জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ
আশরাফুল ইসলাম
হাফেয আব্দুল্লাহ আল-মারূফ 1126 বার পঠিত
রামাযান মাস বছরের সবশ্রেষ্ঠ মাস। এটি রহমত, বরকত, ক্ষমা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। যখন একটি মাস মর্যাদাপূর্ণ হয়, তখন তার ছওয়াব বহু গুণ বেড়ে যায়। রামাযানের একটানা সাধনা অন্য মাসের তুলনায় আল্লাহর কাছে বেশি ছওয়াব পাওয়ার কারণ। তাই সকলের উচিত এই পবিত্র মাসটিতে পরিপূর্ণভাবে সৎকর্মে নিয়োজিত থাকা এবং ছোটবড় যাবতীয় পাপ থেকে বিরত থাকা। যাতে আল্লাহ প্রদত্ত আত্মিক প্রশান্তি লাভ হয় এবং পরকালীন চিরস্থায়ী শান্তির পথ সুগম হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে রামাযান মাসে ইবাদতে মনোযোগ সৃষ্টিতে মনীষীদের কিছু উক্তি তুলে ধরা হ’ল যা আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিবে ইনশাআল্লাহ।
(১) ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, ‘রামাযান মাসের মত অন্য কোন ফযীলতপূর্ণ মাস নেই। আল্লাহ তা‘আলা কোন যুগেই এই উম্মত ছাড়া অন্য কোন উম্মতকে এর মতো সম্মানিত করেননি। এমাসে পাপ মোচন হয় ও যাবতীয় চেষ্টা কবুল হয়। ফলে মুমিন আনন্দিত হয়। আর শয়তান দূরীভূত ও পরাজিত হয়। এই মাস আপনার দরজায় এসে উপস্থিত হয়েছে, তবে কিছু সময় পর এটি আপনাদের ছেড়ে চলে যাবে। অতঃপর একদিন আপনাদের পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে’।[1]
(২) হাফেয ইবনু রজব বলেন, ‘রামাযান মাসে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উম্মতের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেন। এই মাসে শয়তানদের এবং জ্বিনদের শাসকগণকে বন্দি করে দেন, যাতে তারা সেই সব প্ররোচনা ও গুনাহের কাজগুলো করতে না পারে, যা তারা অন্য মাসে করতে সক্ষম ছিল। এর ফলে রামাযান মাসে উম্মতের মধ্যে গুনাহের পরিমাণ কমে যায়’।[2]
(৩) আব্দুল আযীয আত-তারীফী বলেন, ‘সাহারী খেজুর দ্বারা হওয়া উচিত। অথবা খেজুরসহ থাকা উচিত। এটি সুন্নত। যা অনেকেই ভুলে যান। তারা মনে করেন যে, খেজুর কেবল ইফতারের জন্যই সুন্নাত’।[3]
(৪) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন তুমি ছিয়াম রাখ, তোমার কান, চোখ এবং জিহবা যেন মিথ্যা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকে। আর তোমার সেবকের প্রতি কোনো প্রকার কষ্ট দিয়ো না। আর তোমার ছিয়াম রাখার দিন এবং ছিয়াম ব্যতীত দিন যেন একরকম না হয়’।[4]
(৫) প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মদ ইবনু ইব্রাহীম আলে শায়েখ বলেন, রামাযান মাসে ছিয়াম পালনকারীর উচিত তার ছিয়াম রাখার সময় শিষ্টাচার ও ভদ্রতার প্রতি খেয়াল রাখা। তার মুখ সর্বদা আল্লাহর স্মরণ ও কুরআনের তেলাওয়াত দ্বারা পরিপূর্ণ থাকা উচিত। তাকে তার মুখ ও মনকে সকল ধরনের গীবত, মিথ্যা, পরচর্চা এবং সমস্ত প্রকার পাপ ও ব্যভিচার থেকে বাঁচাতে হবে, যা তার ছিয়াম নষ্ট করতে পারে’।[5]
(৬) ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে উদার। আর রামাযান মাসে তিনি আরও বেশি উদার হয়ে উঠতেন। এই মাসে তিনি অধিক পরিমাণে ছাদাক্বাহ, ইহসান, কুরআন তেলাওয়াত, ছালাত, যিকির এবং ই‘তিকাফে লিপ্ত থাকতেন’।[6]
(৭) মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-ওছায়মীন বলেন, ‘রামাযান মাস যা কুরআন তেলাওয়াতের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত সময়। এমন কিছু সালাফ ছিলেন যারা একটি বিশেষ খাতা সঙ্গে রাখতেন। যখনই তারা কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং কোন আয়াত তাদের হৃদয়কে গভীরভাবে প্রভাবিত করত, যা অনেক গভীর অর্থ বা দৃষ্টিকোণ ধারণ করত। তারা সেই আয়াতের ব্যাপারে খাতায় নোট লিখে রাখতেন। ফলে রামাযান মাস শেষ হওয়ার পূর্বে তারা কুরআনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থ লাভ করতেন’।[7]
