আলিয়া উম্মে রাইয়ানের ইসলাম গ্রহণ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 59 বার পঠিত
প্রশ্ন : আপনার পরিচয় ও পড়াশোনা সম্পর্কে বলুন।
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : আমার জন্ম জার্মানিতে। বাবা আমেরিকান সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়ায় ১২ বছরে আমি ১৩টি স্কুলে পড়াশোনা করেছি। এভাবে বেড়ে ওঠায় আমি নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা ও বিভিন্ন সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার সুযোগ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে এভাবেই শুরু হয় আমার ইসলামের পথে যাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করি, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর ওই কোর্স ছেড়ে দিই। ২১ বছর বয়সে আমি ইসলাম গ্রহণ করি। ইসলাম গ্রহণের পর আমি ইংরেজি সাহিত্যের পাশাপাশি বিজ্ঞানে একটি স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করি। মাস্টার্সে আমার বিষয় ছিল রচনা ও অলঙ্কারশাস্ত্র। পরবর্তীতে আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাষাগত দিক নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করি। এছাড়াও আমি ইসলামী শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করেছি, যাতে আমি মানুষকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে পারি। এভাবেই আমার জীবন এগিয়ে চলেছে।
প্রশ্ন : বিশ্বাসের দিক থেকে কেমন ছিল আপনার জীবন?
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : আমাদের পরিবার ছিল খুবই ধার্মিক এবং রক্ষণশীল। বাবা ব্যাপ্টিস্ট আর মা ক্যাথলিক। আমি লালিত-পালিত হয়েছিলাম ক্যাথলিক হিসাবে। বেড়ে ওঠার সময় আমি খ্রিস্টান ধর্মের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে জানতে পারি। আমি বিশ্বাস করতাম, যিশু হলেন ঈশ্বর এবং ঈশ্বরের পুত্র। যদি আমরা তাঁকে গ্রহণ না করি বা তাঁর কাছে প্রার্থনা না করি, তবে আমরা নরকে যাব। এটি ছিল আমার মৌলিক বিশ্বাস। তবে একসময় এই বিশ্বাস সম্পর্কে আমার মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। আমি এক ব্যাপ্টিস্ট ও একজন ক্যাথলিক যাজকের কাছে গিয়েছিলাম। আমি তাদেরই প্রত্যেককেই ট্রিনিটি বা ত্রিত্ববাদ ধারণা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। কারণ বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত অদ্ভুত লাগত। যাজকরা যখন এর ব্যাখ্যা দিলেন, তা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হ’ল।
প্রশ্ন : ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কি কুরআন পড়েছিলেন?
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : একদিন আমার বাবার এক কমান্ডার আমাকে বললেন, আমরা জানি তুমি বিতর্কে ভাল, তুমি মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে ও বোঝাতে পার। তোমার গ্রেড উচ্চ স্তরের। আর তুমি একজন ভাল খ্রিস্টান। তাই আমরা চাই, তুমি এই সংস্থার অংশ হয়ে কাজ কর। তোমার কাজ হবে নারীদের ইসলাম থেকে বিরত রেখে স্বাধীনচেতা ও নারীবাদী হিসাবে জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করা।
তখন আমার মনোযোগ ছিল এসব নারীদের প্রতি। আসলে ইসলাম যে কী, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। স্কুলে আমাদের বইয়ে লেখা ছিল, মুহাম্মাদ একজন মৃগীরোগী, যাঁর খিঁচুনি হ’ত। তিনি মদ্যপান করতেন। এসব ভয়ংকর এবং সম্পূর্ণ অসত্য তথ্য বইয়ে দেওয়া হ’ত। তাই আমি ভাবতাম, মুসলিম নারীরা পশ্চাৎপদ। আমি তাদের সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলাম। তারা জানত যে, ইসলামের পথ থেকে কাউকে সরানো খুব কঠিন, কিন্তু তাদের দুর্বল মুসলিম বানানো সহজ।
একদিন আমি আমার এক ইহূদী মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সেই সময় ইরানিরা আমেরিকান দূতাবাস দখল করে তাদের আটক করেছিল। আমি তাকে বললাম, আমাদের বাবারা কেন তাদের শেষ করে দিচ্ছেন না? সে উত্তরে বলল, ‘আমি গতরাতে আমার বাবাকে একই প্রশ্ন করেছিলাম। উনি বললেন, বেশিরভাগ মানুষেরই মৃত্যুভয় থাকে। এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যারা ইসলাম চর্চা করে, তাদের মৃত্যুর কোনো ভয় থাকে না’। এই কথাগুলো আমি মনে রেখেছিলাম। পরবর্তীতে যখন আমি মুসলিম হলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল, এবার আমি সবকিছু বুঝতে পেরেছি’।
প্রশ্ন : সংস্থাটির মূল লক্ষ্য কি ছিল?
