যবানের পাপ ও পুণ্য
ফায়ছাল মাহমূদ
মুহাম্মাদ আরাফাত যামান 198 বার পঠিত
রজবের বাতাসের তোড়ে শাবানের মেঘ বর্ষিত হ’ল রামাযানে। প্রশংসা সেই মহান রবের, যাঁর অশেষ অনুগ্রহে আমরা রামাযান মাস উপনীত হলাম। এই সেই বরকতময় মাস, যার সান্নিধ্যের মিষ্টতা হাছিলের জন্য অর্ধবছর আগ থেকেই নেককাররা দোয়ার আরজি পেশ করেন। কিন্তু সকল আরজি তো আর কবুল হওয়ার নয়! তার মাঝে অনেকেরটা কবুল হলেও কিছু আরজি থমকে যায় দীর্ঘ নিঃশ্বাসে। প্রিয় পাঠক, আপনার শ্বাস ফুরানোর পূর্বেই উক্ত মাস আপনার দিকে আরেকবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। হয়ত বা এটাই শেষ!
কুরআন নাযিলের উক্ত মাসে আমাদের রবের দেওয়া বড় নে‘মত হ’ল ছিয়াম। যা দ্বারা আপনি তাঁর পানে এগিয়ে যাবেন এবং হ’তে পারবেন তাক্বওয়াবান। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ ‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩)। এর ব্যাখ্যায় তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-এর মতে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রত্যেক মাসে তিন দিন ও আশুরার দিনে ছিয়াম ফরয ছিল, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী ইয়াহূদী সম্প্রদায়ের ওপর মাসে তিন দিন ও আশুরার দিনে ছিয়াম ফরয ছিল। পরবর্তীতে রামাযান মাসের দ্বারা এ ছিয়াম রহিত হয়।
মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, উক্ত তিন দিনের ছিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের ছিয়াম দ্বারা রহিত হয়। অতঃপর উক্ত কয়েক দিনের ছিয়াম আবার রামাযানের ছিয়াম দ্বারা রহিত হয়’।[1]
ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,صَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَاشُورَاءَ، وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ تُرِكَ، وَكَانَ عَبْدُ اللهِ لاَ يَصُومُهُ إِلَّا أَنْ يُوَافِقَ صَوْمَهُ ‘নবী (ছাঃ) আশুরার দিন ছিয়াম পালন করেছেন এবং এ ছিয়ামের জন্য আদেশও দিয়েছেন। পরে যখন রামাযানের ছিয়াম ফরয হ’ল তখন তা ছেড়ে দেওয়া হয়। আব্দুল্লাহ (রাঃ) এ ছিয়াম পালন করতেন না, তবে মাসের যে দিনগুলোতে সাধারণ ছিয়াম পালন করতেন, তাঁর সাথে মিল হলে করতেন’।[2]
উপরের প্রারম্ভিক আলোচনা থেকে এইটা স্পষ্ট যে, আমাদের ন্যায় আমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মাঝেও ছিয়ামের বিধি-বিধান বিদ্যমান ছিল। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমণের পূর্বেই অন্যান্য সকল উম্মত পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তাদের ইবাদতসমূহে ব্যাপক বিকৃতি ঘটেছে। কিন্তু তাদের এই বিকৃত দ্বীনের মাঝেও ছিয়াম সদৃশ্য কিছু উপবাসের প্রচলন রয়েছে। যা দ্বারা সহজেই অনুমেয় যে, এই সম্প্রদায় সমূহ কোন একসময় হয়ত অহি-র বিধানের আলোকে ছিয়াম পালন করত। কিন্তু তারা এর আসল রূপ বিকৃত করায় তাদের ক্ষেত্রে ছিয়ামকে উপবাস বলে উল্লেখিত হবে। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা সূরা বাক্বারাহ হ’তে উল্লেখিত আয়াতটির আলোকে আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আহলে কিতাবের অনুসারী সম্প্রদায় এবং অন্যান্য প্রচলিত ধর্মসমূহে ছিয়ামের বিদ্যমানতা খুঁজে দেখার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
