রামাযানে সফল বিনিয়োগের উপায়

মুহাম্মাদ আব্দুন নূর 348 বার পঠিত

হিজরী সনের মধ্যে রামাযান মাস অন্যান্য মাসের চেয়ে অতুলনীয়। এই মাসের এক মহিমান্বিত রাতে নাযিল হয় আল-কুরআন, যে রাত হাযার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। রামাযানে আমাদের আত্মউন্নয়নের জন্য রয়েছে অফুরন্ত সুযোগ। ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় অতিরিক্ত সুবিধা ও লাভবান হওয়ার জন্য বিনিয়োগ করে। রামাযানে মুমিনদের রয়েছে সৎকর্মের বিনিয়োগের মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি লাভের সুযোগ। আলোচ্য প্রবন্ধে সৎকর্মের মাধ্যমে রামাযান মাসে সফল বিনিয়োগের উপায়গুলো আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ!

(১) সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ : রামাযানে আসমানের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয়, তাই বান্দার কোন দো‘আ বিফল হয় না। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বিশেষ বিশেষ সময়ে বান্দার দো‘আ কবুল করে থাকেন। রামাযানকে সফল করতে সেই সেরা সময়গুলোতে দো‘আ করাই সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। তন্মন্ধে উল্লেখযোগ্য সময় হ’ল আযানের সময়[1], আযান ও ইক্বমতের মাঝে[2], সিজদারত অবস্থায়[3], তাশাহ্হুদের পরে[4], ফরয ছালাতসমূহের শেষাংশে’[5], যোহরের পূর্বে সূর্য পশ্চিমে হেলে যাওয়ার পর[6] রাত্রের শেষভাগে[7] জুমু‘আর দিন[8] ইত্যাদি। আল্লাহর প্রতি কাতরতা, অবনত মনোভাব নিয়ে কাকুতি-মিনতিসহ বিনীতভাবে অনুচ্চস্বরে দো‘আ করতে হবে। সাথে দো‘আ কবুলের জন্য আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করতে হবে। কেননা তাছাড়া দো‘আ কবুল হয় না।[9]

দিনে-রাতে যখনই এই সময়গুলি পাওয়া যাবে তখনই দো‘আ করতে হবে। আপনি ব্যাকুল হৃদয় নিয়ে এমনভাবে দো‘আ করবেন যেন এর মাধ্যমেই আপনি জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি হন। সৎকর্ম সমূহ ও দো‘আ এভাবেই অব্যাহত রাখুন। দেখবেন এক সময় আপনি ইলাহী শীতলতা অনুভব করবেন। যা আপনার হৃদয় জগতকে পবিত্র ও প্রশান্তিময় করে তুলবে।

(২) মসজিদের বিনিয়োগ :

ক. মসজিদে দীর্ঘ সময় কাটানো : মাসজিদ হ’ল আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় স্থান’।[10] চেষ্টা করতে হবে মসজিদেই দীর্ঘ সময় কাটানোর এবং এক ছালাত থেকে পরবর্তী ছালাতের জন্য মসজিদে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা। এতে মসজিদের সাথে যদি আপনার সম্পৃক্ততা দৃঢ় হয়, তাহ’লে আপনি ক্বিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবেন’।[11] উত্তরোত্তর গুনাহ ঝরে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে’।[12]

খ. পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত যথাযথভাবে আদায় করা : তাকবীরে তাহরীমাসহ পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায়ের দৃঢ় সংকল্প করা। এই দৃঢ় সংকল্পটি এই পবিত্র মাস থেকেই শুরু হওয়া উচিত। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ صَلَّى لِلَّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا فِي جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيرَةَ الأُولَى كُتِبَ لَهُ بَرَاءَتَانِ: بَرَاءَةٌ مِنَ النَّارِ، وَبَرَاءَةٌ مِنَ النِّفَاقِ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ৪০ দিন তাকবীরে ঊলা সহ জামা‘আতে ছালাত আদায় করল, তার জন্য দু’টি মুক্তি লেখা হয়। একটি হ’ল জাহান্নাম হ’তে মুক্তি। অপরটি হ’ল নিফাক্ব হ’তে মুক্তি’।[13] ইবনু হাজার বলেন, ‘তাকবীরে ঊলা’ পাওয়া সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। সালাফে ছালেহীন ইমামের সাথে প্রথম তাকবীর না পেলে ৩ দিন দুঃখ প্রকাশ করতেন। আর জামা‘আত ছুটে গেলে ৭ দিন দুঃখ প্রকাশ করতেন’।[14]

