কম্পিউটার এথিকস্ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

হাসীবুর রশীদ 88 বার পঠিত

কম্পিউটার (Computer) শব্দের অর্থ গণনাকারী যন্ত্র যা নিয়মতান্ত্রিকভাবে কিছু হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। উইকিপিডিয়াতে Computer শব্দের অর্থ বলা হয়েছে যে, কম্পিউটার (Computer) শব্দটি গ্রিক ‘কম্পিউট’ (compute) শব্দ থেকে এসেছে। Compute শব্দের অর্থ হিসাব বা গণনা করা।[1] আর ‘Ethics’ শব্দের অর্থ হ’ল নৈতিক, নীতিশাস্ত্র বা নীতিশাস্ত্র সম্বন্ধীয়। তাই উভয়ের সম্মিলিত অর্থই হচ্ছে Computer Ethics বা কম্পিউটার ব্যবহারে নৈতিকতা। তবে মানুষের এই দৈনন্দিন জীবনে ‘তথ্য’-এর সংশ্লিষ্টতা কম্পিউটারকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। আর এই বিষয়টির সাথে সম্পৃক্ত ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’। এই বহুল ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছটিতে মূলত ২ প্রকারের প্রযুক্তি রয়েছে। একটি হ’ল ‘তথ্য প্রযুক্তি’। অন্যটি ‘যোগাযোগ প্রযুক্তি’। আর এই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাথে যে জিনিসটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা হ’ল ‘কম্পিউটার’। বর্তমান বিশ্বের কাঁচামাল হিসাবে ধরা হয় তথ্যকে। তথ্য হ’তে পারে ধর্মীয়, ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অথবা বৈশ্বিক। তবে যেদিন থেকে কম্পিউটার পরিপূর্ণ ব্যবহার শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে এতে ব্যবহৃত তথ্যের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে এসেছে।

কিন্তু তথ্যের অবাধ ব্যবহার এবং অতি স্বেচ্ছাচারিতা মানুষকে পরিণত করেছে পশুর চেয়েও অধম। এজন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী নির্ধারিত কিছু নিয়ম ও নৈতিকতা বেধে দিয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে ‘Computer Ethics’। ১৯৯২ সালে ‘কম্পিউটার এথিকস ইন্সটিটিউট’ কম্পিউটার এথিকস-এর ১০টি নির্দেশনা তৈরী করে, যেটি ‘In Pursuit of a Ten Commandment' for Computer Ethics’ গবেষণাপত্রে উপস্থাপন করা হয়।

তবে বস্ত্তবাদী বিদ্যার নেতিবাচক প্রভাবে বিজ্ঞানের ইতিবাচক ব্যবহার কমে যাচ্ছে। ফলে আমানতদারিতার সম্মুখে জেগে উঠেছে নানা প্রশ্ন। তবে ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বিজ্ঞানের সুষ্ঠু ব্যবহার দ্বারা মানুষের বৃহৎ কল্যাণ সাধণের সুযোগ রয়েছে। কেননা দুনিয়ার কোনো কিছুই মহান প্রতিপালক মানুষের কল্যাণ ব্যতীত বৃথা সৃষ্টি করেননি। আর এদিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا- ‘আমি পৃথিবীর সবকিছুকে পৃথিবীর জন্য শোভা করেছি, যাতে লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভালো কাজ করে’ (কাহফ ১৮/৭)

আলোচ্য প্রবন্ধে উক্ত এথিকস্ এ উপস্থাপিত নৈতিকতার বিষয়গুলো ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর সাথে যে পূর্ব থেকেই প্রতিনিধিত্ব করে সেই বিষয়টিই আলোকপাত করার প্রচেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

১. অন্যের ক্ষতি করার জন্য কম্পিউটার ব্যবহার না করা : অপরের ক্ষতি না করার জন্য ইসলামের কড়া হুঁশিয়ারি রয়েছে। আল্লাহ বলেন,لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ... ‘অত্যাচার করো না ও অত্যাচারিত হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‏ لاَ ضَرَرَ وَلاَ ضِرَارَ- ‏ ‘অন্যের ক্ষতি করো না এবং নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না’।[2] রাসূল (ছাঃ) অন্যের ক্ষতি করে তার প্রতি যুলুম করা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন’।[3]

