পিতার দেওয়া দায়িত্ব

দেলোয়ার হোসাইন 314 বার পঠিত

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। উত্তরবঙ্গের হাড় কাঁপানো শীতে তিন বছর পর গ্রামে এসেছি। দীর্ঘ দিন বাড়ীতে আসা হয়নি। সবশেষ অনার্স থার্ড ইয়ারে থাকাকালীন এসেছিলাম। তারপর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বয়সের দৈর্ঘ্য। বয়সের সাথে সমানুপাতিক হারে বেড়েছে ব্যস্ততা। বেড়েছে ভাল-মন্দ পার্থক্য করার ক্ষমতা। কিন্তু সেই ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করে কেন জানি মন্দটাকেই বেছে নিয়েছি সব সময়। তবু আল্লাহর রহমতে পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখেই ছিলাম আলহামদুলিল্লাহ

পরিকল্পনা ছিল এবার শীতের শেষে সবাইকে নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে যাব। সেই সাথে বাড়ীতেও কয়েক দিন কাটাব। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। তাই প্রচন্ড শীতের মাঝেই ছোটবেলার স্মৃতি জড়ানো আপন নীড়ে ফিরে এসেছি। সর্বশেষ বাড়ী এসেছিলাম বাবার সাথে পুত্রের পরিচয় নিয়ে। আর আজ বাবা এসেছেন আমার সাথে ওপারের যাত্রী হয়ে। পৃথিবীর চিরায়ত নিয়মে এভাবেই দায়িত্বের পালাবদল হয়।

দিন দুয়েক আগেও যে মানুষটার পরিচয় ছিল এ আর শিকদার। এখন তার পরিচয় দুই অক্ষরের লাশ। ছোটবেলায় দেখতাম, বাড়ীতে লোকেরা বাবার খেঁাজ করতে আসলে জিজ্ঞেস করত শিকদার ছাহেব বাড়ীতে আছেন? আর আজ সবাই এসে প্রশ্ন করছেন, লাশ কোথায়? এই বিশাল দোতলা বাড়ীর মালিক এখন থেকে পশ্চিম পাড়ার বঁাশ তলার পাশে বাবলা গাছের নিচে থাকবে! এটাই নাকি বাবার স্থায়ী ঠিকানা।

আমার বুকের ভেতর বারবার ডুকরে উঠছে। দু’চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। এই তীব্র শীতে বাবা কীভাবে এখানে থাকবে! আমার ছেলেটা ঘুমাচ্ছে। রেবেকা মার সাথে। বাবুর মুখটা শুকিয়ে গেছে। আমি তো সব বুঝেও নিজেকে সংবরণ করতে পারছিনা। সে কীভাবে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারানোর ব্যথা সহ্য করবে!

বছর দেড়েক আগে একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই বলল, জানো আববু, আমার প্রথম বন্ধু হ’ল দাদু। আর দাদুর শেষ বন্ধু হ’লাম আমি। তাই কবরে দাফন করে সবাই চলে আসলেও ও বন্ধুকে ফেলে আসেনি। বলে, আমি বন্ধুর সাথেই থাকব। অশ্রুসিক্ত নয়নে দেখলাম, কাঁচা-পাকা বাঁশের বেড়ার ফালি ধরে আমার ছয় বছরের ছেলেটা দঁাড়িয়ে আছে। ছোট্ট চোখ দু’টি ফ্যালফ্যাল করে ধূসর মাটির দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে নাকি মাকে গিয়ে বলেছে, ‘দাদি, দাদি, দাদু কি আর আমাদের সাথে যাবে না? বাবাকে লুকিয়ে আমাকে আইসক্রিম কিনে দেবে না’? মা কেঁদে কেঁদে এখন নীরব, নিস্তব্ধ পাথর হয়ে গেছে।

