কাদিয়ানীদে ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস (২য় কিস্তি)
মুখতারুল ইসলাম
মুখতারুল ইসলাম 2266 বার পঠিত
ভূমিকা :
ইসলামবিরোধী পরাজিত শক্তি ও স্বার্থান্বেষী ইহুদী-খৃষ্টানরা মুসলমানদের আদর্শিক দৃঢ়তা বিনষ্ট করার জন্য নানা সময় বেছে নেয় মুসলমান নামধারী কিছু গাদ্দারকে, যারা বিশ্বাসঘাতকতায় বংশীয়ভাবে পারদর্শী। চিররোগা, মানসিক বিকারগ্রস্ত, চরম স্বার্থপর, ভন্ডনবী মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী তাদের অন্যতম। ভারতের কাদিয়ান শহরে জন্মগ্রহণকারী এই ব্যক্তির হাতে সৃষ্ট দলটি আজ সারাবিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে সুকৌশলে ইসলামী আক্বীদা বিনষ্টের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে কর্মরত। বাতিলপন্থী, বিভ্রান্ত ও অমুসলিম কাদিয়ানী দলটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষে উপমহাদেশে ইংরেজ প্রভুর হাত ধরে মুসলমানদেরকে তাদের প্রাণপ্রিয় ধর্ম ইসলাম থেকে দূরে রাখতে বিশেষকরে মুসলমানদের শক্তির আধার জিহাদ থেকে বিমুখ করতে ইসলামের নামে আত্মপ্রকাশ করে। যা সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শক্তির দূরভিসন্ধির অংশবিশেষ মাত্র। আফ্রিকাসহ অন্যান্য দেশে কাদিয়ানীরা ‘আহমাদিয়া’ নামে নিজেদের পরিচয় দানের মাধ্যমে মুসলমানদের প্রতারণা ও ভ্রমে ফেলার প্রচেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের সাথে মুহাম্মাদ (ছাঃ), যাঁর অপর নাম আহমাদও ছিল, তাঁর সাথে দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। বরং তাদের ভন্ড নবীর নাম হ’ল গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী। পাক-ভারতে এরা কাদিয়ানী[1] নামেই পরিচিত। সম্প্রতি বাংলাদেশের পঞ্চগড় শহরে ৩দিন ব্যাপী ইজতেমা আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে তারা বাংলাদেশের বুকে তাদের শক্তির জানান দিয়েছে। বক্ষমান প্রবন্ধে আমরা তাদের আক্বীদা সম্পর্কে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
কাদিয়ানীদের ঈমানবিধ্বংসী আক্বীদাসমূহ :
কাদিয়ানীদের আক্বীদা সম্পর্কে খ্যাতিমান গবেষক আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (রহঃ) বলেন, যে সকল বাতিল মতবাদ ইসলামের শক্তিকে বিচ্ছিন্ন এবং তার অস্তিত্বকে বিনাশ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তন্মধ্যে একটি হ’ল কাদিয়ানী মতবাদ। এ মতবাদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য হ’ল ইসলামী চিন্তাধারাকে প্রকাশ্যে নয় বরং গোপনীয়ভাবে ধূলিসাৎ করা। কেননা ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা এ কথা প্রমাণ করেছে যে, যখনই ইসলাম বিরোধী কোন দল বা সম্প্রদায় ইসলামের সাথে সম্মুখ সমরে আবির্ভুত হয়েছে কিংবা এর অস্তিত্বকে মুছে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তখন তারা সে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়নি, বরং এর ফলে ইসলামের শক্তি ও মুসলমানদের তৎপরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ইহুদী, নাছারা ও মক্কার মুশরিকগণ তাদের সকল শক্তি নিয়ে ইসলামের সম্মান ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করতে এবং মুসলমানদের সংখ্যালঘু করতে ও তাদের উন্নতিকে রোধ করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু তারা এ সকল উদ্যোগের পর ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তা তো স্পষ্ট। যখন ক্রুসেডের শক্তি পরাভূত হয়, তখন