আটজন হাফেয সন্তানের মা শরীফাহ মাসতুরা
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1782 বার পঠিত
[ভারতের জামি‘আহ সালাফিয়্যাহ বেনারসে ৩১.০৩.২০১৬ মার্চ তারিখে ইসলামী মাদরাসা সমূহের সিলেবাসে আক্বীদা বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক অর্ন্তভুক্তিকরণ চাহিদাপত্র জমাদান উপলক্ষ্যে বিজ্ঞ আলেম-ওলামা ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মাসজিদুল হারামের সম্মানিত মুফতী, মাননীয় শিক্ষক ও প্রখ্যাত সালাফী বিদ্বান ড. অছিউল্লাহ মুহাম্মাদ আববাস অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর শিক্ষা ও কর্মজীবন সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয় যেটি বেনারস থেকে প্রকাশিত উর্দূ মাসিক পত্রিকা ‘মুহাদ্দিছ’-এর জুন ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি ‘তাওহীদ ডাক’-এর পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হলো। সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ করেছেন মুহাম্মাদ দেলাওয়ার হুসাইন (ছানাবিয়াহ, ১ম বর্ষ, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী)।- সহকারী সম্পাদক]।
প্রশ্ন : শায়খ, আপনার নাম, বংশলতিকা, জন্ম তারিখ ও জন্মস্থান সম্পর্কে জানতে পারি কি?
ড. অছিউল্লাহ আববাস : আমার নাম অছিউল্লাহ। বংশ তালিকা - অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আববাস খান বিন আহমাদ খান। আমাদের বংশ তালিকা ৭ম বা ৮ম পুরুষ পর্যন্ত পাওয়া যায়। এর পূর্বে আমার আর জানা নেই। আলহামদুলিল্লাহ আমি ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভারতের পাপরা ভূজ গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। আমাদের বংশের ভূজ বাবা নামে একজন ব্যক্তি এ গ্রামে বসবাসের গোড়াপত্তন করেন। এটাই আমার জন্মস্থান। প্রথমে এই গ্রাম বাস্তী যেলার অন্তর্গত ছিল। এখন এটি উত্তর প্রদেশের সিদ্ধার্থনগর যেলায় অবস্থিত
প্রশ্ন : শায়খ, আপনি প্রাথমিক শিক্ষা কোথা থেকে শুরু করেছেন এবং কোন বয়সে?
ড. অছিউল্লাহ আববাস : আলহামদুলিল্লাহ, আমার দাদা গ্রামের জমিদার ছিলেন। তিনি গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। আমার বংশটি ছিল সম্মানিত। সম্মানিত বলার কারণ ছিল যে, আমার বংশের লোকেরা গ্রামের অন্যদের সাথে বসবাস করার পাশাপাশি, তাদেরকে ছালাত, ছিয়াম, জুম’আ জামা‘আত ইত্যাদি শিক্ষা দিতেন। আমাদের বংশের আরেকজন সম্মানিত ব্যক্তি মাওলানা আমরুল্লাহ নিজ বংশেরই সম্মানিত লোকদেরকে জ্ঞান অর্জনের জন্য মাওলানা নাযীর হুসাইন দেহলবীর নিকট প্রেরণ করতেন। তার এলাকার সাইয়েদ নাযীর হুসাইন-এর ছাত্র মাওলানা ইবাদুল্লাহ (ইউসুফপুর) শিক্ষার প্রসারে গ্রামে একটি মাদরাসা খোলেন। সেখানে আমি পাঁচ বৎসর বয়সে ভর্তি হয়ে প্রাথমিক স্তরের মৌলিক জ্ঞান অর্জন শুরু করি। আমাদের বংশীয় মাওলানা মুহাম্মাদ সেলিম ছিলেন আমার উস্তাদ। তিনি আমাদেরকে খুব আদর করে পড়াতেন। তিনি আমাদের জন্য এতটাই কল্যাণকামী ছিলেন যে, যদি কেউ ক্লাসে অনুপস্থিত থাকত, তিনি তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ-খবর নিতেন, দেখভাল করতেন। তিনি দুই বছর ‘দারুল হাদীছ রহমানিয়া’য় জ্ঞান অর্জন করেন। ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার ফলে মাদরাসটি তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে এবং তা বিরান হয়ে যায়। তখন তিনি আব্দুস সালাম বাসতুবী ছাহেবের মাদরাসা ‘রিয়াযুল ঊলূমে’ ভর্তি হন এবং সেখানে থেকে ফারেগ হন। ১৯৫৯ সালে নিজ গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামে ইউসুফপুরের মাদরাসা ‘দারুল হুদা’য় ভর্তি হন। এই মাদরাসাটিকে মাওলানা আমরুল্লাহ ও ইবাদুল্লাহ এলাকায় প্রচলিত বিদ’আত ও ভ্রান্ত প্রথাগুলোর মূলোৎপাটনের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং এলাকার অধিকাংশ লোকই এখন আহলেহাদীছ। আমি সেখানে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি।
প্রশ্ন : শায়খ, জ্ঞানার্জনের জন্য জামি‘আহ সালাফিয়্যাহতে আপনার আগমন কখন ও কিভাবে?
ড. অছিউল্লাহ আববাস : ‘দারুল হুদা’ মাদরাসায় যেই বছর আমি মিশকাত পড়তাম, সেই বৎসর সেখানে এক প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বক্তা হিসেবে মাওলানা আব্দুর রউফ রহমানী ও মাওলানা আব্দুল জলীল রহমানী এবং বিশেষ মেহমান হিসেবে মাওলানা নাযীর আহমাদ আমলবীকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো। প্রোগামের শেষে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। ক্লাসে যেহেতু আমার পজিশন ১ম ছিল তাই আমাকেও পুরষ্কার দেওয়া হয়। তখন মাওলানা নাযীর আহমাদ ছাহেব বলেছিলেন যে, সবচেয়ে ছোট বটে, তবে সবচেয়ে ভাল। ‘দারুল হুদা’ মাদরাসায় অনেক বিজ্ঞ বিজ্ঞ উস্তাদ ছিলেন যারা বিভিন্ন নামী- দামী প্রতিষ্ঠান থেকে ফারেগ ছিলেন। উস্তাদদের মধ্য থেকে মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম বেনারসী দিল্লী রহমানিয়া থেকে ফারেগ হয়েছিলেন। মাওলানা মুহাম্মাদ ইদ্রীস দেওবন্দ থেকে পড়ে এসেছিলেন। তিনিই একমাত্র উস্তাদ যিনি আহলেহাদীছ ছিলেন। মাওলানা আব্দুর রহমান রহমানী দিল্লী রহমানিয়া থেকে ফারেগ হয়েছিলেন এবং জালালুদ্দীন মূতীপুরী ছাহেব যিনি মাওলানা নাযীর আহমাদ ছাহেবের খুব প্রি্য় ও আস্থাভাজন ছিলেন, তিনি ইউসুফপুরে মাওলানার যাত্রাকালে বলেছিলেন যে, এই বাচ্চাটিকেও জামি‘আহ রহমানিয়া বেনারসে ভর্তি করিয়ে দিবেন। তখন মাওলানা বলেছিলেন, এখনও অনেক ছোট। উত্তরে মাওলানা জালালুদ্দীন বলেছিলেন ছোট কিন্তু খুব মেধাবী ও বিচক্ষণ। তখন মাওলানা আমাকে কিছু প্রশ্ন করেন তার মধ্য থেকে একটি প্রশ্ন ছিল, হাদীছে এসেছে যে, শেষ যামানায় ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে, এর তাৎপর্য কী? আমি এর পুরোপুরি সঠিক উত্তর দিয়েছিলাম, তখন মাওলানা আমার উপর খুবই খুশী হয়েছিলেন। আর তিনি যাওয়ার সময় আমার এলাকার এক সাথী ভাই ছাদেক আলীকে বলে দিলেছিলেন যে, যখন তুমি বেনারস মাদরাসায় আসবে তখন এই বাচ্চাকে সাথে নিয়ে আসবে। সুতরাং ১৯৬২ সালে এখানে (জামি‘আহ সালাফিয়াতে) আমি ভর্তি হয়ে যাই। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করে ১৯৬৬ সালে এখানেই অধ্যাপনার কাজ শুরু করি।
প্রশ্ন : মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি কখন ও কিভাবে ভর্তি হন?