(৮) মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-ওছায়মীন বলেন, ‘তারাবীহ হ’ল রামাযান মাসের ক্বিয়াম, সুতরাং এতে অবহেলা করা উচিত নয়। আর একে তাড়াতাড়ি পড়া উচিত নয়। যেমন কিছু ইমামগণ করে থাকেন। যারা মুছল্লীদের বিশ্রাম নিতে দেয় না। তাদেরকে যথাযথভাবে দো‘আ এবং তাসবীহ করার সুযোগ দেয় না। সুতরাং ইমামদের উচিত তারাবীহের ছালাত দীর্ঘ করা, দাঁড়িয়ে থাকা, রুকূ, সিজদা, রুকূর পর দাঁড়ানো এবং দুই সিজদার মাঝখানে বসার সময়ও দীর্ঘ করা, যাতে মানুষ যথাযথভাবে দো‘আ ও তাসবীহ করতে পারে’।[8]
(৯) ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ) বিভিন্ন অঞ্চলে চিঠি লিখে নির্দেশ দেন যে, ‘রামাযানের সমাপ্তি যেন ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) ও ছাদাক্বাতুল ফিতর দ্বারা করা হয়। কেননা ফিৎরা ছিয়াম পালনকারীর জন্য অতিরিক্ত কথা ও অশালীনতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম। আর ইস্তিগফার সেই ক্ষতিপূরণ করে যা ছিয়ামের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক কথা ও অশালীন আচরণের কারণে বিদীর্ণ হয়েছে’।[9]
(১০) প্রখ্যাত আলেম শায়েখ ছালেহ আল-ফাওযান বলেন, ‘মানুষের উচিত তার সকল আমল ও ইবাদতের পর, বিশেষ করে রামাযান মাসের সমাপ্তিতে, বেশি করে ইস্তিগফার করা। যে মুসলিমকে আল্লাহ তাওফীক দিয়েছেন ছিয়াম রাখার এবং ক্বিয়ামুল লাইল করার, তার কর্তব্য হ’ল এ সকল আমলের পর অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করা এবং বিনীতভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার দরবারে আত্মসমর্পণ করা। সে যেন কখনো এই ধারণা না করে যে, তার আমল নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কারণ সে জানে না তার আমলে হয়তো অনেক ত্রুটি ও ঘাটতি রয়ে গেছে। তাই তার উচিত অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করা এবং নিজের আমলকে আল্লাহর হক অনুযায়ী খুবই নগণ্য মনে করা’।[10]
(১১) শায়েখ ছালেহ আল-ফাওযান বলেছেন, ‘রামাযান হোক বা অন্য যে কোনো সময়, আল্লাহর কাছে আমল কবুল হওয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হ’ল একটি সৎকর্মের পর আরেকটি সৎকর্ম করা। যদি কোনো মুসলিম রামাযানের পরও ভালো অবস্থানে থাকে, নেক আমল ও সৎকাজ বৃদ্ধি করে, তবে এটি তার আমল কবুল হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ। অপরদিকে যদি কেউ এর বিপরীত আচরণ করে নেক আমলের পর পাপ কাজ করে, রামাযান শেষ হলে গুনাহ ও গাফিলতিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিমুখ হয়ে যায়, তবে এটি তার আমল প্রত্যাখ্যাত হওয়ার লক্ষণ’।[11]
(১২) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন, ‘মুসলমানদের জন্য অবশ্যক হ’ল শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে ঈদের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর তাকবীর পাঠ করা। কারণ, আল্লাহ বলেন,وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ ‘আর যাতে তোমরা তোমাদের সুপথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করতে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। অতএব, তাকবীর এমন একটি প্রতীক হওয়া উচিত, যা মসজিদ, ঘরবাড়ি ও বাজারসমূহে প্রতিধ্বনিত হবে।[12]
(১৩) মুহাম্মদ বিন ছালেহ আল-ওছায়মীন বলেন, ‘প্রিয় ভাইয়েরা! রামাযান মাসের সমাপ্তি হওয়ার পূর্বে আল্লাহর নিকট তওবা করুন। তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বিরত থাকুন এবং এমন কাজ করুন যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবে। প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী, তবে ভুলকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন তারা যারা তওবা করেন’।[13]
