তাক্বওয়াই সকল কল্যাণের মূল

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 525 বার পঠিত

তাক্বওয়া অর্থ সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, জবাবদিহিতা, যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ থেকে বেঁচে থাকার প্রেরণা। তাক্বওয়া যাবতীয় অকল্যাণ থেকে আত্মরক্ষার ঢাল স্বরূপ। রবের কাছে সম্মানিত হওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রবের কাছে ক্ষমা পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম তাক্বওয়া অবলম্বন করা। রবকে খুশী করার জন্য তাক্বওয়ার মত গভীর প্রভাবক আর নেই। সৎপথে টিকে থাকার জন্য তাক্বওয়ার চেয়ে বড় নিয়ামক আর নেই। এজন্যই আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা (পরকালের) সম্বল অর্জন কর, আর সর্বোত্তম সম্বল হ’ল তাক্বওয়া। আর হে বুদ্ধিমান মানুষেরা, তোমরা আমাকে ভয় কর (বাক্বারাহ ২/১৯৭)। তাক্বওয়ার প্রশিক্ষণের জন্য গোটা একটি মাস রামাযানকে আল্লাহ রাববুল আলামীন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে মাসে খানা-পিনা ও জৈবিক চাহিদা পূরণের নৈমিত্তিক ও প্রাকৃতিক বৈধ চাহিদা থেকেও নিজেকে নিবারণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, যাতে বান্দা রবের নিষেধসমূহ থেকে অনুরূপভাবে বিরত থাকতে পারে। তার মধ্যে এই অনুভূতির জাগরণ হয় যে, আল্লাহর ভয়ে যদি বৈধ কাজ থেকেই বিরত থাকতে পারি, নিজের আবশ্যকীয় প্রয়োজন থেকেও নিজেকে সংবরণ করতে পারি, তাহ’লে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনে কেন নিজেকে প্রস্ত্তত করতে পারব না!

আল্লাহভীতি মূলতঃ মুখে প্রকাশ করার বিষয় নয়, বরং একটি অন্তরের একটি পবিত্র অনুভূতি, যা সর্বদা তাকে আল্লাহর উপস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাকে আল্লাহর জন্য সমস্ত কল্যাণকর কাজে উদ্বুদ্ধ করে। এটি এমন এক সতর্ক অন্তদৃষ্টির নাম, যা তাকে যাবতীয় হারাম কাজ ও শয়তানী প্রবণতা থেকে রক্ষা করে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করেছে যখন তাদেরকে শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা দেওয় হয়, তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তৎক্ষণাৎ তাদের দৃষ্টি খুলে যায়’ (আল-আরাফ ৭/২০১)

তাক্বওয়া মানুষের মধ্যে এমন এক দায়িত্বানুভূতির জন্ম দেয়, যা তার মাঝে সততা ও ন্যায়বোধকে সর্বদা উচ্চকিত রাখে। তার ভেতরে অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীনতা এবং যে কোন মূল্যে সত্য ও ন্যায়কে ধারণ করার দৃঢ় নৈতিক শক্তি দান করে। তার ভেতর ইস্তিকামাত দান করে। ফলে জেনেশুনে সে কোন অন্যায়ের পথে পা বাড়ায় না। এক মুহূর্তের জন্যও অসত্যকে প্রশ্রয় দেয় না। শত বিপদেও কখনও পথহারা হয় না। অর্থ ও পদের লালসা তাকে কখনও বিপথে ঠেলে দেয় না। তাক্বওয়ার বর্ম তাকে ভিতর থেকে এমনভাবে চাপে রাখে যে, তাকে পাপের পথে পা বাড়াতে বাধা দেয় কিংবা কখনও পাপ হয়ে গেলেও তা থেকে তাকে মুহূর্তেই ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ফলে দূর্নীতি, প্রতারণা, ধেঁাকাবাজি, মুনাফিকী তার জন্য অসম্ভব হয়ে দঁাড়ায়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাহ’লে তিনি তোমাদের জন্য ফুরকান তথা ন্যায়-অন্যায় পার্থক্যকারী জ্ঞান (বিচক্ষণতা) দান করবেন’ (আনফাল ৮/২৯)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা ন্যায়বিচার কর, (কেননা তা তাক্বওয়ার নিকটবর্তী এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সবই জানেন (মায়েদা ৫/৮)