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : ওরা চেয়েছিল ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছি কেন তারা নারীবাদ এবং নারীদের লক্ষ্য করে এগোচ্ছে। তাদের উত্তর ছিল, তুমি যদি একজন পুরুষকে ধ্বংস কর, তাহ’লে শুধু সেই পুরুষই ধ্বংস হবে। কিন্তু তুমি যদি একজন নারীকে ধ্বংস কর, তাহ’লে ধ্বংস হবে পরবর্তী প্রজন্মগুলো’। অর্থাৎ তারা চায় ইসলামের চর্চা কমে যাক। একটি পুরনো কথা আছে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হ’ল যৌনতা, মাদক, এবং গান-বাজনা। এই জিনিসগুলোকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনকে নিজের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
প্রশ্ন : আপনি কি কখনো বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন?
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : আমি কখনো কোনো বড় বিপদের মুখোমুখি হইনি। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে ছিলাম এবং সন্ধ্যায় ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতাম। দিনের বেলায় স্বাভাবিকভাবেই ক্লাসে যেতাম এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়তাম। আমি একদল খ্রিস্টান ও ইহূদীর সঙ্গে মিশতাম। তারা আমাকে শিখিয়েছিল কীভাবে কুরআন ও হাদীছের কিছু বিষয়কে তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞা করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, কুরআনে বলা হয়েছে কীভাবে পর্দা করতে হয় এবং বক্ষদেশ কীভাবে আবৃত করতে হয়। তবে কুরআনে সরাসরি মাথা ঢাকার কথা বলা হয়নি; বরং বলা হয়েছে বক্ষের ওপর চাদর টেনে দিতে। যদি কারো ইসলাম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকে, তাহ’লে সে সঠিক পর্দা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে। কিন্তু কুরআনের এই বিষয়গুলো পড়তে গিয়ে আমি তার প্রেমে পড়ে যাই।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করতে পারিনি, কারণ তৃতীয় বর্ষেই আমি ইসলাম গ্রহণ করি। যে ব্যক্তি আমাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তাকে আমি চিনতাম। আমার অধ্যাপকদেরও চিনতাম। তারা আমাকে কোনো কাজ করতে বলেননি; শুধু আমার পড়াশোনার সমস্ত খরচ বহন করেছিলেন। এমনকি স্নাতক শেষ হওয়ার পর আমেরিকান দূতাবাসে আমার চাকরির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। পুরো প্রক্রিয়াটি হয়তো সাত বছর সময় নিত।
প্রশ্ন : ইসলামে প্রতি আপনার মনে প্রথম কি ধরনের পরিবর্তন অনুভব করেছিলেন?
