রামাযানের ফাযায়েল ও মাসায়েল

শরীফুল ইসলাম মাদানী 1428 বার পঠিত

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে রামাযানের ছিয়াম অন্যতম, যার মাধ্যমে তাক্বওয়া অর্জিত হয়, আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নৈকট্য হাছিল হয়, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভ হয়। তাই সঠিকভাবে ছিয়াম পালন করা যরূরী। প্রকৃত ছায়েম এমন কথা বলে না, যা তার ছিয়ামকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এমন কাজ করে না, যা তার ছিয়ামকে বিনষ্ট করে। ফলে ছায়েম সকলের জন্য কল্যাণকারী হয়। ছিয়াম পালনকারীর জন্য পার্থিব জীবনে রয়েছে অশেষ কল্যাণ এবং পরকালে রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার।

রামাযানের ফযীলত : আল্লাহর অশেষ রহমত ও অফুরন্ত ক্ষমা নিয়ে রামাযান আসে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন রামাযান আসে, তখন রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়’।[1] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করলে বিগত সকল (ছোট) গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’।[2] আল্লাহ বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক নেক আমলের দশগুণ হতে সাতশত গুণ ছওয়াব প্রদান করা হয়। আল্লাহ বলেন, কিন্তু ছওম ব্যতীত, কেননা ছওম কেবল আমার জন্যই রাখা হয় এবং আমিই তার পুরস্কার প্রদান করব’।[3] এছাড়া ‘রামাযান মাসে ওমরাহ পালন করলে হজ্জের সমান নেকী হয়’।[4]

রামাযানের মাসায়েল : অন্যান্য মাসের তুলনায় রামাযানের ফযীলত যেমন বেশি, তেমনি এমাসে মুমিনদের রয়েছে বাড়তি দায়িত্ব। ছিয়াম, সাহারী, ইফতার, তারাবীহ, লাইলাতুল ক্বদর যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমেই কেবল উক্ত বরকত ও মাগফিরাত লাভ করা যায়।

ছিয়ামের নিয়ত : নিয়ত অর্থ ইচ্ছা করা বা সংকল্প করা। অতএব মনে মনে ছিয়াম পালনের সংকল্প করতে হবে। মুখে কিছুই বলতে হবে না। রাসূল (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম এবং ইমাম চতুষ্টয়ের কেউ কখনো মুখে নিয়ত পড়েননি। যদি রাসূল (ছাঃ) নিয়তের জন্য কোন দো‘আ পড়তেন, তাহলে অবশ্যই তা হাদীছে বর্ণিত হ’ত। কিন্তু বিভিন্ন বইয়ে ছালাত, ছিয়াম সহ অন্যান্য ইবাদতের জন্য যে সকল নিয়তের দো‘আ দেখা যায় সেগুলি ছহীহ, যঈফ ও মাওযূ বা জাল কোন হাদীছেই বর্ণিত হয়নি। বরং এগুলি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। মোল্লা আলী ক্বারী, ইবনুল হুমাম, আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী (রহঃ) প্রমুখ খ্যাতনামা হানাফী বিদ্বানগণ মুখে নিয়ত পড়াকে ‘বিদ‘আত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন’।[5] ফরয ছিয়ামের জন্য ছুবহে ছাদিকের পূর্বেই নিয়ত করা যরূরী।[6] আর নফল ছিয়ামের জন্য যোহরের পূর্বে যেকোন সময় নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে, যদি সে ছুবহে ছাদিকের পর থেকে কিছু না খেয়ে থাকে।[7]

সাহারী খাওয়া : ছিয়ামের নিয়তে ছুবহে ছাদিকের পূর্বে কোন কিছু খাওয়াকে সাহারী বলে। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। সাহারী খাওয়ার জন্য রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা সাহারী খাও। কেননা সাহারীতে বরকত রয়েছে’।[8] তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ও আহলে কিতাবদের ছিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সাহারী খাওয়া’।[9]

উল্লেখ্য যে, ছিয়াম ছহীহ হওয়ার জন্য সাহারী খাওয়া শর্ত নয়। অর্থৎ সাহারী খাওয়ার সময় না পেলে কোন কিছু না খেয়ে ছিয়াম পালন করলেও তা ছহীহ হবে।

