শায়খ মুহাম্মাদ জামীল যাইনু (সিরিয়া)

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 125 বার পঠিত

শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু জামীল যাইনু (১৯২৫-২০১০) ছিলেন সমকালীন যুগের একজন প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার এবং লেখক। তিনি ইসলামী আক্বীদা, ফিকহ এবং তাফসীর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত।

প্রাথমিক ও শিক্ষা জীবন : মুহাম্মাদ ইবনু জামীল যাইনু সিরিয়ার আলেপ্পো (হালাব) শহরে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। একটি বেসরকারী স্কুলে পড়াশোনার মাধ্যমে তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন। তারপর ‘দারুল হুফফায’ মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং পাঁচ বছরে কুরআন হিফয সম্পন্ন করেন। অতঃপর আলেপ্পোর শারীআহ কলেজে (পরবর্তীতে থানাভিয়া শারীআহ কলেজ) ভর্তি হন। সেখানে তিনি শারীআহ ও আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে এই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। অতঃপর তিনি আলেপ্পো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরেনসিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে তিনি তার সময়ের অনেক বিখ্যাত আলেমদের কাছ থেকে ইসলামী আইনশাস্ত্র ও সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন।

কর্মজীবন : মুহাম্মাদ ইবনু জামীল যাইনু আলেপ্পোর হাউজ অব টিচার্স-এ শিক্ষক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে প্রায় ২৯ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৭৯ সালে মক্কায় ওমরাহ করতে যান এবং সেখানে শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ)-এর সাথে পরিচিত হন। শায়খ বিন বায তাকে মক্কার মসজিদুল হারামে হজ্জযাত্রীদের জন্য শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন এবং পরবর্তীতে জর্ডানে দাওয়াতের কাজে পাঠান। সেখানে তিনি ইমাম, শিক্ষক ও প্রভাবশালী দাঈ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি মক্কার ‘দারুল হাদীছ আল-খায়রিয়াহ’-তে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে তিনি তাফসীর ও আক্বীদা শিক্ষা দিতেন।

অবদান : শায়খ যাইনু তার জীবনের বেশিরভাগ সময় দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি শায়খ যাইনু সেমিনার ও বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন করেছেন। এছাড়া তিনি বেশ কিছু বই রচনা করেছেন, যা ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো সহজ ও স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। তিনি ‘সিলসিলাতুত তাওজীহাতিল ইসলামিয়াহ’ নামে সহজবোধ্য ছোট ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করেন, যা ইংরেজী, ফরাসি, বাংলা, ইন্দোনেশিয়ান, তুর্কি, উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে- (১) আক্বীদাতুত তাওহীদ (২) আল-ফিক্বহুল মুয়াস্সার (৩) তাফসীরুল কুরআনিল কারীম।

বাংলায় অনূদিত উল্লেখযোগ্য বই : (১) আরকানুল ইসলাম ওয়াল ঈমান, (২) ইসলামী আকীদা বিষয়ক কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল, (৩) ইসলামী আকীদাহ, (৪) ইসলামী জীবন পদ্ধতি, (৫) ইসলামী বিষয়ক কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল, (৬) ইসলামে গান, ছবি ও প্রতিকৃতির বিধান, (৭) ঈমান ইসলামের মূলভিত্তি ও ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, (৮) কিভাবে তাওহীদের দিশা পেলাম, (৯) ফিরকা নাজিয়াহ ও সাহায্যপ্রাপ্ত জামায়াতের মতাদর্শ, (১০) ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনে ইসলামী দিক-নির্দেশনা, (১১) মাবরুর হজ (১২) মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পাথেয়, (১৩) শিশুদের লালন পালনে দায়িত্ব ও করণীয়, (১৪) সন্তান প্রতিপালন, (১৫) ছূফিবাদ ইত্যাদি।

পাশ্চাত্যের সমালোচনার শিকার : শায়খ যাইনু ২০০৫ সালে নিউইয়র্ক-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘Freedom House’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘Saudi Publications On Hate Ideology Invade American Mosques’ শীর্ষক রিপোর্টে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। বিশেষ করে নিম্নোক্ত বক্তব্য দু’টির কারণে তিনি পাশ্চাত্যের বিরাগভাজন হন। (১) ‘গান-বাজনা ব্যভিচারের সূচনা করে। হাততালি ও শিস বাজানো জঘন্য কাজ, এগুলো ত্যাগ করা উচিত’। (২) ‘বিদেশে তৈরি পুতুল কেনা ও শিশুদের উপহার দেওয়া উচিত নয়’। ‘কেন আমরা ইহুদি রপ্তানিকারকদের অর্থায়নে সাহায্য করব?’।

তার বই ‘Islamic Guidelines for Individual and Social Reform’ ২০০৭ সালের ‘PBS Frontline’ প্রামাণ্যচিত্র ‘Homegrown: Islam In Prison’-এ প্রদর্শিত হয়, যা ‘America at a Crossroads’ টেলিভিশন সিরিজের অংশ ছিল। এই প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয় যে, তার বইগুলো বিতর্কিত আল-হারামাইন ইসলামিক ফাউন্ডেশন দ্বারা আমেরিকার বিভিন্ন কারাগারে বিতরণ করা হয়েছিল।

‘Centre for Social Cohesion’-এর একটি গবেষণায় উল্লেখযোগ্যভাবে আলোচিত হন, যার শিরোনাম ছিল ‘Hate on the State: How British libraries encourage Islamic extremism’। গবেষণাটি জেমস ব্যান্ডন ও ডগলাস মারে রচনা করেছিলেন। এতে তাকে ‘সবচেয়ে উগ্র ওয়াহাবী আলেমদের একজন, যার বইগুলো টাওয়ার হ্যামলেটস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে’ বলে বর্ণনা করা হয়। BBC News-ও এই বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।

মৃত্যু : শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু জামীল যাইনু ২০১০ সালের ১৫ই অক্টোবর ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তার সৎআমলসমূহ কবুল করুন ও তাকে জান্নাতুল ফেরদাঊস দান করুন। আমীন।



আরও