তাদের আধিপত্য চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং ইসলামের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মুকাবিলায় তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানি ভেঙে পড়ে, যেমন করে ইসলামের উষালগ্নে ইসলামের গতি প্রতিরোধে মুশরিক ও ইহুদী সম্প্রদায় ব্যর্থ হয়েছিল। এমনিভাবে বাহাছ-মুনাযারা এবং তর্ক-বিতর্কের ক্ষেত্রে এবং ক্ষমতার ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমেও তারা ইসলামের মুকাবিলায় কখনও সফলতা অর্জন করতে পারেনি। অনন্তর তাদের সমুদয় অপচেষ্টা সত্ত্বেও ইসলাম প্রচার ও প্রসারে নতুন নতুন দিক-দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এ সকল বিপদাপদ ইসলামের উন্নতি, মহত্ত্ব এবং স্থিতিশীলতাকেই বরং বৃদ্ধি করেছে। তাই যেমন তারা ইসলামের কোনরূপ ক্ষতিসাধনে ব্যর্থ হয়, তেমনিভাবে তারা ইসলামের জ্যোতি প্রবাহের সম্মুখে বাঁধা সৃষ্টি করতে নিরাশ হয়ে পড়ে। আরব উপদ্বীপের মুশরিক, ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের এ অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রবেশ করার যুগে আফগানিস্তান, ইরান ও চীনের হিন্দু, বৌদ্ধ, অগ্নিপুজারী ও শিখরাও এর অভিজ্ঞতা লাভ করেছে যেরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল তাদের বন্ধুগণ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে। উপরন্তু তারা এটাও অনুধাবন করেছে যে, ইসলামের পাষাণ প্রস্তরটি অতি কঠিন। একে ভেঙে ফেলা বা তাতে ফাটল বা ছিদ্র করা সম্ভব নয়।
এই তিক্ত অভিজ্ঞতা ইসলামের অনিষ্টকারী শত্রুদেরকে যে নতুন চিন্তাধারার খোরাক জোগায়, তা হ’ল এই যে, তারা প্রকাশ্যে ইসলামকে প্রতিরোধ করার পদ্ধতি পরিবর্তন করে। কেননা প্রকাশ্য প্রতিরোধ মুসলমানদের আত্মমর্যাদা ও প্রতিরোধ শক্তিকে আরো বৃদ্ধি করে তোলে। ফলে তারা মুসলমান ও ইসলামের উপর আঘাত হানতে প্রতারণা ও কপটতার কৌশল অবলম্বন করে এবং ইসলামকে মুকাবিলার জন্য ইসলামের নামে মুসলমানদের মধ্য থেকে পৃথক নতুন ধর্ম তৈরী করে। তারা ভাবল এভাবে ধীরে ধীরে ইসলামের অস্তিত্ব ও চিন্তাধারাকে মুছে ফেলা যাবে। এমনই পূর্ব পরিকল্পিত চিন্তাধারা থেকে কাদিয়ানী মতবাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রথমতঃ তারা একটি মুসলিম দলরূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং তারা ইসলাম বিরোধী বিষাক্ত চিন্তাধারা এমনভাবে প্রচার করতে শুরু করে, যাতে সাধারণ লোক বুঝে উঠতে না পারে। অতঃপর তারা ক্রমশঃ গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করতে লাগল। যখন তাদের জালে কিছু অনভিজ্ঞ লোক এমনিভাবে ফেঁসে যায় যে তাদের পালাবার আর কোন পথ থাকে না, তখন খোলাখুলিভাবে এদের সম্মুখে তাদের এ ভ্রান্ত আক্বীদাই বহাল থেকে যায়, আর যাদেরকে হেদায়াত ও মুক্তি দান করা আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, তারা এ ভ্রান্তি থেকে রেহাই পায়। এ চিন্তাধারায় এবং ইসলামবিদ্বেষী সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিতে তারা এ পরিকল্পিত স্তরগুলোকে তাবলীগ ও দাওয়াতের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করে নিল, যাতে তারা মুসলমানদের বিভ্রান্ত এবং ইসলামের প্রকৃত রূপকে কলুষিত করতে পারে।
বক্ষমান
প্রবন্ধে কাদিয়ানী মতবাদের প্রকৃত আকীদাসমূহ এবং যে উদ্দেশ্যে তাদের
সৃষ্টি, তা প্রামাণ্য তথ্যসূত্র থেকে উল্লেখ করব, যাতে পাঠকবৃন্দ এর ব্যাপক
ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পারেন। অনুরূপভাবে এদের প্রতারণা এবং মুনাফেকী
