চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়াম

ডা. মুহাম্মাদ সাইফুর রহমান 860 বার পঠিত

রামাযানের এক মাস ছিয়াম পালন মুসলমানের উপর ফরয। ছিয়াম পালনের মাধ্যমে দৈহিক, আত্মিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপকারিতা লাভ করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন- أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ- ‘‘গণিত কয়েকটা দিন মাত্র। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি পীড়িত হয় অথবা সফরে থাকে, সে যেন এটি অন্য সময় পালন করে। আর যাদের জন্য এটি খুব কষ্টকর হয়, তারা যেন প্রতিদিনের পরিবর্তে একজন করে মিসকীনকে খাদ্য দান করে। যদি কেউ স্বেচ্ছায় বেশী দেয়, সেটা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর যদি তোমরা ছিয়াম রাখ, তবে সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ’ (বাক্বারাহ ২/১৮৪)

সর্বক্ষণ আহার, সীমাতিরিক্ত ভোজন ও দূষিত খাদ্য খাওয়ায় শরীরে এক প্রকার বিষাক্ত উপকরণ ও উপাদানের সৃষ্টি হয় এবং জৈব বিষ জমা হয়। যার কারণে দেহের নির্বাহী ও কর্ম-সম্পাদনাকারী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিষাক্ত উপকরণ ও জৈব বিষ দমনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ফলে তখন জটিল ও কঠিন রোগের জন্ম হয়। দেহের মধ্যকার এমন বিষাক্ত ও দূষিত উপাদানগুলো অতি দ্রুত নির্মূলকরণের নিমিত্তে পাকস্থলীকে মাঝে মধ্যে খালি করা একান্ত প্রয়োজন। ছিয়াম এর একমাত্র সহায়ক, যার বিকল্প ভাবা যায় না। এ প্রসঙ্গে ডা. ডেভিড জকার্স বলেন- ‘রামাযানের (ছিয়াম পালনের) অভ্যাস হ’তে পারে সর্বোত্তম পন্থা। এটি স্বাস্থ্যের কোন ঝুঁকি ছাড়াই স্বাস্থ্য সুবিধাগুলো ভোগ করার সবচেয়ে নিরাপদ উপায়’।[1] আর এজন্য বলা হয় ছিয়াম সুস্বাস্থ্যের জন্যে একটি শক্তিশালী অস্ত্র। বুদ্ধিমত্তার সাথে এর প্রয়োগ হলে এ থেকে বিস্ময়কর ফল পাওয়া যেতে পারে।[2] আলোচ্য নিবন্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়ামের উপকারী দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হ’ল।

মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র : পন্ডিতগণ বলেছেন, Empty stomach is the power house of knowlege. ‘ক্ষুধার্ত উদর জ্ঞানের আঁধার’। ছিয়াম সাধনায় মানুষের মানসিক ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। মনোসংযোগ ও যুক্তি প্রমাণে স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়। আর স্নায়ুবিক প্রখরতার জন্য ভালোবাসা, আদর-স্নেহ, সহানুভূতি, অতিন্দ্রীয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। এ ব্যাপারে ডাঃ আলেক্স হেইগ বলেন, ‘ছিয়াম হ’তে পারে মানুষের মানসিক শক্তি ও বিশেষ বিশেষ-অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি বর্ধিত হয়’।[3]

হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস : গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত ছিয়াম রাখলে হৃদরোগের ঝুঁকি ৫৮% কমে যায়। ছিয়াম রাখলে শরীরের ক্ষতিকর LDL (Low Density Lipoprotin) বা খারাপ কোলেস্টেরল কমে যায় এবং সুগারের মেটাবলিজম হয়। ফলে HDL (High Density Lipoproden) উপকারী কোলেস্টেরল ৩০-৪০% বৃদ্ধি পায়। আর TG কোলেস্টেরল, শরীরের ওজন, বি.এম. আই. কমে যায়। এক কথায় ছিয়াম হচ্ছে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর ঔষুধ বিহীন অন্যতম একটি উপায়’।[4]

হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য Intermittent Fasting বা মাঝে মধ্যে উপবাস নিয়ে পাশ্চাত্যে যে আলোড়ন হচ্ছে এ ব্যাপারে অনেক আগেই রাসূল (ছাঃ) আমাদের উৎসাহিত করেছেন। রাসূল (ছাঃ) রামাযান মাসের বাইরে নিয়মিত ছিয়াম রাখতেন। যেমন প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবারে ছিয়াম, প্রতি মাসে ৩টি করে আইয়ামে বীযের ছিয়াম, শাওয়াল মাসে ৬টি ছিয়াম, মুুহাররম মাসের দু’টি ছিয়াম, আরাফার দিনে ছিয়াম ইত্যাদি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন দেশে গবেষণা হচ্ছে। Intermittent Fasting বা মাঝে মধ্যে ছিয়াম রাখলে সারাবছর ছিয়াম রাখার সুফল পাওয়া সম্ভত। বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক ডাক্তার চিকিৎসার অংশ হিসাবে রোগীদের সপ্তাহে দু-তিন দিন ফাস্টিংয়ের উপদেশ দিচ্ছেন। আলহামদুলিল্লাহ![5]

শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ দূরীকরণ : ড. লুটজানারের মতে, খাবারের উপাদান থেকে সারা বছর ধরে মানুষের শরীরে জমে থাকা কতিপয় বিষাক্ত পদার্থ (Toxin) চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র সহজ ও স্বাভাবিক উপায় হচ্ছে উপবাস। উপবাসের ফলে শরীরের অভ্যন্তরে দহনের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে শরীরে জন্মে থাকা বিষাক্ত পদার্থসমূহ দগ্ধীভূত হয়ে যায়। আর আরবী ‘রামাযান’ শব্দটি ‘রময’ ধাতু থেকে উৎপত্তি। যার অর্থ দহন করা, জ্বালিয়ে দেয়া, পুড়িয়ে ফেলা। এভাবে ধ্বংস না হলে ঐসব বিষাক্ত পদার্থ শরীরে রক্তচাপ, একজিমা, অন্ত্র ও পেটের পীড়া ইত্যাদি বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির জন্ম দেয়।

ইউরোপের ঘরে ঘরে ইদানিং উপবাসের হিড়িক পড়ে গেছে। সবার মুখে এই চেতনা সৃষ্টির পিছনে সত্তর দশকে প্রকাশিত একটি বইয়ের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বইটি হচ্ছে প্রখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদ ড. হেলমুট লুটজানার এর The Secret of Sucessul Fasting অর্থাৎ ‘উপবাসের গোপন রহস্য’। বইটিতে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রনালী বিশ্লেষণ করে নিরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম স্বাস্থ্যের অধিকারী হ’তে হলে বছরের কতিপয় দিন উপবাসের পরামর্শ দেয়া হয়েছে’।[6]

পেপটিক আলসার থেকে মুক্তি : পাকস্থলি এবং ক্ষুদ্রান্তের প্রথম অংশ Doudenum-এর মিউকাসাতে ‘ঘা’ কে ‘পেপটিক আলসার’ বলে। অনিয়মিত খাবার, অত্যাধিক চা পান, ধুমপান, দুঃশ্চিন্তা, ক্ষতিকর ওষুধ সেবন। বিশেষ করে এসপিরিন জাতীয় ওষুধ সেবন পেপটিক আলসারের অন্যতম কারণ। নিয়মিত ছিয়াম পালন করলে পেপটিক আলসার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নিয়মিত পেট খালি রাখলে এবং নিয়মিত আহার করলে পেটে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যাতে আলসার বা ক্ষত শুকাতে সহায়ক হয়।

ডাঃ ক্লীভ তার Peptic Ulcer নামক গবেষণামূলক পুস্তকে লিখেছেন, বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এ রোগ অনেক কম। অথচ দক্ষিণ ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ নাইজেরিয়ায় এ রোগ অত্যন্ত বেশী। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় মুসলমান ও মালয়েশিয়ার মালয়ী মুসলমানদের তুলনায় ঐসব দেশের চীনাদের মধ্যে এ রোগ বেশ কয়েকগুণ বেশী। তাই ডাঃ ক্লীভ জোর দিয়ে বলেন, Fasting does not produce Organic disease. ‘ছিয়াম কোন রোগ সৃষ্টি করেনা’।[7]