ড. অছিউল্লাহ আববাস : ১৯৬৬ সালে জামি‘আহ সালাফিয়্যাহতে পাঠদানের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে এক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে শায়খ আব্দুল কাদের শাইবাতুল হামদ এবং হিন্দুস্থানে নিযুক্ত সঊদী রাষ্ট্রদূত ইউসুফ ফাওযান ছাহেব আগমন করেন। তখন শায়খ আব্দুল কাদের ছাহেব বলেন যে, শায়খ ইবনে বায-এর পক্ষ থেকে চারজন ছাত্রকে মদীনা মুনাওয়ারায় লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেই সুবাদে জামি‘আহর চারজন ছাত্রকে নির্বাচন করা হয়। তারা হ’লেন শায়খ আব্দুল হামীদ রহমানী, শায়খ আব্দুস সালাম মাদানী, শায়খ আব্দুর রহমান লাইসী এবং আমি ।
অতঃপর আমরা শায়খ আব্দুল কাদেরের সাথে ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মদীনা মুনাওয়ারায় যাই। তখন শিক্ষাবর্ষ শেষ হ’তে মাত্র তিন মাস বাকি ছিল। আমি ছাড়া বাকী তিনজন কুল্লিয়ার ১ম বর্ষে ভর্তি হন, আর আমি ছানাবিয়া ২য় বর্ষে। যখন মাস পূর্ণ হ’ল তখন একদিন শায়খ ইবাদ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, আব্দুল হামীদ তোমার কতদিন আগে এসেছিল? তখন আমি বললাম দুই বছর। তখন তিনি বললেন, সে এখন কুল্লিয়া ১ম বর্ষে আর তুমি ছানাবিয়্যাহ শেষ বর্ষে এবং তোমার অনুপস্থিতি অনেক বেশী ।
অনুপস্থিতি এভাবে যে, তখন হাযিরা হ’ত সিট নম্বর হিসাবে। কিন্তু আমি জানতাম না যে আমার সিট নম্বর ছিল ৪৫। তাই যেখানেই খালি পেতাম সেখানেই বসে পড়তাম। এই জন্য শায়খ মনে করেছেন আমি অনুপস্থিত থাকি। তাই আমাকে ছানাবিয়্যাহ ২য় বর্ষে ভর্তি হতে হয়। এই বিষয়টি আমার খুব কঠিন মনে হয়। কেননা আববা বলতেন, পড়তে হয় তো ঘরেই পড়। তাহ’লে কৃষিকাজও করতে পারবে। পাশাপাশি দাওয়াত ও তাবলীগ করতে পারবে। আমার মাথায় এটি ছিল। পরবর্তীতে আলাহ তা‘আলার বাণী- وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ বস্ত্ততঃ তোমরা এমন বহু কিছু অপসন্দ কর, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার বহু কিছু পসন্দ কর, যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সবকিছু জানেন, কিন্তু তোমরা জানো না (বাক্বারাহ ২/২১৬)।-এই আয়াতটির সত্যতার প্রকাশ ঘটে আমার জীবনে। কেননা এ কারণে আমি এক বছর পিছিয়ে যাই আর যেই বছর আমার কুল্লিয়া শেষ হয় সেই বছরই মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স বিভাগ খোলা হয়। আবার যেই বছর মাস্টার্স শেষ হয় সেই বছরেই ডক্টরেট বিভাগ খোলা হয়। অর্থাৎ এক বছর পিছিয়ে যাওয়ার ফলে আমি ঠিক সময়মত মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। নতুবা হয়ত দেশেই ফিরে যেতাম। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
প্রশ্ন : শায়খ, আপনি কুল্লিয়ার কোন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন? তারপর মাস্টার্সে ও ডক্টরেট বিভাগে কিভাবে আপনার ভর্তি সম্পন্ন হয়েছিল?
ড. অছিউল্লাহ আববাস : আমি কুল্লিয়াতে ‘দাওয়াহ’ বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। আর মাস্টার্সে আমার ভর্তি হওয়াটা একমদই ভাগ্যের বিষয় ছিল। কেননা যেই বছর আমার কুল্লিয়া শেষ হয় সেই বছর মক্কার উম্মুল কুরায় ‘কুল্লিয়াতুশ শারঈয়্যাহ ওয়াদ দিরাতুল ইসলামিয়্যাহ’ বিভাগে মাস্টার্স খোলা হয়। তখন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় তার পুরাতন ছাত্রদেরকে একত্রিত করতে থাকে এবং এই ঘোষণা দেয় যে, ছয় জন অনারবী ছাত্র ভর্তি নেওয়া হবে। বাকীরা হবে আরবী। তখন ৫০/৬০ জন অনারবী ছেলে দরখাস্ত করে। তারমধ্যে আমিও একজন ছিলাম। তখন ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। আল্লাহর অশেষ দয়া ও অনুগ্রহে যারা মনোনীত হয় তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। সেই সময় শায়খ হাম্মাদ ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’-এর ১ম খন্ড-এর তাখরীজের কাজ শুরু করেন । তখন আমিও তার সাথে প্রায় অর্ধেক কিতাবের তাখরীজের কাজ সম্পন্ন করি। তখন শায়খ মুছত্বফা আ‘যমী ছাত্রদেরকে একটি প্রশ্ন করেন যে, কেউ যদি আরবী ভাষায় প্রকাশিত কিতাবসমূহকে অনুসন্ধান করতে চায় তবে কোন কিতাবের সাহায্য নেওয়া উচিৎ? কেউ উত্তর দিলনা। অবশেষে আমি উত্তর দিলাম যে, ইউসুফ বিন আলাইয়ান বিন মূসা সারফীস যিনি একজন লেবাননী খৃষ্টান তাঁর লিখিত গ্রন্থ ‘মু‘জামুল মাত্ববূ‘আত আল-আরাবিয়্যাহ’। তখন শায়খ মুছত্বফা আ‘যমী শায়খ আমীন আল-মিছরীকে সম্বোধন করে বলেন যে, শায়খ আল্লাহর কসম হিন্দুস্তানবাসীরাও আলেম। অতঃপর আমার যখন মাস্টার্স সম্পন্ন হয়, তার তিন মাস পূর্বে ডক্টরেট বিভাগ খোলা হয়। তাই পরবর্তীতে ডক্টরেট-এ ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই এবং সেই সময় আমি বিবাহ করি। ডক্টরেট করার সময় আমি লাইব্রেরীতে কাজের আবেদন করি। আল্লাহ তা‘আলার দয়ায় আমার আবেদন মঞ্জুর করা হয়। তখন থেকেই আমি লাইব্রেরীর সাথে জুড়ে যাই।
প্রশ্ন : ডক্টরেটে আপনার কোন বিষয়টি প্রিয় ছিল এবং তা কোন শায়েখের তত্বাবধানে হয়েছিল?