এসব ভাবতে ভাবতেই জালালুদ্দীন কাকা ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, কান্দিস না বাপ। মানুষ যাওনের লেগ্যগাই আহে। মানুষ শুধু যায় আর আসে। এভাবেই পৃথিবীর পালাবদল ঘটে। মহান প্রভু এই আসা-যাওয়ার মিছিলেই মাখলুকের দ্বারা তাঁর দ্বীন ও যমীনের আবাদ করিয়ে নেন। মন খারাপ করিস না। বেশী বেশী দো‘আ কর।

দিন পাঁচেক পর মা, রেবেকা আর বাবুকে রেখেই কর্ম জীবনে ফিরে এলাম। ব্যস্ত এই শহরটা আর দশ দিনের মতোই ছিল। হয়তোবা নতুন বছরের আগমনে চাঞ্চল্য আরো বেড়েছে। শফীক, মামূন আর ছিয়াম ছাহেবদের কাছে এই শহরটা হয়তো অন্য আর দশটা দিনের মতোই। শুধু আমার কাছেই শূন্যতায় ভরা। ডেস্কের চায়ের কাপটা, গোছানো সেই হিসাব-নিকাশের ফাইলগুলো কিংবা বাবার গল্পের সাথী অতিমাত্রায় পান খেকো দারোয়ান আব্দুল মতীন মিয়াও ব্যস্ত নিজ কাজে। সবাই নিজ অক্ষে পূর্বের ন্যায় ঘূর্ণায়মান। সবকিছুই আগের মতোই আছে। শুধু আমার বাবাই নেই!

পরশু ব্যালকনিতে আনমনে বসে স্মৃতিগুলো হাতড়াচ্ছিলাম। শুনেছি, মানুষ নাকি স্মৃতিকাতর। স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝে নিজের অস্তিত্ত্বের জানান দিয়ে কখনো সুখ সাগরে ভাসিয়ে দেয় আবার কখনো দুঃখের অতল তলে তলিয়ে দেয়। বাবা এখানেই বসতেন। আমার ছেলের সাথে ফুলের টবগুলোতে পানি দিতেন। অনেকটা সময় এখানে কাটাতেন। কখনো ডায়েরীর সাথে তো, কখনো হাদীছ কিংবা ধর্মীয় কোন বই নিয়ে। ডায়েরীটির অবস্থা এখন প্রভুহীন ভৃত্যের ন্যায়। চার তাকের আলমারীর শিখরে এখন তার স্থান। নিঃসঙ্গ পড়ে আছে বাবার শেষ ব্যবহৃত কলমটি।

হঠাৎ মা এসে বলল, বাপ কী করিস? কিছু না, মা। এমনি একটু বসে আছি। তোর বাবাও ঠিক এমন ছিলেন। মন খারাপ থাকলে একাকী স্রষ্টার সাথে কথা বলতেন। বলতেন, আমাকে সবচাইতে বেশী ভালবাসে আমার আল্লাহ। পৃথিবীর কেউ আমার সাথে মৃত্যুর পর থাকবে না। থাকবে আমার আল্লাহর রহমত। মনে রাখিস, আল্লাহ যাকে ভালবাসেন, তার আর কিছুই দরকার নাই।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে স্মৃতির পাতায় নোঙ্গর ফেলে বলতে শুরু করলেন, তখন তোর আববার পোস্টিং কুমিল্লাতে। আসলে সরকারী চাকুরীজীবীদের পার্মানেন্ট কোন আড্রেস হয় না। আজ টেকনাফ, তো কাল তেঁতুলিয়া। তোর বাবার বদলির পুরো ধকল যেতো আমার উপর দিয়ে। ভাগ্যিস তোর দাদা-দাদী সাথে থাকত! যদিও যেলা চিফ প্রকৌশলীর সহধর্মিনী হিসাবে সবজায়গাতেই বেশ সমাদর পেতাম। আমার কষ্ট দেখে তোর দাদা বলত, বউমার অনেক কষ্ট হয়ে যায়। একটা কাজের মেয়ে রাখনা! তোর আববা বলতেন, মানুষ কাজ করবে। এটা তার দেখতে কষ্ট লাগে। তাই আমিও জোরাজুরি করিনি।

