যৌবনে পাওয়া রামাযানকে মূল্যায়ন করুন!

ফায়ছাল মাহমূদ 1195 বার পঠিত

রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক ঘোষিত বনু আদমের ৬০ থেকে ৭০ বছর গড় আয়ুর মধ্যে যৌবনকালে তথা ১৫ থেকে ৩৫ বা ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ শারীরিক ও মানসিক শক্তিমত্তার শীর্ষে থাকে। অসাধ্যকে সাধন, অসম্ভবকে সম্ভব, দুর্গমকে সুগম, বন্ধুর পথকে মসৃণ এবং যেকোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন বা সমাজ সংস্কার এই যুবকদের দ্বারাই বাস্তবায়িত হয়।

যৌবনকাল হ’ল মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। মোটামুটি এই সময়ের কর্ম তার জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্য নির্ধারণ করে। বিশেষত একজন মুসলিম যদি যৌবনকালে মহান রবের দেওয়া প্রতি ফোঁটা রক্তের আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারে তাহ’লে আল্লাহ অধিক খুশি হন। যৌবনের এই ইবাদতই হ’তে পারে ছায়াহীন ক্বিয়ামতের ময়দানে সুশীতল ছায়ার ব্যবস্থা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ فِى ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ الإِمَامُ وَشَابٌّ نَشَأَ فِى عِبَادَةِ رَبِّهِ... ‘যেদিন আল্লাহর বিশেষ ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ তা‘আলা সাত শ্রেণীর ব্যক্তিকে তাঁর ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন।... তন্মধ্যে এমন যুবক যে আল্লাহর ইবাদতে জীবন অতিবাহিত করেছে’।[1]

তবুও মানুষ হিসাবে ভুল করে অথবা যৌবনের তাড়নায় আমরা আল্লাহর দেওয়া আমানতের কথা ভুলে যাই। কখনো দুনিয়ার চাকচিক্যের মোহে কূল-কিনারা হারিয়ে পাপের অতুল সাগরে ডুবে যাই। কখনো বা পার্থিব মরীচিকার পিছনে ছুটতে ছুটতে দিশেহারা হয়ে হতাশায় মুষড়ে পড়ি। এই দিশেহারা যুবকদের আলোর সন্ধান দিতে রহমত ও মাগফিরাতের বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে আসে রামাযান।

এখনই তওবার শ্রেষ্ঠ সময় : আল্লাহ তাঁর সকল পাপী বান্দার প্রতি তওবা কবুলের শুভ সংবাদ দিয়ে বলেন,قُلْ يَاعِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ‘বল, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (যুমার ৩৯/৫৩)। যদি কেউ খালেছ অন্তরে তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, তাহ’লে তিনি তাকে ক্ষমা করার নিশ্চয়তা দিয়েছেন অত্র আয়াতে।

পাপের সাগরে ডুবন্ত হে যুবক ভাই! এটাই সুযোগ পাপ থেকে উত্তরণের। জাহেলিয়াতের অন্ধকার পথের সন্ধান করা হে তরুণ! এখনই সময় আলোর পথে ফেরার। ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় পালিত প্রতিটি ছিয়াম, ক্বিয়াম হ’তে পারে গুনাহ মাফের উত্তম উপলক্ষ্য।

রামাযান ও যৌবন থাকতেই সতর্ক হৌন!

হাযার মাসের চেয়েও উত্তম হ’তে পারে এ মাসের একেকটি রাতের ইবাদত। জীবন থাকলে হয়তো রামাযান আবার পাওয়া যাবে কিন্তু যৌবনের মূল্যবান সময় আর ফিরে আসবে না। বার্ধক্যের নুয়ে পড়া শরীরে ইবাদতের শক্তি থাকবে না। এজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ ‘পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে পাঁচটিকে গণীমত মনে কর’। তন্মধ্যে شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ ‘বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকে’।[2]

অন্যদিকে রামাযানের সুযোগকে অবহেলায় নষ্ট করাকেও দুর্ভাগ্য বলা হয়েছে। ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে আরোহণ করলেন। অতঃপর ১ম সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন! ২য় সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন! এরপর ৩য় সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, আমীন! লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা আপনাকে তিন সিঁড়িতে তিন বার আমীন বলতে শুনলাম। তিনি বললেন, আমি যখন ১ম সিঁড়িতে উঠলাম, তখন জিব্রীল আমাকে এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি রামাযান মাস পেল। অতঃপর মাস শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাকে ক্ষমা করা হ’ল না, সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। আল্লাহ তাকে স্বীয় রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। আমি বললাম, আমীন’![3] তাই যৌবনে কাটানো এই রামাযানই হ’তে পারে আমাদের জীবনের উত্তম পাথেয় অর্জন অথবা মহা আফসোসের কারণ।

প্রিয় যুবক ভাই! আল্লাহকে ভয় করুন!