(১৪) মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘প্রথম দশ দিনের তুলনায় মধ্যবর্তী দশ দিন উত্তম। মধ্যবর্তী দশ দিনের তুলনায় শেষ দশ দিন উত্তম। এই বিষয়টি প্রায়শই সঠিকভাবে প্রমাণিত হয় যে, সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হ’ল তার শেষ সময়। যা প্রথম সময়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যেমন শুক্রবারের বিকেল তার প্রথম অংশের তুলনায় উত্তম। আরাফার দিন বিকেল তার প্রথম অংশের তুলনায় উত্তম। এর রহস্য আল্লাহ্ জানেন। তবে মানুষের মন যখন কাজ শুরু করে, তখন তা ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ে। ফলে তারা শেষ সময়ের বরকত পেতে আগ্রহী হয় এবং সে সময়ে ভালো কাজ করার জন্য আবার উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে’।[14]
(১৫) ইবনু আশূর বলেন, সূরা বাক্বারাহ ১৮৬ আয়াতوَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ‘আর যখন আমার বান্দারা তোমাকে আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে, (তখন তাদের বল যে) আমি নিকটেই আছি’-এই আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ছিয়াম পালনকারী ব্যক্তির দো‘আ কবুল হওয়ার আশা থাকে। আর রামাযান মাসে দো‘আর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। পাশাপাশি রামাযান মাসের প্রতিটি দিন শেষে দো‘আ করা বৈধ’।[15]
(১৬) বিন বায (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘ক্বদরের রাত্রি হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম’ (ক্বদর ৯৭/৩)। এর অর্থ হ’ল, এই রাতে করা ইবাদত ও চেষ্টা হাযার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। এটি একটি মহান ফযীলত। হাযার মাস মানে প্রায় ৮০ বছর ৪ মাসের সমান, যা একটি পূর্ণ জীবনকাল। যে ব্যক্তি এই রাতের মূল্য বুঝতে পারবে, সে এক মহা কল্যাণের ভাগ্যবান হবে। একজন মুমিনের উচিত, এই দশ দিন ও রাতগুলিতে ইবাদতে মনোনিবেশ করা, ভাল কাজের জন্য পরিশ্রম করা এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য ও তাওফীক কামনা করা’।[16]
(১৭) মুহাম্মদ বিন ছালেহ আল-ওছায়মীন বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ) রামাযানের শেষ দশকে ইবাদতের জন্য নিজেদের একান্তভাবে নিবেদিত করতেন। আর রাতের পুরোটা সময় আল্লাহর আনুগত্যে কাটাতেন। এটি ছিল তার আত্মত্যাগ। কিন্তু এই আত্মত্যাগ আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ছিল। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তাঁর বান্দাদের উপর অনুগ্রহ করেন। অতএব যখন তিনি আপনাকে কাজ করতে সক্ষম করেন, তখন প্রথমে সেই কাজ করার জন্য অনুগ্রহ প্রদান করেন। তারপর সেই কাজ গ্রহণ করার জন্য দ্বিতীয়বার অনুগ্রহ দান করেন’।[17]
হাফেয আব্দুল্লাহ আল-মারূফ
[কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]
[1]. বুসতানুল অয়িযীন ওয়া রিয়াযুস সামেঈন ১/২১৫ পৃ.।
[2]. লাতায়েফুল মা‘আরেফ ১/১৮১ পৃ.।
[3]. তীবী শরহ মিশকাত ৪/১৫৭ পৃ.।
[4]. ইবনু আবী শায়বা, কিতাবুছ ছিয়াম ২/৪২২ পৃ.।
[5]. ফাতাওয়া ও রিসালাস ১৩/১৭৯ পৃ.।
[6]. জাদুল মা‘আদ ২/৩২ পৃ.।
[7]. আল-কাফিয়াতুশ শাফিয়াহ, শরহ ইবনু ওছায়মীন ১/৫০৩-৫০৪ পৃ.।
[8]. আল-লিক্বায়াতুর রামাযানিইয়াহ ৬৫২ পৃ.।
[9]. আল-লাতায়েফুল মা‘আরেফ ২১৪ পৃ.।
[10]. মাজালিসু শাহরে রামাযান ১১৮ পৃ.।
[11]. মাজালিসু শাহরে রামাযান ১১৯ পৃ.।
[12]. তাফসীর আত-তাবারী ৩/২২২ পৃ.।
[13]. মাজালিসু শারহে রামাযান ১/১৬৩ পৃ.।
[14]. আল-লেক্বাউশ শাহরিইয়াহ ৭১/৪ পৃ.।
[15]. তাফসীর ইবনু আশুর ২/১৭৯ পৃ.।
[16]. শরহ কিতাবুছ ছিয়াম মিন উমদাতিল আহকাম ২৭ পৃ.।
[17]. শরহ রিয়াযুছ ছালেহীন ৫/৭৭২ পৃ.।