সংগঠনের বিরোধিতা কেন?

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 2890 বার পঠিত

আধুনিক পশ্চিমা দর্শনে যে সকল মতবাদ বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হ’ল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। এই মতবাদ মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করে এবং প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে একচ্ছত্রভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর একটি সাধারণ ফলাফল হ’ল এমন যে, ব্যক্তি কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবতে শেখে এবং সমাজের প্রতি দায়বোধ থেকে মুক্ত থাকে। যাকে এক কথায় বলা যায় নির্ভেজাল আত্মকেন্দ্রিকতা। এই মতবাদে অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতার যে সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার যে পোক্ত ধারণা রোপণ করা হয়েছে, তা একটি আদর্শবাদী ও নৈতিকতাসম্পন্ন সমাজের জন্য উপযোগী নয়। বিশেষ করে মুসলিম সমাজে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কেননা ইসলামে মানুষের পারস্পরিক বন্ধন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এতে সর্বদা দায়িত্বশীলতা ও সামাজিকতাবোধকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। প্রত্যেকেই এখানে পরস্পরের প্রতি কিছু অধিকার ও দায়বোধের নিগড়ে আবদ্ধ, যেখানে স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার কোন জায়গা নেই। আর এভাবেই ইসলাম মানবতাবোধসম্পন্ন মানুষের জন্য অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা।

বলা বাহুল্য যে, মানুষের স্বভাবধর্ম হ’ল সামাজিকতা ও সংঘবদ্ধতা। ইসলাম এই স্বভাবধর্মকে লালন করার জন্য মুসলিম সমাজকে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। ইসলামের বুনিয়াদী ইবাদতসমূহ তথা ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত সবই যেন মানুষকে সংঘবদ্ধতা ও পরার্থপরতার প্রতি একেকটি বলিষ্ঠ আহবান। এজন্যই একজন মুসলমান কখনও সমাজবিচ্ছিন্ন হ’তে পারে না। সামাজিক দায়মুক্তও সে হ’তে পারে না। ফলে ইসলামও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকার করে বটে; কিন্তু পশ্চিমাদের দায়মুক্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ইসলামের দায়িত্বশীল ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও আত্মকেন্দ্রিকতার এই দর্শন নিয়ে আমাদের এই আলোচনার হেতু হ’ল সাম্প্রতিক সময়ে একদল ওলামায়ে কেরাম এবং সাধারণ মুসলমানদের মাঝে ইসলামী দল ও সংগঠন সম্পর্কে অগভীর কিছু চিন্তাধারার আবির্ভাব। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এমন চিন্তাধারা বিশেষ অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু যারা বিদ্বান ও বোদ্ধা হিসাবে সর্বমহলে সুপরিচিত তারা যখন এ বিষয়ে খাপছাড়া মন্তব্য করেন এবং দায়িত্বহীনভাবে ইসলামী দল ও সংগঠনকে সরাসরি ফিৎনা হিসাবে অভিহিত করেন, তখন সত্যিই গভীর হতাশা ও আফসোসের সৃষ্টি হয়। ইসলামের চিরন্তন সংঘবদ্ধতার ধারণার বিপরীতে তারা যে খোঁড়া বক্তব্য ও যুক্তি পেশ করেছেন তা নিছক নতুন মোড়কে পশ্চিমী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বহিঃপ্রকাশ। তাদের এই অবিবেচনাপ্রসূত ফৎওয়া প্রদান থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আপন গন্ডি ছাড়িয়ে তারা খুব কমই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারেন। ফলে অন্যের প্রচেষ্টা ও সংগ্রামকে তার স্বীয় অবস্থান থেকে কখনই মূল্যায়ন করতে পারেন না।

সত্যের পক্ষে সংগ্রামরত যেসব বিখ্যাত আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামের জিহাদী চেতনা জাগরুক রয়েছে সারাবিশ্বে এবং বিগত কয়েক শতাব্দীতে যে পদ্ধতিতে দ্বীনের দাওয়াতের প্রচার ও প্রসার হচ্ছে, তাকে এক লহমায় ফিৎনার কারণ বলে যারা আখ্যায়িত করতে পারেন, তারা সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে নিঃসন্দেহে অগভীর জ্ঞানের অধিকারী।