মাথা ছাড়া যেমন মানুষকে কল্পনা করা যায় না বা পূর্ণ মানব হয় না, ঠিক তেমনি তাক্বওয়া ছাড়া ইবাদত আল্লাহর কাছে পূর্ণতা পায় না। তাক্বওয়া প্রত্যেক মুসলিমের অপরিহার্য গুণ। এজন্য আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوْتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُوْنَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা অবশ্যই মুসলিম না হয়ে মরো না’ (আলে ইমরান ৩/১০২)

এই তাক্বওয়া অর্জনের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে সকল নবীর উম্মতের উপরে ছিয়াম ফরয করেছেন। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হ’ল, যেমন তা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩)

তাক্বওয়ার পরিচয় সম্পর্কে ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, اَلتَّقْوَى هِيَ فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ ‘তাক্বওয়া বা আল্লাহভীরুতা হচ্ছে আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা বাস্তবায়ন করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা’।[4] একজন ছায়েম ছিয়াম পালনকালে যেমন আল্লাহর ভয়ে গোপন কক্ষে একাকী থাকলেও পানাহার করে না, তেমনিভাবে পূর্ণ সুযোগ ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মুসলিম যুবক কোন হারামে লিপ্ত হবে না এটাই তাক্বওয়ার দাবী। ছিয়ামের মাধ্যমে একজন প্রকৃত মুসলিম যুবকের সর্বাবস্থায় হারাম থেকে বেঁচে থাকার এই প্রশিক্ষণই গ্রহণ করা উচিত।

ইলম অর্জনে ব্রতী হৌন!

রামাযানের এত বেশি ফযীলতের অন্যতম কারণ এই যে, এ মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ ‘রামাযান হ’ল সেই মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যা মানুষের জন্য সুপথ প্রদর্শক ও সুপথের স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। কুরআন নাযিলের মাস হিসাবে রামাযান যেমন সম্মানিত হয়েছে, কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ যুবক তেমনি দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত হন। তাই এ মাসে বেশি বেশি দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করুন।

প্রিয় ভাই! কুরআন নাযিলের মাসে অন্তত এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করুন। এই কুরআনই হবে আপনার জন্য জান্নাতের সুপারিশকারী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,اَلصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَقُوْلُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيْهِ وَيَقُوْلُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ- ‘ছিয়াম ও কুরআন ক্বিয়ামতের দিন বান্দার জন্য আল্লাহর নিকট সুফারিশ করবে। ছিয়াম বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে দিনের বেলায় খানাপিনা ও প্রবৃত্তি পরায়ণতা হ’তে বিরত রেখেছিলাম। অতএব তার ব্যাপারে তুমি আমার সুফারিশ কবুল কর। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলা ঘুম থেকে বিরত রেখেছিলাম। অতএব তার ব্যাপারে তুমি আমার সুফারিশ কবুল কর। রাসূল (ছাঃ) বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুফারিশ কবুল করা হবে’।[5]

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্য মাসের তুলনায় রামাযানে অধিক কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এসময় প্রতি রাতে জিব্রীল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে কুরআন শোনাতেন’।[6] আমাদের অনুসরণীয় সালাফগণও এ মাসে অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। যেমন-(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, ক্বাতাদাহ (রাঃ) অন্য সময় প্রতি সাত দিনে এক খতম এবং রামাযানে প্রতি তিন দিনে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন। (২) ইমাম মালেক, যুহরী ও সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) রামাযানে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কুরআন তেলাওয়াতে রত হ’তেন।[7]

সাধ্যমত দান-ছাদাক্বাহ করুন!

রামাযান মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অধিক পরিমাণে দান করতেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন,كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ النَّاسِ بِالْخَيْرِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِى رَمَضَانَ، حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، يَلْقَاهُ كُلَّ لَيْلَةٍ فِى رَمَضَانَ حَتَّى يَنْسَلِخَ، يَعْرِضُ عَلَيْهِ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم الْقُرْآنَ، فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ أَجْوَدَ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ ‘ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকলের চেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন। রামাযানে যখন জিব্রীল (আঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি আরো বেশী দান করতেন। রামাযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত জিব্রীল (আঃ) প্রতি রাতেই তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী করীম (ছাঃ) তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিব্রীল (আঃ) যখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি প্রবাহিত বায়ুর চেয়ে অধিক দান করতেন’।[8]