১৯৫৮-১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ডা. মুহাম্মাদ গোলাম মুয়াযযাম সহ কয়েকজন ডাক্তার ঢাকা ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ছিয়ামের বিভিন্ন দিক নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেন। এ গবেষণায় দেখা যায় যে, শতকরা প্রায় ৮০ জন ছিয়াম পালনকারীর বেলায় Gastric Acid স্বাভাবিক পাওয়া গেছে। শতকরা প্রায় ৩৬ জনের অস্বাভাবিক এসিডিটি স্বাভাবিক হয়েছে। প্রায় শতকরা ১২ জন ছিয়াম পালনকারীর এসিড একটু বেড়েছে। তবে কারো ক্ষতিকর পর্যায়ে যায়নি। সুতরাং ছিয়াম পালন করলে পেপটিক আলসার হ’তে পারে এমন ধারণা ভুল ও মিথ্যা’।[8]

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি : ছিয়াম একই সাথে দেহে রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে। ছিয়াম পালনের ফলে দেহে রোগ জীবাণুবর্ধক জীর্ণ অন্ত্রগুলো ধ্বংস হয় ও ইউরিক এসিড বাধাপ্রাপ্ত হয়। দেহে ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন প্রকার নার্ভ সংক্রান্ত রোগ বেড়ে যায়। পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদগণ এক বাক্যে স্বীকার করেছেন- The power and endurance of the body under fasting Conditions are remarkable: After fast Fast properly taken the body is literally born afresh. ছিয়াম পালনে শরীরের শক্তি ও সহনশীলতা সত্যিই বিস্ময়কর: সঠিকভাবে ছিয়াম পালনের পর শরীর যেন নতুন প্রাণ ফিরে পায়’।[9]

ডা. জুয়েলস এমভি বলেছেন, ‘যখনই একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখনই দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে’।

ডা. এ. এম গ্রিমী বলেন, ছিয়ামের প্রভাব মানব স্বাস্থ্যের উপর অটুটভাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে এবং রোজার মাধ্যমে শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আধুনিক যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানে ছিয়ামের ব্যবহারিক তাৎপর্য উপলব্ধি করেই জার্মান, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের ব্যবস্থাপত্রে উপবাস থাকার কথা বলা হয়’।[10]

লিভার ও কিডনী সুরক্ষা : লিভার ও কিডনী মানুষের শরীরের অন্যতম দু’টি ইঞ্জিন। লিভার তথা যকৃত মানব দেহের এক বৃহত্তম গ্রন্থি। পুরো একমাস ছিয়াম রাখার ফলে লিভার, প্লীহা কিডনী ও মূত্রথলির উপকার সাধিত হয়। বড় লিভার স্বাভাবিকভাবে কমে ছোট হয়ে যায় এবং লিভারে বাড়তি মেদ বা চর্বি জমতে পারে না’।[11]

অনুরূপ কিডনীও শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নাম। কিডনীকে জীবনও বলা হয়। কিডনী (Kidney) দেহে ছাকনী হিসাবে কাজ করে। থাকে রেচনতন্ত্র বলা হয়। প্রতি মিনিটে কিডনী ১ হ’তে ৩ লিটার রক্ত সঞ্চালন করে। রক্তের অপদ্রব্য পৃথকীকরণের মাধ্যমে মূত্রথলিতে প্রেরণ করে। ছিয়াম অবস্থায় কিডনী বিশ্রামে থাকে। কিন্তু তার রেচনক্রিয়া অব্যাহত রেখে পেশাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত বর্জ্য পদার্থ ত্যাগ করে। যার জন্য মানুষ সুস্থ থাকে এবং রক্ত পরিষ্কার ও বর্ধিত হয়’।[12]

রক্তের উপর ছিয়ামের কল্যাণকর প্রভাব : দিনের বেলায় ছিয়াম রাখার কারণে রক্তের পরিমাণ কমে যায়। এ রক্ত স্বল্পতা হৃদপিন্ডকে খুবই কল্যাণকর বিশ্রাম দেয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, ইন্টারসেলুলার বা কোষের আন্তঃসংযোগ কমে যাওয়ার কারণে টিসুর উপর চাপ কমে যায়। টিসুর উপর চাপ অথবা ডায়াসটোলিকের চাপ হৃদপিন্ডের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছিয়ামের মাধ্যমে ডায়াসটোলিকের ওপর প্রেসার সব সময়েই কম থাকে। সে সময় হৃদপিন্ড থাকে বিশ্রামে। বর্তমানে বস্ত্তবাদী আদর্শে জীবন-যাপনের কারণে মানুষ হাইপার টেনশনে ভুগতে থাকে। রামাযানের এক মাসের ছিয়াম ডায়াসটোলিকের ওপর প্রেসার কমিয়ে দেয়ার কারণে মানুষ অবর্ণনীয় উপকার লাভে সক্ষম হয়’।[13]