কুমিল্লা যাওয়ার ছয় মাস পরই তুই পেটে আসিস। তখন তোর বড় বোনের বয়স মাত্র ২ বছর। ও সবসময় তোর দাদির কাছে থাকত। তাই শুরুতে ভালই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম। ফলে না চাইতেও একটা কাজের মেয়ে নিতে হ’ল। পাশের ফ্লাটের মারিয়াম ভাবীকে বলেছিলাম। উনি একদিন সকালে দশ-এগার বছর বয়সের একটা মেয়েকে নিয়ে এলেন। তোর বাবা কোনভাবেই এত ছোট মেয়েকে দিয়ে কাজ করাবেন না। শেষে না করতে হ’ল।

তিন দিন পর সকালে তোর বাবা নাশতা করছিল। হঠাৎ মেয়েটা এসে হাযির। মেয়েটার নাম কুলছুম। এসে বলল, ‘আমার বাপ-মা নাই। বাপ এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। আর মা অন্য জায়গায় বিয়ে করে চলে গেছে। থাকি মামা বাড়ী। মামী কইছে, কাম না করলে বিয়া দিয়া দিব। আপনে আমার বাপের লাহান। আমারে কাজটা দেন, স্যার’! তোর বাবা আর নাশতা শেষ করলেন না। আমার দিকে ইশারা করে চলে গেলেন। মেয়েটা সেদিন থেকে কাজ শুরু করল।

ওর কাজের বিষয়টা আমারও খারাপ লাগত। কিন্তু আমি অসুস্থ ছিলাম। মাস ছয়েক পর তোর বাবাকে বলে স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। সকালে টুকটাক হেল্প নিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিতাম। ভালই চলছিল। হঠাৎ একদিন শুনলাম মেয়েটার বিয়ে। আমি, তোর দাদা-দাদী আকাশ থেকে পড়লাম। তোর বাবা অনাধিকার চর্চায় বিশ্বাসী না। তবুও আমার কথায় ওর মামাকে বোঝাতে গেলেন। কিন্তু কোন লাভ হ’ল না। অল্প সময়েই মেয়েটা আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিল।

পরের শীতেই আমরা চলে আসি। নতুন শহরে নতুন ব্যস্ততায় পুরাতন সব স্মৃতি হারিয়ে যায়। কুলছুমের কথাও আর কারো মনে পড়ে না। কিন্তু বছর দেড়েক আগে তোর বাবার কাছে অপরিচিত নম্বর থেকে একটা ফোন আসে। রিসিভ করলে বলল, ‘স্যার! আমি কুমিল্লা প্রকৌশল অফিস থেকে বলছি। স্যার! এখানে এক মহিলা আজ দুই মাস যাবৎ আপনাকে খুঁজছে’।

প্রথমে তোর বাবা বুঝে উঠতে পারেননি। স্মৃতিগুলো হারিয়ে গেছে। যেভাবে কাঁচা চুল শুভ্র চুলের আধিক্যে হারিয়ে যায়। তোর বাবা পরিচয় জানতে চাইলে ভদ্রলোক বলেন, ‘স্যার! মহিলাকে নাকি আপনি চেনেন এবং খুব ভালবাসেন। আমি কয়েকবার বলেছি, চলে যাও! কিন্তু সে যাবে না। ঠিকানা তো জানিনা। খালি নাম বলেছে কুলছুম। যতবারই যেতে বলি, ততবারই শুধু কেঁদে বুক ভাসায়। শেষে না পেরে আপনার খেঁাজ করে কল দিলাম। বাকিটা আপনার ব্যাপার’।

তোর বাবার তখন শ্বাসকষ্টটা বেশ বেড়েছিল। তুই বা আমি কেউই জানলে হয়তো যেতে দিতাম না। তাই আমাকে বলেছিল, তোর ছিদ্দীক চাচা ডেকেছে তাই যাচ্ছে। তাহ’লে তুমি জানলে কীভাবে?