হে যুবক ভাই! রামাযান বা এর পরবর্তী ঈদুল ফিতর আমাদের জীবনে বাড়তি আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে আসে। এসময় চাকরিজীবী ভাইয়েরা নিয়মিত বেতনের সাথে বোনাস লাভ করেন। সেখান থেকে পিতা-মাতা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন পোষাক ক্রয়সহ বিভিন্ন শখ পূরণে খরচ করেন। তেমনি আল্লাহর জন্যও একটি অংশ নির্ধারণ করুন। ক্বিয়ামতের দিন যখন পরিবার-পরিজন সকলে মুখ ফিরিয়ে নিবে সেদিন এই দানই আপনাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। আদী ইবনু হাতেম (রাঃ) বলেন,أَنَّهُ ذَكَرَ النَّارَ فَتَعَوَّذَ مِنْهَا وَأَشَاحَ بِوَجْهِهِ ثَلاَثَ مِرَارٍ ثُمَّ قَالَ ‏اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ ‘রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) জাহান্নামের আগুন সম্পর্কে আলোচনা করলেন। এরপর তা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন এবং মুখমন্ডল তিনবার ফিরিয়ে নিলেন। এরপর তিনি বললেন, এক টুকরা খেজুরের বিনিময়ে হলেও তোমরা অগ্নি থেকে বেঁচে থাক। যদি তা না পাও তবে অন্তত একটি ভাল কথার বিনিময়ে হলেও’।[9]

প্রিয় ভাই! আপনার যদি সামর্থ্য না থাকে তাহ’লে ভাল কথা বলুন। মানুষকে সৎকাজের পথপ্রদর্শন করুন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ ‘যে ব্যক্তি কোন কল্যাণের পথনির্দেশ করে, তার জন্য উক্ত কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ প্রতিদান রয়েছে’।[10] তাই নিজে আমল করার পাশাপাশি দাওয়াতী কাজে অংশগ্রহণ করুন।

নফল ইবাদতে মনোনিবেশ করুন!

নফল ইবাদতে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয় এবং এর দ্বারা বান্দার ফরয ইবাদতের ঘাটতি পূরণ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ النَّاسُ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ أَعْمَالِهِمُ الصَّلَاةُ، قَالَ: يَقُولُ رَبُّنَا جَلَّ وَعَزَّ لِمَلَائِكَتِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ: انْظُرُوا فِي صَلَاةِ عَبْدِي أَتَمَّهَا أَمْ نَقَصَهَا؟ فَإِنْ كَانَتْ تَامَّةً كُتِبَتْ لَهُ تَامَّةً، وَإِنْ كَانَ انْتَقَصَ مِنْهَا شَيْئًا، قَالَ: انْظُرُوا هَلْ لِعَبْدِي مِنْ تَطَوُّعٍ؟ فَإِنْ كَانَ لَهُ تَطَوُّعٌ، قَالَ: أَتِمُّوا لِعَبْدِي فَرِيضَتَهُ مِنْ تَطَوُّعِهِ، ثُمَّ تُؤْخَذُ الْأَعْمَالُ عَلَى ذَاكُمْ ‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে তার ছালাতের। যদি তার ছালাতের হিসাব সঠিক হয় তাহ’লে সে সফলকাম হবে ও নাজাত পাবে। আর যদি ছালাত বিনষ্ট হয়ে যায় তাহ’লে সে বিফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি ফরয ছালাতে কিছু কমতি হয়, তাহ’লে প্রতিপালক আল্লাহ বলবেন, দেখ আমার বান্দার কোন নফল ইবাদত আছে কি-না? তখন নফল দিয়ে ফরযের ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর তার অন্যান্য সকল আমল সম্পর্কেও অনুরূপ করা হবে (যেমন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি)’।[11]

রামাযান মাসে সবচেয়ে বেশি নফল আমলের সুযোগ পাওয়া যায়। রামাযানে রাতে তারাবীহ ছালাতে গুনাহ মাফের সুযোগ থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ক্বদরের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় ছালাতে রত থাকবে, আল্লাহ তার বিগত সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন’।[12]

আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোআ করুন!