সেল বা কোষের ওপর ছিয়ামের প্রভাব : ছিয়ামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে সেল সমূহের ভারসাম্য সৃষ্টির উপর। ছিয়ামের মাধ্যমে দেহের সেল বা কোষ বিশ্রাম লাভ করে। লালাযুক্ত ঝিল্লিকে বলা ‘ইপিথেলিয়াম’ সেল। এ সেল বা কোষ দেহের বর্জ্য নিষ্কাশনের দায়িত্ব পালন করে। ছিয়ামের মাধ্যমে এসব কোষ বিশ্রাম পাওয়ার কারণে তাদের পুষ্টি নিশ্চিত হয়। দেহের এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সারা বছর রামাযানের মাসের প্রতীক্ষায় থাকে। কারণ ছিয়ামের মাধ্যমে তাদের বিশ্রামের সুযোগ ঘটে। অধিকতর সক্রিয় হওয়ার কারণে নিজের মধ্যে তারা সজীবতা লাভে সক্ষম হয়’।[14]

পাকস্থলী ও অন্ত্র : ডাঃ সলোমান তার গার্হস্থ্য স্বাস্থ্য বিধিতে মানব দেহকে ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করে বলেন, ‘ইঞ্জিন রক্ষা কল্পে মাঝে মাঝে ডকে নিয়ে চুল্লি হ’তে ছাই ও অঙ্গার সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাশিত করা যেমন আবশ্যক। উপবাস দ্বারা মাঝে মাঝে পাকস্থলী হ’তে অজীর্ণ খাদ্য নিষ্কাশিত করাও তেমনি আবশ্যক। যকৃত ও পাকস্থলীর অবস্থান পাশাপাশি। কখনো বিভিন্ন খারাপ খাদ্যের প্রভাব যকৃতের উপর পড়ে। পাকস্থলী স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারাইজড মেশিন। যার ভিতরে অনায়েসে বিভিন্ন প্রকার খাবার হজম হয়। পাকস্থলীসহ অন্যান্য অঙ্গ সক্রিয়ভাবে ২৪ ঘন্টা কর্তব্যরত থাকা ছাড়াও স্নায়ুচাপ ও খারাপ খাদ্যের প্রভাবে এতে এক প্রকার ক্ষয় সৃষ্টি হয়। আবার অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের ফলে পাকস্থলীর আয়তন বৃদ্ধি পায়। আর এই আয়তন বর্ধিত হওয়াতে মানুষের শরীরের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। কিন্তু দীর্ঘ একমাস ছিয়াম সাধনা পাকস্থলীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। শরীরের অন্যান্য পেশির মত পাকস্থলীকে খাদ্যমুক্ত বা বিশ্রামে রাখা প্রয়োজন। এতে করে ক্ষয়পূরণ ও পুনর্গঠন কাজে সাহায্য করে’।[15]

পাকস্থলির এসিড হ্রাস : কেউ কেউ মনে করেন যে, ছিয়াম রাখলে পাকস্থলির এসিড (Gastric Hcl) বৃদ্ধি পায়। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। বাংলাদেশের কয়েকজন উচ্চপদস্থ গবেষক ডাক্তার ১৯৫৯ সালের রামাযান মাসে ৭জন ছিয়াম পালনকারী ও ৫জন ছিয়াম পালনকারী নন এমন ব্যক্তির পাকস্থলির এসিড পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, ছিয়াম অবস্থায় পাকস্থলির এসিড সবচেয়ে কম থাকে’।[16]

অটোফেজি ও ছিয়াম : অটোফেজি (Autophagy) শব্দটি গ্রীক Auto phagein থেকে এসেছে। এর প্রথম অংশ ‘অটো’ অর্থ ‘স্বয়ং’ এবং ‘ফেজি’ অর্থ ‘খাওয়া বা ভোজন’। সুতরাং অটোফেজি বলতে স্বভোজন বা নিজেকে খাওয়া বোঝায়। শুনতে সাংঘাতিক মনে হলেও এটা আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। অটোফেজি একটি জটিল ক্যাটাবলিক বা ভাঙ্গন প্রক্রিয়া। ছিয়ামের মাধ্যমে যা পূর্ণ সক্রিয় হয়ে ওঠে’।[17]