নিছক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কিংবা স্বার্থদুষ্ট হয়ে তারা যেভাবে পশ্চিমাদের মত আত্মকেন্দ্রিকতায় আবদ্ধ থাকাকে প্রাধান্য দেন, তাতে না থাকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, না থাকে সমাজ সংস্কারের আকুতি, আর না থাকে ইতিহাসের আহবান শোনার মত দূরদর্শিতা। বরং নিজেকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখার আত্মতৃপ্তিই যেন তাতে ঝরে পড়ে। একজন মুখলিছ দাঈ ইলাল্লাহর জন্য যেটা কখনই কাম্য নয়। 

পান্ডিত্যের একটি রোগ হ’ল সুশীলতা। সুশীলতা তখনই রোগ হয়ে যায়, যখন তা ব্যক্তিস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং  ঝুঁকিহীনতাকে পছন্দ করে। নিজেকে নিরাপদ জায়গায় রেখে সমাজ ও মানুষের উপর দায়িত্বহীনভাবে মতামত ব্যক্ত করে। সত্যকে সত্য ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলার মত সৎসাহস দেখাতে ভয় পায়। নিজের ভীরুতা, কাপুরুষতা এবং অক্ষমতাকে আড়াল করতে অন্যায্য পান্ডিত্য ও বিতর্কের আশ্রয় নেয়। আমাদের কিছু প্রাজ্ঞ ওলামায়ে কেরামও সম্ভবতঃ অনুরূপ রোগেই আক্রান্ত হয়েছেন। 

পৃথিবীর কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজই সংঘবদ্ধ হওয়া ছাড়া এককভাবে করা সম্ভব নয়। একক কোন ব্যক্তির পক্ষে একটি সভ্যতা গড়ে তোলা কখনও সম্ভব নয়। পৃথিবীতে যত সভ্যতা গড়ে উঠেছে, যত সংগ্রাম ও বিপ্লবের ইতিহাস রচিত হয়েছে সবকিছুর পিছনে ছিল একদল সুসংগঠিত মানুষের সংঘবদ্ধ প্রয়াস। সংগঠন হ’ল এই সংঘবদ্ধ প্রয়াসেরই আধুনিক নাম মাত্র। এটা যারা না বোঝেন কিংবা উৎকট স্বার্থবাদিতাদুষ্ট হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রগলভ কথাবার্তা বলেন, তারাই কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর সংগঠনের নাম কি ছিল কিংবা ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ কোন সংগঠন করতেন- এই ধরনের অতীব শিশুতোষ প্রশ্ন করতে পারেন। এ যেন ঠিক সেই বিদ‘আতীদের মতই মন্তব্য যারা বলে থাকেন, মুনাজাত যদি বিদ‘আত হয়, তবে ফ্যান-লাইটও তো বিদ‘আত। কেননা এগুলো রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে ছিল না। রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে নিঃসন্দেহে প্রচলিত আকার ও কাঠামোযুক্ত সংগঠন ছিল না, কিন্তু সংঘবদ্ধতা ছিল। যেমনভাবে প্রচলিত নিয়মের মাদরাসা শিক্ষা কাঠামো ছিল না, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। যুগের প্রয়োজনে শরী‘আতের মূলনীতি ঠিক রেখে রূপ-কাঠামো বদল হবে এটাই স্বাভাবিক। এতে অস্পষ্টতার কিছু নেই।

আধুনিক যুগে আরব বিশ্বের ওলামায়ে কেরাম দল ও সংগঠন বিষয়ে যে সকল ফৎওয়া দিয়েছেন, তা কেবল তাদের স্ব স্ব দেশ ও সমাজের জন্য প্রযোজ্য। সে সকল ফৎওয়া সর্বসময়ে, সর্বদেশে ও সর্বসমাজের জন্য প্রযোজ্য হবে এমন কোন আবশ্যকতাও নেই। এতদসত্ত্বেও তাঁদের ফৎওয়াসমূহ একত্রিত করে যারা তাদেরকে বিতর্কিত করতে চান এবং অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করতে চান, তারা নিঃসন্দেহে কোন সদুদ্দেশ্য পোষণ করেন না।

তারা রাসূল (ছাঃ)-এর জামা‘আতবদ্ধতার হাদীছগুলোকে কেবল একক ইমামভিত্তিক জামা‘আতের সাথে প্রযুক্ত করেন। অথচ তারা ভাল করেই জানেন যে, আজকের যুগে বিশ্বজুড়ে একক জামা‘আত থাকার কোন সুযোগ নেই। সেই যুগের তো অবসান হয়েছে ওছমান (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর থেকেই। কিন্তু তাই বলে কি জামা‘আতবদ্ধতার হুকুম সমূলে তিরোহিত হয়ে যায়? রাসূল (ছাঃ) কোন সফরে তিনজন একত্রিত হলেও যেখানে একজন আমীর নিয়োগ করতে বলেছেন, সেখানে ইসলামে সংঘবদ্ধতার রূপ ও প্রকৃতি অনুধাবনে মোটেও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। শায়খ উছায়মীন যথার্থই বলেন, ‘কিছু মানুষ মনে করেন যে, আজকের দিনে মুসলমানদের কোন ইমামও নেই, বায়‘আতও নেই। জানি না তারা কি চান যে, মানুষ বিশংখলভাবে চলুক এবং তাদের কোন নেতা না থাকুক? নাকি তারা চান যে এটা বলা হোক- প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের আমীর বা নেতা? (ইবনুল উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতি‘ ৮/৯)।

মোদ্দাকথা হ’ল, ইসলামী সমাজ কখনও নেতৃত্ববিহীন চলতে পারে না। সর্বযুগে, সর্বাবস্থায় এবং সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব আবশ্যক। বর্তমানে ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজকে দ্বীনের পথে পরিচালনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বে যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মপালনে কোন উৎসাহ প্রদান করা হয় না, সেখানে এই ধরনের জামা‘আতের কোনই বিকল্প নেই। নিঃসন্দেহে একক জামা‘আত সর্বোত্তম এবং শৃংখলাসাধনে সবচেয়ে ফলপ্রসূ। কিন্তু যুগের বাস্তবতায় অনেক সময় কোন স্থানে একাধিক বা অসংখ্য জামা‘আত হ’তেও পারে। সেমতবস্থায়ও সাধ্যমত তাক্বওয়া ও দ্বীনদারীর ভিত্তিতে সর্বাধিক উপযুক্ত জামা‘আতকে খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা যাবে না।

সর্বোপরি আলেমদের কেউ তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইজতিহাদী মত পেশ করতেই পারেন। সেটা তাঁদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু কারো আপত্তি ও পিছুটানের কারণে সমাজের বহমান কোন স্রোত থেমে থাকবে না। আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে পরিচালনার দায়িত্ব যে কাউকে দিয়ে, যেভাবে খুশী পালন করিয়ে নেবেনই। তাতে আমরা যুক্ত হব কি না, সেটাই হ’ল আমাদের সিদ্ধান্ত। সবাই যে সামনের সারির মুজাহিদ হবেন, একথা মোটেও সত্য নয়। কেউ না কেউ পেছনের সারিতে থাকতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। দিন শেষে যার যার আপন হিসাবই মুখ্য। নিজেকে দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বোচ্চ সফলদের কাতারে নিতে পারলাম কিনা সেটিই আমাদের মূল বিবেচ্য। আমাদের প্রতিটি কথা, প্রতিটি চিন্তা পরকালীন নিক্তিতে মাপা হবে, সেটিই মহাসত্য। এই মহাসত্যকে বুকে ধারণ করার মত দৃঢ়চিত্ততা, সৎসাহস, স্বচ্ছ অন্তর যেন আমরা অর্জন করতে পারি, এটাই হোক আমাদের সাধনা। সচেতন যুবসমাজের প্রতি আমাদের আহবান থাকবে, সমাজ সংস্কারের মঞ্চে আমাদের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতা যেন কোন অবস্থাতেই হীনবল ও ভঙ্গুর না হয়। শয়তানের ওয়াসওয়া যেন আমাদের দুর্বলচিত্ত ও কাপুরুষ না বানিয়ে দেয়। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন এবং দ্বীনের প্রকৃত খাদেম হিসাবে পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!



আরও