ইফতার করা : ছিয়ামের অন্যতম সুন্নাত হল সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ ‘মানুষ ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতদিন তারা ইফতার দ্রুত করবে’।[10] তিনি আরো বলেন,لَا يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ، لِأَنَّ الْيَهُودَ، وَالنَّصَارَى يُؤَخِّرُونَ ‘দ্বীন ততদিন পর্যন্ত বিজয়ী থাকবে যতদিন মানুষ ইফতার তাড়াতাড়ি করবে। কেননা ইহুদী, নাছারারা দেরীতে ইফতার করে’।[11] দ্রুত ইফতার করার অর্থ হ’ল সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা।[12]

ইফতারকালে দো‘আ : অন্যান্য খাবার খাওয়ার ন্যায় ‘বিসমিল্লাহ’ (بسم الله) বলে ইফতার শুরু করবে[13] এবং ইফতার শেষে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ (الحمد لله) বলবে।[14] ইফতারের দো‘আ হিসাবে প্রসিদ্ধ দো‘আটি (আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া ‘আলা রিযকিকা আফতারতু) ‘যঈফ’।[15] তবে ইফতার শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়া যাবে,ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ (যাহাবায যামাউ ওয়াবতাল্লাতিল উরূকু ওয়া ছাবাতাল আজরু ইনশাআল্লা)। অর্থ : ‘পিপাসা দূরীভূত হল ও শিরাগুলি সঞ্জীবিত হল এবং আল্লাহ চাহেন তো পুরস্কার ওয়াজিব হল’।[16]

ছিয়াম ভঙ্গের কারণ সমূহ : ছিয়াম অর্থ বিরত থাকা। ছুবহে ছাদিক হ’তে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানাপিনা ও যৌনসম্ভোগসহ কিছু কাজ থেকে বিরত থাকাকে ছিয়াম বলে। অপরদিকে ছায়েম কর্তৃক নিম্নোক্ত কাযর্সমূহ সম্পাদিত হলে ছিয়াম ভঙ্গ হয়।

(১) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে খানাপিনা করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার ক্বাযা আদায় করতে হয়। পক্ষান্তরে অনিচ্ছাকৃত ও ভুলবশত পানাহার করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় না।[17]

উল্লেখ্য যে, খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে এমন ইনজেকশন গ্রহণ করলে ছিয়াম ভঙ্গ হবে। কিন্তু খাদ্যের চাহিদা পূরণ না হ’লে ছিয়াম ভঙ্গ হবে না। অনুরূপভাবে চোখে ও কানে ঔষধ ব্যবহার করলে, পায়ুপথে ঔষধ ব্যবহার করলে, ইনহেলার বা গ্যাস ব্যবহার করলেও ছিয়াম ভঙ্গ হবে না। কেননা এগুলো খাওয়া ও পান করার অন্তর্ভূক্ত নয় এবং এগুলো পাকস্থলীতে পৌঁছে না এবং দেহে শক্তি উৎপাদন করে না।

(২) ছিয়াম অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী সহবাস করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার উপর ক্বাযা ও কাফ্ফারা ওয়াজিব হয়।[18] ক্বাযা ছিযাম আদায়ের পাশাপাশি কাফ্ফারা স্বরূপ একজন দাসমুক্তি অথবা একটানা দু’মাস ছিয়াম পালন করবে অথবা ৬০ জন মিসকীন খাওয়াতে হবে।[19] প্রত্যেক মিসকীনকে অর্ধ ছা‘ বা ১ কেজি ২৫০ গ্রাম চাল দিলেও কাফ্ফারা আদায় হয়ে যাবে।

উল্লেখ্য যে, এই কাফ্ফারা কেবল রামাযান মাসের জন্যই প্রযোজ্য। রামাযান ব্যতীত অন্য কোন মাসে ছিয়াম অবস্থায় সহবাস করলে কাফ্ফারা ওয়াজিব নয়।

(৩) হস্তমৈথুনের মাধ্যমে বীর্যপাত ঘটালে ছিয়াম ভঙ্গ হবে।[20] তবে তার উপর কাফ্ফারা ওয়াজিব নয়; বরং সে তওবা করবে ও ক্বাযা আদায় করবে। পক্ষান্তরে ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে অথবা রোগের কারণে কোন উত্তেজনা ছাড়াই বীর্যপাত হলে ছিয়াম ভঙ্গ হবে না।