ছিয়াম নিয়ে বিস্ময়কর তথ্য দিয়ে নোবেল পেয়েছেন জাপানী গবেষক ও বিজ্ঞানী ওশিনরি ওহসুমি। তিনি ‘অটোফেজি’ নিয়ে গবেষণা করেন এবং ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার জয় করেন। তিনি প্রতি বছর ছিয়াম রাখেন। মুসলমান না হয়েও তিনি কেন ছিয়াম রাখেন এ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে ছিয়াম সম্পর্কে এক বিস্ময়কর তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মুসলমানরা যাকে ছিয়াম বলে, আমি তাকে বলি ‘অটোফেজি’। আমাদের ঘরে যেমন আবর্জনার স্থান বা ডাস্টবিন থাকে। কিংবা আমাদের কম্পিউটারে যেমন ‘রিসাইকেল বিন’ থাকে, তেমনি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন আছে। সারা বছর শরীরের কোষগুলো খুব ব্যস্ত থাকার কারণে ডাস্টবিন পরিষ্কার করার সময় পায় না।

ফলে কোষগুলোতে অনেক আবর্জনা ও ময়লা জমে যায়। কোষগুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে, তাহ’লে কোষগুলো এক সময় নিস্ক্রিয় হয়ে শরীরের বিভিন্ন প্রকার রোগ সৃষ্টি করে। ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মতো অনেক বড় বড় রোগের শুরু হয় মূলত এখান থেকেই। মানুষ যখন খালি পেটে থাকে, তখন শরীরের কোষগুলো অনেকটা বেকার হয় পড়ে, তখন প্রতিটি কোষ তার ভিতরের আবর্জনা ও ময়লাগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে। কোষগুলোর আমাদের মত আবর্জনা ফেলার জায়গা নেই বলে তারা নিজেদের আবর্জনা নিজেরাই খেয়ে ফেলে। চিকিৎসা বিদ্যার ভাষায় এই পদ্ধতিকে বলা হয় অটোফেজি’।[18]

২০১৬ সালে অটোফেজি আবিষ্কারের পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের বা ধর্ম না মানা অনেক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ সারা বছর বিভিন্ন সময়ে ‘অটোফেজি’ করে শরীরকে সুস্থ রাখে। লক্ষণীয় যে, অমুসলিমরা অটোফেজি করছে এর অভাবনীয় উপকারিতা জেনে। আর মুসলিমরা অটোফেজি করে আসছে হাযার বছর ধরে কিছু না জেনে; শুধুমাত্র ইলাহী বিশ্বাস নিয়ে।

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন : অধিক ভক্ষণ, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ ইত্যাদি কারণে চর্বি জমে রক্তবাহী নালিকাগুলো সরু হয়ে যায়। ফলে ভেইন (শিরা) ও আর্টারীতে রক্তচাপ বেড়ে যায়; একে বলে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশান। চর্বি জমে সূক্ষ্ম আর্টারীগুলো আরো সরু হয়, ফলে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তা থেকে হার্ট, ব্রেইন, কিডনি ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সৃষ্টি হয় হার্টের করোনারী থ্রোম্বোসিস, মস্তিষ্কে সেরিব্রাল থ্রম্বসিস, কার্ডিয়াক এ্যাজমা, এমনকি হার্টফেইলুর। চোখের রক্তবাহী আর্টারী সরু হওয়ায় চোখের রেটিনার নানারূপ পরিবর্তন দেখা দেয়। মস্তিষ্কে থ্রম্বোসিস হয়ে একচোখের দৃষ্টি কমে যাওয়া, মুখমন্ডল বাঁকা হয়ে যাওয়া, দেহের অর্ধাংশ অবশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়। অত্যধিক রক্তচাপের কারণ হ’তে পারে C.V.A (কাডিও ভ্যাসকুলার অ্যাকসিডেন্ট), তাতে হ’তে পারে তাৎক্ষণিক মৃত্যু বা কয়েকদিন পর্যন্ত বেহুঁশ এর পর মৃত্যু।[19] ছায়েম ব্যক্তির ছিয়ামের আগুনে তার শরীরের চর্বি কমিয়ে আনতে পারে। নিয়মিত তেলাওয়াত ও ইবাদতের ফলে হাইপারটেনশান ও তা থেকে সৃষ্ট নানাবিধ জটিল উপসর্গ থেকে শরীরকে রক্ষা করতে পারে।