থেকে তারা সতর্ক হ’তে পারেন’।[2]
কাদিয়ানীদের প্রধান প্রধান যে আক্বীদা সমূহ এখানে আলোচিত হবে তা নিমণরূপ :
(ক) আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা সম্পর্কে। (খ) আল-কুরআনুল কারীম সম্পর্কে। (গ) হাদীছে নববী ও খতমে নবুঅত সম্পর্কে। (ঘ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আম্বিয়াকেরাম ও ছাহাবাগণ সম্পর্কে। (ঙ) মাসীহ মাওঊদ তথা প্রতিশ্রুত মাসীহ বা ঈসা ইবনু মারইয়াম (আঃ) সম্পর্কে। (চ) জিহাদ সম্পর্কে। (ছ) মক্কা মুকাররামা ও মদীনা মুনাওয়ারার উপরে কাদইয়ানকে প্রাধান্যদান সম্পর্কে। নিম্নে বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা হ’ল।
(ক) আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা সম্পর্কে :
আল্লামা
ইহসান ইলাহী যহীর (রহঃ) মহান আল্লাহ সম্পর্কে কাদিয়ানীদের আক্বীদা খন্ডনে
বলেন, ‘আল্লাহ সম্পর্কে কাদিয়ানীরা বিদঘুটে ও হাস্যকর আক্বীদা পোষণ করে।
তারা সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টিজীবের সাথে সত্তাগতভাবে সাদৃশ্য জ্ঞান করে।
কাদিয়ানীদের বিশ্বাস মানুষের মতই আল্লাহ ছিয়াম রাখেন, ছালাত আদায় করেন,
ঘুমান আবার জাগ্রত হন, লিখেন ও স্বাক্ষর করেন, বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত
নিতে গিয়ে সিদ্ধান্ত সঠিক নেন আবার ভুলও করেন, স্ত্রী সহবাস করেন এবং
সন্তান জন্ম দেন, বিভক্ত হন, সাদৃশ্য রাখেন এবং তিনি দেহ বিশিষ্ট
(নাউযুবিল্লাহ)’।[3] মহান আল্লাহ তা‘আলা এ সমস্ত নিকৃষ্ট কথা থেকে
পূত-পবিত্র। তিনি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা যা কারো সাথে তুলনীয় নয়। তিনি
অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেয়নি এবং তিনিও কারো থেকে জন্মিত নন। মহান
আল্লাহ বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ-
অর্থাৎ ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই। তিনি সবকিছু শোনেন ও দেখেন’।[4]
আল্লাহ সম্পর্কে তাদের বাতিল আক্বীদাগুলি নিম্নরূপ :
১. তথাকথিত ভন্ড নবী গোলাম আহমাদ বলে, আল্লাহ আমাকে বলেছেন, আমি ছালাত পড়ি ও ছিয়াম রাখি, জাগ্রত থাকি ও নিদ্রা যাই (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আল-বুশরা’ ২য় খন্ড, ৯৭ পৃঃ)।[5]
২. সে আরো বলে, আল্লাহ বলেছেন, আমি রাসূলের পক্ষ হ’তে উত্তর দেই, আমি ভুলও করি এবং সঠিকও করি। আমি রাসূলকে বেষ্টন করে রেখেছি (আল-বুশরা ২য় খন্ড, ৭৯ পৃঃ)।[6]
৩. সে তার কাশফ সম্পর্কে বলে, আমি (أنا رأيت في الكشف) কাশফের দ্বারা দেখেছি যে, আমি অনেকগুলি কাগজ আল্লাহ তা‘আলার কাছে পেশ করছি তাতে স্বাক্ষর করার জন্য এবং আমি যে সকল দাবী করেছি তা অনুমোদনের জন্য। অতঃপর আমি দেখতে পেলাম তিনি তাতে লাল কালি দ্বারা স্বাক্ষর করেছেন। কাশফের সময় আমার কাছে আব্দুল্লাহ নামে আমার একজন ভক্ত উপস্থিত ছিল। অতঃপর আল্লাহ কলম ঝাড়লেন। এতে লাল কালির ফোঁটা আমার কাপড়ে ও আমার ভক্ত আব্দুল্লাহ[7]-এর কাপড়ে পড়ল। কাশফ যখন শেষ হ’ল তখন বাস্তবে দেখতে পেলাম আমার ও আব্দুল্লাহর কাপড় সেই লাল রঙ্গে রঞ্জিত হয়ে গেছে। অথচ আমাদের নিকট কোন লাল রং ছিল না। এখন পর্যন্ত এ কাপড়গুলো আমার মুরীদ আব্দুল্লাহর নিকট মওজুদ আছে (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তিরিয়াকুল কুলূব’ এবং ‘হাকীকাতুল অহী’ ২৫৫ পৃঃ)।[8] দুনিয়ায় যারাই এ ধরনের ভন্ডামী করেছে তারাই নানা ধরনের কাশফের আশ্রয় নিয়েছে। গোলাম আহমাদের ভন্ডামীর এমনই একটি নমুনাপত্র এটি।
৪.