(৪) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে ছিয়াম ভঙ্গ হবে। তবে অনিচ্ছাকৃত বমি হলে ছিয়াম ভঙ্গ হবে না।[21]

(৫) ছিয়াম অবস্থায় মহিলাদের হায়েয অথবা নিফাস দেখা দিলে ছিয়াম ভঙ্গ হবে এবং পরবর্তীতে উক্ত ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করবে।[22]

উল্লেখ্য যে, ছিয়াম অবস্থায় হিজামা বা শিঙ্গা লাগালে ছিয়াম ভঙ্গ হবে কি না? এ ব্যাপারে ছহীহ মত হল, ছিয়াম ভঙ্গ হবে না। তবে সন্দেহমুক্ত থাকার জন্য ছিয়াম অবস্থায় শিঙ্গা লাগানো থেকে বিরত থাকাই ভাল। অনুরূপভাবে শরীরের কোন অঙ্গ কেটে যাওয়ায় রক্তক্ষরণ হলে ছিয়াম ভঙ্গ হবে না।

যাদের জন্য ছিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয :

(১) অসুস্থ ব্যক্তি ছিয়াম ভঙ্গ করতে পারে (বাক্বারাহ ২/১৮৪)। অসুস্থতা দুই প্রকার (ক) স্থায়ী রোগ; যা থেকে সুস্থতা আশা করা যায় না বা অনেক বিলম্ব হয়। এমন ব্যক্তি ছিয়াম ছেড়ে দিবে এবং প্রত্যেক ছিয়ামের ফিদইয়া স্বরূপ একজন মিসকীনকে খাওয়াবে। (খ) অস্থায়ী রোগ; যা থেকে সুস্থতা আশা করা যায়। এমন ব্যক্তি ছিয়াম ছেড়ে দিবে এবং সুস্থ হওয়ার পরে ক্বাযা আদায় করবে।

(২) মুসাফির ব্যক্তি ছিয়াম ছেড়ে দিতে পারে (বাক্বারাহ ২/১৮৪)। তবে সফর শেষে বাড়ী ফিরে ছিয়ামগুলির ক্বাযা আদায় করবে।

(৩) বয়স্ক ব্যক্তি; যে ছিয়াম পালনে অক্ষম। সে ছিয়াম ছেড়ে দিবে এবং ফিদইয়া স্বরূপ প্রত্যেক ছিয়ামের জন্য একজন মিসকীন খাওয়াবে (বাক্বারাহ ২/১৮৪)

(৪) গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারিণী নারী ছিয়াম পালনের কারণে নিজের অথবা সন্তানের ক্ষতির আশংকা করলে ছিয়াম ত্যাগ করতে পারে। তবে সে কি পরিত্যাক্ত ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করবে না ফিদইয়া দিবে, সে ব্যাপারে সর্বাধিক ছহীহ মত হল, সে ক্বাযা আদায় করবে।

উল্লেখ্য যে, ফিদইয়া হ’ল প্রত্যেকটি ছিয়ামের বিনিময়ে একজন মিসকীনকে এক বেলা খাওয়াবে অথবা অর্ধ ছা‘ বা ১ কেজি ২৫০ গ্রাম চাল দিবে।

ছালাতুল লাইল : তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, ক্বিয়ামে রামাযান, ক্বিয়ামুল লাইল সবকিছুকে এক কথায় ‘ছালাতুল লাইল’ বা ‘রাত্রির নফল ছালাত’ বলা হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ফরয ছালাতের পরে সর্বোত্তম ছালাত হল রাত্রির (নফল) ছালাত’।[23] তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি রামাযানের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রির ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’।[24]

তারাবীহ-এর রাক‘আত সংখ্যা : এক্ষেত্রে সুন্নাত হল, রাতের ছালাত বিতর সহ (৮+৩)=১১ রাক‘আত। একদা আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, রামাযান মাসে রাসূল (ছাঃ)-এর রাতের ছালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন, রামাযান ও রামাযান ছাড়া অন্য মাসে রাসূল (ছাঃ)-এর রাতের ছালাত ১১ রাক‘আতের বেশী ছিল না’।[25] রাতের ছালাত বলতে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ দু’টিকেই বুঝানো হয়। অতএব রাসূল (ছাঃ) যে আমল নিয়মিত করেছেন তার উপর আমল করাই আমাদের জন্য উত্তম হবে। কেননা ৮ রাক‘আত তারাবীহ রাসূল (ছাঃ)-এর নিয়মিত আমল। পক্ষান্তরে ২০ রাক‘আত মর্মে বর্ণনাগুলির কোনটি যঈফ, কোনটি মুনকার, কোনটি আবার মাওযূ‘ বা জাল।

ই‘তিকাফ করা : ই‘তিকাফ হ’ল রামাযানের শেষ দশদিনে মহান প্রভুকে ডাকার উদ্দেশ্যে কোন মসজিদে অবস্থান করা। একনিষ্ঠভাবে মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম মাধ্যম হ’ল ই‘তিকাফ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ই‘তিকাফ করেছেন এবং তাঁর উম্মতকে তা করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন।

ই‘তিকাফ পুরুষ-মহিলা সবাই করতে পারে। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) রামাযানের শেষ দশকে মহান আল্লাহ তাকে মৃত্যু দান করা পর্যন্ত ই‘তিকাফ করেছেন’।[26] উল্লেখ্য যে, ই‘তিকাফ করার জন্য মসজিদ শর্ত।

লাইলাতুল ক্বদর : লাইলাতুল ক্বদর এমন এক বরকতপূর্ণ রাত; যে রাতে আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন। এই রাতের আমল হাযার মাসের আমলের চেয়ে উত্তম। এই রাতে লাওহে মাহফূযে সংরক্ষিত ভাগ্যলিপি থেকে আগামী এক বছরের ভাগ্য সংশ্লিষ্ট ফেরেশতার নিকট পেশ করা হয় (ক্বদর ৯৭/১-৫)। এই রাত কোন রাত তা আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)-কে ভুলিয়ে দিয়েছেন। তবে তা রামাযানের শেষ দশকের বিজোড় রাত সমূহে সন্ধান করতে বলেছেন।[27]

লাইলাতুল ক্বদরের দো‘আ : ক্বদরের রাতে অন্যান্য দো‘আর সাথে যে দো‘আটি সবচেয়ে বেশী পড়বে তা হ’ল : ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নাকা ‘আফুব্বুন তুহিববুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী’অর্থ : ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা পসন্দ কর। অতএব আমাকে তুমি ক্ষমা কর’।[28]

যাকাতুল ফিৎর : ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ছা‘ খেজুর, যব ইত্যাদি (অন্য বর্ণনায়) খাদ্যবস্ত্ত ফিৎরার যাকাত হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই আমাদেরকে আদায়ের নির্দেশ দান করেছেন’।[29] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে প্রত্যেক ছোট-বড়, পুরুষ-নারী, ধনী-গরীবের নিকট থেকে এক ছা‘ গম (যাকাতুল ফিৎর) আদায় কর। ধনীকে আল্লাহ এর বিনিময়ে পবিত্র করবেন। আর ফকীরকে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার প্রদানকৃত যাকাতুল ফিতরের অধিক ফিরিয়ে দিবেন’।[30] উল্লিখিত হাদীছদ্বয় থেকে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হয়।

(১) মাথাপিছু এক ছা‘ হারে যাকাতুল ফিৎর ফরয। যা বর্তমানের হিসাবে আড়াই কেজি চাউলের সমান। পক্ষান্তরে অর্ধ ছা‘ ফিৎরা প্রদানের যে প্রচলন রয়েছে, তার সঠিক ইতিহাস হল, মু‘আবিয়া (রাঃ) ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে সিরিয়া থেকে মদীনায় এসেছিলেন এবং সাথে কিছু গম নিয়ে এসেছিলেন। তিনি দেখলেন তাঁর সাথে আনীত অর্ধ ছা‘ গমের মূল্য মদীনার এক ছা‘ খেজুরের মূল্যের সমান হয়। এহেন প্রেক্ষাপটে মু‘আবিয়া (রাঃ) শুধুমাত্র গমের ক্ষেত্রে অর্ধ ছা‘ ফিতরা আদায়ের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। আর এটা ছিল মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর ইজতিহাদ যা আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) সহ অন্যান্য ছাহাবায়ে কেরাম প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, (রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায়) আমি যা দিতাম তাই-ই দিয়ে যাব’।[31]

