খলীল মেইক (আমেরিকা)

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 159 বার পঠিত

প্রশ্ন : আপনার জীবন সম্পর্কে বলুন?

খলীল মেইক : আমার নাম খলীল মেইক। আমি ডালাস, টেক্সাসের বাসিন্দা। আমি একটি খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি এবং ছোটবেলা থেকে আমার ইচ্ছা ছিল একজন ব্যাপটিস্ট (খ্রিষ্টধর্মের একটি শাখা) প্রচারক হওয়ার। তবে ১৯৮৯ সালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়নে গভীরভাবে নিমগ্ন হওয়ার পর আমি ইসলাম গ্রহণ করি। আজ আমি মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতে পেরে গর্বিত। বর্তমানে আমি ‘মুসলিম লিগ্যাল ফান্ড অফ আমেরিকা’ নামক একটি জাতীয় দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করছি, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের অভিবাসন, দেওয়ানী এবং ফৌজদারী মামলায় সহায়তা প্রদান করে।

প্রশ্ন: ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আপনার বিশ^াসগুলো কেমন ছিল?

খলীল মেইক : আমাদের পরিবার প্রতি রবিবারে গির্জায় যেত এবং গ্রীষ্মকালে ভ্যাকেশন বাইবেল স্কুলে অংশ নিত। একবার আমাদের গির্জায় একজন প্রচারক দোযখ সম্পর্কে একটি ভিডিও প্রদর্শন করেছিলেন, যা আমাকে খুব ভয় পাইয়ে দেয়। তখন আমার বয়স ৬ বা ৭ বছর। ওই ঘটনার পর দিন রাতে আমি আমার পাড়ার সব বাড়িতে গিয়ে সকল শিশু ও তাদের পরিবারকে গির্জায় আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করি।

যখন আমি বড় হ’তে শুরু করি, তখন ধর্মীয় কর্মকান্ড কেবল রবিবারের একটি রীতিতে পরিণত হয়। এরপর কলেজে এসে আমি আমার বিশ্বাসের চর্চা করিনি। যখন আমি মাত্র দেড় বছর বয়সী ছিলাম, তখন আমার মা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। তার মৃত্যুর পর আমার বাবা একটি বীমা করেছিলেন, যা আমি ১৮ বছর বয়সে পেঁŠছানোর পর একবারে পাই। সে সময় আমি স্বাধীন ছিলাম এবং কলেজে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পার্টি ও আনন্দে সময় কাটিয়েছিলাম। গ্রাজুয়েশনের পর আমি বুঝতে পারলাম, আমি যে পথে চলছি তা সঠিক নয়। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার ধর্মীয় রীতিনীতির দিকে ফিরে যাব এবং আমি পুনরায় একজন ব্যাপটিস্ট প্রচারক হওয়ার পরিকল্পনা করলাম।

প্রশ্ন : ইসলামের দিকে আপনার যাত্রা শুরু হলো কীভাবে?

খলীল মেইক : আমার ইসলামের পথচলা শুরু হয় কলেজে, যখন আমি ব্যাপটিস্ট প্রচারক হওয়ার পরিকল্পনা করি। আমি সেমিনারিতে (Seminary) অর্থাৎ খৃষ্টীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার বদলে ডিগ্রি শেষ করে সেমিনারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। উৎসাহের সাথে আমি বন্ধুদের ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করতাম এবং তাদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করতে চাইতাম। আমি সবসময় প্রশ্ন করতাম, আপনি কী বিশ্বাস করেন এবং কেন?

তখন এক মুসলিম বন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল, কিন্তু তার সাথে কখনো ধর্ম নিয়ে আলোচনা হয়নি। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী বিশ্বাস কর? সে বলল, আমি মুসলিম। আমি প্রথমে বুঝতে পারলাম না, এটি কোন সংগঠন নাকি ধর্ম। আমি তাকে খ্রিস্টান বানানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে কখনো আমার সাথে বিতর্ক করত না। শুধু ধর্ম নিয়ে আলোচনা করত। একবার সে আমাকে আহমাদ দীদাতের একটি পুস্তিকা দিল, যেখানে বাইবেলের ঐতিহাসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল এবং লেখা ছিল, এই বই কি ঈশ^রের বাক্য?

আমি বিশ্বাস করতাম বাইবেল শতভাগ সত্য। কারণ আমি এভাবেই বড় হয়েছি। কিন্তু কখনো এর ঐতিহাসিকতা নিয়ে পড়াশোনা করিনি। এরপর আমি বাইবেলের ঐতিহাসিকতা শিখতে চেষ্টা করি। যতই পড়ছিলাম, সমস্যা বাড়তেই থাকল। নিউ টেস্টামেন্টের আরবী বা হিব্রু ভাষার কোনো আসল পান্ডুলিপি নেই। শুধু গ্রীক ও ল্যাটিন নথি রয়েছে এবং আমি আবিষ্কার করলাম বাইবেলের কপিগুলোর মধ্যে কোনো মিল নেই। এমনকি ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট বাইবেলও ভিন্ন। এভাবে ২০০০ বছর ধরে খ্রিস্টান বিশ্বাসে অনেক অজানা বিষয় রয়েছে, যা আমাকে আশাহত করেছিল।

প্রতিশোধমূলক মনোভাব থেকে আমি আমার মুসলিম বন্ধুকে কুরআনের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। সে আমাকে নবীর সীরাতের উপর একটি বই দিল, যেখানে কুরআনের ঐতিহাসিক পটভূমি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত ছিল। কুরআন আরবী ভাষায় প্রণীত, যা নবীর সময়কাল পর্যন্ত সংরক্ষিত এবং মুখস্থ করা হয়েছে। এর ঐতিহাসিকতা সহজ এবং স্পষ্ট। কুরআনের মধ্যে বাইবেলের মতো কোনো বিতর্ক বা অসঙ্গতি নেই। বাইবেলে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পরিচয় সম্পর্কে দীদাতের একটি বই পড়ে আমি বুঝতে পারলাম যে, বাইবেলে যীশুর নাম কোথাও উল্লেখ নেই। বাইবেলের কিছু অংশে একজন নবী আগমনের কথা বলা হয়েছে, যা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের প্রতিফলন। শেষ পর্যন্ত আমি নিশ্চিত হলাম যে, বাইবেলে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে রয়েছে।

পরে আমি দীদাতের বই ‘ঈসা : ইসলামের একজন নবী’ পড়লাম। প্রথমে মনে হয়েছিল, এটা সম্ভব নয়। কারণ তিনি খ্রিস্টান ছিলেন। কিন্তু মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝে দেখলাম, যীশুর জীবন, অলৌকিক ঘটনা ও জন্ম আমাদের সঙ্গে মেলে। তবে আমরা তাকে ঈশ^র মনে করি, যা মুসলিমরা মনে করে না। তখন বুঝলাম, দুই ধর্ম প্রায় এক। কিন্তু পরিত্রাণের বিষয়টি আলাদা। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, যীশুই ঈশ^র এবং পাপের জন্য মারা গেছেন। আর মুসলমানরা এক ঈশ^রে বিশ্বাস করে। বাইবেলে যীশু নিজেকে ঈশ^র বলেননি। বরং সর্বত্র পিতার বড়ত্ব স্বীকার করছেন। এতে আমি নিশ্চিত হলাম যে, বাইবেল আমাকে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়।

প্রশ্ন : কোথায় এবং কীভাবে আপনি ইসলাম গ্রহণ করলেন?

খলীল মেইক : মুহাম্মাদ (ছাঃ)-ই শেষনবী নিশ্চিত হবার পর আমি ডেন্টনে এক মসজিদে গেলাম। কিন্তু সেখানে দরজা তালাবদ্ধ ছিল। আমি তালাবদ্ধ মসজিদের সামনে দঁাড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ ফুটপাতে বসে ভাবছিলাম, আমি কি করবো? অপেক্ষা করবো নাকি ফিরে যাব? কয়েক মিনিট পর একটি গাড়ি এসে থামল। ভেতর থেকে একজন নেমে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো সাহায্য লাগবে? আমি বললাম, হ্যঁা, আমি এখানে মুসলিম হ’তে এসেছি। তিনি দরজা খুললেন। তখন ছালাতের সময় হয়েছিল। ভেতরে সবাই উচ্ছসিতভাবে জানতে চাইলেন, আপনি ইসলামের স্তম্ভগুলো জানেন? আমি বুঝতে পারলাম, আমার জ্ঞান সীমিত। শুধু জানতাম, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম পরিত্রাণের বিশ্বাস ছাড়া প্রায় এক। একদিকে ট্রিনিটি (ত্রিত্ববাদ), অন্যদিকে তাওহীদ (একত্ববাদ)। আমি নিশ্চিত ছিলাম, তাওহীদই সত্য। তাই আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। এরপর তারা আমাকে একটি বই দিলেন, যা ছিল ‘হালাল ও হারাম’ নামক একটি বইয়ের ইংরেজী সংস্করণ।

প্রশ্ন : আপনার স্ত্রী কখন ও কীভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন?

খলীল মেইক : কলেজে থাকতেই আমার স্ত্রীর সঙ্গে এনগেজমেন্ট হয়েছিল, যদিও তখনো বিয়ে করিনি। আমরা গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলাম। তবে তিন বছর ধরে একসঙ্গে ছিলাম। আমি যখন মসজিদে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে বাসায় ফিরলাম, তাকে বললাম, তোমার সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। সে জিজ্ঞেস করল, কী কথা? আমি বললাম, আমি মুসলিম হয়েছি। তখন তার মুখ বিস্ময়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে বলল, কি! তুমি এটা কী করেছ?! আমি শান্তভাবে আবার বললাম, আমি মুসলিম হয়েছি। সে রেগে গিয়ে চিৎকার শুরু করল। সে বলতে লাগল, আমি এটা করব না, ওটা করব না...। আমি বললাম, শান্ত হও, শুধু আমার জন্য খুশি হও। তোমার যা ভালো লাগে করো। ধীরে ধীরে সে শান্ত হ’ল।

আমি হালাল ও হারাম বইটি পড়তে শুরু করলাম এবং দ্রুতই জানলাম যে, মুসলিমরা সুদের ব্যবসা করে না। অথচ আমি ফাইন্যান্সে ডিগ্রি নিয়েছি। আমি সুদের হার এবং অর্থ দিয়ে অর্থ উপার্জনের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। যেহেতু এখন যাজকও হচ্ছি না, তাহ’লে আমার করণীয় কী? আমি নতুন কাজ খুঁজতে শুরু করলাম এবং শেষ পর্যন্ত ট্রাকিং বিক্রয় প্রতিনিধির একটি চাকরি পেলাম। ব্যবসায়ীদের ফোন করে বলতাম, আপনার পণ্য পরিবহনের জন্য আমাদের ট্রাক ব্যবহার করুন। এভাবেই আমার উপার্জন শুরু হ’ল।

আমি হালাল ও হারাম বইয়ে পড়লাম, মুসলমানরা শুকরের গোশত খায় না। আগে খ্রিস্টানরাও এটা অপবিত্র মনে করত। কিন্তু যীশুর মৃত্যুর পর তারা বিশ্বাস করল, সব পাপ মোচন হয়েছে, তাই এখন খাওয়া যায়। আমি তো ছোটবেলা থেকেই খেয়ে আসছি! আমি স্ত্রীকে বললাম, আমি একটা নতুন কিছু শিখেছি। সে জিজ্ঞেস করল, কী? আমি বললাম, মুসলিমরা শুকরের গোশত খায় না, তাই এটা আমাকে দিও না। সে হতবাক হয়ে তাকাল, যেন আমি কোনো কাল্টে (পূজা বা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান) যোগ দিয়েছি!

বইয়ের আরো কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর জানলাম, মুসলিম পুরুষরা স্বর্ণ পরিধান করে না। অথচ আমরা ইতোমধ্যে বিয়ের জন্য স্বর্ণের আংটি ঠিক করেছিলাম। আমি স্ত্রীকে বললাম, আমরা কি রূপার আংটি নিতে পারি? সে রেগে আংটি খুলে ছুঁড়ে ফেলে বলল, আমি কখনোই...! এরপর চুপ হয়ে গেল। অবশেষে আমি তাকে মসজিদে যেতে রাজি করালাম। আমরা ইসলামী নিয়ম অনুুুুুুুুুুুুুুযায়ী বিয়ে করলাম। তবে আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী গির্জায়ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলাম। অর্থাৎ আমাদের দুই ধর্ম অনুযায়ী দু’টি বিয়ে হ’ল। সে আমাকে অনেক ভালোবাসত। কিন্তু আমার পরিবর্তনগুলোকে অদ্ভুত মনে করত। কিন্তু সে সবকিছু সহ্য করছিল।

ওমাহায় কিছু মুসলিমের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তারা আমাকে এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল, যেন আমি কোনো তারকা! মসজিদের লাইব্রেরিতে গিয়ে খুশি হলাম। তুলনামূলক ধমতত্ত্ব, মুসলিম-খ্রিস্টান বিতর্কসহ অনেক মূল্যবান বই ও ভিডিও সেখানে ছিল। আমি সেগুলো ধার নিয়ে পড়তাম। তারপর স্ত্রীকে বলতাম, ‘দেখো, আমি কী শিখলাম!’ সে প্রথমে কিছুক্ষণ শুনত। কিন্তু ৫-১০ মিনিট পর বলত, উফ! আর শুনতে চাই না। আমাকে একটু একা থাকতে দাও!

কয়েক মাস পড়াশোনা, ভিডিও দেখা আর কাজের পর আমি পুরোপুরি মুসলিম হয়ে উঠলাম। স্ত্রী আমার পরিবর্তন লক্ষ্য করল। তবে এতে সে আতঙ্কিত হয়নি, শুধু পর্যবেক্ষণ করছিল। একদিন সে বলল, আমি অন্য মুসলিমদের দেখতে চাই। আমি হেসে বললাম, আমি কি তোমার জন্য যথেষ্ট নই?

একদিন আমি মসজিদে গিয়ে বললাম, এটা আমার স্ত্রী। সে অন্য মুসলমানদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। আপনারা কি সাহায্য করতে পারেন? তারা বলল, আমাদের এক হালাকা আছে, যেখানে শুক্রবারে একসঙ্গে পরিবারগুলো বসে কুরআনের আলোচনা করে। সেখানে তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বহ ইত্যাদি আলোচনা হয়। তারপর ছালাত আদায় করে সবাই একসাথে খাবার খাই। তারপর বিদায় নিই। আপনি তাকে নিয়ে আসুন, সবাই একে অপরকে জানবে। আমরা প্রথম হালকায় গেলাম এবং সেখানে সে মুসলিম নারী, পুরুষ এবং শিশুদের সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশা করে নতুন কিছু শিখল। এটি তার জন্য ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ছিল। পরের বার যখন আমরা যাচ্ছিলাম, সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, যদি আমি আপনার সঙ্গে ছালাত আদায় করি, সমস্যা হবে? আমি বললাম, না, তুমি শুধু লাইনে দঁাড়িয়ে আমাদের অনুসরণ করো। সে জানত না কীভাবে ছালাত আদায় করতে হয়। তবে সে অংশগ্রহণ করতে চাইল।

আরও কয়েকটি হালাকা যাওয়ার পর একদিন সে আমাকে বলল, আমি মনে করি, আমি প্রস্ত্তত। আমি বললাম, প্রস্ত্তত? কিসের জন্য? সে বলল, মুসলিম হ’তে, কিন্তু আমি...। সে আমাকে বলল যে সে কিছু জিনিস করবে না, কিন্তু আমি জানতাম, সে ধীরে ধীরে আমার পথে আসছে। অবশেষে সে মুসলিম হয়ে গেল। এখন সবই করছে।

প্রশ্ন : ইসলাম গ্রহণের পর আপনার আনুভূতি কেমন ছিল?

খলীল মেইক : ইসলাম গ্রহণ করা আমার জন্য একটি বড় পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু মুসলিম হওয়ার পর আমি এক ধরনের শান্তি ও আরাম অনুভব করলাম যা আগে কখনো অনুভব করিনি। যেটা আল্লাহ আমার হৃদয়ে এক অনাবিল শান্তি দিয়ে পূর্ণ করে দিলেন। আমি জানতাম না যে, আমার মধ্যে কোন বিষয়ে এত আলোড়ন তৈরি করতে পারে। আমার জীবনে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যেগুলো আমি আগে লক্ষ্য করিনি। মুসলিম হওয়ার পর যখন আপনি অপরিচিত কাউকে সালাম দিবেন, অথবা পরিচিত কাউকে দেখবেন, তখন আপনি একটা নতুন ধরনের সংযোগ অনুভব করবেন। যে সীমাবদ্ধতাগুলো আগে ছিল, তা আপনি আর অনুভব করবেন না। এটা এক আধ্যাত্মিক সংযোগের মতো, যা আগে কখনো ছিল না। এটা যেন নেশার মত।

প্রশ্ন : আপনার পিতা-মাতা বা পরিবারের অন্যদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

খলীল মেইক : আমার বাবা-মা প্রথমে আমার মুসলিম হওয়ার সিদ্ধান্তকে সাময়িক আবেগ মনে করেছিলেন। তারা ভাবতেন, আমি দ্রুতই এই পথ থেকে সরে আসব। তারা মনে করেছিল, তরুণ হিসাবে আমি একটি নতুন কিছুর প্রতি আকর্ষিত হয়েছি মাত্র। সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমার স্ত্রীর পরিবার আরও রক্ষণশীল ছিল। তার বাবা এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, আমাদেরকে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। এমনকি এ কারণে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছিল, তারা আলাদাভাবে বসবাস করছিল। তার মা তাকে বলতেন, তুমি খুশি তো আমি খুশি। তবে যখন আমার স্ত্রী পর্দা করতে শুরু করল, তখন তার মা বাইরে অস্বস্তি বোধ করতেন। তিনি চিন্তিত ছিলেন যে, অন্যরা আমাদের কীভাবে দেখবে। তবে ধীরে ধীরে এই সমস্যাটি ছোট হয়ে গিয়েছিল এবং তার মা এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। পরে তার বাবাও যোগাযোগ শুরু করেছিলেন এবং আমরা বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিলাম। তার বৃদ্ধ বয়সে আমরা তার সেবা করেছি এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা তার পাশে ছিলাম। প্রথমে একটু অস্বস্তি ছিল, কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমরা একে অপরকে বুঝতে পেরেছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক অনেক ভালো ছিল।

প্রশ্ন : রাসূল (ছাঃ)-এর কোন বিষয় আপনাকে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছে?

খলীল মেইক : নবী (ছাঃ) সম্পর্কে যা সবার মনে আকর্ষণ তৈরি করে, তা হ’ল তাঁর সমস্যা সমাধানের অপূর্ব দক্ষতা। হোক সহিংসতা অথবা তার নিজের পরিবার ও সম্প্রদায়ের সমস্যা, যা আমরা আজও মুখোমুখি হচ্ছি, তিনি তা সহজেই সমাধান করতে পারতেন। আমেরিকান সংস্কৃতিতে আমাদের সুপারহিরোদের ধারণা আছে। কিন্তু সুপারহিরোদের আসল শক্তি কী? সেটা হ’ল দীর্ঘদিন ধরে মানুষের একটি সমস্যা চলমান থাকে। তারপর একজন সুপারহিরো এসে সব কিছু ঠিক করে দেয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে আসলে কেউই সেই সুপারহিরোর গুণাবলী নিয়ে জন্মায় না। তবে যখন আপনি জানবেন যে, একসময় মরুভূমির মধ্যে একজন মানুষ, চরম অজ্ঞতার মাঝে একটি মহান বাণী পেয়েছিলেন এবং সহিংসতার সময়ে তা কীভাবে এক ব্যক্তির কাছ থেকে বিশ্বের প্রতিটি কোণে পেঁŠছে গিয়েছিল, তখন আপনি বুঝবেন যে, তিনিই আসল সুপারহিরো। এই ঘটনা একেবারেই কাল্পনিক গল্পের চেয়ে অনেক বেশি প্রেরণাদায়ক। তাই আমাদের সত্যিকারের হিরোদের চিনতে হবে, যাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলী ও পরিবর্তনের শক্তি রয়েছে।

প্রশ্ন : সবশেষে দর্শকদের মধ্যে যাদের হৃদয় ইসলামের প্রতি উষ্ণ, তাদেরকে কী পরামর্শ দিতে চান?

খলীল মেইক : আমি কি আমার খলীল মেইক পড়তে বলতে পারি? এই প্রশ্নটা এক সেকেন্ডের জন্য মাথায় এল। কিন্তু তারপর বুঝলাম, বিচার দিবসে এসব কিছুই তাদের কাজে আসবে না। যখন আপনি একা আপনার স্রষ্টার সামনে দঁাড়িয়ে থাকবেন, তখন বিশ্বাস একটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে ওঠে। এটা এমন এক সিদ্ধান্ত, যা সবারই একা একা নিতে হবে। আপনাকেই ভাবতে হবে কেন আপনি এখানে? কোথায় যাচ্ছেন? কী করতে হবে আপনাকে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউ আপনাকে দিতে পারবে না। আর কেউ আপনার সাফল্যের ভাগও নেবে না। বিশ্বাস যখন দৃঢ় হয়, তখন তা যেকোনো বাধা, প্রতিকূলতা বা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে যেতে পারে। যখন আপনার মস্তিষ্ক ও হৃদয় একসাথে কাজ করে, তখন আপনি একটি অদম্য শান্তি এবং শক্তি অনুভব করবেন। তাই কখনো অন্যদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তা করবেন না। আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সাথে আপনার পথ চলুন, আর বিশ্বাস রাখুন যে আল্লাহ প্রতিটি পদক্ষেপে আপনার পাশে আছেন। তিনি আছেনই।

[তথ্য সূত্র : Towards Eternityথেকে শ্রুতিলিখন]



বিষয়সমূহ: গল্প
আরও