অন্যত্র এই ভন্ডনবী সুমহান মর্যাদার অধিকারী আল্লাহকে ‘অক্টোপাস’ নামক
সামুদ্রিক প্রাণীর সাথে তুলনা করেছে। সে বলে, আল্লাহর অস্তিত্বের প্রকৃতিকে
আমরা এরূপ ধরে নিতে সক্ষম যে, তাঁর অনেক হাত, পা রয়েছে। তাঁর অগণিত
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে, যা কিম্ভুতকিমাকার এবং যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থেরও কোন
সীমারেখা নেই। তিনি হ’লেন (مثل الأخطبوط) অক্টোপাস সদৃশ। তার অনেক
শিরা-উপশিরা রয়েছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সম্প্রসারিত (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তাওযীহুল মারাম’ ৭৫ পৃঃ)।[9]
৫. গোলামের ভক্ত কাযী ইয়ার মুহাম্মাদ[10]
ভক্তির আতিশয্যে গদগদ হয়ে তার বক্তব্যে বলে, ‘মসীহ মাওঊদ’ (গোলাম আহমাদ)
একসময় তার নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছে, সে নিজেকে স্বপ্নে দেখে যে
সে যেন একজন মহিলা। আর আল্লাহ তা‘আলা তার মধ্যে নিজের (قوةه الرجولية)
পুরুষত্ব শক্তি প্রকাশ করলেন (ইয়ার মুহাম্মদ, ‘যাহিয়াতুল ইসলাম’ ৩৪ পৃঃ)।[11]
৬. সে আরো বলে যে, আল্লাহ আমাকে বলেছেন, তোমার সৃষ্টি আমার পানি থেকে এবং ওদের সৃষ্টি (الجبن) কাপুরুষত্ব থেকে (গোলামের ‘আনজামে আছেম’ ৫৫ পৃঃ)।[12]
৭.
কাদিয়ানীরা গোলাম আহমাদকে আল্লাহর পুত্র এবং সেই প্রকৃত আল্লাহ বলেও
বিশ্বাস করে। তার নিজেরই বক্তব্য হ’ল, আল্লাহ আমাকে এই বলে সম্বোধন করেছেন,
শুন হে আমার ছেলে! (গোলামের ‘আল বুশরা’ ১ম খন্ড ৪৯ পৃঃ)।[13]
৮. সে আরো বলে, প্রভু আমাকে বলেছেন, তুমি আমা হ’তে এবং আমি তোমা থেকে। (ظهورك ظهوري) তোমার প্রকাশ আমার প্রকাশ (গোলামের ‘অহিয়ে মুকাদ্দাস’ ৬৫০ পৃঃ)।[14]
৯. সে আরো বলে, আল্লাহ তা‘আলা আমার মধ্যে অবতরণ করেছেন এবং তাঁর ও তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে আমি হ’লাম মাধ্যম (গোলাম রচিত ‘কিতাবুল বারিয়্যা’ ৭৫ পৃঃ)।[15]
১০.
সে আরো বলে, আমার উপর অহী এসেছে। আমি তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি এমন একটি
পুত্রের, যে হবে সত্য ও উচ্চ মর্যাদার প্রতীক, যেন আল্লাহ আকাশ হ’তে অবতরণ
করেছেন (গোলাম রচিত ‘ইসতেফতা’ ৮৫ পৃঃ)।[16]
১১.