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : প্রথমেই বলতে হয়, কুরআন পাঠ করলে বোঝা যায় যে এটি অত্যন্ত যৌক্তিক ও অর্থবহ। মনোযোগ দিয়ে আয়াতগুলো পড়লেই এর গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। সৃষ্টিকর্তা এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো সন্তান নেই। তিনি সর্বশক্তিমান এবং সমস্ত পূর্ণগুণাবলী তাঁর মধ্যে নিহিত। যা কিছু আমরা কল্পনা করতে পারি, তার থেকেও মহত্তম তিনি। এই বিষয়গুলো আমার কাছে গভীর অর্থবহ মনে হয়েছে। তাই যখন সত্যের সন্ধানে ছিলাম এবং ইসলামের শিক্ষাগুলো আমার মনে আবেদন সৃষ্টি করছিল। তখন খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে আরও জানার জন্য আমি ক্লাস করার সিদ্ধান্ত নিলাম, যাতে একজন ভাল খ্রিস্টান হ’তে পারি।
ক্লাসে উপস্থিত হলাম। অধ্যাপক ছিলেন হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট, ৮০ বছর বয়সী একজন অত্যন্ত বিদ্বান ব্যক্তি, যিনি খ্রিস্টধর্ম বিষয়ে সুপরিচিত। প্রথম ক্লাসেই তিনি কিং জেমস বাইবেলের ইংরেজি সংস্করণটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘এই বইটি ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দাও’। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, যীশু খ্রিস্ট ইংরেজিতে কথা বলতেন না। এরপর তিনি মূল প্রসঙ্গে এসে জানালেন যে, তিনি একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। তিনি মনে করতেন ঈশ্বর এক, আর যীশু একজন নবী। সুবহানাল্লাহ! অধ্যাপক খ্রিস্টানই রয়ে গিয়েছিলেন, তবে তাঁর গবেষণার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন বাইবেলে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। তিনি আমাদের মূল পাঠ্য থেকে প্রমাণ দেখালেন এবং ব্যাখ্যা করলেন কীভাবে, কেন এবং কারা বাইবেলে পরিবর্তন এনেছে। এসব জানার পর খ্রিস্টধর্মের প্রতি আমার বিশ্বাস আরও দুর্বল হয়ে গেল।
একই সময়ে আমি কুরআন পাঠ করছিলাম এবং নবীজি (ছা.)-এর বাণী অধ্যয়ন করছিলাম। আমি বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করলাম। কারণ তখনও ভবিষ্যতে একজন রাষ্ট্রদূত বা উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, যদি ইসলাম গ্রহণ করি, তবে সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো আমাকে ত্যাগ করতে হবে। তাই আমি সব ধর্মের শিক্ষা গভীরভাবে অধ্যয়ন করলাম এবং শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম, ইসলামই সত্য ধর্ম। আমি বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্মকে মূলত দর্শন হিসেবে দেখেছি, ধর্ম হিসেবে ততটা নয়। লক্ষ লক্ষ দেবতা বা একজন মানুষকে ঈশ্বর বলে মেনে নেওয়া আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি।
ইসলামের প্রতি আমার বিশ্বাস দৃঢ় হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হ’ল এর যৌক্তিকতা। সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, এমনকি পদার্থবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকেও ইসলামের শিক্ষা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। বহু বছর ধরে বিভিন্ন ধর্ম অধ্যয়ন করেও ইসলামে প্রবেশ না করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসলামই সত্য বলে প্রতিভাত হয়েছে।
প্রশ্ন : কিভাবে আপনি ইসলামে প্রবেশ করলেন?
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : ‘আমি বলব, সপ্তাহখানেকের মধ্যে। যখন আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম, তার প্রায় এক সপ্তাহ আগে আমি একটি স্বপ্ন দেখলাম। আমি ভয়ে দৌড়াচিছলাম, আমার পেছনে কিছু একটা ছিল। আমি সেটি দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবে শুনতে পাচ্ছিলাম সেটা আমাকে শেষ করে দিতে চাইছে। তখন প্রচন্ড ভয় পেয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি কাতরভাবে বললাম, ঈশ্বর, যীশু, মুহাম্মাদ, বুদ্ধ... আপনারা যেই হোন না কেন, আমি শুধু সত্য জানতে চাই। আমি জানতে চাই, আপনারা কে?
তার আগে আমি কুরআন পড়েছিলাম, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে নয়। আমি কুরআন ভালবাসতাম, তবে ইসলাম চাইতাম না। ভাবতাম, ইসলাম গ্রহণ করলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এই স্বপ্নের পর আমি সত্য জানতে চাইলাম, সুতরাং আমার অভিপ্রায় সম্পূর্ণ বদলে গেল। এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক শিক্ষার্থীর ফোন কল পেলাম। সে জানাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘুরতে আসা কিছু মানুষ আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি সেখানে গিয়ে যে ব্যক্তি সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তার বয়স হবে ৮০ এর উপরে। দীর্ঘ সাদা দাড়ি এবং ধবধবে সাদা চুল ছিল, তবে তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন। আমি তাকে প্রশ্ন করলে, তিনি বললেন, বাইবেলে এটা পরিবর্তন করা হয়েছে। এই কথা যখন আমার অধ্যাপক বলেছিলেন, তখন বিষয়টি আমার মনে প্রতিফলিত হ’ল। আমি বুঝলাম, এটি সত্য। আমি আর অস্বীকার করতে পারলাম না, বিষয়টি এখন পরিষ্কার এবং এটি যৌক্তিক। সেই পর্যায়ে আমি বিষয়টি উপলব্ধি করলাম।
আমি ভাবলাম, যদি আমি ঈসা (আঃ)-এর যুগে ইহূদী হতাম, তাহ’লে আমি ঈসা (আঃ)-কে গ্রহণ করতাম। তাহ’লে এখন কেন আমি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে অস্বীকার করব? নিজের জীবন দিয়ে হলেও কি সেটি সম্ভব? এটা সহজ ছিল না, তবে সত্যি বলতে, আমি বিশ্বাস করি যে আল্লাহ আমাকে শক্তি দিয়েছিলেন, কারণ আমি ছিলাম আদরে বখে যাওয়া সন্তান। আমি এমন ছিলাম, যে শুধু বাবার কাছে গিয়ে বলতাম, এটি চাই, এটি চাই। তিনি বলতেন, এই যে কার্ড, যাও, নিয়ে যাও। সিদ্ধান্তটি সহজ ছিল না, কিন্তু আমি ভাবলাম, সত্যকে আমি কীভাবে অস্বীকার করব? এটা ঠিক যে, ইসলামে সবকিছু আমি ব্যাখ্যা করতে পারি না, তবে আল্লাহ আমাকে নিদর্শন দেখিয়ে যাচ্ছেন। আমি সত্যি বিশ্বাস করি।
প্রশ্ন : আপনার শাহাদাহ পাঠের মুহূর্তের কথা আমাদের বলবেন কি?
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : রাতের শেষে তখন ফজরের সময়। শায়খ আমাকে বলেছিলেন, আমাদের ছালাত পড়তে হবে। সারারাত ধরে আমি এই বেচারা বৃদ্ধ লোকটার সাথে কথা কাটাকাটি করছিলাম। যাওয়ার সময় তিনি বললেন, আমি কখনো কারো কাছ থেকে মুসলিম হওয়ার আমন্ত্রণ পাইনি, এখন আমি মুসলিম হ’তে আমন্ত্রণ না জানিয়ে কারো কাছ থেকে বিদায় নিই না। যখনই তিনি আমাকে এ কথাগুলো বললেন, আমার মনের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল, এটাই আমি চাই। আলহামদুলিল্লাহ, আমি তাকে হ্যাঁ বলে দিলাম। যখন আমি কালিমা শাহাদাত পাঠ করলাম, তখন আমার এমন একটা অনুভূতি হ’ল, যেমনটা আমার আগে কখনো হয়নি। ‘আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে বলতেই আমার মনে হ’ল, আমার বুক থেকে খুব ভারি কিছু একটা নেমে এলো। আক্ষরিকভাবে আমার মনে হ’ল আমি যেন জীবনে প্রথমবারের মতো শ্বাস নিলাম।
সারাটা দিন ধরে আমি উচ্ছ্বসিত ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমি মুক্ত। আমি উপলব্ধি করলাম, অবশ্যই আমি সেই স্থান খুঁজে পেয়েছি, যেখানে আমার থাকা দরকার। আমি জেনে গেছি, আমি কে এবং কি হ’তে হবে। আর মনে হ’ল আমি আধ্যাত্মিক আনন্দে আছি। আমি বাড়ীতে গিয়ে বাবাকে কল করলাম। তখন তিনি ছিলেন জার্মানিতে। আমি বললাম, আমি মুসলিম হয়ে গেছি। তিনি বললেন, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? কেউ কি তোমার মগজ ধোলাই করেছে? ব্যাপারটা নিয়ে তিনি খুশি ছিলেন না। বললেন, যা হয়েছে, হয়েছে। আমি একটা টিকেট পাঠাচ্ছি। কালই তুমি প্লেনে চড়ে জার্মানিতে চলে আসো। আমি বললাম, আমি ইসলামকে অস্বীকার করতে পারবো না। এটাই সত্য। তিনি আমাকে বললেন যে, যদি তুমি এই টিকিট না নাও, আমি ধরে নেব আমার কোনো মেয়ে নেই। তুমি মরে গেছো।
আমার পরিবারে মূলত বাবা যা বলেন, সবাই সেটাই অনুসরণ করে। আমাকে একা করে দেওয়া হ’ল। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল, আর আলহামদুলিল্লাহ আমার কাছে শুধু রববুল আলামীন। আমার একেবারে নতুন একটা চেরি রেড ক্যামেরা ছিল। সেটা বিক্রি করে পরবর্তী এক বছর চললাম এই টাকায়, কারণ আমার কোনো চাকরি ছিল না। আমি পড়াশোনা শেষ করিনি, বাবা আমাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। আমার ভাই, বোন, ফুফু কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করত না।
তবে সুবহানাল্লাহ, কোনো কোনো দিন বিল্ডিংয়ের নিচে নেমে এসে ভাল খবর পেতাম। আমি কাউকে কখনো বলিনি যে আমার সমস্যা আছে। আমি কখনো কাউকে বলিনি যে আমার পরিবার আমাকে অধিকারচ্যুত করেছে। আমি উপর তলায় থাকতাম, সেখান থেকে নেমে এসে ডাক বাক্সে খোঁজ করে দেখলাম, কেউ ভোরে টাকা পাঠিয়েছে। আমি জানি না কে পাঠাত। আমি ধরে নিচ্ছি যে মুসলিম সমাজ ভেবেছিল, এই মহিলার সাহায্য দরকার। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি জানি না কে সেখানে টাকা পাঠাত। তবে আলহামদুলিল্লাহ, টাকাটা আমার খুব কাজে লাগত।
প্রশ্ন : আপনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হলেন কেন?
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : যেদিন আমি মুসলিম হয়েছিলাম, সেদিন আমি হিজাব পরেছিলাম। আমার অধ্যাপক আমাকে দেখে বললেন, এটা কী পরেছো? আমি তাকে বললাম, আমি মুসলিম হয়েছি। তিনি তখন বললেন, তুমি কি জানো, তুমি কি সব কিছু হারিয়ে ফেলেছো? এরপর আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হ’ল। এক সহপাঠী আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি ক্লাস করতে থাক, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, তুমি এখন থেকে F পাবে। আমি তখন বুঝতে পারছিলাম না কী করতে হবে। এক বছর আমি প্রতিষ্ঠানটি পরিত্যাগ করেছিলাম। এমনকি আমি একটি ফাইল ক্লার্কের চাকরি নিতে চেয়েছিলাম, যেখানে কেবল কাগজপত্র সাজানোর কাজ ছিল, কিন্তু তারা আমাকে বলল, ‘দুঃখিত, তোমার হিজাবের জন্য এখানে চাকরি হবে না’।
বাবা জানতেন যে, আমি ফেরারি গাড়ি পছন্দ করি। তিনি আমাকে একটি ফেরারি গাড়ি কিনে দিয়ে বললেন, তুমি যদি হিজাব খুলে ফেলো, তাহলে এই গাড়ি তোমার হবে। তবে আমি তাকে বলেছিলাম, দুঃখিত, দুনিয়া না আল্লাহ? কোনটি আমি চাই? এই পছন্দটি আমার জন্য খুব সহজ ছিল, আলহামদুলিল্লাহ। বছরের শেষে, আমি জানলাম যে আমি রেড সস দিয়ে পাস্তা খেতে আর পছন্দ করি না। সেসব সময় আমি যা কিনতে পারতাম তা ছিল টমেটো পেস্ট, কিছু মসলা এবং ম্যাকারনি। কিন্তু এরপর আল্লাহই আমার জন্য পথ খুলে দিলেন, সুবহানাল্লাহ।
প্রশ্ন : আপনি কীভাবে এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিলেন?
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : আমি জানি এটি কিছুটা অদ্ভুত শোনাতে পারে। তবে হাদীছে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ যদি কাউকে ভালবাসেন, তাহ’লে তাঁকে পরীক্ষা করেন। সুতরাং আমি উপলব্ধি করলাম, আল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করছেন। তিনি দেখতে চান, আমি সত্যিই বিশ্বাস করি কি-না। তিনি দেখতে চান আমি সৎপথে থাকতে পারি কি না। যদি আমি তা পারি, তবে তিনি আমাকে ভালবাসবেন। এই চিন্তাটাই আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছে।
প্রশ্ন : আপনার শেষ অনুভূতি ব্যক্ত করুন?
শরীফা কারলো আন্দালুসিয়া : মুসলিম হওয়ার পর সম্ভবত ১০-১২ বছর আমি কাউকে বলিনি কিভাবে আমি মুসলিম হয়েছিলাম। এখানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমি সত্যিই আনন্দিত যে আমি এখানে এসে এই সাক্ষাৎকার দিতে পেরেছি’।
[তথ্য সূত্র : ইন্টারনেট