ড. অছিউল্লাহ আববাস : মাস্টার্সে পড়ার সময় আমি নিয়ত করেছিলাম যে, ডক্টরেটে যখন পড়বো তখন ‘ফাযায়েলুছ ছাহাবা’ বিষয়টির তাহক্বীক্ব ও তাখরীজের কাজ করবো। কেননা এই কিতাবটি কারো কাছে ছিলনা। তবে আমার জানা ছিল যে, মিনায় বসবাসকারী আব্দুর রহীম ছাদীকের কাছে এর একটি পান্ডুলিপি রয়েছে, যা তিনি তুর্কি থেকে এনেছিলেন। ডক্টরেটে আমার তত্বাবধায়ক ছিল ‘সাইয়্যিদ ছিফর মিছরী, যিনি শায়েখ রবী‘ বিন হাদী আল-মাদখালীরও তত্বাবধায়ক ছিলেন।
প্রশ্ন : শায়খ, ‘উম্মুল কুরা’ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও হারাম শরীফের সম্মানিত মুফতী হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার আলাপ-আলোচনা কখন ও কিভাবে শুরু হয়?
ড. অছিউল্লাহ আববাস : ১৩৯৭ হিজরী যখন আমি ডক্টরেট করেছিলাম তখন মুহাম্মাদ নাছের রাশেদকে হারামাইনের দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা হয়। তিনি হারাম শরীফের উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন। হারাম শরীফের দিকে তাকিয়ে ‘উম্মুল কুরা’র ভিসিকে বললেন যে, আমাকে এমন একজন ছাত্র দিন যে হাদীছ, উছূলে হাদীছ, তাফসীর, উলূমে তাফসীরের দারস দিতে পারবে। তখন ভিসি আমাকে ডেকে বললেন, হারাম শরীফে যাবে? তাহ’লে ১৩০০ রিয়াল পাবে। আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। আর মনে মনে এই আয়াত পাঠ করে ছিলাম رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنْزَلْتَ إِلَيَّ مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ ‘হে আমার পালনকর্তা! আমি তোমার পক্ষ হ’তে আমার প্রতি কল্যাণ নাযিলের মুখাপেক্ষী’ (ক্বাছাছ ২৮/২৪)। অতঃপর আমাকে সেখানে পাঠানো হয়।
১৩৯৮ হিজরী (১৯৭৯খৃঃ)-তে যখন মাহদী দাবীদার জুহাইমান আল-উতাইবীর হামলার ঘটনা ঘটল, তখন আমরা সমস্ত মানুষ সেখানেই ছিলাম। পনের দিন আমরা চিৎ হয়ে ছালাত আদায় করেছি। যখন-ই আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়োজাহাজ অতিক্রম করত, তখনই ছাত্ররা ভয় পেয়ে যেত। যখন তাদের মনে বেশী ভয় সঞ্চারিত হত, তখন আমি তাদেরকে ‘গ্রীষ্মের খরতাপযুক্ত মেঘ অচিরেই দূর হয়ে যাবে’ বলে সান্ত্বনা দিতাম। আর আমি এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ২০০ পৃষ্ঠা হাদীছের তাখরীজ করে ফেলি।
১৩৯৮ হিজরীর শেষে যিলক্ব‘দ মাসে আমার প্রবন্ধ পেশ করি। আর ১৩৯৯ হিজরীতে আমার ডক্টরেট শেষ হয়। ১৪০১ হিজরী সনে মুহাররম বা রবীউল আওয়াল মাসে হজ্জের পরে ‘কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয়’ জেদ্দায় আমার প্রবন্ধের পর্যালোচনাও শেষ হয়।
যখন হারাম শরীফে যাই তখন মুহাম্মাদ নাছির রাশেদ আমাকে দিয়ে দরখাস্ত লিখান যে, আমি এই কাজ খুব ভালোভাবে আঞ্জাম দিব এবং অধ্যাপনাতেও কোন ক্রটি করব না। আর ছয় বছর আমি এই প্রতিষ্ঠানেই অধ্যাপনা করেছি। তখন শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ সাবীলের সাথে ভালোভাবে পরিচিত হয়ে যাই। কেননা ১৪০০ হিজরীতে ‘মু’তামারুদ দাওয়াহ ওয়াত তা‘লীম’-এ আমি তার সাথে হিন্দুস্থানে এসেছিলাম এবং মিসর ও নাইজেরিয়াতেও গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে হারাম শরীফে থাকার পরামর্শ দেন এবং সাথে সাথে সেখানে আরবীতে দারস প্রদানের সুযোগ দেন। পরবর্তীতে শায়েখ সাবীল আমাকে তার উপদেষ্টা বানিয়ে নেন। এভাবে তিন বছর ছিলাম। তখন এক আইন জারী হয় যে, হারাম শরীফের সে ব্যক্তিই দরস দিতে পারবে, যার কাছে সউদী নাগরিকত্ব রয়েছে। তখন আমি খুব পেরেশান হয়ে শায়েখ সাবীলের ঘরে গিয়ে এই আয়াতটি পাঠ করি, فَلَمَّا أَحَسَّ عِيسَى مِنْهُمُ الْكُفْرَ قَالَ مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللَّهِ ‘অতঃপর যখন ঈসা তার কওমের মধ্যে কুফরী অনুভব করল, তখন বলল, কে আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী হবে? (আলে-ইমরান ৩/৫২)। আমি শায়েখকে পুরো বিষয়টি খুলে বলি ও সাহায্য কামনা করি। কিছু দিন পর আমি ঘরে ছিলাম। তখন সাবীল সাহেবের ছেলে ওমর সাবীলের ফোন আসে যে, বাবা আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। আমি পেরেশান হয়ে গেলাম যে কী ব্যাপার? তারপর আমি গেলাম, তিনি আমাকে ভালভাবে নিলেন ও বললেন, যাও দরস দাও। এটা ১৪১৬ হিজরীর ঘটনা। অতঃপর ১৪১৯ হিজরীতে আমি বুখারীর দরস দেওয়া শুরু করি। মাশাআল্লাহ আজ পর্যন্ত তা চালু রয়েছে।
প্রশ্ন : শায়েখ সঊদী আরবে আপনি কোন কোন শিক্ষক থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন?
ড. অছিউল্লাহ আববাস : সেখানে তো আমি অনেক শিক্ষক থেকে ফায়দা লাভ করেছি, তাদের ক্লাসেও শামিল ছিলাম। তাদের কয়েকজনের নাম উলেখ করছি, শায়খ হাম্মাদ আনছারী, শায়খ মুছত্বফা আনছারী, শায়খ আলী নাছির ফাক্বীহী, শায়খ হাসান আল-গুমারী, শায়খ আলী আমীন মিছরী (তিনি সিরিয়ার নাগরিক ছিলেন), শায়খ ছালেহ বিন হামীদ, শায়খ আব্দুর রহমান, শায়খ আবু সুলাইমান, শায়খ রবী‘ বিন হাদী আল-মাদখালী (ছানাবিয়্যাতে তাঁর কাছে ‘শারহুল আক্বীদাতুল ওয়াসাতিয়্যাহ’ পড়তাম) প্রমুখ। এছাড়াও আরো অনেক উস্তাদ রয়েছেন যাদের থেকে আমি জ্ঞানার্জন করেছি।
প্রশ্ন : শায়খ, আপনি কোন আলেম থেকে ইজাযাহ সনদ লাভ করেছেন?
ড. অছিউল্লাহ আববাস : আমার খুবই আফসোস হয় যে, এ পর্যন্ত মাত্র চারজন শিক্ষকের কাছ থেকে ইজাযাহ সনদ লাভ করেছি। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল, আল্লামা শানক্বীত্বী (রহঃ), শায়খুল হাদীছ ওবাইদুল্লাহ রহমানী, শায়েখ আবেদ হাসান (রহঃ) এবং মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ সাবীল (রহঃ) যিনি হজ্জব্রত পালনরত অবস্থায় ছিলেন। মজার ব্যাপার হ’ল যখন আমি তাঁর নিকট ইজাযাহ সনদ চাইলাম তখন তিনি আমাকে বললেন, اجزتك من قبل ان تقول ‘তুমি বলার আগেই আমি তোমাকে অনুমতি দিয়ে দিয়েছি’।