অতএব, আমাদের সর্ববিষয়ে সর্বদা সতর্ক অবলম্বন করতে হবে, যেন আমাদের যেকোনো প্রকার কথা ও কর্ম দ্বারা যেন অন্যের কোনো প্রকার ক্ষতিসাধন না হয়।

২. অন্যের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টির জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তিকে ব্যবহার না করা : যেকোনো কাজে মানুষকে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে তার সময়ের অপচয় করিয়ে তাকে ক্ষতির মুখে ফেলে দেওয়া এক প্রকার যুলুম। এজন্যই মানুষকে কষ্ট দিতে মহান আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا- ‘অপরাধ না করা সত্ত্বেও যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে’ (আহযাব ৩৩/৫৮)

এ ব্যাপারে হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تَحَاسَدُوْا وَلاَ تَنَاجَشُوْا وَلاَ تَبَاغَضُوْا وَلاَ تَدَابَرُوْا وَلاَ يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا. الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ. التَّقْوَى هَا هُنَا. وَيُشِيْرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ.‘তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, পরস্পর ধোঁকাবাজি করো না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না, একে অপরের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে অগোচরে শত্রুতা করো না এবং একে অন্যের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করবে না। তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে থাকো। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর অত্যাচার করবে না, তাকে অপদস্ত করবে না এবং হেয় প্রতিপন্ন করবে না। তাক্বওয়া এখানে, এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনবার স্বীয় বক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে হেয় জ্ঞান করে। কোন মুসলিমের উপর প্রত্যেক মুসলিমের জান-মাল ও ইয্যত-আব্রু হারাম’।3F[4]

মানুষকে কষ্ট দেওয়ার আরেকটি মাধ্যম হচ্ছে ধোঁকা দেওয়া বা প্রতারণা করা। এ সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيهَا فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلاً فَقَالَ‏ مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُولَ اللهِ‏ قَالَ‏ أَفَلاَ جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَىْ يَرَاهُ النَّاسُ مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي-‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্তূপীকৃত খাদ্যদ্রব্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এর ভিতর হাত ঢুকালে আঙুল ভিজা অনুভব করলেন। তিনি মালিককে বলেন, এটা কি? সে উত্তর দিল, বৃষ্টির পানিতে এগুলো ভিজে গিয়েছিল, হে আল্লাহর রাসূল! তখন তিনি বললেন, ভিজাগুলোকে স্তূপের উপরে রাখলে না কেন, যাতে লোকেরা তা দেখতে পায়? যে ধোঁকা দেয় সে আমার (উম্মতের) অন্তর্ভুক্ত নয়’।4F[5] তিনি আরো বলেন, مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا، وَالْمَكْرُ وَالْخِدَاعُ فِي النَّارِ، ‘যে ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আর ধোঁকাবাজ ও প্রতারক জাহান্নামে যাবে’।5F[6]

৩. অন্যের কম্পিউটারের ডেটার উপর নজরদারি না করা : কোন মানুষের প্রতি নজরদারি বা খারাপ ধারণা পোষণ করা সমীচীন নয়। কেননা এতে মানুষ কষ্ট পায়। বরং মুমিনের প্রতি সুধারণা পোষণ করা কর্তব্য। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اجْتَنِبُوْا كَثِيْرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অধিক ধারণা হ’তে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ’ (হুজুরাত ৪৯/১২)

মানুষের দোষ-ত্রুটি খুঁজতে রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন এবং এর মন্দ পরিণতি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,وَلاَ تَتَّبِعُوْا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِى بَيْتِهِ ‘তোমরা দোষ-ত্রুটি তালাশ করবে না। কারণ যারা তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষ-ত্রুটি তালাশ করলে তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপদস্থ করে ছাড়বেন’।[7]

বর্তমান কিছু হ্যাকারদের কাজই হ’ল বিভিন্ন কম্পিউটার থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহ করে ব্যহারকারীকে বিপাকে ফেলে টাকা দাবি করা। অথচ রাসূল (ছাঃ) মুসলিম ভাইয়ের গোপনীয় বিষয় প্রকাশে নিরুৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন,مَنْ سَتَرَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمَنْ كَشَفَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ كَشَفَ اللهُ عَوْرَتَهُ حَتَّى يَفْضَحَهُ بِهَا فِى بَيْتِهِ، ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপনীয় বিষয় গোপন রাখবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার গোপনীয় বিষয় গোপন রাখবেন। আর যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপনীয় বিষয় ফাঁস করে দিবে, আল্লাহ তার গোপনীয় বিষয় ফাঁস করে দিবেন। এমনকি এই কারণে তাকে তার ঘরে পর্যন্ত অপদস্থ করবেন’।7F[8]