দো‘আ কবুলের মাস রামাযান। এ মাসের শুরুতে আল্লাহ রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেন।[13] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَنَادَى مُنَادٍ يَا بَاغِىَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِىَ الشَّرِّ أَقْصِرْ وَلِلَّهِ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ وَذَلِكَ فِى كُلِّ لَيْلَةٍ- ‘আর একজন আহবানকারী ডেকে বলেন, ‘হে কল্যাণের অভিযাত্রী এগিয়ে চলো! হে অকল্যাণের অভিসারী বিরত হও! এ মাসে বহু জাহান্নামীকে মুক্ত করা হয়। আর এটি প্রতি রাত্রিতে করা হয়’।[14] এজন্য বেশি বেশি জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভের দো‘আ করতে হবে। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,ثَلاَثُ دَعَوَاتٍ لاَ تُرَدُّ، دَعْوَةُ الْوَالِدِ، وَدَعْوَةُ الصَّائِمِ، وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ- ‘তিন ব্যক্তির দো‘আ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (১) সন্তানের জন্য পিতার দো‘আ। (২) ছিয়াম পালনকারীর দো‘আ। (৩) মুসাফিরের দো‘আ’।[15] প্রিয় ভাই! রামাযান মাসের দিন রাতকে আপনার দো‘আ কবুলের সুবর্ণ সুযোগ মনে করুন। আপনার যাবতীয় মনোবাসনা আল্লাহর কাছে পেশ করুন। দিনে-রাতে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করুন।

অশ্লীল ও অপ্রয়োজনীয় কথা-কাজ পরিহার করুন!

প্রিয় যুবক ভাই! যৌবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হ’ল প্রবৃত্তির অনুসরণ। অশ্লীল কথাবার্তা ও অপ্রয়োজনীয় কাজ যেন যৌবনের নিত্যসঙ্গী। এগুলো থেকে নিজেকে হেফাযত করার প্রশিক্ষণ হিসাবে ছিয়ামকে গ্রহণ করুন। মনে রাখবেন, কেবল পানাহার পরিত্যাগের নাম ছিয়াম নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ لَّمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِى أَنْ يَّدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করল না, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’।[16]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ، فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ، أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّى امْرُؤٌ صَائِمٌ ‘ছিয়াম (অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে) ঢাল স্বরূপ। অতএব যখন তোমাদের কেউ ছিয়াম পালন করে, সে যেন মন্দ কথা না বলে এবং অপ্রয়োজনীয় কথা না বলে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা লড়াই করতে আসে তখন বলবে, আমি ছায়েম’।[17]

মিডিয়া ব্যবহারে সতর্ক হৌন!

বর্তমান যুবসমাজের বড় একটি অংশ মোবাইল, ইন্টারনেটসহ আধুনিক মিডিয়ায় আসক্ত। যা আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে। অথচ প্রতি সেকেন্ড সময় আল্লাহর দেওয়া নে‘মত। ক্বিয়ামতের দিন এর হিসাব ছাড়া কেউ পা বাড়াতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَا تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلَاهُ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَا أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ؟ ‘ক্বিয়ামতের দিন আদম সন্তানের পদদ্বয় একটওু নড়তে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। ১. তার বয়স সম্পর্কে, সে তা কী কাজে ব্যয় করেছে? ২. তার যৌবন সম্পর্কে, সে তা কী কাজে ক্ষয় করেছে? ৩. তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা হ’তে অর্জন করেছে? ৪. আর তা কোথায় ব্যয় করেছে? এবং ৫. যে জ্ঞানার্জন করেছিল, সে অনুযায়ী কী আমল করেছে?’[18]

প্রিয় ভাই! মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদি মানুষের প্রয়োজনে আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো মানুষের জীবন ও যোগাযোগ সহজ ও দ্রুত করেছে। কিন্তু এগুলোর অপব্যবহার মানুষের জীবনের মূল্যবান সময় ও নৈতিকতা কেড়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর একটি হাদীছ স্মরণ রাখবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ المَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ ‘ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হ’ল, অনর্থক বিষয় পরিহার করা’।[19] তাই রামাযানের এই বরকতময় মাসে আপনার ইবাদতের মূল্যবান সময় যেন অনর্থক ব্যয় না হয় সে বিষয়ে যত্নবান হৌন।

ই‘তিকাফে নির্জনে আল্লাহকে ডাকুন!

রামাযানে ই‘তিকাফ আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের এক বড় মাধ্যম। এতে লায়লাতুল ক্বদর সহজে লাভ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে নববীতে রামাযানের শেষ দশকে নিয়মিত ই‘তিকাফ করতেন। এমনকি তিনি মৃত্যুর বছর বিশ দিন ই‘তিকাফ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْتَكِفُ فِى كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِى قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতি রামাযানে দশদিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে বছর বিশ দিন ই‘তিকাফ করেন’।[20]

লায়লাতুল ক্বদরে রাত্রি জাগরণ করুন!

