দাদীর ভালোবাসা
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
চারিদিকে তারুণ্যের জয়জয়কার। তরুণরা ন্যায়ের পথে এগিয়ে চলার যে দৃঢ় সংকল্প নিয়েছে, তা এক নতুন দিনের সূচনা। মাস চারেক আগে বন্ধু ছিয়াম বলেছিল, তারুণ্যের বিবেক জেগেছে। ভ্রষ্টতার পথ থেকে ন্যায়ের দিকে ঝুঁকছে। এমন পরিবর্তন তো ছিল সময়েরই দাবি।
আমরা তখন দাখিল পরীক্ষার্থী। দুপুরের খাবার সেরে একটু বই নিয়ে বসেছি। হঠাৎ বছর ত্রিশের এক যুবক এসে সালাম দিয়ে নম্র কণ্ঠে বললেন, ভাই! আমি রাজশাহীতে নতুন এসেছি। এখানকার তেমন কিছু চিনি না। কয়েকদিন হোটেলের খাবার খেতে খেতে ক্লান্ত। শুনলাম এখানে আপনারা মেসে খাওয়া-দাওয়া করেন। আপনাদের সাথে আমার কী একটু ব্যবস্থা করা যায়?
আমি একটু অপ্রস্ত্তত হয়ে পড়লাম। বললাম, ভাই! আসলে এটা মেস নয়। বড় ভাইদের সাথে মিলে আমরা ছয়-সাতজন থাকি। তবে ভাইয়ের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলাম না। বললাম, আমি বড় ভাইদের সাথে কথা বলে দেখব। রাতে খাওয়ার সময় বড় ভাইদের সাথে কথা বললাম। প্রথমে একটু আপত্তি করলেও শেষমেশ সবাই রাযী হলেন। তানিম ভাই আমাদের ছোট্ট সংসারের সদস্য হয়ে গেলেন।
কয়েক দিনের মধ্যে তানিম ভাই খুব সহজেই আমাদের সাথে মিশে গেলেন। তাঁর নম্রতা, মিষ্টি ব্যবহার, আর গল্প বলার ভঙ্গি সবাইকে মুগ্ধ করত। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমাদের সংসারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেন। এক রাতে আমরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছি। কথায় কথায় তানিম ভাইয়ের পরিবারের প্রসঙ্গ উঠল। তিনি বললেন, আমরা তিন ভাই। কোন বোন নেই। ভাইদের মধ্যে আমি মেজো। ছোট ভাই মায়ের সাথে বাড়িতেই থাকে।
সাখাওয়াত ভাই প্রশ্ন করলেন, আর বড় ভাই? উনি কোথায় থাকেন? তানিম ভাই একটু চুপচাপ হয়ে গেলেন। মুখটা গম্ভীর করে বললেন, বড় ভাইয়ের কথা আসলে কখনো কারও সাথে বলা হয়নি। তবে আজ আপনাদের বলতে ইচ্ছে করছে। বছর কয়েক আগে আমি তখন ঢাকা আদমজী কলেজের ছাত্র। বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই’ ডিপার্টমেন্টে অনার্স শেষ বর্ষে পড়েন। আমাকে তার সাথে হলে নিয়ে গিয়ে রাখলেন। বড় ভাই ছিলেন অন্যরকম মানুষ। তিনি ছোটবেলা থেকেই ছালাত-ছিয়ামে অভ্যস্ত ছিলেন। সহজে তাহাজ্জুদ মিস করতেন না। ইসলামের বিষয়ে ছিল তার গভীর আগ্রহ। পড়াশোনাও করতেন প্রচুর। তার চলাফেরা, চিন্তা-চেতনা ছিল সমবয়সী অন্যান্য তরুণদের পুরোপুরি বিপরীত। তার বন্ধুরা অনেকেই আনন্দ-ফূর্তি আর বেহায়াপনায় মত্ত থাকলেও ভাই তখন পড়াশোনা ও ইবাদতে সময় কাটাতেন। তিনি ছিলেন আমার দেখা আদর্শ মুসলিম তরুণ। কখনই অন্যায়ের সাথে আপোষকামিতা ছিল না। এটাও ঠিক ওটাও ঠিক, এতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন হক মাত্র একটি। হক কথা বলতে গিয়ে কখনই ভাবতেন না যে, এটা কার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। তানিম ভাই থেমে থেমে কথা বলছেন। তার গলার স্বর ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। দু’চোখে অশ্রু টলমল করছে।
ছিয়াম বলল, তারপর কী হ’ল ভাই?
হঠাৎ একদিন বাবা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তখন ভাইয়ার মাস্টার্স শেষ হয়েছিল মাত্র। ইচ্ছে ছিল বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ফরেন ক্যাডারে যোগ দেবেন। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সেই স্বপ্ন আজিমপুর কবরস্থানে হারিয়ে গেল। সংসারের প্রয়োজনে ভাই তড়িঘড়ি চাকরি খুঁজতে লাগলেন। ভালো একটা চাকরি পেয়েও গেলেন। আমাদের জীবন একটু সচ্ছল হ’ল।
বয়সে বড় হ’লেও ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল খুব গভীর। মাঝে-মধ্যেই আমরা তুরাগ নদীর তীরে যেতাম। সেখানে বসে নানা বিষয়ে কথা বলতাম। একদিন ভাই বললেন, তানিম! তোদের হক আমি ঠিকমতো আদায় করতে পারিনি রে। পারলে মাফ করে দিস। আর মায়ের খেয়াল রাখিস। তখন তার চোখে অশ্রু ছলছল করছিল। কিন্তু তখন আমি বিষয়টা বুঝতে পারিনি। ভাইকে এর আগেও অনেকবার কাঁদতে দেখেছি। হয়তো এজন্যই সেদিনের অশ্রুর গন্তব্যটা আমি উপলব্ধি করতে পারিনি।
এ কথা বলার ঠিক এক সপ্তাহ পর ভাইয়া নিখোঁজ হয়ে গেলেন। আমরা এখনও তার ফিরে আসার অপেক্ষা করি। যত জায়গায় সম্ভব তাকে খুঁজেছি। কোথাও কোন খোঁজ পাইনি। হাসপাতালগুলোতে অনেকবার খুঁজেছি। মাঝে মধ্যে এখনও যাই। কিন্তু হতাশা নিয়ে ফিরে আসতে হয়।
তানিম ভাইয়ের কথা শুনে আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। রাফী ভাইয়ের হাতের খাবার আবার প্লেটেই ফিরে গেল। সবাই চুপচাপ। চারদিকে থমথমে নীরবতা। মনে হচ্ছিল, তানিম ভাইয়ের কণ্ঠে যেন বড় ভাইয়ের আত্মত্যাগের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
সে রাতে আমরা সবাই নতুনভাবে জীবনকে উপলব্ধি করলাম। তারুণ্যের শক্তি, আত্মত্যাগের মহিমা, আর ন্যায়ের পথে চলার দৃঢ় সংকল্প যেন আমাদের মনকে আন্দোলিত করে তুলল।
[লেখক : একাদশ শ্রেণী ,রাজশাহী সরকারী কলেজিয়েট স্কুল এ্যান্ড কলেজ]