একজন আদর্শবান ব্যক্তির গুণাবলী (৪র্থ কিস্তি)
এ. এইচ. এম. রায়হানুল ইসলাম
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিলের মাস হ’ল রামাযান। যার মধ্যে রয়েছে উম্মতে মুহাম্মাদীর হেদায়াত, বরকত ও অফুরন্ত নে’মত। রামাযানে জিব্রীল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কুরআন শুনাতেন এবং শুনতেন। আর এজন্য রামাযান আসলেই কুরআন চর্চার একটি অমীয় আবহ তৈরী হয়। এই কারণে সালাফে ছালেহীন দুনিয়ার যাবতীয় কাজ-কর্ম পরিত্যাগ করে কুরআনী জীবন গঠনে সচেষ্ট হতেন। রামাযানকে সাফল্যমন্ডিত করতে কুরআন চর্চায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতেন। এমনও অনেক সালাফ ছিলেন যারা এ মাসে হাদীছের পঠন ও পাঠদান বন্ধ রাখতেন। আলোচ্য প্রবন্ধে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হ’ল।
কুরআন তেলাওয়াতের ফযীলত : কুরআন তেলাওয়াতের মধ্যে রয়েছে অফুরন্ত বরকত। এটি এমন এক লাভজনক লেনদেন যা কখনো ক্ষতির সম্মুখীন হয় না। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَنْ تَبُورَ- ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, ছালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রূযী দান করেছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে। তারা এমন ব্যবসা কামনা করে, যা কখনো ধ্বংস হয় না’ (ফাত্বির ৩৫/২৯)।
কুরআনের প্রত্যেক অক্ষর পড়ার জন্য ছওয়াব রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব তথা কুআনের এর একটি বর্ণ পাঠ করবে, তার একটি নেকী হবে। আর একটি নেকী, দশটি নেকীর সমান। আমি বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ একটি বর্ণ; বরং ‘আলিফ’ একটি বর্ণ, ‘লাম’ একটি বর্ণ এবং ‘মীম’ একটি বর্ণ’।[1] এছাড়াও ক্বিয়ামতের দিন কুরআন অধ্যয়নকারীকে বলা হবে, কুরআন তেলাওয়াত কর এবং উপরে উঠতে থাকো। দুনিয়ায় তুমি যেভাবে ধীরে-সুস্থে তেলাওয়াত করতে, সেভাবে তেলাওয়াত করো। কেননা তেলাওয়াতের শেষ আয়াত সংখ্যায় জান্নাতে তোমার বাসস্থান হবে’।[2] এ কারণে রামযানে কুরআন বেশি বেশি তেলাওয়াত করা উচিত।
কুরআন তেলাওয়াতের আদবসমূহ
(১) পবিত্রতা বজায় রাখা : পবিত্র অবস্থায় তথা ওযূ অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত করা উত্তম। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ওযূ ব্যতীত আমি আল্লাহর নাম নেওয়া অপসন্দ করি’।[3] আর কুরআন তেলাওয়াত যিকরের অন্তর্ভুক্ত। তবে ওযূ ছাড়াও কুরআন তেলাওয়াত করা যাবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকর করতেন।[4] ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘ওযূ করে কুরআন পড়া মুস্তাহাব। তবে ওযূ ছাড়া কুরআন পড়লে কোনো দোষ নেই’।[5]
(২) নিরিবিলি ও উপযুক্ত স্থান নির্বাচন : কুরআন তেলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য হ’ল আয়াতগুলো বুঝা এবং হৃদয়ে গভীরভাবে ধারণ করা। তাই এমন স্থানে পড়া উচিত যেখানে মনোযোগ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নেই। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তম স্থান হ’ল মসজিদ। কারণ সেখানে প্রশান্তি ও বরকত বেশি থাকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ، ‘যখন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর গৃহসমূহের কোন একটি গৃহে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং একে অপরের সাথে মিলে (কুরআন) অধ্যয়নে লিপ্ত থাকে তখন তাদের উপর শান্তিধারা অবতীর্ণ হয়। রহমত তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং ফেরেশতাগণ তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখেন’।[6]