প্রকৃত আল্লাহভীতি মানুষের জন্য এমন কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে, যা সে অনুমানও করতে পারে না। আল্লাহর ভয়ে কোন একটি পাপ বা অন্যায় থেকে যদি কেউ পরহেয করতে পারে, আল্লাহ তাকে এর বিনিময়ে এত অঢেল বিনিময় দান করেন, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পর্যন্ত অব্যাহত হ’তে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তার জন্য তিনি উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন এবং এমন উৎস থেকে রিযিক প্রদান করেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর স্বীয় উদ্দেশ্য পূরণ করবেনই’ (তালাক ৬৫/২-৩)

তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির স্বরূপ অনুধাবন করা সবার পক্ষে সমানভাবে সম্ভব নয়। অনুভূতিশূন্য কিংবা লোক দেখানো আল্লাহভীতি অন্তরে কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। তাতে কোন কল্যাণও অর্জিত হয় না। বরকতও থাকে না। এজন্য আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, ভয় করার মত ভয়। আর তোমরা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মারা যেও না’ (আলে ইমরান ৩/১০২)

তাক্বওয়াবান ব্যক্তি সত্যের ব্যাপারে কখনও তর্কলিপ্ত হয় না। বরং সত্যকে জানামাত্র তার অন্তর সেদিকে ধাবিত হয়। সত্যকে গ্রহণ করতে সে কোন প্রকার কুন্ঠাবোধ করে না। কোন অবস্থাতেই সে শিরক-বিদ‘আত, কুসংস্কারের প্রতি শিথিলতা দেখায় না। আল্লাহ বলেন, ‘যিনি সত্য এনেছে (রাসূল ছা.) এবং যে তা সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই হ’ল মুত্তাকী’ (যুমার ৩৯/৩৩)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল’ (আহযাব ৩৩/৭০)

তাক্বওয়াবান মানুষ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত। আল্লাহ তাদেরকে সবচেয়ে বেশী ভালভাসেন যারা আল্লাহকে ভয় করে কোন অন্যায় কর্ম ও আচরণ ত্যাগ করে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাক্বওয়া সম্পন্ন’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন, যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল’ (নাহল ১৬/১২৮)

তাক্বওয়াশীলকে আল্লাহ এত পছন্দ করেন যে, আল্লাহ সেই মহাপাপী ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, যে আল্লাহর ভয়ে তাঁর শাস্তি থেকে বঁাচতে নিজেকে ছাই ভস্ম করার অছীয়ত করেছিল (মুসলিম হা/ ২৭৬)। আল্লাহর ভয়ে যে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে সে চোখে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না (তিরমিযী হা ১৬৩৯)

প্রিয় পাঠক, প্রতিটি সেকেন্ডে আমাদের মৃত্যুর ক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর পথে এগিয়ে চলেছি। যে কোন মুহূর্তে, যে কোন সময়ে আমাদের এই সংক্ষিপ্ত দুনিয়াবী সফরের পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। এজন্য আসুন! পরকালীন সফর শুরু হওয়ার পূর্বে নিজের পাথেয় সঞ্চয়ের জন্য সর্বোচ্চ সাধনা করি। তাক্বওয়ার মতো অমূল্য সম্বলকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে সংরক্ষণ করি। এতেই আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের চিরন্তন কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে তাক্বওয়ার গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করা এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাক্বওয়ার যথাযথ অনুশীলন করার তাওফীক দান করুন। আমীন!



বিষয়সমূহ: আমল পরকাল
আরও