ছিয়াম যেখান থেকে শুরু : মানবজাতির যাত্রা আদম (আঃ)-এর মাধ্যমে শুরু হয়, যাঁর ওপর প্রথম শারঈ বিধান নাযিল হয়।। মহান রব বলেন,قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ‘আমি বললাম তোমরা সবাই তা (জান্নাত) থেকে নেমে যাও। অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন হিদায়াত আসবে, তখন যারা আমার হেদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না’ (বাক্বারাহ ২/৩৮)।
প্রথম নবী আদম (আঃ)-এর শরী‘আতে ছিয়ামের বিধান দেওয়া হয়েছিল বলে তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও সেই ছিয়ামের ধরণ ও প্রকৃতি কেমন ছিল তা আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে বাইবেল, কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীছের কিতাব একেবারে নিশ্চুপ। বলা হয়ে থাকে পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবীর শরী‘আতেই চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে ছিয়ামের বিধান ছিল। এ ছিয়াম আইয়ামে বীয বা শুভ্ররাত্রিগুলোর দিনের ছিয়াম নামে খ্যাত।
নূহ (আঃ)-এর ছিয়াম : নূহ (আঃ)-এর যামানায় এসে আল্লাহর দ্বীনের পুনর্জাগরণ ঘটে। অন্যান্য নবীদের ন্যায় তিনিও মাসে তিনটি ছিয়াম রাখতেন। তাফসীর ইবনে কাছীরে বর্ণিত হয়েছে,عَنْ مُعَاذٍ، وَابْنِ مَسْعُودٍ، وَابْنِ عَبَّاسٍ، وَعَطَاءٍ، وَقَتَادَةَ، وَالضَّحَّاكِ بْنِ مُزَاحِمٍ- أَنَّ الصِّيَامَ كَانَ أَوَّلًا كَمَا كَانَ عَلَيْهِ الْأُمَمُ قَبْلَنَا، مِنْ كُلِّ شَهْرٍ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ -. وَزَادَ: لَمْ يَزَلْ هَذَا مَشْرُوعًا مِنْ زَمَانِ نُوحٍ إِلَى أَنْ نَسَخ اللَّهُ ذَلِكَ بِصِيَامِ شَهْرِ رَمَضَانَ. প্রসিদ্ধ তাফসীরবিদ মু‘আয, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ), আতা, কাতাদা ও দাহহাক (রহঃ) বর্ণনা করেন, নূহ (আঃ) হ’তে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর যুগেই প্রতি মাসে তিনটি করে ছিয়ামের বিধান ছিল। পরবর্তীতে ইহা রামাযানের ছিয়াম দ্বারা রহিত হয়’।[3]
মাসিক এই ৩দিন ছাড়াও নূহ (আঃ) বিশেষ কিছু দিনে ছিয়াম পালন করতেন। যেমনটি আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: صَامَ نُوحٌ الدَّهْرَ، إِلَّا يَوْمَ الْفِطْرِ وَيَوْمَ الْأَضْحَى ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, নূহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহার দিন বাদে সারা বছর ছিয়াম পালন করতেন’।[4]
ইবরাহীম (আঃ)-এর ছিয়াম : মুসলিম মিল্লাতের পিতা ছহীফাপ্রাপ্ত নবী ইব্রাহীম (আঃ)-এর যুগে ৩০টি ছিয়াম ছিল বলে কেউ কেউ লিখেছেন। ইব্রাহীম (আঃ)-এর সন্তান ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর কুরাইশদের মাঝেও ছিয়ামের প্রচলন ছিল। যেমনটি আয়েশা (আঃ) হ’তে বর্ণিত, أَنَّ قُرَيْشًا كَانَتْ تَصُومُ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فِي الجَاهِلِيَّةِ ‘জাহেলী যুগে কুরাইশগণ আশুরার দিন ছিয়াম পালন করত’।[5]