দুঃখের সাগরে আমাকে একা রেখে যাওয়ার কদিন আগেই বলেছিলেন। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, তার সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই যাবার পূর্বে এতটুকু বলে তোর নামে এই কাগজটা রেখে গিয়েছেন। বলেছিল, তার চলে যাওয়ার পরই যেন তোকে দেই এবং আমি নিজেও যেন না দেখি। স্ত্রীর প্রতি এটাই তার শেষ আদেশ। এই বলে মা চলে গেল। বাবার হাতের অঁাচড়। ছোট্ট ছোট্ট কালো হরফগুলো সাদা পাতার উপরে জ্বলজ্বল করছে। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসছে। সোয়েটারের হাতাতে অশ্রু মুছে পড়তে আরম্ভ করলাম।

‘হে আমার কলিজার টুকরা! আমাকে হয়তোবা চোখে হারাচ্ছো! হয়তো এখন আর অফিস থেকে বাসায় ফিরে মাকে বল না, বাবা আর বাবু কই? উত্তরে তোমার মাও হয়তো বলেনা, তোর বাবা আর বাবু মাগরিবের ছালাতে গেছে। সপ্তাহে দু’দিন হয়তো ইনহিলারটা চেক কর না। হয়তো আমার নয়নের মণি ছোট্ট নাতিটাকে, এই বলে বকা দাওনা যে, আববু! দাদুকে বেশী বিরক্ত করবে না। জুম‘আ কিংবা ঈদের ছালাতের জায়নামায তোমাকে আর দু’টো নিতে হয় না। হয়তো একাই চলছ নশ্বর ধরণীতে। মনে রেখ, ধরণীতে যাওয়া আসার এই পালাক্রমে তোমাকে একাই থাকতে হবে।

মানুষ চলে যায়। কিন্তু তার সৎ কর্মগুলো থেকে যায়। তুমি আমার ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ। ধরণীতে এমন কিছু সৎ কাজ সম্পাদন করতে হয়, তা যেন কোন কাকপক্ষীও টের না পায়। কেবল আল্লাহই দেখবেন এবং তিনিই এর প্রতিদান দিবেন। হে আমার কলিজার টুকরা! বছর খানেক ধরে আমি একটা মহৎ কাজ হাতে নিয়েছি। আমি চাই, আমার পরে এ কাজের আঞ্জাম তুমি দিতে থাকবে। এটা তোমার পিতার অনুরোধ নয়, আদেশ। আমার মৃত্যুর পর তোমার ছিদ্দীক চাচার কাছে যাবে। উনি তোমাকে একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দিবেন। সেটাতে প্রতি মাসে পূর্ব নির্দিষ্ট একটা এমাউন্ট পাঠাবে। কখনো জানতে চেষ্টা করবেনা, এটা কার, কোথায়, কার কাছে আমি এ টাকা পাঠাচ্ছি। মনে রেখ, ইহকালীন কর্মের উপর পরকালীন সুখ-শান্তি নির্ধারিত হয়। তাই ইহকালীন সময়টাকে শুধুই স্রষ্টার জন্য বরাদ্দ কর’। ইতি, তোমার বাবা!

আজ ছ’বছর হয়ে গেল। আমি আমার পিতার আদেশ পালন করে চলেছি। পাপে ভরা জীবনে এটাই হয়তো একমাত্র ভাল কাজ। হয়তো বাবার দেওয়া এই দায়িত্ব পালনের বিনিময়েই আল্লাহ আমাকে রহম করবেন। আজও জানিনা, কোথায় আর কেন এই টাকা পাঠাই। জানার চেষ্টাও করিনি। প্রদর্শনের এই পৃথিবীতে একটা ভাল কাজ থাক না লোকচক্ষুর অন্তরালে, নিজের থেকেও গোপন।

[লেখক : একাদশ শ্রেণী, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল এ্যান্ড কলেজ/



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও