তাওহীদুল ইবাদাত
ড. আবু আমীনা বিলাল ফিলিপ্স
আসাদুল্লাহ আল-গালিব 11930 বার পঠিত
কবরের ফেৎনা বা পরীক্ষা :
প্রত্যেক ব্যক্তি কবরের ফেৎনা বা পরীক্ষার সম্মুখীন হ’তে হবে সে সমাহিত হোক বা না হোক। কেননা কবর অর্থ মৃত্যুর পরবর্তী বারযাখী জীবন। যা দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে থাকে’।[1] এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুঃসহ ব্যাপার। নিম্নে বারযাখী জীবনে পরীক্ষার কিছু নমুনা ও তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়সমূহ কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে তুলে ধরা হ’ল।
আল্লাহর পথে পাহারাদার :
যে ব্যক্তি আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার সন্তুষ্টির নিমিত্তে তার রাহে কোন মুসলিম জনপদ পাহারা দেয় সে ব্যক্তি কবরের বারযাখী জীবনে পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়। এ সম্পর্কে হাদীছ,
عَنْ سَلْمَانَ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ رِبَاطُ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ خَيْرٌ مِنْ صِيَامِ شَهْرٍ وَقِيَامِهِ وَإِنْ مَاتَ جَرَى عَلَيْهِ عَمَلُهُ الَّذِى كَانَ يَعْمَلُهُ وَأُجْرِىَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ وَأَمِنَ الْفَتَّانَ-
হযরত সালমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, একটি দিবস ও একটি রাতের সীমান্ত পাহারা একমাস ছিয়াম পালন এবং ইবাদতে রাত জাগার চাইতেও উত্তম। আর যদি এ অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে, তাতে তার এ আমলের ছওয়াব জারী থাকবে। আর তার (শহীদসূলভ) রিযিক অব্যহত রাখা হবে এবং সে ব্যক্তি ফেৎনাবাজদের থেকে নিরাপদে থাকবে’।[2]
অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে,
عَنْ فَضَالَةَ بْنِ عُبَيْدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ كُلُّ مَيِّتٍ يُخْتَمُ عَلَى عَمَلِهِ إِلَّا الَّذِي مَاتَ مُرَابِطًا فِي سَبِيلِ اللَّهِ، فَإِنَّهُ يُنَمَّى لَهُ عَمَلُهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَيَأْمَنُ فِتْنَةَ الْقَبْرِ-
হযরত ফাযালা বিন উবাইদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (ছাঃ) বলেছেন, প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির সকল প্রকার কাজের উপর সীলমোহর করে দেওয়া হয়। কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় পাহারারত অবস্থায় যে লোক মৃত্যুবরণ করে ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার কাজের ছওয়াব বাড়ানো হবে এবং সে সকল প্রকার ফেৎনা থেকে নিরাপদে থাকবে’।[3]
আবু আব্দুল্লাহ আল-কুরতুবী (রহঃ) বলেন, পাহারা শুধুমাত্র আল্লাহর পথেই হ’তে হবে। হোক সেটা উট পাহারা বা সীমানা পাহারা কিংবা ঘোড়া বা পদব্রজে পাহারা’।[4]
আল্লাহর পথে শহীদ :
আল্লাহর পথে শহীদ ব্যক্তিও কবরের ফেৎনা থেকে পরিত্রাণ পায়। এ সম্পর্কে হাদীছ,
عَنْ رَجُلٍ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ رَجُلاً قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا بَالُ الْمُؤْمِنِينَ يُفْتَنُونَ فِى قُبُورِهِمْ إِلاَّ الشَّهِيدَ قَالَ كَفَى بِبَارِقَةِ السُّيُوفِ عَلَى رَأْسِهِ فِتْنَةً-
নবী করীম (ছাঃ)-এর এক ছাহাবী হ’তে বর্ণিত, এক ছাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! শহীদ ব্যতীত অন্যন্য মুমিনগণ কবরের ফেৎনার সম্মুখীন হবে, এর কারণ কি? তিনি বললেন, তার মাথার উপর তরবারির ঝলক তাকে কবরের ফেৎনা থেকে নিরাপদে রাখবে’।[5]
ইবনুল কাইয়ুম (রহঃ) বলেন, এই হাদীছে মাথার উপর তরবারির ঝলক’-এর প্রকৃত অর্থ আল্লাহই ভাল জানেন। এর দ্বারা সে তার ঈমান থেকে মুনাফিকী দূর করেছে। ফলে ঈমান থেকে তার বিচ্যুতি ঘটেনি। যদি সে মুনাফিক হ’ত তাহ’লে সে যুদ্ধের মাঠে যেত না। সুতরাং এটা প্রমাণিত হয় যে, সে তার ঈমানের মযবুতির উপর টিকে থেকে আল্লাহর জন্য ও সত্যকে প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে তার আত্মাকে উৎসর্গ করেছে’।[6]
জুম‘আর দিনে বা রাতে মৃত্যুবরণকারী :
কোন ব্যক্তি জুম‘আর দিনে মৃত্যুবরণ করে তাহ’লে ঐ ব্যক্তি কবরে ফেৎনা থেকে রক্ষা পাবে। এ সম্পর্কে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَمُوتُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوْ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ إِلَّا وَقَاهُ اللَّهُ فِتْنَةَ الْقَبْرِ-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (ছাঃ) বলেছেন, জুম‘আর দিনে অথবা রাতে কোন মুসলমান ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, তাহ’লে কবরে শাস্তি থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন’।[7]
সত্যবাদী ব্যক্তি :
যারা সত্যবাদী তাদের কবরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কি না এ বিষয়ে মতনৈক্য রয়েছে। তবে অগ্রাধিকারযোগ্য মত হ’ল, যেহেতু রাসুল (ছাঃ) সাধারণভাবে বলেছেন,إِذَا قُبِرَ الْمَيِّتُ أَتَاهُ مَلَكَانِ أَسْوَدَانِ أَزْرَقَانِ يُقَالُ لِأَحَدِهِمَا الْمُنْكَرُ وَالْآخَرُ النَّكِيرُ- ‘মৃত্যু লোককে বা তোমাদের কাউকে যখন কবরের মধ্যে রাখা হয়, তখন কালো বর্ণের এবং নীল চোখ বিশিষ্ট দু’জন ফেরেশতা তার নিকট আসেন। তাদের মধ্যে একজনকে মুনকার অপরজনকে নাকীর বলা হয়’।[8]
ইবনুল কাইয়ুম (রহঃ) বলেন, ছহীহ হাদীছ সমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, নিশ্চয় সত্যবাদীদের কবরে জিজ্ঞাসা করা হবে যেমন অন্যরা জিজ্ঞাসিত হয়’।[9]
শিশু ও পাগলদের কবরে ফেৎনা :
শিশু ও পাগল ব্যক্তি তারা কবরের জীবনে ফেৎনার সম্মুখীন হবে কি না; এ বিষয়ে কিছু বিদ্বান যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, জ্ঞানবান ব্যক্তিরাই শুধুমাত্র পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে। ফলে শিশু ও পাগলদের কবরের ফেৎনা থেকে উর্ধ্বে থাকবে’।[10]
মোদ্দাকথা হ’ল, ছহীহ হাদীছের বর্ণনামতে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির কবরে এমনটা ঘটবে। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রহঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে এমন এক নিষ্পাপ নবজাত শিশুর জানাযায় বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, اَللَّهُمَّ قِه عَذَاب الْقَبْرِ হে আল্লাহ! তুমি তাকে কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা কর’।[11] অন্যত্র বলা হয়েছে, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রহঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর পিছনে এমন একটি শিশুর জানাযা পড়েছি, যে শিশু কখনও পাপ করেনি। আমি তাকে বলতে শুনেছি, اَللَّهُمَّ أَعذْهُ من عَذَابِ الْقَبْرِ হে আল্লাহ! তুমি তাকে কবরের আযাব হ’তে বাঁচাও’।[12]
পূর্ববর্তী উম্মতের কবরের ফেৎনা :
মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا طَائِرٍ يَطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلَّا أُمَمٌ أَمْثَالُكُمْ مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ يُحْشَرُونَ- ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল সকল প্রাণী এবং দু’ডানায় ভর করে আকাশে সন্তরণশীল সকল পাখি তোমাদেরই মত একেকটি সম্প্রদায়। (তাদের হেদায়াতের বিষয়ে) কোন কিছুই আমরা এই কিতাবে বলতে ছাড়িনি। অতঃপর তাদের সকলকে তাদের প্রতিপালকের কাছে সমবেত করা হবে’ (আনফাল ৬/৩৮)।
মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা অন্যত্র বলেন, وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا- ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার পিছে পড়ো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও হৃদয় প্রত্যেকটির বিষয়ে তোমরা (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হবে (বনু ইস্রাঈল ১৭/৩৬)।
ইবনু কাইয়ুম (রহঃ) বলেন, প্রত্যেক নবীর উম্মত কবরের ফেৎনার সম্মুখীন হবেন। নিশ্চয় তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের পর কবরে শাস্তি দেওয়া হবে। তারপরও আল্লাহ এ বিষয়ে অধিক অবগত’।[13]
কবরে কাফের-মুনাফিকদের অবস্থা :
মহান আল্লাহ বলেন,فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ- ‘অতঃপর আমরা যাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করা হয়েছিল তাদেরকে এবং রাসূলগণকে অবশ্যই (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসাবাদ করব’ (আরাফ ৭/৬)।
যেহেতু কাফেরদেরকে কিয়ামতের দিন আল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, সেহেতু তাদেরকেও কবরের ফেৎনার সম্মুখীন হ’তে হবে’।[14] এ বিষয়ে স্পষ্টত হাদীছে বলা হয়েছে,
عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا وُضِعَ فِي قَبْرِهِ وَتَوَلَّى عَنْهُ أَصْحَابُهُ وَإِنَّهُ لَيَسْمَعُ قَرْعَ نِعَالِهِمْ أَتَاهُ مَلَكَانِ فَيُقْعِدَانِهِ، فَيَقُولَانِ مَا كُنْتَ تَقُولُ فِي هَذَا الرَّجُلِ؟ لِمُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَمَّا الْمُؤْمِنُ فَيَقُولُ أَشْهَدُ أَنَّهُ عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ فَيُقَالُ لَهُ انْظُرْ إِلَى مَقْعَدِكَ مِنَ النَّارِ، قَدْ أَبْدَلَكَ اللَّهُ بِهِ مَقْعَدًا مِنَ الْجَنَّةِ، فَيَرَاهُمَا جَمِيعًا. وَأَمَّا الْمُنَافِقُ وَالْكَافِرُ فَيُقَالُ لَهُ مَا كُنْتَ تَقُولُ فِي هَذَا الرَّجُلِ؟ فَيَقُولُ لَا أَدْرِي كُنْتُ أَقُولُ مَا يَقُولُ النَّاسُ فَيُقَالُ لَا دَرَيْتَ وَلَا تَلَيْتَ وَيُضْرَبُ بِمَطَارِقَ مِنْ حَدِيدٍ ضَرْبَةً، فَيَصِيحُ صَيْحَةً يَسْمَعُهَا مَنْ يَلِيهِ غَيْرَ الثَّقَلَيْنِ-
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, বান্দাকে যখন কবরে রাখা হয় এবং তার সাথী-সঙ্গীগণ সেখান থেকে ফিরতে থাকে, আর তখনও সে তাদের জুতার শব্দ শুনতে পায়। এমতাবস্থায় তার নিকটে দু’জন ফেরেশতা আসেন ও তাকে উঠিয়ে বসান। অতঃপর তাকে বলেন, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কী বলতে? অর্থাৎ মুহাম্মাদ সম্পর্কে (রাবীর ব্যাখ্যা)। তখন সে ব্যক্তি মুমিন হ’লে বলে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ইনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তখন তাকে বলা হয়, তাকিয়ে দেখ জাহান্নামে তোমার স্থান। ঐটার বদলে আল্লাহ তোমার জন্য জান্নাতে স্থান নির্ধারণ করেছেন। ঐ ব্যক্তি তখন দু’টি স্থানই দেখে।
অতঃপর মুনাফিক ও কাফির তথা কপট বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী ব্যক্তিকে বলা হয়, তুমি এই ব্যক্তি সম্পর্কে কী বলতে? তখন সে বলে, আমি জানি না। তার সম্পর্কে আমি তাই-ই বলতাম যা লোকেরা বলত। এ সময় তাকে বলা হয়, বেশ কথা। তুমি বিবেক দ্বারাও বুঝনি, পড়েও শেখনি। অতঃপর তাকে লোহার হাতুড়ি দিয়ে ভীষণ জোরে পিটানো হ’তে থাকে। তাতে সে এমন জোরে চীৎকার করতে থাকে যে, জিন ও ইনসান ব্যতীত আশপাশের সবাই তা শুনতে পায়’।[15]
কবরে রূহের প্রত্যাবর্তন :
রূহ হ’ল আল্লাহ তা‘আলার একটি সৃষ্ট বস্ত্ত। যা মানুষের অভ্যন্তরে অদৃশ্য আকারে থাকে। একজন মানুষের নির্ধারিত বয়সসীমা শেষ হ’লে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত অথবা শাস্তির ফেরেশতার দ্বারা ঐ ব্যক্তির রূহ কবয করা হয়ে থাকে। অতঃপর কবরের বারযাখী জীবনে দু’জন ফেরেশতার প্রশ্নোত্তরের সময় ঐ ব্যক্তির নিকট পুনরায় রূহ সঞ্চারিত হয় তবে তা দুনিয়ার জীবনের মত নয়।
এ বিষয়ে বারা ইবনু আযেব (রাঃ) বলেন, আমরা একবার রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে আনছারীদের মধ্যে এক ব্যক্তির জানাযায় গেলাম। আমরা কবরের নিকট গেলাম; কিন্তু তখনও কবর খোঁড়া হয়নি। তখন রাসূল (ছাঃ) বসলেন এবং আমরাও তাঁর আশেপাশে বসলাম, যেমন আমাদের মাথায় পাখি বসেছে, (অর্থাৎ, চুপচাপ)। তখন রাসূলের হাতে একটি কাঠের টুকরা ছিল, যা দ্বারা তিনি (চিন্তিত ব্যক্তিদের ন্যায়) মাটিতে দাগ কাটছিলেন। অতঃপর তিনি মাথা উঠালেন এবং বললেন, আল্লাহর নিকট কবর আযাব হ’তে পানাহ চাও। তিনি এটা দুই কি তিন বার বললেন।
অতঃপর বললেন, মু‘মিন বান্দা যখন দুনিয়াকে ত্যাগ করতে এবং আখেরাতের দিকে অগ্রসর হ’তে থাকে, তখন তার নিকট আসমান হ’তে উজ্জ্বল চেহারাবিশিষ্ট একদল ফেরেশতা আসেন, যাদের চেহারা যেন সূর্য। তাদের সাথে জান্নাতের কাফনসমূহের একটি কাফন থাকে এবং জান্নাতের খোশবুসমূহের এক রকম খোশবু থাকে। তাঁরা তার দৃষ্টিসীমা থেকে দূরে বসেন। অতঃপর ‘মালাকূল মাউত’ আযরাঈল (আঃ) তার নিকটে আসেন এবং তার মাথার নিকটে বসে বলেন, হে পবিত্র রূহ! বের হয়ে এস আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তোষের দিকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তখন তার রূহ বের হয়ে আসে যেমন মশক হ’তে পানি বের হয়ে আসে। তখন আযরাঈল (আঃ) তাকে গ্রহন করেন এবং এক মুহূর্তের জন্যও নিজের হাতে রাখেন না; বরং ঐ সকল অপেক্ষমান ফেরেশতা এসে তাকে গ্রহণ করেন এবং তাকে ঐ কাফন ও ঐ খোশবুতে রাখেন। তখন তা হ’তে পৃথিবীতে প্রাপ্ত সমস্ত খোশবু অপেক্ষা উত্তম মেশকের খোশবু বের হ’তে থাকে।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, তাকে নিয়ে ফেরেশতাগণ উপরে উঠতে থাকেন এবং যখনই তারা ফেরেশতাদের মধ্যে কোন ফেরেশতাদলের নিকট পৌঁছেন তারা জিজ্ঞেস করেন, এই পবিত্র রূহ কার? তখন ফেরেশতাগণ দুনিয়াতে তাকে লোকেরা যে সকল উপাধি দ্বারা ভূষিত করত, সে সকলের মধ্যে উত্তমটি দ্বারা ভূষিত করে বলেন, এই হ’ল অমুকের পুত্র অমুকের রূহ, তারা তাকে নিয়ে প্রথম আসমান পর্যন্ত পৌঁছেন (এইরূপ প্রশ্নোত্তর চলতে থাকবে)। অতঃপর তারা আসমানের দরজা খুলতে চান, আর অমনি তাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়। তখন প্রত্যেক আসমানের সম্মানিত ফেরেশতাগণ তাদের পশ্চাৎগামী হন। উহার উপরে সপ্তম আসমান পর্যন্ত পৌঁছেন।
এ সময় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দার ঠিকানা ‘ইল্লিয়ীনে’ লিখ এবং তাকে (তার কবরে) যমীনে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। কেননা, আমি তাদেরকে যমীন হ’তে সৃষ্টি করেছি এবং যমীনের দিকেই তাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করব, অতঃপর তার রূহ তার শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর তার নিকট দুইজন ফেরেশতা আসেন এবং তাকে উঠিয়ে বসান, তারপর তারা তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার রবব কে? তখন সে উত্তরে বলে, আমার রবব আল্লাহ!...।[16]
এ সম্পর্কে অপর একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضى الله عنه أَنَّهُ حَدَّثَهُمْ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا وُضِعَ فِى قَبْرِهِ وَتَوَلَّى عَنْهُ أَصْحَابُهُ وَإِنَّهُ لَيَسْمَعُ قَرْعَ نِعَالِهِمْ، أَتَاهُ مَلَكَانِ فَيُقْعِدَانِهِ فَيَقُولاَنِ... আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, বান্দাকে যখন কবরে রাখা হয় এবং তার সঙ্গী-সাথীগণ সেখান থেকে ফিরতে থাকে, আর তখনও সে তাদের জুতার শব্দ শুনতে পায়। এমতাবস্থায় তার নিকটে দু’জন ফেরেশতা আসেন ও তাকে উঠিয়ে বসান’...।[17]
মৃত্যুপরবর্তী সময়ে রূহের অবস্থান :
মৃত্যুর পর সৎ বান্দাদের রূহ ইল্লিয়ীনে এবং পাপীদের রূহ সিজ্জীনে অবস্থান করে’।[18] অতঃপর তাদের আমল অনুযায়ী তাদের রূহের উপর শান্তি অথবা শাস্তি প্রদান করা হয়’।[19]
মুমিনের আত্মা সম্পর্কে অপর এক হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّـمَا نَسَمَةُ الْمُؤْمِنِ طَيْرٌ تَعْلُقُ فِي شَجَرِ الْجَنَّةِ حَتَّى يُرْجِعَهُ اللَّهُ فِي جَسَدِهِ يَوْمَ يَبْعَثُهُ ‘মুমিনের রূহ জান্নাতী গাছের পাখির রূপ ধারণ করে থাকবে, ক্বিয়ামতের দিন তাদের স্বীয় শরীরে পুনঃস্থাপন করা পর্যন্ত’।[20]
অপর এক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِأَصْحَابِهِ إِنَّهُ لَمَّا أُصِيبَ إِخْوَانُكُمْ يَوْمَ أُحُدٍ، جَعَلَ اللَّهُ أَرْوَاحَهُمْ فِي جَوْفِ طَيْرٍ خُضْرٍ تَرِدُ أَنْهَارَ الْجَنَّةِ تَأْكُلُ مِنْ ثِمَارِهَا، وَتَأْوِي إِلَى قَنَادِيلَ مِنْ ذَهَبٍ مُعَلَّقَةٍ فِي ظِلِّ الْعَرْشِ فَلَمَّا وَجَدُوا مَأْكَلَهُمْ وَمَآثِرَهُمْ وَمُقِيلَهُمْ قَالُوا مَنْ يُبَلِّغُ إِخْوَانَنَا عَنَّا أَنَّا أَحْيَاءٌ فِي الْجَنَّةِ لِئَلَّا يَزْهَدُوا فِي الْجَنَّةِ وَلَا يَنْكُلُوا عِنْدَ الْحَرْبِ. قَالَ اللهُ تَعَالَى أَنَا أُبَلِّغُهُمْ عَنْكُمْ، فَأَنْزَلَ اللهُ تَعَالَى وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ... إلى أخر الآيات -
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, উহুদ যুদ্ধের দিন যখন তোমাদের ভাইয়েরা শহীদ হয়, মহান আল্লাহ তাদের রূহগুলোকে সবুজ রঙের পাখির মধ্যে স্থাপন করলেন। তারা জান্নাতের ঝর্ণাসমূহের উপর দিয়ে যাতায়াত করে, সেখানকার ফলমূল খায় এবং আরশের ছায়ায় ঝুলানো সোনার ফানুসে বসবাস করে। তারা যখন নিজেদের মনঃপূত খাবার, পানীয় ও বাসস্থান পেল, তখন বলল, কে আমাদের এ সংবাদ আমাদের ভাইদের নিকট পৌঁছে দিবে, আমরা জান্নাতের জীবিত আছি, এখানে আমাদেরকে নিয়মিত রিযিক দেয়া হচ্ছে! (এটা জানতে পারলে) তারা জিহাদে অমনোযোগী হবে না এবং যুদ্ধের ব্যাপারে অলসতা করবে না। অতঃপর মহান আল্লাহ বললেন, আমি তাদের নিকট তোমাদের এ সংবাদ পৌঁছে দিব। বর্ণনাকারী বলেন, মহান আল্লাহ এ আয়াত অবতীর্ণ করলেন, وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ ‘যারা আল্লাহর পথে নিহিত হয়েছে তোমরো তাদেরকে মৃত মনে করো না। প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত, তারা তাদের রবের নিকট নিয়মিত রিযিক পাচ্ছে’ (আলে ইমরান ৩/১৬৯)’। [21]
(ক্রমশ)
[লেখক : মাস্টার্স, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]
[1]. মাসিক আত-তাহরীক; মে‘১৬, ১৯তম বর্ষ, ৮তম সংখ্যা; মির‘আত ১/২১৭, ২২০।
[2]. মুসলিম হা/ ১৯১৩ (১৬৩)।
[3]. তিরমিযী হা/১৬২১; আবু দাঊদ হা/১২৫৮; মিশকাত হা/৩৮২৩।
[4]. আত-তাযকিরাতু বি আহওয়ালিল মাওত ও ঊমুরিল আখেরাহ ১/৪১৮ পৃ.।
[5]. নাসাঈ হা/২০৫৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৪৯৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৩৮০; হাদীছ ছহীহ।
[6]. আর রূহ-২২২ পৃ.।
[7]. তিরমিযী হা/১০৪৭; মিশকাত হা/১৩৬৭।
[8]. তিরমিযী হা/ ১০৭১; ইবনু মাজাহ হা/. মিশকাত হা/১৩০।
[9]. আর- রূহ পৃ.।
[10]. মাজমু‘ ফাৎওয়া -৪/২৮০ পৃৃৃৃ. ।
[11]. আস-সুন্নাহ ২/৫৯৬ পৃ.।
[12]. মুয়াত্তা মালেক হা/৬১০।
[13]. আর-রূহ পৃ.২৩৬ ।
[14]. আর-রূহ পৃ.২৩৩পৃ.।
[15]. বুখারী হা/১৩৭৪; মুসলিম হা/৭০ (২৮৭০); মিশকাত হা/১২৬ ।
[16]. আহমাদ হা/১৮৫৫৭; মিশকাত হা/১৬৩০।
[17]. বুখারী হা/১৩৭৪; মিশকাত হা/১২৬ ।
[18]. আহমাদ হা/১৮৫৫৭; মিশকাত হা/১৬৩০।
[19]. গাফের ৪০/৪৫-৪৬; আবুদাঊদ হা/৪৭৫৫; মিশকাত হা/১৩১।
[20]. নাসাঈ হা/২০৭৩; ইবনু মাজাহ হা/৪২৭১; মিশকাত হা/১৬৩২।
[21]. আবুদাঊদ হা/২৫২০; মিশকাত হা/৩৮৫৩।