(৩) উপযুক্ত সময় নির্বাচন : মন যখন সতেজ ও মনোযোগী থাকে তখন কুরআন পড়া উচিত। এক্ষেত্রে রাতের সময় বিশেষভাবে উপকারী। কারণ তখন পরিবেশ শান্ত থাকে। আর ঐ সময় এবং চিন্তা-ভাবনা সুগভীর হয়। এজন্য আল্লাহ বলেন, إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا ‘নিশ্চয়ই রাত্রি জাগরণ প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং বিশুদ্ধ পাঠের সর্বাধিক উপযোগী’ (মুজাম্মিল ৭৩/৬)। এছাড়াও ক্বিয়ামতের দিন কুরআনের সুপারিশ সংক্রান্ত হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,وَيَقُولُ الْقُرْآنُ: مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ ‘কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, তাই আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন’।[7]
(৪) আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা : কুরআন শুধুমাত্র পড়ার জন্য নয়, বরং তা বুঝে এবং চিন্তা করে পড়ার জন্য নাযিল হয়েছে। আল্লাহ বলেন,كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)। কোনো শব্দ বা আয়াত বুঝতে না পারলে বিশুদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ থেকে অর্থ জেনে নেয়া উচিত। সালাফগণ দ্রুত পড়ার পরিবর্তে বুঝে পড়ার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
(৫) সুন্দর কণ্ঠে তেলাওয়াত করা : সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতে রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ ‘তোমরা সুললিত কণ্ঠে কুরআনকে সুসজ্জিত করে পাঠ কর’।[8] তিনি আরো বলেন,حَسِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ، فَإِنَّ الصَّوْتَ الْحَسَنَ يَزِيْدُ الْقُرْآنَ حُسْناً- ‘তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বর দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যমন্ডিত কর। কেননা সুমিষ্ট স্বর কুরআনের সৌন্দর্য বাড়ায়’।[9] অন্যত্র তিনি বলেন,حُسْنُ الصَّوْتِ زِيْنَةُ القُرْآنِ، ‘সুন্দর আওয়াজ (কণ্ঠস্বর) কুরআনের সৌন্দর্য’।[10]
(৬) তেলাওয়াতের সময় কান্না বা কান্নার অনুভূতি আনা : কুরআন তেলাওয়াতের সময় কান্না করা এবং আন্তরিক অনুভূতি প্রকাশ করা নেককার বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ বলেন, قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا- وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولًا- وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا- ‘তুমি বল, তোমরা কুরআনে বিশ্বাস করো বা না করো (এটি নিশ্চিতভাবে সত্য)। যাদেরকে ইতিপূর্বে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের (অর্থাৎ আহলে কিতাবদের) উপর যখনই এটি পাঠ করা হয়েছে, তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়েছে’। ‘আর তারা বলে, মহাপবিত্র আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পালনকর্তার প্রতিশ্রুতি অবশ্যই কার্যকর হয়ে থাকে’। আর তারা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় আরও বৃদ্ধি পায়’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/১০৭-১০৯)।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, কুরআন তেলাওয়াতের সময় কান্নার ব্যাপারে অনেক হাদীছ ও ছাহাবাদের বর্ণনা রয়েছে। হযরত ওমর (রাঃ) একবার ফজরের ছালাতে সূরা ইউসুফ তেলাওয়াত করছিলেন। তখন তিনি এত কাঁদলেন যে, চোখের অশ্রু বুকের উপর পড়তে লাগল। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি এত কাঁদতেন যে, তাঁর কান্নার শব্দ পেছনের কাতার থেকেও শোনা যেত।
হযরত ইবনু আববাস (রাঃ)-কে একদিন দেখা গেল, তাঁর চোখের নিচে অশ্রুতে ভিজে দাগ পড়ে গেছে। হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর সময় কিছু ইয়েমনী লোক যখন কুরআন পড়তে শুরু করল, তখন তারা সবাই কাঁদতে লাগল। তখন আবুবকর (রাঃ) বললেন, ‘আমরাও আগে এমন ছিলাম’।[11] কুরআন পাঠের সময় মর্ম বুঝে কান্না করা আল্লাহর এক বিশেষ নে’মত। এটি খাঁটি তাক্বওয়ার পরিচায়ক, অন্তরের কোমলতা ও আল্লাভীতির নিদর্শন।
(৭) কুরআনের সাথে আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া : আমরা কুরআন তেলাওয়াত করি এর আলোকে জীবনযাপন করার জন্য এবং এর আয়াতের সঙ্গে আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য। এই সম্পৃক্ততা অর্জিত হয় কুরআনের অর্থ বুঝার মাধ্যমে। তারপর সেই আয়াতের শিক্ষা থেকে আমল করার মাধ্যমে। হুযায়ফাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘এক রাতে আমি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে তাহাজ্জুদের ছালাত আদায় করলাম। তিনি সূরা বাক্বারাহ পড়তে শুরু করলে আমি ভাবলাম, তিনি হয়ত একশত আয়াত পড়ে রুকূ করবেন। কিন্তু এরপরেও তিনি পড়ে চললেন। তখন আমি চিন্তা করলাম, তিনি এর (বাক্বারাহ) দ্বারা পুরো দু’রাকা‘আত পড়ে সালাম ফিরাবেন। কিন্তু তিনি এরপরেও পড়তে থাকলে আমি ভাবলাম সূরাটি শেষ করে তিনি রুকূ করবেন। কিন্তু এরপর তিনি সূরা নিসা পড়তে শুরু করলেন এবং তা পাঠ করলেন। অতঃপর তিনি সূরা আলে ইমরান শুরু করলেন এবং তা পাঠ করলেন। তিনি থেমে থেমে ধীরে ধীরে পড়ছিলেন এবং তাসবীর আয়াত আসলে তাসবীহ পড়ছিলেন। আর কিছু চাওয়ার আয়াত আসলে চাইলেন। যখন আশ্রয় প্রার্থনা করার কোন আয়াত পড়ছিলেন তখন আশ্রয় প্রার্থনা করছিলেন’।[12]
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘যখন কোনো দো‘আর আয়াত আসবে, তখন আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ চাইতে হবে। যখন শাস্তির আয়াত আসবে, তখন আল্লাহর কাছে সেই শাস্তি থেকে মুক্তি চাইতে হবে। যখন প্রশংসাসূচক আয়াত আসবে, তখন আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করতে হবে’।[13]
এভাবে কুরআনের আয়াতের সাথে আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া আমাদের বোঝার গভীরতা, চিন্তাশক্তি এবং হৃদয়ের সতর্কতার প্রমাণ দেয়। কুরআন শুধুমাত্র তেলাওয়াতের জন্য নয়, বরং তা উপলব্ধি করা, হৃদয়ে ধারণ করা এবং তার আলোকে জীবন পরিচালনা করাই প্রকৃত উদ্দেশ্য।
(৮) হৃদয় বিগলিত আয়াতগুলি বারবার পড়া : কোনো আয়াত পড়ার সময় যদি হৃদয় বিগলিত হয়, তাহ’লে সেটি বারংবার পড়া উচিত। এটি হৃদয়ের কোমলতা এবং আধ্যাতিক অনুভূতি ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকবে। আর এটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অভ্যাস ছিল। তিনি কখনও একটি আয়াত বারবার তেলাওয়াত করতেন। আবু যার (রাঃ) বলেন, এক রাতে রাসূল (ছাঃ) শুধু একটি আয়াত পড়ে পুরো রাত কাটিয়ে দিলেন। তিনি বারবার এটি তিলাওয়াত করছিলেন,إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ‘যদি তুমি তাদের শাস্তি দাও, তবে তারা তো তোমারই বান্দা। আর যদি তুমি তাদের ক্ষমা করো, তবে নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (মায়েদা ৫/১১৮)।[14]
এই অভ্যাস আমাদের শেখায় যে, কুরআন তেলাওয়াত কেবল মুখে উচ্চারণ করা নয়, বরং তা হৃদয়ের গভীরে অনুভব করা। যে আয়াত আপনার হৃদয়ে স্পর্শ করে, তা বারবার পড়া এবং তার অর্থ নিয়ে চিন্তা করা। এ মাসে আমরা কুরআনের বাণী হৃদয়ে ধারণ করি, এর মিষ্টতা আস্বাদন করি এবং এর বিধানসমূহ শিখে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।-আমীন!
রামাযানে সালাফদের কুরআন তেলাওয়াত
(১) সায়িব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ওমর (রাঃ) ওবাই ইবনু কা’ব ও তামীম আদ্ দারী-কে আদেশ করলেন যেন তারা লোকেদেরকে নিয়ে রামাযান মাসের রাতের এগার রাক‘আত তারাবীহর ছালাত আদায় করে। এ সময় ইমাম তারাবীহের ছালাতে এ সূরাগুলো পড়তেন। যে সূরার প্রত্যেকটিতে ১০০-এর বেশী আয়াত ছিল। বস্ত্তত ক্বিয়াম লম্বা হওয়ার কারণে আমরা আমাদের লাঠির উপর ভর করে দাঁড়িয়ে ফজরের নিকটবর্তী সময়ে ছালাত শেষ করতাম’।[15]
(২) আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল্লাহ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) রামাযানে প্রতি তিন দিনে একবার কুরআন খতম করতেন, আর অন্যান্য সময়ে প্রতি সপ্তাহে একবার অর্থাৎ এক জুম‘আ হ’তে পরবর্তী জুম‘আর মধ্যে সম্পূর্ণ কুরআন তেলাওয়াত শেষ করতেন’।[16]
(৩) ইউনুস ইবনু ইয়াজিদ বলেন, রামাযান মাসে প্রবেশ করলে ইবনু শিহাব (রহ.)-এর একমাত্র কাজ ছিল কুরআন তেলাওয়াত এবং আতিথেয়তা’।[17]
(৪) ইবনু আব্দুল হাকাম বলেন, যখন রামাযান মাস আসত, ইমাম মালেক (রহঃ) হাদীছ পাঠ করা ও আলেমদের সাথে বৈঠক থেকে বিরত থাকতেন এবং কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি মনোযোগ দিতেন’।[18]
(৫) আব্দুর রাযযাক (রহঃ) বলেছেন, রামাযান মাসে প্রবেশ করলে সুফিয়ান ছওরী (রহঃ) অন্যান্য সকল নফল ইবাদত ত্যাগ করতেন এবং পুরোপুরি কুরআন তেলাওয়াতে মনোযোগ দিতেন’।[19]
(৬) ইব্রাহীম নাখাঈ (রহঃ) বলেন, আসওয়াদ (রহঃ) রামাযানে প্রতি দুই রাতে একবার কুরআন খতম করতেন। তিনি মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্রাম নিতেন। আর রামাযানের বাইরে প্রতি সাত রাতে একবার কুরআন খতম করতেন’।[20]
(৭) সালাম ইবনু আবী মুতী‘ বলেছেন, ‘ক্বাতাদা প্রতি সাত দিনে কুরআন খতম করতেন। রামাযান এলে তিনি প্রতি তিন দিনে একবার খতম করতেন। আর যখন শেষ দশক আসত, তখন প্রতি দিবারাত্রিতে এক খতম করতেন’।[21]
(৮) ইমাম শাফেঈ (রহঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি রামাযান মাসে দিনে ও রাতে দু’টি খতম সম্পন্ন করতেন, এবং অন্যান্য সময় তিনি এক খতম সম্পন্ন করতেন।[22]
(৯) ছহীহ বুখারীর প্রণেতা আবু আব্দুল্লাহ আল-বুখারী (রহঃ) রামাযান মাসের রাত ও দিনের মধ্যে একবার কুরআন খতম করতেন।[23]
উপসংহার : রামাযান ও রামাযানের বাইরের মাসগুলো আমাদের অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করা উচিত। কেননা এই কুরআনও আমাদের পক্ষে ও বিপক্ষে সাক্ষী দিবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ ‘কুরআন হবে তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ’।[24] আর কুরআন পড়তে গিয়ে কারো কষ্ট হয় তার দ্বিগুণ ছওয়াব রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَهُوَ مَاهِرٌ بِهِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِى يَقْرَؤُهُ وَهُوَ يَشْتَدُّ عَلَيْهِ فَلَهُ أَجْرَانِ، ‘কুরআন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ফেরেশতাদের সঙ্গী হবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পড়ার সময় আটকে যায় এবং কষ্ট করে তেলাওয়াত করে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ ছওয়াব’।[25] পরকালীন পথেয় অর্জনে আল্লাহ আমাদেরকে অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াতের তাওফীক দান করুন।-আমীন!
সিবগাতুল্লাহ
[লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, মারকায শাখা।
[1]. তিরমিযী হা/২৯১২।
[2]. আবুদাঊদ হা/১৪৬৪; তিরমিযী হা/২৯১৪; মিশকাত হা/২১৩৪।
[3]. আবুদাঊদ হা/১৭; নাসাঈ হা/৩৮; মিশকাত হা/৪৬৭।
[4]. মুসলিম হা/৩৭৩; আবূদাঊদ হা/১৮; তিরমিযী হা/৩৩৮৪।
[5]. নববী, আত-তিবয়ান ফী আদাবি হামলাতিল কুরআন ৭৩ পৃ.।
[6]. মুসলিম হা/২৬৯৯।
[7]. মাজমাউয যাওয়াইদ হা/৫০৮১।
[8]. আবূদাঊদ হা/১৪৬৮; ইবনু মাজাহ হা/১৩৪২; মিশকাত হা/২১৯৯।
[9]. দারিমী হা/৩৫৪৪; ছহীহাহ হা/৭৭১; ছহীহুল জামে‘ হা/৩১৪৫।
[10]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩১৪৪; ছহীহাহ হা/১৮১৫।
[11]. নববী, আত-তিবয়ান ফী আদাবি হামলাতিল কুরআন ৮৬-৮৮ পৃ.।
[12] মুসলিম হা/৭৭২।
[13]. নববী, আত-তিবয়ান ফী আদাবি হামলাতিল কুরআন ৯১ পৃ.।
[14]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৫০।
[15]. মুওয়াত্বা হা/৩৭৯; মিশকাত হা/১৩০২।
[16]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা ২/২৫৫ পৃ.।
[17]. কুরতুবী, আত-তামহীদ ৬/১১১ পৃ.।
[18]. ইবনু রজব, লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ ১/১৭১পৃ.।
[19]. ইবনু রজব, লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ ১/১৮৩ পৃ.; আবু ওমর কুরতুবী (মৃ. ৪৬৩), আত-তামহীদ ৬/১১১ পৃ.।
[20]. ইবনু রজব, লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ ১/১৭১ পৃ.; আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল মুহসিন, ফিক্বহুল আদইয়া ১/৭২ পৃ.।
[21]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৫/১৭৬ পৃ.।
[22]. তাফসীর ইবনু কাছীর ১/৮৫।
[23]. তাফসীর ইবনু কাছীর ১/৮৫।
[24]. মুসলিম হা/২২৩; মিশকাত হা/২৮০।
[25]. বুখারী হা/৪৯৩৭ আবূদাঊদ হা/১৪৫৪; তিরমিযী হা/২৯০৪।