দাউদ (আঃ)-এর ছিয়াম : আসমানী কিতাবপ্রাপ্ত নবী হিসেবে তার উম্মতের মাঝেও ছিয়াম পালনের বিধান ছিল। এমনকি মুহাম্মাদ (ছাঃ) দাউদ (আঃ)-এর ছিয়ামকে সর্বোত্তম ছিয়াম বলে উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,صُمْ أَفْضَلَ الصِّيَامِ عِنْدَ اللهِ، صَوْمَ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلَام كَانَ يَصُومُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمًا ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিয়াম দাউদ (আঃ)-এর ছিয়াম। তিনি একদিন ছিয়াম পালন করতেন এবং একদিন বিনা ছিয়ামে থাকতেন’।[6]
মূসা (আঃ) ও ইহূদী ধর্মে ছিয়াম : ইহূদীদের ওপর মুহাররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন ছিয়াম পালন করা ফরয ছিল। ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المَدِينَةَ فَرَأَى اليَهُودَ تَصُومُ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، فَقَالَ: مَا هَذَا؟ قَالُوا: هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ هَذَا يَوْمٌ نَجَّى اللَّهُ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ، فَصَامَهُ مُوسَى، قَالَ: فَأَنَا أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ، فَصَامَهُ، وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে ইহূদীদের আশুরার দিনে ছিয়ামরত অবস্থায় পেলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আজকে তোমরা কিসের ছিয়াম পালন করছ? তারা বলল, এটা সেই মহান দিন যেদিন আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও তাঁর কওম বনী ইস্রাইল ফির‘আউনের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। ফলে শুকরিয়া স্বরূপ মূসা (আঃ) ঐ দিনে ছিয়াম রেখেছিলেন, তাই আমরা আজকে ছিয়াম পালন করছি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসা (আঃ)-এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিন ছিয়াম পালন করেন এবং সবাইকে ছিয়াম রাখার নির্দেশ দেন’।[7]
মূসা (আঃ)-এর ছিয়াম পালনের বিষয়ে ইহূদী-খ্রিস্টানদের বিকৃত ধর্মগ্রন্থে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। বিশেষত তূর পাহাড়ে আল্লাহর সানিধ্যে থাকা অবস্থায় মূসা (আঃ) ৪০ দিন ছিয়াম রেখেছিলেন। এই মর্মে বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে, ‘সিনাই পাহাড়ের উপরে মোশি সদাপ্রভুর কাছে চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি রুটি কিংবা পানি কিছুই খান নি। সদাপ্রভু সেই পাথরের ফলক দু’টির উপর তাঁর ব্যবস্থার কথাগুলো আবার লিখে দিলেন, আর সেগুলোই হ’ল সেই দশ আজ্ঞা’।[8] ইহুদীরা উক্ত ৪০ দিনের ৪০তম দিনটিতে আজও উপবাস রাখে। এছাড়া তারা ৯ আগস্ট হাইকাল বাইতুল মুকাদ্দাস ধ্বংস দিবসে ছিয়াম রাখে, এ দিন তারা খাদ্য, স্ত্রী সহবাস ও জুতা পরিধান থেকে বিরত থাকে।
সম্মানিত পাঠক! বাইবেল মূলত আহলে কিতাবদের ইতিহাসবিদ এবং ধর্মগুরুদের জমাকৃত ইতিহাসের বই। যার মধ্যে আল্লাহর প্রেরিত আসমানী কিতাব তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিলসহ অন্যান্য নবীদের শিক্ষা যুক্ত করার প্রয়াস করা হয়েছিল, যার অধিকাংশই বিকৃত হয়ে গিয়েছে। আর তার সত্যায়ন করার মতো কোন প্রমাণই তাদের নিকট বিদ্যমান নেই। তাই আমরা বাইবেল থেকে যা কিছুই বর্ণনা করব তা মূলত আহলে কিতাবদের ছিয়ামের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের বর্ণিত ইতিহাস হিসাবে।
ঈসা (আঃ) ও খ্রিস্টান ধর্মে ছিয়াম : ঈসা (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের মাঝে বিভিন্ন ধরনের ছিয়াম পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। বাইবেলে প্রায় ৭০ বার উপবাস রাখার বর্ণনা এসেছে। আর সেই উপবাসগুলোর মাঝে ভিন্ন ভিন্ন ধরণ রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল, (১) যুদ্ধে জয়লাভে উপবাস করা’।[9] (২) পুত্র লাভের জন্য উপবাস।[10] (৩) আল্লাহর সাহায্য এবং নিরাপত্তা কামনা করে উপবাস।[11] (৪) জেরুজালেমের প্রতি সাহায্যের জন্য উপবাস।[12] (৫) শোকে এবং অনুতাপে উপবাস।[13] (৬) ঈসা (আঃ) এর নির্দেশে তাঁর শিষ্যরা উপবাস করবে।[14] (৭) ভূত ছাড়ানোর সাধ্যের জন্য উপবাস।[15] এছাড়া আরও অন্যান্য।
বর্তমান সময়ে অনেক চার্চে আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য ফাদার বা পুরোহিতের নির্দেশে নির্দিষ্ট কয়েক দিন খাদ্য পানীয় থেকে বিরত থাকার রীতি রয়েছে। যার ইফতার হবে নিরামিষ দিয়ে। যা প্রতি সপ্তাহে ২৪ ঘন্টা অথবা ৪৮ ঘন্টা পালন করা হয়। এছাড়া বড় দিনের উপবাস, তাওবার উপবাস যা ৫৫ দিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। অন্যান্য উপবাসের মধ্যে জন্মদিন উপলক্ষ্যে উপবাস রয়েছে। যা ৪৩ দিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। আরও রয়েছে দূতগণের উপবাস, মারিয়ামের উপবাস ইত্যাদি। এইভাবে তাদের ধর্মে নানান ধরনের উপবাস বিদ্যমান থাকলেও তার কোনটিকেই তারা আবশ্যকীয় হিসাবে পালন করে না। বরং কেউ ইচ্ছা করলে রাখতে পারে। আবার ইচ্ছা করলে ছাড়তে পারে।
গ্রীক, রোমান ও অন্যান্যদের উপবাস : গ্রীক ও রোমানরা যুদ্ধের আগে উপবাস রাখত যাতে ক্ষুধা ও কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। খ্রিস্টান পাদ্রীদের ও পারসিক অগ্নিপূজকদের এবং হিন্দু যোগী ইত্যাকার ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে উপবাসের বিধান ছিল। পারসিক ও হিন্দু যোগীদের উপবাসের ধরণ ছিল, তারা উপবাস থাকা অবস্থায় মাছ-গোশত, পাখি ইত্যাদি ভক্ষণ করা থেকে বিরত থাকত বটে; কিন্তু ফল-মূল এবং সামান্য পানীয় গ্রহণ করত। মূর্তিপূজক ঋষীরা উপবাসের ব্যাপারে এতই কঠোর ছিল যে, তারা উপবাস থাকা অবস্থায় মাছ-গোশত, পাখি ইত্যাদি ভক্ষণ করা থেকে বিরত থাকত, স্ত্রী সহবাস করত না। সারা বছর উপবাস রেখে আত্মাকে কষ্ট দিত। আর এভাবে তারা পবিত্রতা অর্জনের সাধনা করত।
এছাড়াও প্রাচীন চীনা সম্প্রদায়ের লোকেরা একাধারে কয়েক সপ্তাহ উপবাস রাখত। জাপানিজ ইতিহাসেও ৭দিন এবং ২১দিন উপবাস রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়।
জাহেলী যুগে সাবেঈ সম্প্রদায়ের উপবাস : গ্রহ-নক্ষত্র পূজারী সাবেঈ সম্প্রদায়ের ব্যাপারে ইবনেু নাদিম তার ফিহরাসাত কিতাবের নবম খন্ডে উল্লেখ করেন, সাবেঈ সম্প্রদায়ের লোকেরা ত্রিশ দিন উপবাস থাকত। আযার মাসের ৮দিন অতিবাহিত হলে এ উপবাস শুরু হ’ত, কানুনে আউয়াল মাসে ৯টি, শাবাত মাসে ৭টি উপবাস। এ সাত উপবাস পালনের পরে তারা ঈদুল ফিৎর উদযাপন করত। উপবাস অবস্থায় তারা খাদ্য, পানীয় ও স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি থেকে বিরত থাকত’।[16]
হিন্দু ধর্মে উপবাস : সিন্ধু নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা দর্শনভিত্তিক ধর্ম হিন্দুদের মাঝেও উপবাস রাখার প্রচলন রয়েছে। তারা মাসের একাদশী এবং পূর্ণিমায় উপবাস থাকে। এছাড়া বিভিন্ন দেব দেবীর অনুসারীরা সপ্তাহের ভিন্ন ভিন্ন দিনে উপবাস থাকে। যেমন, হনুমান ভক্তরা শনিবার, শিব ভক্তরা সোমবার, শক্তি দেবীর ভক্তরা মঙ্গলবার, বিষ্ণু ভক্তরা বৃহস্পতিবার ইত্যাদি। বাৎসরিক বিভিন্ন উৎসবকে উপলক্ষ্য করেও তারা উপবাস পালন করে। যেমন, মহা শিবরাত্রি, নবরাত্রি, বিজয় দশমী, দিওয়ালি, কারওয়া চাওত[17] ইত্যাদি। তারা উপবাস থাকা অবস্থায় মাছ-গোশত, পাখি ইত্যাদি ভক্ষণ করা থেকে বিরত থাকলেও ফল-মূল এবং সামান্য পানীয় গ্রহণ করে।
বৌদ্ধ ধর্মে উপবাস : এই ধর্মের পুরুষ এবং নারী পুরোহিতরা বিনয়া নিয়ম অনুসারে প্রতিদিন দুপুরের খাবারের পর সকল ধরণের খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। তারা এভাবে খাদ্য থেকে বিরত থেকে সংযম ও শারীরিক নিয়ন্ত্রণ করে। তারা তাদের চন্দ্রমাসের ১, ৯, ১৫ ও ২২ তারিখে ৪দিন উপবাস পালন করে।
এইগুলো ছিল প্রসিদ্ধ ধর্মসমূহে ছিয়াম বা উপবাসের ইতিহাস এবং তার প্রমাণিকতা। যা সূরা বাক্বারাহ হ’তে চয়নকৃত كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ ‘যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর’। এই আয়াতের দাবী এবং এর আলোকে বলা চলে, পূর্ববর্তী উম্মত এবং অন্যান্য সম্প্রয়দায়ের মাঝে এখনো ছিয়াম বা উপবাসের প্রচলন দেখা যায়। যদিও প্রতিটি সম্প্রদায় তাদের উপর নির্ধারণ করা বিধানগুলো বিকৃত করেছে এবং তাদের সুবিধা অনুযায়ী কম বেশি করছে। কিন্তু আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ আসমানী কিতাব এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছের বদৌলতে শেষ উম্মত হিসাবে মুসলিমরা এখনো ছিয়ামের প্রকৃত রূপের সংস্পর্শে রয়েছে। ফালিল্লা-হিল হামদ। আমরা নববী তরীকায় রামাযানের ফরয ছিয়াম, অন্যান্য মুস্তাহাব ছিয়াম, যেমন, আরাফার ছিয়াম, মুহাররমের ছিয়াম, প্রতি চন্দ্র মাসে ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের ছিয়াম পালন করছি। আর এর দ্বারা অসংখ্য নেকী লাভের মাধ্যমে পরকালীন জান্নাতের পথ সুগম করতে পারি। আল্লাহ আমাদের এই রামাযানে পরকালীন পাথেয় অর্জনের তাওফীক দান করুন।-আমীন!
মুহাম্মাদ আরাফাত যামান
[1]. তাফসীরে কুরতবী ২/২৭৫।
[2]. বুখারী হা/১৮৯২।
[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর ১/৪৯৭, তাফসীরে কুরতবী ২/২৭৫; তাফসীরে ত্বাবারী ৩/৪১১; তাফসীরে মানার ২/১১৬।
[4]. ইবনেু মাজাহ হা/১৭১৪; আলবানী বলেছেন হাদীছটি যঈফ।
[5]. বুখারী হা/১৮৯৩।
[6]. মুসলিম হা/১১৫৯।
[7]. বুখারী হা/২০০৪; মুসলিম হা/১১৩০।
[8]. বাইবেল, যাত্রাপুস্তক ৩৪:২৮।
[9]. বাইবেল, বিচার ২০:২৬।
[10]. বাইবেল, শ্যামূয়েল ১:৬-৭।
[11]. বাইবেল, বংশাবলি ২০:৩।
[12]. বাইবেল, নহিমিয় ১:৪।
[13]. বাইবেল, নহিমিয় ৯:১-২।
[14]. বাইবেল, মথি ৯:১৪-১৫।
[15]. বাইবেল, মথি ১৭:২১।।
২০. সহীহ হাদিসের আলোকে সাওম বিশ্বকোষ, আব্দুল্লাহ আল-মামুন আযহারী, ২৩ পৃ.।
[17]. হিন্দু মেয়েরা তাদের স্বামীদের মঙ্গল কামনায় কার্তিক মাসের ১৮তম দিবসে।