গ. প্রথম সারিতে দাঁড়ানোর প্রতি আগ্রহ তৈরী করা : রামাযানের প্রথম দিন থেকেই প্রথম সারিতে দঁাড়িয়ে ছালাত আদায়ের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আর এজন্য নিজের সাথে নিজেকেই প্রতিযোগিতা করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَوْ يَعْلَمُ النَّاسُ مَا فِي النِّدَاءِ وَالصَّفِّ الْأَوَّلِ، ثُمَّ لَمْ يَجِدُوا إِلَّا أَنْ يَسْتَهِمُوا عَلَيْهِ، لَاسْتَهَمُوا ; وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِي التَّهْجِيرِ، لَاسْتَبَقُوا إِلَيْهِ وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِي الْعَتَمَةِ وَالصُّبْحِ، لَأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا- ‘যদি লোকেরা জানত যে, আযান, প্রথম কাতার ও আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায়ে কি নেকী রয়েছে, তাহ’লে তারা পরস্পরে প্রতিযোগিতা করত। অনুরূপভাবে যদি তারা জানত এশা ও ফজরের ছালাতে কি নেকী রয়েছে, তবে তারা হামাগুড়ি দিয়ে হ’লেও ঐ দুই ছালাতে আসত’।[15] এটি প্রমাণ করে যে, প্রথম সারিতে দাঁড়ানো একটি বিশেষ মর্যাদা এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে জানলে মানুষ আরও বেশি আগ্রহী হ’ত।

ঘ. নফল ইবাদতে যত্নশীল হওয়া : এমনও ব্যক্তি আছেন যারা নফল ইবাদতে তেমন যত্নশীল নন। অথচ তা ফরয ইবাদতের সম্পূরক। কেননা ‘ক্বিয়ামতের দিন (মীযানের পাল্লায়) ফরয ইবাদতের কমতি হ’লে প্রতিপালক আল্লাহ বলবেন,انْظُرُوا هَلْ لِعَبْدِي مِنْ تَطَوُّعٍ فَيُكَمَّلَ بِهَا مَا انْتَقَصَ مِنَ الفَرِيضَةِ ‘দেখ আমার বান্দার কোন নফল ইবাদত আছে কি-না। তখন নফল দিয়ে তার ঘাটতি পূরণ করা হবে’।[16] অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দিবারাত্রিতে ১২ রাক‘আত ছালাত আদায় করে, তার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ করা হবে। যোহরের পূর্বে চার, পরে দুই, মাগরিবের পরে দুই, এশার পরে দুই ও ফজরের পূর্বে দুই’।[17]

ঙ. মসজিদে ইমামের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় করা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে তিন রাত জামা‘আতের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় করেছেন’।[18] স্মাতর্ব এই যে, কেউ কেউ ইমামের সাথে বিতর ছালাত না পড়ে মসজিদে থেকে বেরিয়ে আসেন। এতে করে ঐ ব্যক্তি সারারাত্রি নফল ছালাত আদায়ের নেকী থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ الرَّجُلَ إِذَا صَلَّى مَعَ الْإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ حُسِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَةٍ ‘কোন ব্যক্তি যখন ইমাম সালাম ফিরিয়ে ছালাত হ’তে বের হওয়া পর্যন্ত তার সাথে ছালাত আদায় করে তার জন্যে এক পূর্ণ রাত ছালাত আদায় করার ছওয়াব লেখা হয়’।[19] সুতরাং ইমামের সাথেই ছালাত শেষ করলেই সারারাত্রি ছালাত আদায়ের নেকী লাভ হবে ইনশাআল্লাহ।

(৩) দৈনন্দিন বিনিয়োগ : দৈনন্দিন দান-ছাদাক্বা করার প্রতি সকলের যত্নবান হওয়া উচিত। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَحَبُّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللهِ تَعَالَى أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلّ ‘সেই আমল আল্লাহর অধিক পসন্দনীয় যে আমল নিয়মিতভাবে করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়’।[20] এই পবিত্র মাসে দান-ছাদাক্বার মাধ্যমে মুসলিমদের জন্য বিশেষ এক অনুভূতি সৃষ্টি হয়। যেমন হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্যান্য লোকদের তুলনায় অত্যধিক দানশীল ছিলেন। রামাযান মাসে যখন জিব্রীল (আঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি অত্যধিক দানশীল হয়ে যেতেন’।[21]

(৪) পারিবারিক বিনিয়োগ : পিতা-মাতা এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটা হ’তে পারে তাদের সঙ্গে একত্রে ইফতার করা, পরিবারকে একত্রিত করা, তাদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, পিতা-মাতা ও আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্কের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায়। যেমন হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, مَنْ وَصَلَهَا وَصَلْتُهُ، وَمَنْ قَطَعَهَا بَتَتُّهُ ‘যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক দৃঢ় রাখবে, আমি তার সাথে যুক্ত থাকব। আর যে ব্যক্তি সেটা ছিন্ন করবে, আমি তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিব’।[22]

যদি কেউ এই সম্পর্কের গুরুত্ব ও মূল্য অনুভব করে, তবে সে তার আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করবে। সুতরাং অন্তরে ভালো কাজ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজ হ’ল মাতা-পিতার সেবা। তাই রামাযানে তাদের সেবা ও আনুগত্যে মনোযোগী হওয়া উচিত। যেন আল্লাহর রহমত আপনার ওপর নাযিল হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, رِضَا الرَّبِّ فِي رِضَا الْوَالِدِ ‘পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি’।[23] রাসূল (ছাঃ) বলেন,الْوَالِدُ أَوْسَطُ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ، فَحَافِظْ عَلَى وَالِدَيْكَ أَوِ اتْرُكْ ‘পিতা হ’লেন জান্নাতের মধ্যম দরজা। এক্ষণে তুমি তোমার পিতা-মাতাকে হেফাযত কর অথবা পরিত্যাগ কর’।[24] রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতার উভয়কে কিংবা কোন একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল কিন্তু জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না; তার নাক ধূলায় ধূসরিত হৌক! একথা তিনি তিনবার বলেন’।[25]

পারিবারিক সম্পর্কের দৃঢ়তা সমৃদ্ধ করতে রামাযানে পারিবারিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। যা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করবে। এছাড়া অন্যান্য পারিবারিক উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে, যা তাদের উপর দৃশ্যমান প্রভাব ফেলে।

(৫) পারস্পরিক বিনিয়োগ :

ক. মুসলিম ভ্রাতৃত্ব দৃঢ় করা : রামাযানে পারস্পরিক মুসলিম ভ্রাতৃত্ব দৃঢ় করতে একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, উপহার দেওয়া, একে অপরের ভুল ক্ষমা করা, ক্ষোভ দূর করা, দো‘আ করা এবং একে অপরের খবর নেওয়া এগুলি সবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যার বিনিময়ে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মহা পুরস্কার লাভ হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا- ‘তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই। তবে যে পরামর্শে তারা মানুষকে ছাদাক্বা করার বা সৎকর্ম করার কিংবা লোকদের মধ্যে পরস্পরে সন্ধি করার উৎসাহ দেয় সেটা ব্যতীত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সেটা করে, নিশ্চয়ই আমরা তাকে মহা পুরস্কারে ভূষিত করব’ (নিসা ৪/১১৪)

খ. পারস্পরিক সহযোগিতা করা : পিতা ও তাঁর সন্তানদের উচিত পরিবারের জন্য যা কিছু ক্রয় করেন, তা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রতিদান লাভের নিয়তে করা। একইভাবে মাতা ও তাঁর কন্যাদেরও উচিত খাবার প্রস্ত্ততের সময় একই নিয়ত রাখা এবং এতে কোনো ধরনের বিরক্তি প্রকাশ না করা। তবে সবকিছুতেই সংযম বজায় রাখতে হবে। না অপচয়, না কার্পণ্য। এছাড়াও আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ইফতার বিনিময়ের বিষয়টি অবহেলা করা উচিত নয়; বরং এটি শুধুমাত্র সামাজিক রীতি নয়, বরং ইহসানের মাধ্যমে প্রতিবেশীর প্রতি সদয় হওয়া ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।

(৬) রামাযানে হজ্জ : রামাযানকে আরো সাফল্য মন্ডিত করতে এ মাসে ওমরাহ পালন করা যেতে পারে। কারণ এ মাসের ওমরাহ পালন হজ্জ সমতুল্য ছওয়াব রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,فَإِنَّ عُمْرَةً فِى رَمَضَانَ تَقْضِى حَجَّةً مَعِى ‘রামাযান মাসে ওমরাহ করা হজ্জ করার ন্যায় অথবা আমার সাথে হজ্জ করার ন্যায়’।[26] অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই রামাযান মাসের ওমরাহ একটি হজ্জের সমান।[27] তবে এই ওমরাহ পালনে হজ্জের ফরযিয়াত আদায় হবে না; বরং হজ্জের সমপরিমাণ নেকী পাওয়া যাবে।

(৭) রামাযানে এক দিনে একাধিক ছিয়াম পালন : রামাযানে আমাদের নেকী অর্জনে অধিক পরিমাণে উদগ্রীব থাকতে হবে। সেজন্য আমাদের একদিনে একাধিক ছিয়াম পালনের ছওয়াব অর্জনে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আর এটা হ’তে ছায়েমকে ইফতার করানোর মাধ্যমে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ، غَيْرَ أَنَّهُ لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا- ‘যে ব্যক্তি ছায়েমকে ইফতার করাবে, তার জন্য ছায়েমের সমপরিমাণ ছওয়াব রয়েছে। অথচ তাদের ছওয়াবে কোন কমতি করা হবে না’।[28] সুতরাং কতই না সুন্দর হয় যদি আমরা মসজিদে ছায়েমদের ইফতারের ব্যবস্থা করি এবং এর মাধ্যমে ছওয়াবের আনন্দ অনুভব করি!

(৮) হাত-পা, চোখ-কান ও অন্তরের বিনিয়োগ : রামাযানের ছিয়ামের যথার্থ নেকী লাভের জন্য হাত-পা, চোখ-কান ও অন্তরের ছিয়াম পালন করতে হবে। অর্থাৎ যাবতীয় হারাম থেকে বিরত রাখার সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। নচেৎ ছিয়ামের পূর্ণ নেকী লাভ হবে না। কেননা এগুলি মাধ্যমে অনেক পাপ সংঘটিত হয়। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘কথার যেনা হ’ল বলা, চোখের যেনা হ’ল দেখা, কানের যেনা হ’ল শোনা, হাতের যেনা হ’ল ধরা, পায়ের যেনা হ’ল এগিয়ে যাওয়া, মনের যেনা হ’ল কামনা করা। অতঃপর গুপ্তাঙ্গ সেটিকে বাস্তবায়িত করে’।[29] 

(৯) পাপাচারের স্থান ও পরিবেশ থেকে দূরে থাকা : যেসব স্থান ও পরিবেশে পাপাচার সংঘটিত হয়, সেখান থেকে দূরে থাকা যরুরী। যাতে তা মন্দ কাজের প্ররোচনার সুযোগ না পায়। মূলত রামাযান হ’ল ধৈর্য, অধ্যবসায় ও আত্মসংযমের এক মহিমান্বিত মাস। এ মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। তাই মন সহসাই সংযত থাকে ও আত্মসংবেদনশীল হয়। ফলে চারপাশের সবাই ছিয়াম রাখে ও ছালাত আদায়ে মনোযোগী হয়। এরপরেও কিছু মানুষরূপী শয়তান পাপকর্মে লিপ্ত থাকে। এদের এড়িয়ে চলতে হবে। সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহে রামাযানের পরিবেশ ও পরিস্থিতি সমস্ত পাপাচার থেকে দূরে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

(১০) প্রত্যহ কুরআনী মজলিস আয়োজন করা : রামাযানকে স্বার্থক করতে বারবার কুরআন খতম করা এবং তা গভীরভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে। এটা হ’তে পারে ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে। কুরআন খতমের জন্য একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত। আর কতই না সুন্দর হয়, যদি বাবা-মা তাদের সন্তানদের সঙ্গে বসে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন করেন। আর তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন ও নিজেদের জীবনকে কুরআনের আলোয় আলোকিত করেন। এভাবে ঘর আল্লাহর স্মরণে জীবন্ত হয়ে ওঠে ও ঈমানী পরিবেশে পরিপূর্ণ হয়।

(১১) মোবাইল ফোন ব্যবহার সীমিত করা : মোবাইল ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সময় কমিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট মিনিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে; যাতে রামাযানের ছওয়াব এবং রামাযানের বরকত আপনার কাছ থেকে হারিয়ে না যায়।

তথাপি আধুনিক প্রযুক্তি যেমন স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভাল কাজের প্রচার, উৎসাহ প্রদান এবং তাদেরকে আল্লাহর ইবাদতে আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে। এছাড়াও সময় কাটানোর জন্য মোবাইল ব্যবহার না করে ইসলামিক বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা পড়া যেতে পারে। যাতে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পাপ থেকে  বাঁচা যায়।

(১২) রামাযানে সময়ের সদ্ব্যবহার করা : রামাযানে বাজারে থাকার সময় কমানোর চেষ্টা করুন। যদি সম্ভব হয়, যা আপনি প্রয়োজন তা কেনার জন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়াও ভালো হবে। আরো ভালো হয় রামাযান শুরুর আগেই অতীব প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র ও ঈদ মার্কেট করে ফেলা। যাতে রামাযানের শেষ দশকের গুরুত্বপূর্ণ সময় বাজারে ঘুরে সময় নষ্ট না করে, যাতে সময়ের সদ্ব্যবহার করা যায়।

(১৩) উত্তম বন্ধু নির্বাচন করা : এই বরকতময় মাসের যথাযথভাবে সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে উপযুক্ত সঙ্গীর নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাদের সাথে থাকলে পাপ থেকে বাঁচা যায় এবং ছওয়াবের কাজে অগ্রগামী হওয়া যায়। যেমন বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا ‘আর তুমি নিজেকে ধরে রাখো তাদের সাথে যারা তাদের প্রতিপালককে সকালে ও সন্ধ্যায় আহবান করে তাঁর চেহারা কামনায় এবং তুমি তাদের থেকে তোমার দু’চোখ ফিরিয়ে নিয়ো না পার্থিব জীবনের জৌলুশ কামনায়। আর তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য করোনা যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে’ (কাহফ ১৮/২৮)

(১৪) ধারাবাহিকতা বজায় রাখুন : যেসব ভাল কাজের অভ্যাস গড়ে উঠেছে, রামাযান শেষে সেগুলিকে অব্যাহত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিপূর্ণভাবে অবিচল থেকে ইবাদতের প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশের একটি বড় নিদর্শন হ’ল এই ধারাবাহিকতা। নিজের প্রতি কঠোর হ’তে হবে এবং সেই সকল বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে, যা ইবাদতের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

উপসংহার : রামাযান মাসে মোট ৭২০ ঘণ্টা থাকে। প্রত্যেক মুসলিম এই মূল্যবান সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে অফুরন্ত বরকত অর্জন করতে পারে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে উপরিউক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে সফলতা এবং গ্রহণযোগ্যতা দান করেন। আসুন ভেবে দেখি! হয়তো এই রামাযানই আমাদের জীবনের শেষ রামাযান হ’তে যাচ্ছে। বিদায়ী ছিয়াম ও ছালাত এর পূর্বে ইখলাছের সাথে কঠোর পরিশ্রমের নিয়ত করি, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন আমীন!

মুহাম্মাদ আব্দুন নূর

[কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]


[1]. আবু দাঊদ হা/২৫৪০; দারেমী হা/৭১২, মিশকাত হা/৬৭২।

[2]. আবু দাঊদ হা/৫২১; তিরমিযী হা/২১৩, ৩৫৯৪; মিশকাত হা/৬৭১।

[3]. মুসলিম হা/৪৮২; নাসাঈ হা/১১৩৭; মিশকাত হা/৮৯৪।

[4]. তিরমিযী হা/৫৯৩; মুসনাদু আবী ইয়ালা হা/১৭; মিশকাত হা/৯৩১।

[5]. তিরমিযী হা/৩৪৯৯; মিশকাত হা/৯৬৮।

[6]. তিরমিযী হা/৪৭৮, হাদীছ ছহীহ।

[7]. বুখারী হা/১১৪৫; মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২২৩।

[8]. বুখারী হা/৯৩৫; মুসলিম হা/৮৫২।

[9]. নাসাঈ হা/১২৮৪; আবুদাঊদ হা/১৩৩১; মিশকাত হা/৭০৯।

[10]. মুসলিম হা/১৫৬০; মিশকাত হা/৬৯৬।

[11]. বুখারী হা/৬৬০; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।

[12]. মুসলিম হা/২৫১; তিরমিযী হা/৫১; ইবনু মাজাহ হা/৪২৮।

[13]. তিরমিযী হা/২৪১; মিশকাত হা/১১৪৪।

[14]. মির‘আত ৪/১০২ পৃ.।

[15]. বুখারী হা/৬১৫; মুসলিম হা/৪৩৭; মিশকাত হা/৬২৮।

[16]. নাসাঈ হা/৪৬৫; তিরমিযী হা/৪১৩ মিশকাত হা/১৩৩০।

[17]. তিরমিযী হা/৪১৫; মুসলিম হা/৭২৮; মিশকাত হা/১১৫৯।

[18]. আবুদাঊদ হা/১৩৭৫; নাসাঈ হা/১৩৬৪; মিশকাত হা/১২৯৮। 

[19]. তিরমিযী হা/৮০৬; আবুদাঊদ হা/১৩৭৫; মিশকাত হা/১২৯৮।

[20]. মুসলিম হা/৭৮৩; মিশকাত হা/১২৪২, রাবী আয়েশা (রাঃ)।

[21]. বুখারী হা/১৯০২; মুসলিম হা/২৩০৮; মিশকাত হা/২০৯৮।

[22]. তিরমিযী হা/১৯০৭; আবুদাঊদ হা/১৬৯৪; মিশকাত হা/৪৯৩০।

[23]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৪৪৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৫০৭।

[24]. ইবনু মাজাহ হা/২০৮৯; মিশকাত হা/৪৯২৮; ছহীহাহ হা/৯১৪।

[25]. মুসলিম হা/২৫৫১; মিশকাত হা/৪৯১২।

[26]. বুখারী হা/১৮৬৩; ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘মহিলাদের হজ্জ’ অনুচ্ছেদ।

[27]. বুখারী হা/১৭৮২; মুসলিম হা/১২৫৬; মিশকাত হা/২৫০৯।

[28]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৪৬; তিরমিযী হা/৮০৭; বায়হাক্বী শু‘আব হা/৩৯৫৩; মিশকাত হা/১৯৯২।

[29]. বুখারী হা/৬২৪৩; মুসলিম হা/২৬৫৭; মিশকাত হা/৮৬।



আরও