৪. তথ্য চুরির উদ্দেশ্যে কম্পিউটার ব্যবহার না করা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَعَنَ اللهُ السَّارِقَ يَسْرِقُ الْبَيْضَةَ فَتُقْطَعُ يَدُهُ، وَيَسْرِقُ الْحَبْلَ فَتُقْطَعُ يَدُهُ- ‘সে চোরের উপর আল্লাহর লা‘নত, যে একটি ডিম চুরি করার ফলে তার হাত কাটা হয় এবং যে একটি দড়ি চুরি করার ফলে তার হাত কাটা যায়’।[9] অত্র হাদীছে একটি ডিম ও একটি দড়ি চুরি করাকে জঘণ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করেছেন। অথচ কম্পিউটারের মাধ্যমে অন্যের লেখা অনুমতি ছাড়াই নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া, অন্যের ডিজাইন নিয়ে ব্যবসা করা, কোন কোম্পানির ব্যবসায়িক গোপন তথ্য সংগ্রহ করে অন্যের কাছে বিক্রি করাসহ নানাবিধ অপরাধ হর-হামেশা চলছে। যা অনেকেই অপরাধ মনে করেন না। তাই অন্যের কপিরাইট কোন কিছু নিজের করে নেওয়া থেকে বেঁচে থাকা যরূরী।

৫. মিথ্যা তথ্য রটানো থেকে বিরত : যে কোন অবস্থায় মিথ্যা তথ্য রটানো বা গুজবে কান দিয়ে অথবা স্রেফ ধারণার ভিত্তিতে কোন অপপ্রচার বা অনাকাঙ্ক্ষিত কর্ম করা নিষিদ্ধ। রাসূল (ছাঃ) বলেন,كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سمع ‘†কান ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শোনে তা-ই প্রচার করে’।[10] তিনি আরও বলেন, وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلَّا ظَنًّا إِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِى مِنَ الْحَقِّ شَيْـًا إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ- ‘আর তাদের অধিকাংশ কেবল অনুমানেরই অনুসরণ করে, সত্যের পরিবর্তে অনুমান তো কোন কাজে আসে না, তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবগত (ইউনুস ১০/৩৬)

এক্ষণে মিথ্যা তথ্য রটানোর পরিণাম এবং তা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! যদি কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন খবর নিয়ে আসে, তাহ’লে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে; যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়কে আঘাত না কর এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও’ (হুজুরাত ৪৯/৬)

অতএব মিথ্যা তথ্য রটানো থেকে যেমন বিরত থাকা কর্তব্য, তেমনি এর ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও উচিত নয়।

৬. যেসব সফটওয়্যার-এর জন্য অর্থ প্রদান করা হয়নি (পাইরেটেড), সেগুলো ব্যবহার বা কপি না করা : অন্যের অনুমতি ব্যতীত তার যেকোনো জিনিস ব্যবহার করা অন্যায়। তা যদি হয় তথ্যের অথবা পারিশ্রমিকের বিষয় তা অন্যায় কাজ। তাই উৎপাদনকারী যেই হোক না কেন তার থেকে সেবা গ্রহণের পর যথারীতি তার পাওনা পরিশোধ করা বাঞ্ছনীয়। যদি এরূপ না করা হয় তবে তা হবে মহা যুলুম। তাদের প্রথম দাবী বা অধিকার হ’ল তাদের শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أعْطوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ ‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরী দিয়ে দাও’।[11] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে। তার মধ্যে একজন হ’ল যে শ্রমিকের নিকট থেকে পূর্ণ শ্রম গ্রহণ করে, অথচ তার পূর্ণ মজুরী প্রদান করে না’।[12] অন্যের জিনিস আত্মসাৎ করা গর্হিত অপরাধ। কোনো প্রকৃত ধার্মিক ও রুচিশীল ভদ্র মানুষ এমন করতে পারে না। তাই যে যা আত্মসাৎ করবে, তা নিয়ে বিচারের মাঠে উপস্থিত হবে।

আল্লাহ বলেন, وَمَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَغُلَّ وَمَنْ يَغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ- ‘কোনো নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে তিনি খিয়ানত করবেন। আর যে ব্যক্তি খিয়ানত করবে সে ক্বিয়ামতের দিন সেই খিয়ানত করা বস্ত্ত নিয়ে উপস্থিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই পরিপূর্ণভাবে পাবে যা সে অর্জন করেছে। আর তাদের প্রতি কোনো অন্যায় করা হবে না’ (আলে ইমরান ৩/১৬১)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি যাকে তোমাদের কোনো কাজের দায়িত্বশীল করি, অতঃপর সে সুচ পরিমাণ বস্ত্ত বা তার চেয়ে বেশি সম্পদ আত্মসাৎ করল, সেটাই হবে খিয়ানত। কিয়ামতের দিন সেই বস্ত্ত নিয়ে সে উপস্থিত হবে’।F[13] বর্তমানে লক্ষণীয় যে, অধিকাংশ ডেভেলপারগণ কম্পিউটার সফটওয়্যার সমূহ বিনামূল্যে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। তারা মূল সফটওয়্যার এর নকল কপি (crack version/mod version) ব্যবহার করছেন। এতে করে দেখা যাচ্ছে যে নির্দিষ্ট কোম্পানি তাদের পারিশ্রমিক পাচ্ছে না। আমার আমাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে তাদের সেবাগুলো ব্যবহার করব অথচ তাদের শ্রমের মর্যাদা না দিয়ে পারিশ্রমিক দেব না, এটা কি এক প্রকারের যুলুব বা আত্মসাৎ নয় কি?

৭. অনুমতি ব্যতিরেকে অন্যের কম্পিউটার রিসোর্স ব্যবহার না করা : কোন ব্যক্তির মালিকানাধীন জিনিস তার অনুমতি ছাড়া গ্রহণ করা যাবে না। সেটা যে ধরনের বস্ত্তই হোক। সুতরাং কপিরাইট করা থাকলে বা মালিকের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকলে সে জিনিস গ্রহণ করা নাজায়েয’।F[14]

অতএব, এক্ষেত্রে প্রয়োজনে উক্ত ব্যক্তির সাথে আলোচনা করে তার অনুমতিসাপেক্ষে সম্মিলিতভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, নতুবা নয়।[15] চুরিকৃত তথ্য যত সামান্যই হৌক না কেন, তা হকদারের নিকটে ফিরিয়ে দিয়ে আল্লাহর নিকটে খালেছ তওবা না করলে হয়ত এই সামান্য মালই তার আখেরাতের অনন্ত জীবনে জাহান্নামে প্রবেশের কারণ হয়ে যাবে। অতএব আসুন! আমরা অতীত জীবনের কথা স্মরণ করি। বুদ্ধিমান মুমিন দুনিয়ার চিন্তা করে না বরং আখেরাতের চিন্তা করে।

৮. অন্যের জ্ঞানমূলক বা গবেষণালব্ধ ফলাফলকে নিজের মালিকানা বলে দাবি না করা : অন্যের জিনিস নিজের নামে দাবি করাও এক প্রকার চুরি এবং তা মহা যুলুম। এর মাধ্যমে অর্জিত জিনিস আখেরাতে ব্যক্তির জন্য বড়ই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কেননা এসবই ‘হাক্কুল ইবাদ’ বা বান্দার হক, যা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। এতে মালিকের অগোচরে, মালিককে ঠকিয়ে তা হরণ করা হয়। কখনো জোর-জবরদস্তি করে অন্যের তথ্য বা সম্পদ গ্রাস করা হয়। অথচ এ থেকে আল্লাহ তা‘আলা চূড়ান্তভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না’ (নিসা ৪/২৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ- ‘আর তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না এবং অন্যের সম্পদ গর্হিত পন্থায় গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তোমরা জেনেশুনে তা বিচারকদের নিকট পেশ করো না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৮)

৯. প্রোগ্রাম লেখার পূর্বে গভীর চিন্তা করা : কথায় আছে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। কথাটি একেবারে নিরেট সত্য। মানুষের দ্বারা সম্পন্ন প্রতিটি কর্মের পিছনে একটি সৎ উদ্দেশ্য থাকা আবশ্যক। যার মাধ্যমে সে নিজেও উপকৃত হবে, অন্যরাও তেমনি উপকৃত হবে। তাই নিজের কর্মের প্রভাব অন্যের উপর যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ বিষয়ে মুমিন ব্যক্তি অহি-র বাণী সর্বদাই স্মরণে রাখে। তাদের উদ্দেশ্যই মহান আল্লাহ বলেন, وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘আর তোমরা সৎকর্ম সম্পাদন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (হজ্জ ২২/৭৭)। তিনি আরও বলেন, وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ ‘তোমরা সৎকর্ম ও আল্লাহভীতির কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর’ (মায়েদা ৫/২)। তাই প্রোগ্রাম লেখার পূর্বে ব্যক্তি ও সমাজের উপর তা কী ধরনের প্রভাব ফেলবে সেটি চিন্তা করা।