কোলেস্টরেল (cholesterol) হ্রাস : শরীরের শিরা ও ধমনীগুলোকে (Veins and Artemis) নদী-নালার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। নদী-নালার প্রবাহ যত বেশী থাকে, সেগুলি ততবেশী সতেজ থাকে। সেখানে পলি জমলে তা ভরাট হয়ে অচল হয়ে যায়। তেমনিভাবে দেহের মধ্যে কোলেস্টেরল জমলে শিরা-উপশিরাগুলি সরু হয়ে যায় এবং রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। ছিয়াম পালনে দেহের চর্বি ও কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায় ও তা স্বাভাবিক থাকে’।[20]

নেশা পরিহারের সুবর্ণ সুযোগ : আমরা জানি ধুমপানসহ সর্বপ্রকারের মাদকতা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যার শেষ পরিণাম মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। রামাযানুল মুবারকে বাধ্যতামূলকভাবে সারাদিন ধুমপান না করায় ফুসফুস দীর্ঘ সময় ধরে নিকোটিনের বিষক্রিয়া হ’তে মুক্ত থাকে। যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী হয়। তাছাড়া যারা ধুমপান ত্যাগ করতে চান, তাদের জন্য রামাযান একটি মোক্ষম সুযোগ এনে দেয়। ছিয়ামের এক মাসের প্রশিক্ষণ বাকী এগারটি মাসে কাজে লাগাতে পারলে চিরদিনের জন্য ধুমপান সহ সর্ব প্রকারের মাদকতা পরিহার করা সম্ভব’।[21]

ওজন হ্রাস : ছিয়াম পালন করলে শরীরের ভার আস্তে আস্তে কিছু কমে যায়। এভাবে শরীরের ভার কমে যাওয়া খুবই উপকারী। ছিয়াম পালনের মাধ্যমে শরীরে বাড়তি মেদ (চর্বি) জমতে বাঁধাপ্রাপ্ত হয় এবং ক্যালরির অভাবে মেদ ক্ষয় হ’তে থাকে। যার জন্য স্থুলাকার কমে যায় এবং স্বাস্থ্য স্বাভাবিক ও সুঠাম হয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শরীরের অতিরিক্ত ওজন হ্রাসের জন্য নানারূপ চিকিৎসা পদ্ধতি চালু রয়েছে। যার সবকয়টি কষ্টসাধ্য ও ব্যয় সাপেক্ষ। তাই শরীরের বাড়তি ওজন কমানোর জন্য ছিয়াম একপ্রকার থেরাপিউটিক ব্যবস্থা’।[22]

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্ময়কর তথ্য : অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র প্রফেসর মোরপান্ড বলেছেন, আমি ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি লেখাপড়া করার চেষ্টা করেছি। ছিয়াম অধ্যায়ে লেখাপড়া করার সময় আমি খুবই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছি। চিন্তা করেছি, ইসলাম তার অনুসারীদের জন্যে এক মহান ফর্মুলা দিয়েছে। ইসলাম যদি তার অনুসারীদের জন্য কোন বিধান না দিয়ে শুধু এ ছিয়ামই দিত, তবু এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হ’তে পারত না’।[23]

শেষ কথা পরিশেষে বলা যায় যে, ছিয়াম পালনের মাধ্যমে মানুষ যে স্বাস্থ্যগত উপকার লাভ করে তা অবর্ণনীয়। বর্তমানে অমুসলিম স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীগণও ছিয়ামের কল্যাণকারিতার জন্য অসুস্থ্য রোগীদেরকে প্রেসক্রাইব করছেন যা সত্যিই বিস্ময়কর। যেমন ডাঃ জুয়েলস, ডাঃ ডিউই, ডাঃ এলেক্স হিউ প্রমুখ প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেছেন যে, ছিয়াম শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এর ফলে দেহের জীবাণুবর্ধক অন্ত্রগুলি ধ্বংস হয়, ইউরিক এসিড বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। ছিয়াম চর্মরোগ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গ্যাষ্ট্রিক আলসার ইত্যাদির জন্য অত্যন্ত উপকারী বিবেচিত হয়েছে। মেদ ও কোলেষ্টেরল কমানোয় ছিয়ামের জুড়ি নেই। সর্বোপরি ছিয়াম মনে শান্তি আনে, কু-প্রবৃত্তি প্রশমিত করে, দীর্ঘ জীবন দান করে।[24] তাই ছিয়ামসহ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রতিটি বিধান সমগ্র মানবজাতির জন্য কল্যাণকর। মানুষ রামাযানের ছিয়ামের পরশ পাশাপাশি অন্যান্য নফল ছিয়ামগুলো পালন করলে এমনিতেই নানান রোগ থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।- আমীন!

ডা. মুহাম্মাদ সাইফুর রহমান

[সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, দিনাজপুর-পূর্ব সাংগঠনিক যেলা]


[1]. প্রফেসর ড. এ. কে. এম আজহারুল ইসলাম, রোজা-স্বাস্থ্য-অটোফেজি ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা (র‌্যাকস পাবলিকেশন্স, জানুয়ারী ২০২৩) পৃ. ৩।

[2]. হাসনাইন ইমতিয়াজ, সিয়াম সাধনা: চিকিৎসা শাস্ত্রের আলোকে (ঢাকা : ইফাবা, ২য় মুদ্রণ মার্চ/১৯৮৩), পৃঃ ১১-১২।

[3]. স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়ামের উপকারিতা, ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর, তাওহীদের ডাক, জুলাই-আগস্ট-২০১৩।

[4]. রোজা-স্বাস্থ্য-অটোফেজি ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা ১২৮ পৃ.

[5]. প্রাগুক্ত।

[6]. মোহাম্মাদ আবুল কালাম আজাদ ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজা’ দৈনিক ইনকিলাব, ‘সম্পাদকীয়’ ২৪শে মে ২০১৮।

[7]. ডা. এইচ. এম. এ. আর মামুনুর রশীদ, ‘স্বাস্থ্যশিক্ষা ও ইসলাম : রোযায় পেপটিক আলসার ভীতি ও ইসলামী দৃষ্টিতে সমাধান’ (ইফাবা : এপ্রিল-২০০৫) পৃ. ৭১।

[8]. মোহাম্মাদ আবুল কালাম আজাদ ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজা’ দৈনিক ইনকিলাব, ‘সম্পাদকীয়’ ২৪ শে মে ২০১৮।

[9]. অধ্যাপক সাইদুর রহমান, মাহে রমজানের শিক্ষা ও তাৎপর্য (ঢাকা : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংস্কৃতি কেন্দ্র, ১৯৮৫ ইং), পৃ. ১৭ ।

[10]. প্রাগুক্ত।

[11]. মুহাম্মাদ আবু তালেব, Science From AL Quran (র‌্যাকস পাবলিকেশন্স দ্বিতীয় প্রকাশ ২০১১) পৃ. ৯৫।

[12]. ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছির, ‘স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়াম সাধনা’ মাসিক আল ইখলাছ, মার্চ ২০২৪।

[13]. আব্দুস সালাম মিয়া হুমায়ুন, ‘পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে মুহাম্মাদ (ছা.)’ (ইসলাম হাউস পাবলিকেশন্স ৫ম সংস্করণ নভেম্বর ২০২১) পৃ. ২৭৪।

[14]. পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে মুহাম্মাদ (ছা.) ২৭৫ পৃ.।

[15]. স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়াম।

[16]. স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ইসলাম ৭০ পৃ.।

[17]. রোজা, স্বাস্থ্য ও অটোফেজি : ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা ১৬৭ পৃ.।

[18]. মোঃ জিল্লুর রহমান, ‘বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অটোফেজি ও রোযার উপকারিতা’, দৈনিক আমার বার্তা ঢাকা, ২৪ শে মার্চ ২০২৪।

[19]. মাসিক আত-তাহরীক, জানুয়ারী ১৯৯৮ পৃ. ১৯।

[20]. নববী চিকিৎসা পদ্ধতি; কামারুজজামান বিন আব্দুল বারী, মাসিক আত-তাহরীক, মে ২০২১।

[21]. মাসিক আত-তাহরীক, ডিসেম্বর ২০০০ পৃ. ২।

[22]. প্রাগুক্ত

[23]. পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে মুহাম্মাদ (ছাঃ) ২৭০ পৃ.।

[24]. ইসলামী বিধান ও আধুনিক বিজ্ঞান ৫০-৫১ পৃ.।



বিষয়সমূহ: ছিয়াম-রামাযান
আরও