এই ঘটনা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘বিশেষ আপেক্ষিকতা’ বা ‘গ্র্যাভিটেশনাল টাইম ডাইলোশান’ নামে পরিচিত।

আপেক্ষিকতায় নিউটনীয় তত্ত্ব : পদার্থবিজ্ঞান মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞান এবং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি-র যুগান্তকারী অবদানের পর কিংবদন্তি বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন ১৬৮৬ সালে তার বিখ্যাত ক্লাসিকাল মেকানিক্সের তিনটি সূত্র প্রণয়ন করেন। এই সূত্রগুলোর ক্ষেত্রে সময় ছাড়া বাকি সবকিছু আপেক্ষিক। সময় একমাত্র নিরপেক্ষ, যা পর্যবেক্ষকের অবস্থানের পরিবর্তনে ভিন্ন হয় না। সরল উদাহরণ দিয়ে বললে, ক্রিকেট খেলার সময় ব্যাটার যখন বলটি হিট করে, তখন বলটি তাৎক্ষণিকভাবে উল্লম্বভাবে উপরে উঠে যায় না। বরং, সময়ের সাথে সাথে বলটি দূরত্ব অতিক্রম করে সিক্স হয়ে যায়। এখানে সময়ের পরিবর্তন সবার জন্য সমান। এমন নয় যে, আমার জন্য ২ সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে, আর আমার বন্ধুর জন্য ৪ সেকেন্ড। সবক্ষেত্রেই সময়ের গতিপ্রকৃতি সবার জন্য অভিন্ন। এটি সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

আমাদের এই জগৎ মূলত তিনটি স্থানিক মাত্রা (ত্রিমাত্রিক) এবং একটি মাত্রা অর্থাৎ সময় নিয়ে গঠিত। নিউটনীয় বলবিদ্যায় সময়কে পরম বা নিরপেক্ষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এর অর্থ হ’ল, সময় কোনো পর্যবেক্ষকের জন্য কখনো আলাদা বা পরিবর্তিত হয় না। এটি সর্বদা সবার জন্য এক ও অভিন্ন থাকে। নিউটনীয় বলবিদ্যার প্রধান ধারণা হ’ল, সময় একটি অপরিবর্তনশীল এবং স্থির রাশি, যার সাপেক্ষে অন্যান্য সব পরিমাপীয় রাশি পরিবর্তিত হয়। তবে সময় ব্যতীত অন্য সব রাশি আপেক্ষিক। সহজ ভাষায়, নিউটনের গতিসূত্রগুলো স্থির বস্ত্তকে কেন্দ্র করেই প্রণীত। উদাহরণ স্বরূপ, একটি গাড়ি যদি স্থির অবস্থা থেকে কোনো বল প্রয়োগের মাধ্যমে গতি অর্জন করে, তবে সেই পরিবর্তন এবং এর ফলাফল ব্যাখ্যা করতে নিউটনের গতিসূত্র প্রয়োগ করা হয়। নিউটনের তিনটি সূত্র মূলত বল প্রয়োগের ফলে কোনো বস্ত্তর গতি বা অবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে, তা সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে।

উদাহরণ স্বরূপ মনে করুন! আজ আমি আর আমার বন্ধু দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি, আর আপনি আমাদের দর্শক। আমরা দু’জন একই গতিতে দৌড়াচ্ছি অর্থাৎ আমার গতি আর আমার বন্ধুর গতি সমান। এখন যদি আমি আমার বন্ধুকে দেখি, মনে হবে সে আমার অবস্থানেই রয়েছে। কারণ আমাদের অবস্থান পরস্পরের তুলনায় অপরিবর্তিত। অর্থাৎ আমার দৃষ্টিতে সে স্থির। কিন্তু আপনার অর্থাৎ দর্শকের দৃষ্টিতে আমরা দু’জনেই একই গতিতে দৌড়াচ্ছি। কারণ আপনার গতি শূন্য। এখানেই অবস্থান স্থির বা গতিশীল হওয়ার বিষয়টি আপেক্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমার বন্ধু স্থির কিন্তু আপনার কাছে আমরা দু’জনই গতিশীল।

আপেক্ষিকতায় আইন্সটাইনের তত্ত্ব : আমাদের ত্রিমাত্রিক স্থান ব্যবস্থায় নিউটনীয় বলবিদ্যা অনুসারে, সময়কে একটি আলাদা অক্ষ হিসাবে ধরা হ’ত। তবে আইন্সটাইনের তত্ত্ব অনুসারে সময় আমাদের এই ত্রিমাত্রিক স্থান ব্যবস্থার চতুর্থ মাত্রা। অর্থাৎ আমাদের জগত সময়সহ আরও তিনটি মাত্রা মিলিয়ে একটি চার মাত্রিক ব্যবস্থায় অবস্থান করছে। চতুর্থ মাত্রা বুঝতে অতিরিক্ত চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আইন্সটাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী সময় আপেক্ষিক। আমরা সাধারণত জানি, সময় সবার কাছে অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয়। কিন্তু আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে সময় বেগের উপর নির্ভরশীল এবং এটি সাপেক্ষিক। এটি অনেকের কাছে প্রথমে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তবে সেই সময়ের এক সাধারণ কেরানী, যিনি কখনো ভাবেননি যে তার নাম ইতিহাসে লেখা হবে, আজকের দিনে সেই তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন।

যদি সময় আপেক্ষিক হয়, তাহ’লে কী ঘটবে? ধরুন, আমি চলমান আর আপনি স্থির। তাহ’লে আমার কাছে ১ সেকেন্ড আপনার কাছে ১.৬৪ সেকেন্ড হ’তে পারে। এটিই হচ্ছে ‘সময়ের সম্প্রসারণ’ বা 'টাইম ডিলেশন'। অর্থাৎ সময় আপেক্ষিক এবং এটি বেগ সাপেক্ষে পরিবর্তিত হয়। তবে যদি বেগ আলোর বেগের কাছাকাছি না হয়, তবে এই পার্থক্য অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং তা সাধারণত উপেক্ষা করা যায়।

আরেকটি বৈজ্ঞানিক উদাহরণ দেওয়া যাক, ‘মিউওন’ নামক কণিকা। কণা বলতে সাধারণত আমরা ধূলিকণার কথা বলি, যা সাধারণ চোখে দেখতে খুবই ক্ষুদ্র হয়। এই কণার ছোট বা ক্ষুদ্র অংশকেই কণিকা বলা হয়। ‘মিউওন’ একটি বিশেষ ধরনের কণিকা, যার স্থায়িত্বকাল মাত্র ২.২ মাইক্রোসেকেন্ড! মাইক্রোসেকেন্ড মানে এক সেকেন্ডের ১ লক্ষ ভাগের এক ভাগ, যা অত্যন্ত ক্ষুদ্র সময়। তাত্ত্বিকভাবে, এই সময়টুকু খুবই অল্প, যা চোখের পলক ফেলতেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তবে ‘মিউওন’ কণিকার গতি আলোর গতির কাছাকাছি, অর্থাৎ এটি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩০ লক্ষ মিটার অতিক্রম করতে সক্ষম। ফলে সাধারণত মিউওন কণা, যা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা, অতিবেগতিক গতির কারণে তার স্থায়িত্বকাল অনেক কমে যায় বা ধীরে চলে। এ কারণে তাত্ত্বিকভাবে মিউওন কণিকার অস্তিত্ব শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়! এটি অবিশ্বাস্য মনে হ’তে পারে। তবে বিজ্ঞানের আলোকে এটি প্রমাণিত।

আপেক্ষিকতায় ইসলামী তত্ত্ব : আপেক্ষিকতা নিয়ে অনেক কথা হ’ল। অনেক তত্ত্ব নিয়েও ঘাটাঘাটি হ’ল। এখন ইসলাম এই ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’ কতটা সাপোর্ট করে তা দেখে আসি। আপেক্ষিকতা বলতে এখন শুধু আইনস্টাইনের থিওরি বুঝব, যেহেতু আধুনিকায়নে মডার্ণ ফিজিক্স প্রকৃতির ব্যাখ্যা করতে পারে।

আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,وَإِنَّ يَوْمًا عِنْدَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّونَ ‘আর নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের কাছে একটি দিন তোমাদের গণনার এক হাযার বছরের সমান’ (হজ্জ ২২/৪৭)। উক্ত আয়াতে স্পষ্ট ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’- এর নির্দেশ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং নিজেই সময়ের আপেক্ষিকতার দিকটি বুঝিয়েছেন। কুরআন কিন্তু কোন সায়েন্সের বই কিংবা ডকুমেন্টারি না, কুরআন হ’ল সাইন বা নিদর্শন।

উক্ত আয়াতে সময়ের আপেক্ষিকতার নিদর্শন সহজেই অনুধাবন করা যায়। শুধু উক্ত আয়াতই নয়, আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন,تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ ‘যে সিঁড়ি দিয়ে ফেরেশতাগণ ও জিব্রীল তার দিকে ঊর্ধ্বারোহন করে। যে দিনের পরিমাণ তোমাদের পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান’ (মা‘আরিজ ৭০/৪)

সময়ের আপেক্ষিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আইনস্টাইনের Theory of relativity তে ১৯০৫ সালে। এর আগে সময়ের আপেক্ষিকতা নিয়ে মানুষের তেমন ধারণা ছিল না। মজার ব্যাপার হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা ১৫০০ বছর পূর্বেই এই আপেক্ষিকতা নিয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আর আজ আমরা বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কারে অভিমুগ্ধ! মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা যে ১৫০০ বছর আগেই ব্যাপারটি বলেছিলেন, এক্ষণে আমরা সেটির থিওরিটিকাল বহিঃপ্রকাশ দেখলাম মাত্র।

আয়াতটি একটু গভীরভাবে বুঝে দেখি। আমাদের কাছে যা ৫০ হাযার বছর, ফেরেশতারা তা মাত্র এক দিনে অতিক্রম করেন। ঠিক সময়ের অপেক্ষিকতার ব্যাপারটা। ফেরেশতাদের সময়ের সম্প্রসারণ কত বেশী? এক দিন আর পঞ্চাশ হাযার বছরের তুলনা! ‘মিউওন’ কণিকার উদাহরণটা আরেকবার পড়ে দেখুন। মডার্ণ ফিজিক্সের আলোকে, বেগের গতিশীলতার উপরে আমাদের সময় আপেক্ষিক। তাহ’লে ফেরেশতাদের গতি কেমন? তারা ১ বছর অতিক্রমের পথটুকু আমাদের অতিক্রম করতে ৫০ হাযার বছরের প্রয়োজন! ঠিক ‘মিউওন’ কণিকা ২.২ মাইক্রোসেকেন্ড স্থায়িত্বকাল অধিক গতির ফলে সময়ের কেমন সম্প্রসারণ! ব্যাপারগুলো ভেবে দেখেছেন! আলোর সৃষ্টিকর্তা চাইলেই আলোর চেয়ে দ্রুত গতিশীল হ’তে পারেন। চাইলেই ফেরেশতাদের তিনি সেই সক্ষমতা দিতে পারেন!

রাসূল (ছাঃ)-এর মে‘রাজ ভ্রমণ : ‘বোরাক্ব’ আরবী ‘বারক্ব’ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন যার অর্থ বিদ্যুৎ (Electric/Current)। বিদ্যুতের অন্যতম প্রধান ধর্ম হচ্ছে দ্রুত পরিবাহিত হওয়া। সেকারণ দ্রুতগতি বুঝাতে বলা হয়ে থাকে বিদ্যুত গতি। মক্কা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত ঘোড়া বা উটে যাতায়াতে দু’মাসের পথ। রাতের শেষভাগে জিবরীল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশমতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে বোরাক্বে আরোহণ করিয়ে বায়তুল্লাহ থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছে তিনি বোরাক্বটিকে একটি পাথরের সাথে বেঁধে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে দু‘রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। অতঃপর তাঁর নিকট ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণের বিশেষ বাহন উপস্থিত করা হয়। মতান্তরে ঐ বোরাক্বের মাধ্যমে জিবরীল (আঃ) তাঁকে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত নিয়ে যান।[1]

তিনি প্রথম আসমানে আদম, দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহইয়া ও ঈসা, তৃতীয় আসমানে ইউসুফ, চতুর্থ আসমানে ইদরীস, পঞ্চম আসমানে হারূণ, ষষ্ঠ আসমানে মূসা এবং সপ্তম আসমানে ইব্রাহীম (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ফেরেশতাদের কলম দিয়ে লেখার খসখস আওয়ায শোনেন। ছয়শো ডানাবিশিষ্ট জিব্রীলকে তার নিজস্ব রূপে নিকট থেকে দেখেন। সিদরাতুল মুনতাহার গাছ দেখেন। সপ্তম আসমানে বায়তুল মা‘মূর মসজিদ দেখেন। হাউয কাওছার, জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেন। তিনি জান্নাতের নে‘মতরাজি ও জাহান্নামের কঠিন শাস্তিসমূহ প্রত্যক্ষ করেন। তাঁকে তাঁর জন্য নির্ধারিত সুফারিশের স্থান ‘মাক্বামে মাহমূদ’ দেখানো হয়। সিদরাতুল মুনতাহায় পেঁŠছলে চারদিকে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এরই মধ্যে আল্লাহ তাঁর সাথে সরাসরি অহি-র মাধ্যমে কথা বলেন। অতঃপর তিনি নেমে আসেন এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে নবীগণের ছালাতে ইমামতি করেন। অতঃপর বোরাকে চড়ে রাত্রি কিছু বাকী থাকতেই মক্কায় মাসজিদুল হারামে ফিরে আসেন। এর সবকিছুই এক রাতেই সংঘটিত হয়’।[2]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মুখনিঃসৃত মে‘রাজের বর্ণনা সম্বলিত হাদীছে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আমার জন্য বোরাক্ব পাঠানো হ’ল। বোরাক্ব গাধা থেকে বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট একটি সাদা রঙের জন্তু। যতদূর দৃষ্টি যায় এক পদক্ষেপে সে ততদূর চলে’।[3] এক কথায় রাসূল (ছাঃ) এক রাতেই ইসরা এবং মে‘রাজ করেছেন, উর্ধ্বগমন করেছেন সপ্তাকাশের সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত। যেখানে একটি আকাশ আসমান-যমীন পর্যন্ত বিস্তৃত। সেটিও তো আল্লাহর কুদরত।

ক্বিয়ামতের দিনের সময় : হিসাবের দিন এক দিনই হবে। তবে সেই দিনটি পৃথিবীর হিসাবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান হবে’।[4] উল্লেখ্য যে, আরবীতে সত্তর, সাতশো, এক হাযার ও পঞ্চাশ হাযার সংখ্যাগুলি সাধারণত আধিক্য বুঝানোর অর্থে বলা হয়। সুতরাং উক্ত আয়াত ও হাদীছসমূহের বর্ণিত সময়টি আযাব বা শাস্তির সাথে সম্পৃক্ত। কাফেরদের উপর এই দিনটি ৫০ হাযার বছরের সমান ভারী হবে। অর্থাৎ দিনটি তাদের জন্য খুবই কষ্টকর হবে। কষ্ট ও শাস্তির আধিক্যের কমবেশীর কারণে ক্বিয়ামতের দিনের স্থায়িত্ব তাদের কাছে হাযার হাযার বছরের সমান মনে হবে। আরবরা খুশীর দিনকে ‘সংক্ষিপ্ত’ এবং কষ্টের দিনকে ‘দীর্ঘ’ বলে বুঝাতো (কুরতুবী)। অন্যদিকে মুমিনদের জন্য এই দিনটি হবে খুব সংক্ষিপ্ত। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘মুমিনদের জন্য ক্বিয়ামতের দিনটি যোহর থেকে আছরের মধ্যবর্তী সময়ের মত হবে’।[5] অপর হাদীছে এসেছে, ‘এই দিনটি মুমিনের জন্য এক ওয়াক্ত ফরয ছালাত আদায় করার থেকেও সংক্ষিপ্ত মনে হবে’।[6] সুতরাং এই দিনের দীর্ঘতা কিংবা সংক্ষিপ্ততা বিভিন্ন লোকের জন্য তার আমলের অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন রূপ অনুভূত হবে’।[7]

উপসংহার : আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের চোখে আপেক্ষিকতা অকল্পনীয় বিষয়। সময় যে আপেক্ষিক তা সূরা ইখলাছ পড়লেই বুঝতে পারবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন’ (ইখলাছ ১১২/২)। তিনি ছাড়া মহাবিশ্বের, মহাজগতের সকল ক্ষুদ্র অণু-পরমাণু তাঁরই মুখাপেক্ষী। মজার ব্যাপার হ’ল, এই আপেক্ষিকতার থিওরি ছাড়াও জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি এখনো সম্পূর্ণ না, ত্রুটি রয়েছে অনেকাংশে। জেনারেল থিওরিটা অন্য ব্যাপার, ভরের ফলে স্থানের বক্রতা প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞানের নিত্য আবিষ্কারের ভেতরেও রয়েছে অনেক ত্রুটি, যেটির জন্য দরকার আরও গবেষণা। দরকার ইসলামের অন্যান্য ভাবনাসমূহ আলোচনা করা। যেগুলো আজ তেমন নেই মুমিনদের অন্তরে। কথাগুলো ভাবলেই মনে পড়ে যায় সূরা মুহাম্মাদের কথা, أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا ‘তবে কি তারা কুরআন অনুধাবন করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলি তালাবদ্ধ?’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)। আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন-হাদীছের প্রকৃত বিজ্ঞানী হওয়ার তাওফীক দান করুন।-আমীন!

[ছানাবিয়া ১ম বর্ষ, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী।]

[1]. মাসিক আত-তাহরীক ১৭/৮ সংখ্যা, মে ২০২৪।

[2]. বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬৪, ১৭৮; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৬।

[3]. বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬২, ১৬৪; মিশকাত হা/৫৮৬২।

[4]. মা‘আরেজ ৭০/৩-৪; মুসলিম হা/৯৮৭; মিশকাত হা/১৭৭৩।

[5]. হাকেম হা/২৮৪; ছহীহাহ হা/২৪৫৬; ছহীহুল জামে হা/৮১৯৩।

[6]. আহমাদ হা/১১৭৩৫, ইবনু হিববান হা/৭৩৩৪, সনদ দুর্বল; তবে হায়ছামী এবং ইবনু হাজার একে ‘হাসান’ বলেছেন।

[7]. মাসিক আত-তাহরীক ২৩/৩, ডিসেম্বর ২০১৯।



আরও