১০. যোগাযোগের ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌজন্যতা প্রদর্শন করা : মানবজীবনে আদব বা শিষ্টাচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আদবকে ইসলামের সারবস্ত্ত বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। আদর্শ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব অপরিসীম। ছোটদের আদর-স্নেহ করা ও বড়দের সম্মান-শ্রদ্ধা করা ইসলামী শিষ্টাচার। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيَعْرِفْ حَقَّ كَبِيْرِنَا فَلَيْسَ مِنَّا- ‘যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান বোঝে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[16] রাসূল (ছাঃ) অন্যের উপকারে নিয়োজিত থাকার গুরুত্ব বর্ণনা করে বলেন, ‘মসজিদে নববীতে একমাস ধরে ই‘তিকাফ করার চাইতে আমার মুসলিম ভাইয়ের কোন প্রয়োজন মিটাতে যাওয়া আমার নিকট অধিক পসন্দনীয়’।[17] তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় সে, যে লোকদের জন্য সর্বাধিক উপকারী’।[18]

ইসলাম যেহেতু সকল যুগের সর্বাধুনিক, তাই নৈতিকতার সমস্ত বিষয়ই এই পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থায় মহান আল্লাহ কর্তৃত প্রেরিত হয়েছে। কিন্তু যত বিধানই আরোপ করা হোক না কেন সত্যের বিধান কেবল মাত্র মহান প্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আর এই অহি-র বিধানই হচ্ছে অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস। এর আওতায় শুধু Computer Ethics কেন, মানুষের সার্বিক জীবনের সকল কিছুরই সমাধান পাওয়া সম্ভব। যা অন্য কোন ধর্মে আদৌ পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা যেন আলোচ্য বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য রেখে নিজেদের সার্বিক জীবনে তার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটিয়ে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি কামনা করি। মহান আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন-আমীন।


[১ম বর্ষ, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, প্রযুক্তি ইউনিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।]

  1. https://en.wikipedia.org/wiki/Computer।
  2. ইবনু মাজাহ হা/২৩৪০।
  3. বুখারী হা/২৪৪৭, মুসলিম হা/২৫৭৮, মিশকাত হা/৫১২৩।
  4. মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৮৫।
  5. মুসলিম হা/১০২; আবুদাঊদ হা/৪৩৫২; তিরমিযী হা/১৩১৫; ইবনু মাজাহ হা/২২২৪; মিশকাত হা/২৮৬০।
  6. ছহীহ ইবনে হিববান হা/৫৬৭; ছহীহুত তারগীব হা/১৭৬৮।
  7. আবুদাউদ হা/৪৮৮০; তিরমিযী হা/২০৩২; ছহীহুল জামে‘ হা/২৩৩৯।
  8. ইবনু মাজাহ হা/২৫৪৬; ছহীহাহ হা/২৩৪১।
  9. বুখারী হা/৬৭৯৯, মুসলিম হা/১৬৮৭; মিশকাত হা/৩৫৯২।
  10. মুসলিম হা/৫; মিশকাত হা/১৫৬।
  11. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৯৮৭, হাদীছ ছহীহ।
  12. বুখারী হা/২২২৭; মিশকাত হা/২৯৮৪।
  13. মুসলিম হা/১৮৩৩।
  14. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ১৫/৪১৯; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৩/১৮৮; উছায়মীন, লিক্বাউল বাবিল মাফতূহ ১৯/১৭৮।
  15. মাসিক আত-তাহরীক, প্রশ্নোত্তর, আগষ্ট‘২৩ প্রশ্ন (৫/৪০৫)।
  16. আবুদাঊদ হা/৪৯৪৩; তিরমিযী হা/১৯২০; ছহীহুত তারগীর হা/১০০।
  17. ছহীহাহ হা/৯০৬; ছহীহুত তারগীব হা/২৬২৩।
  18. ছহীহাহ হা/৪২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৩২৮৯।


বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও