ব্যর্থ জীবনের গল্প
নাজমুন নাঈম
একদা তিনজন যুবক নিজেদের কিছু কাজের প্রয়োজনে বিদেশ ভ্রমণে গিয়েছিল। সেখানে তারা থাকার জন্য ভালো মানসম্মত কোন হোটেল পাচ্ছিল না। অবশেষে একটি বহুতল ভবনের ৭৫ তলায় তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।
হোটেল বুকিং দেওয়ার সময় রিসেপশনিস্ট তাদের বলল, আমাদের দেশের নিয়ম-কানুন কিন্তু তোমাদের দেশের মতো নয়। এখানকার লিফটগুলো রাত ১০-টায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অতএব তোমরা যেখানেই যাও নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই ফিরে আসতে হবে। এই সময়ের পরে লিফট চালু করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ এটি একটি কম্পিউটার সিস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা এখান থেকে অনেক দূরে একটি ভবনে অবস্থিত। তোমরা বুঝতে পেরেছ তো?
তারা বলল, হ্যাঁ, বুঝেছি।
প্রথম দিন তারা সময়মতো ফিরে এসে নির্বিঘ্নে তাদের কক্ষে পৌঁছে গেল। কোন সমস্যার সম্মুখীন হ’ল না। কিন্তু দ্বিতীয় দিন তারা ৫ মিনিট দেরি করে ফেলল। বুঝতে পারার পর লিফট ধরার জন্য তারা যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে আসল। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে তারা লিফট ধরতে পারল না। লিফটের দরজা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তারা অনেক অনুরোধ করল, এমনকি কান্নার উপক্রম হ’ল। কিন্তু কোন লাভ হ’ল না। ফলে তাদের একমাত্র উপায় হ’ল যে, সিঁড়ি দিয়ে পায়ে হেঁটে তাদের ৭৫ তলায় রুমে পৌঁছাতে হবে। একজন বলল, আমি একটি পরামর্শ দিচ্ছি। আমরা প্রত্যেকে ২৫ তলা করে উঠার সময় একটি করে গল্প বলব। প্রথম জন শুরু করবে, তারপর দ্বিতীয় জন, তারপর তৃতীয় জন এভাবে গল্প বলতে বলতে আমরা ৭৫ তলায় পৌঁছে যাব। এতে আমাদের কষ্ট অনুভব কম হবে।
তারা বলল, খুব ভালো পরামর্শ! তাহ’লে তুমিই শুরু কর।
প্রথমজন বলল, আমি এমন মজার কৌতুক ও হাসির গল্প বলব, যা শুনে হাসতে হাসতে তোমাদের পেট ব্যথা হয়ে যাবে। তারা বলল, এটাই তো আমরা চাই! সত্যিই প্রথমজন এত মজার গল্প বলল যে, তারা হাসতে হাসতে পাগলের মতো হয়ে গেল। তাদের হাসির প্রাবল্যে মনে হ’ল যেন, পুরো বিল্ডিং কেঁপে উঠল।
তারপর দ্বিতীয়জনের পালা এলো। সে বলল, আমার কাছে কোন মজার গল্প নেই। কিছু সিরিয়াস গল্প আছে। তারা সেই সিরিয়াস গল্পই শুনতে রাযী হ’ল। তাই সে ২৫ তলা ধরে তাদের কিছু জীবন ঘনিষ্ঠ বাস্তবধর্মী গল্প শোনাল।
এরপর ৫০ তলায় পৌঁছালে তৃতীয় জনের পালা এলো। সে বলল, আমার কাছে শুধু দুঃখের গল্প আছে। মন খারাপ করা বিষাদময় গল্প! তারা বলল, আল্লাহর নাম নিয়ে তুমি সেটাই বল। এরপর অন্তত আমরা রুমে পৌঁছে শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। অতঃপর সে এমন সব মন খারাপ করা গল্প বলা শুরু করল, যা শুনলে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌখিন বাদশা ও ক্ষমতাশীল রাজাদের জীবনও দুর্বিষহ মনে হবে!
অবশেষে তারা প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে যখন ৭৫ তলায় রুমের দরজার সামনে পৌঁছাল, তখন সে বলল, এখন আমি তোমাদেরকে সর্বশেষ এবং আমার জীবনের সবচেয়ে বিষাদময় গল্পটি বলব। গল্পটি হ’ল, আমরা আমাদের রুমের চাবি রিসিপশনে ফেলে এসেছি!
এটা শোনার পর তারা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
গল্পটি যেন অপরিণামদর্শী মানুষের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। একজন তরুণ জীবনের প্রথম ২৫ বছর আনন্দে মেতে থাকে। মজা করে, ফূর্তি করে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করে। এরপর জীবনের দ্বিতীয় ২৫ বছরে সে সংসার শুরু করে, সন্তানদের বড় করে, জীবিকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। এভাবে সে পঞ্চাশ বছর বয়সে পৌঁছায়।
এরপর শেষ ২৫ বছরে তার জীবনের কষ্টকর অধ্যায় শুরু হয়। হরেক রকম দুঃখ-দুশ্চিন্তা মাথায় ভীড় জমায়। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রতিনিয়ত বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনদের বিদায়ে একাকিত্ব তাকে ঘিরে ধরে। জীবন তখন সুঁচের অগ্রভাগের ন্যায় সংকীর্ণ মনে হয়।
এভাবে যখন সে জীবনের একবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছায়, শরীরে নানা অসুখ বাসা বাঁধে, এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে হয়, সন্তানদের চিন্তাও বেড়ে যায়, কেউ ভাই-বোনের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, কেউ ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে, পরিবারের সুখের জন্য সব কিছু উজাড় করে দেয়। কিন্তু সুখের লাভ হয় না। মরীচিকার ন্যায় দৃষ্টির প্রান্তসীমায় কেবল চিকচিক করে। অবশেষে যখন মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়, তখন সে বুঝতে পারে, প্রকৃত সুখের চাবিটি সে জীবনের প্রথম ভাগেই ফেলে এসেছে! যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে অফুরন্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে আল্লাহর পথে চলেনি। যৌবনের উন্মাদনা তাকে জীবনযাত্রা শেষের করুণ পরিণতি সম্পর্কে ভুলিয়ে রেখেছিল। ফলে আখিরাতের জন্য কোনই প্রস্ত্ততি তার নেই!
অতঃপর ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে শূন্য হাতে দাঁড়িয়ে আফসোস করে বলতে থাকবে, ‘যদি আমি একবার (দুনিয়ায়) ফিরে যেতে পারতাম, তাহ’লে আমি সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হ’তাম’ (যুমার ৩৯/৫৮)।
কিন্তু তখন আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না...
মূল : মুহসিন জববার; অনুবাদ : নাজমুন নাঈম
[সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাবি শাখা]