সম্মানিত পাঠক! প্রথমত অর্ধ ছা‘ ফিৎরার প্রচলন রাসূল (ছাঃ) থেকে আসেনি; বরং তা ছিল মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর ইজতিহাদ। আর তাও ছিল শুধুমাত্র গমের ক্ষেত্রে; অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে নয়। দ্বিতীয়ত তা ছিল এমন এক প্রেক্ষাপটে যখন অর্ধ ছা‘ গমের মূল্য এক ছা‘ খেজুরের মূল্যের সমান ছিল। বর্তমানে তেমনটি নেই; বরং তার উল্টা। অতএব উল্লিখিত দলীলকে পুঁজি করে সকল ক্ষেত্রে অর্ধ ছা‘ ফিৎরা আদায়ের কোন সুযোগ নেই।

(২) যাকাতুল ফিৎর ফরয হওয়ার জন্য নিছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া শর্ত নয়। কেননা উল্লিখিত হাদীছদ্বয়ে শিশু, কৃতদাস ও গরীবের উপরেও যাকাতুল ফিৎর ফরয বলে আখ্যায়িত হয়েছে।

(৩) খাদ্যদ্রব্য দ্বারাই যাকাতুল ফিৎর আদায় করতে হবে। কেননা টাকা দ্বারা ফিৎরা আদায়ের রীতি ইসলামের সোনালী যুগে ছিল না। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা বাজারে চালু থাকা সত্ত্বেও তিনি খাদ্য বস্ত্ত দ্বারাই ফিৎরা আদায় করেছেন ও করতে বলেছেন।

যাকাতুল ফিৎর আদায়ের সময় : রামাযান শেষে শাওয়ালের চাঁদ উদয়ের পর থেকে ঈদের মাঠে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়ে যাকাতুল ফিৎর আদায় করতে হবে। তবে প্রয়োজনে এক অথবা দু’দিন পূর্বে থেকে যাকাতুল ফিৎর আদায় করা যায়। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) ঈদুল ফিতরের এক অথবা দু’দিন পূর্বে ফিৎরা আদায় করেছেন।[32]

যাকাতুল ফিৎর বণ্টনের খাত সমূহ : যাকাতুল ফিতর বণ্টনের খাত ৮ টি। তা হ’ল : (১) ফক্বীর (২) মিসকীন (৩) যাকাত আদায়কারী ও হেফাযতকারী (৪) ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কোন অমুসলিম (৫) দাস মুক্তির জন্য (৬) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি (৭) আল্লাহর রাস্তায় ও (৮) মুসাফির (তওবা ৯/৬০)

উল্লেখ্য যে, আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ৮টি খাতের মধ্যেই যাকাত বণ্টন সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এর বাইরে যাকাত প্রদান করা জায়েয নয়। তবে যাকাতকে সমান ৮ ভাগে ভাগ করা যরূরী নয়। বরং ৮টি খাতের মধ্যে যে খাতগুলো পাওয়া যাবে সেগুলোর মধ্যে প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে কম-বেশী করে যাকাত বণ্টন করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে কোন একটি খাতে সম্পূর্ণ যাকাত প্রদান করলেও তা আদায় হয়ে যাবে।

উপসংহার : অফুরন্ত রহমত ও মাগফিরাতের ঝর্ণাধারা নিয়ে রামাযানের চাঁদ উদিত হয়। পুরো মাস জুড়ে তাই মুমিনরা লিপ্ত ও রহমতের ফলগুধারায় ডুবে থাকে আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রচেষ্টায়। যে ব্যক্তি তা অর্জন করতে পারে সেই সফল হয়। আর যে নিজের পাপসমূহ ক্ষমা করিয়ে নিতে পারে না, সে ব্যর্থ হয়। ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে আরোহণ করলেন। অতঃপর ১ম সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন! ২য় সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন! এরপর ৩য় সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন! লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা আপনাকে তিন সিঁড়িতে তিন বার আমীন বলতে শুনলাম। তিনি বললেন, আমি যখন ১ম সিঁড়িতে উঠলাম, তখন জিব্রীল আমাকে এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি রামাযান মাস পেল। অতঃপর মাস শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাকে ক্ষমা করা হ’ল না, সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। আমি বললাম, আমীন’![33] আল্লাহ আমাদের বেশী বেশী দো‘আ, যিকর ও ইস্তিগফার করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী

[কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ

 

[1]. মুসলিম হা/১০৭৯; নাসাঈ হা/২১০০

[2]. বুখারী হা/৩৮; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৮৫

[3]. বুখারী হা/১৯০৪; মুসলিম হা/১১৫১; মিশকাত হা/১৯৫৯

[4]. বুখারী হা/১৭৮২

[5]. মিরক্বাত (দিল্লী ছাপা) ১/৪০-৪১ পৃ.; হেদায়া ১/৯৬ পৃ.

[6]. আবুদাউদ হা/২৪৫৪; নাসাঈ হা/২৩৩১; মিশকাত হা/১৯৮৭

[7]. মুসলিম হা/১১৫৪

[8]. বুখারী হা/১৯২৩; মুসলিম হা/১০৯৫

[9]. মুসলিম হা/২৬০৪; মিশকাত হা/১৯৯৩

[10]. বুখারী হা/১৯৫৭; মুসলিম হা/১০৯৮; মিশকাত হা/১৯৮৪

[11]. আবুদাউদ হা/২৩৫৩; মিশকাত হা/১৯৯৫; ছহীহ তারগীব হা/১০৭৫

[12]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩৬৪

[13]. বুখারী হা/৫৩৭৬; মুসলিম হা/২০২২; মিশকাত হা/৪১৫৯

[14]. বুখারী হা/৫৪৫৮; মিশকাত হা/৪১৯৯

[15]. যঈফুল জামে‘ হা/৪৩৪৯

[16]. আবুদাঊদ হা/২৩৫৭; মিশকাত হা/১৯৯৩-৯৪

[17]. বুখারী হা/১৯৩৩; মুসলিম হা/১১৫৫; মিশকাত হা/২০০৩

[18]. আবুদাউদ হা/২৩৯৩; ইবনু মাজাহ হা/১৬৭১

[19]. বুখারী হা/১৯৩৬; মুসলিম হা/১১১১; মিশকাত হা/২০০৪

[20]. বুখারী হা/৭৪৯২; মুসলিম হা/১১৫১; মিশকাত হা/১৯৫৯

[21]. আবুদাউদ হা/২৩৮০; তিরমিযী হা/৭২০; ইবনু মাজাহ হা/১৬৭৬; মিশকাত হা/২০০৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৬২৪৩

[22]. বুখারী হা/৩০৪, ৩২১; মুসলিম হা/৩৩৫; মিশকাত হা/১৯

[23]. মুসলিম হা/১১৬৩; মিশকাত হা/২০৩৯

[24]. বুখারী হা/৩৮; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৮৫

[25]. বুখারী হা/২০১৩; মুসলিম হা/৭৩৮; আবূদাঊদ হা/১৩৪১; নাসাঈ হা/১৬৯৭; তিরমিযী হা/৪৩৯

[26]. বুখারী হা/১৫০৮; মুসলিম হা/৯৮৫

[27]. বুখারী হা/২০২৫; মুসলিম হা/১১৭১

[28]. আহমাদ হা/২৫৪২৩; ইবনু মাজাহ হা/৩৮৫০; মিশকাত হা/২০৯১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৩৭

[29]. বুখারী হা/১৫০৩; মুসলিম হা/৯৮৪; মিশকাত হা/১৮১৫, ১৮১৬

[30]. দারাকুতনী হা/২১২৭; ত্বাহাবী, শারহু মা‘আনিল আছার হা/২৮৮১

[31]. বুখারী হা/১৫০৮; মুসলিম হা/৯৮৫

[32]. বুখারী হা/১৫১১

[33]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪০৯, ছহীহ লিগায়রিহী



বিষয়সমূহ: ছিয়াম-রামাযান
আরও