রামাযান মাসের সবচেয়ে মর্যাদামন্ডিত রাত হ’ল লায়লাতুল ক্বদর। এটি হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতের মর্যাদা বর্ণনায় আল্লাহ একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেছেন। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ এ রাতে জেগে জেগে ইবাদত করতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন,إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ ‘রামাযানের শেষ দশক উপস্থিত হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোমর বেঁধে নিতেন’। রাত্রি জাগরণ করতেন ও স্বীয় পরিবারকে জাগাতেন’।[21] তিনি বলেন,يَجْتَهِدُ فِى الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مَا لاَ يَجْتَهِدُ فِى غَيْرِهِ ‘শেষ দশকে রাসূল (ছাঃ) যত চেষ্টা করতেন, অন্য সময় তত করতেন না’।[22]

সুযোগ থাকলে ওমরাহ পালন করুন!

রামাযান বছরের শ্রেষ্ঠ মাস। এ মাসে সকল নেক আমলের ছওয়াব বান্দা বহুগুণ লাভ করে। অনুরূপভাবে এই মাসে ওমরাহ সম্পাদনের মাধ্যমে হজ্জ করার সমপরিমাণ ছওয়াব অর্জন করা যায়। রাসূল (ছাঃ) বললেন,فَإِنَّ عُمْرَةً فِيْ رَمَضَانَ تَقْضِيْ حَجَّةً أَوْ حَجَّةً مَعِيْ রামাযান মাসে ওমরাহ করা হজ্জ করার ন্যায় অথবা আমার সাথে হজ্জ করার ন্যায়’।[23] অন্যত্র তিনি বলেছেন,إِنَّ عُمْرَةً فِىْ رَمَضَانَ تَعْدِلُ حَجَّةً ‘নিশ্চয়ই রামাযান মাসের ওমরাহ একটি হজ্জের সমান’।[24] তবে এই ওমরাহ পালনে হজ্জের ফরযিয়াত আদায় হবে না; বরং হজ্জের সমপরিমাণ নেকী পাওয়া যাবে। তাই সুযোগ ও সাধ্য থাকলে রামাযানে ওমরাহ পালন করুন।

উপসংহার : প্রিয় যুবক ও তরুণ ভাই! বছরের মধ্যে রামাযান মাস যেমন শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাসম্পন্ন, মানব জীবনে যৌবনকাল তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। তাই যৌবনে পাওয়া এই রামাযানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন। শাওয়ালের চাঁদ উদিত হওয়ার পূর্বেই সকল গুনাহ ক্ষমা করিয়ে নেওয়ার দৃঢ় সংকল্প করুন ও প্রচেষ্টা চালান। তাহ’লেই ঈদের দিন সত্যিকারের আনন্দ ও প্রশান্তি আপনার জীবনে আসবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন।- আমীন!

-ফায়ছাল মাহমূদ

[কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ ও
শিক্ষক আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নাওদাপাড়া, রাজশাহী]

[1]. বুখারী হা/১৪২৩; মুসলিম হা/১০৩১।

[2]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৯৭৬৭।

[3]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪০৯, ছহীহ লিগায়রিহী

[4]. মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া ৩/৬১৪

[5]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/১৯৯৪; মিশকাত হা/১৯৬৩ ছহীহ।

[6]. বুখারী হা/৬।

[7]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ছিয়াম ও ক্বিয়াম (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৩য় প্রকাশ, মার্চ ২০২৩ খৃ.) পৃ. ১১৩-১৪।

[8]. বুখারী হা/৬।

[9]. মুসলিম হা/১০১৬।

[10]. মুসলিম হা/১৮৯৩; তিরমিযী হা/২৬৭১।

[11]. আবুদাঊদ হা/১৮৯৩।

[12]. মুসলিম হা/৭৫৯।

[13]. মুসলিম হা/১০৭৯; বুখারী হা/১৮৯৯; মিশকাত হা/১৯৫৬। 

[14]. তিরমিযী হা/৬৮২; ইবনু মাজাহ হা/১৬৪২; মিশকাত হা/১৯৬০।

[15]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৭৯৭।

[16]. বুখারী হা/১৯০৩।

[17]. বুখারী হা/১৯০৪; মুসলিম হা/১১৫১ (১৬৪); ইবনু মাজাহ হা/১৬৩৮; মিশকাত হা/১৯৫৯, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[18]. তিরমিযী হা/২৪১৬; ছহীহাহ হা/৯৪৬।

[19]. তিরমিযী হা/২৩১৭-১৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৬।

[20]. বুখারী হা/২০৪৪।

[21]. বুখারী হা/২০২৪; মুসলিম হা/১১৭৪।

[22]. মুসলিম হা/১১৭৫।

[23]. বুখারী হা/১৮৬৩।

[24]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাত হা/২৫০৯।



বিষয়সমূহ: ছিয়াম-রামাযান
আরও