এতদ্ব্যতীত কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলা স্ত্রী সহবাস করেন
এবং তাঁর সন্তানাদি জন্ম লাভ করে। অতঃপর এর চেয়ে অদ্ভুত বিষয় তারা বিশ্বাস
করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের নবী গোলাম আহমাদের সাথে সহবাস করেছেন। শুধু
তা-ই নয় বরং এ সহবাসের ফল সে নিজেই। প্রথমত: যার সাথে আল্লাহ সহবাস করেছেন
সে হ’ল তাদের নবী গোলাম আহমাদ। অতঃপর সে-ই গর্ভ ধারণকারী। দ্বিতীয়ত: সে-ই
জন্মগ্রহণকারী সন্তান। সে নিজে বলে, ‘আমার মধ্যে ঈসার রূহ ফুঁকে দেয়া
হয়েছে, যেমন মরিয়ামের মধ্যে ফুঁকে দেয়া হয়েছিল। রূপকভাবে আমি গর্ভ ধারণ
করলাম। কয়েক মাস পরই যা দশ মাসের ঊর্ধ্বে নয়, মরিয়াম হ’তে পরিবর্তিত হয়ে
ঈসা হয়ে গেলাম। এ পদ্ধতিতে আমি মরিয়ম পুত্র হয়ে গেলাম (গোলাম কাদিয়ানীর ‘সাফিনায়ে নূহ’ ৪৭ পৃঃ)।[17]
১২.
আরো সে বলেছে, ‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে মারইয়াম নামে নামকরণ করেছেন, যে
মারইয়াম ঈসাকে গর্ভ ধারণ করেছিলেন। সূরায়ে তাহরীমের মধ্যে আল্লাহর এ বাণীতে
আমিই উদ্দেশ্য, ‘ইমরানের কন্যা মরিয়ম যিনি তার সতীত্ব রক্ষা করেছেন। অতঃপর
আমি উহাতে আমার রূহ ফুঁকে দিলাম’। অবশ্যই আমি সেই একমাত্র ব্যক্তি যে দাবী
করছে ‘আমিই মরিয়ম এবং আমার মধ্যেই ঈসার রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে’ (গোলামের ‘হাকীকাতুল অহি’ ৩৩৭ পৃঃ)।[18]
১৩. সে আরো বলে, আল্লাহ বলেছেন, হে সূর্য! হে চন্দ্র! তুমি আমা হ’তে এবং আমি তোমা হ’তে (গোলাম রচিত ‘হাকীকাতুল অহি’ ৭৩ পৃঃ)।[19]
কাদিয়ানীরা গোলাম আহমাদকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর মত আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করে। এমনকি অবশেষে ভন্ড গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীকে তারা স্বয়ং আল্লাহ বলে বিশ্বাস করে।
বস্ত্ততঃ
গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীকে তারা যে প্রভুর পুত্র বলে দাবী করে, সেই প্রভু হ’ল
ইংরেজরা। যেমন গোলাম আহমাদ নিজেই স্পষ্ট করে বলেছে যে, ‘আমার প্রতি ইংরেজি
ভাষায় কয়েকবার ইলহাম হয়েছে। শেষবারে এ ইলহাম হয়, I CAN WHAT I WILL TO DO
অর্থাৎ ‘আমি যা চাই, তাই করতে পারি’। কথার উচ্চারণ ও বাক্য ভঙ্গি থেকে আমি
বুঝতে পারলাম যেন একজন ইংরেজ আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছে (গোলাম রচিত ‘বারাহীনে আহমাদিয়া’ ৮০ পৃঃ)।[20]
পর্যালোচনা :
এ সমস্ত নিকৃষ্টতম আক্বীদাগুলি কোন প্রকার পর্যালোচনার অযোগ্য। নিতান্ত মস্তিষ্কবিকৃত ব্যতীত এসকল কথা কেউই বলতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলাকে এই ব্যক্তি কেবল মানবিক গুণে গুণান্বিত করেনি, বরং জঘন্য সব অপবাদ আরোপ করে সমগ্র পৃথিবীর মুসলমানদের লা‘নতের বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে।
শায়খ ইহসান ইলাহী যহীর তাঁর গ্রন্থে আল্লাহর পরিচয় বর্ণনা করে যে সকল আয়াত উদ্ধৃত করেছেন তা এখানে উল্লেখ করা হ’ল।
১.
মহান আল্লাহ বলেন, قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ-اللَّهُ الصَّمَدُ-لَمْ
يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ-وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ- অর্থাৎ বল,
তিনি আল্লাহ এক। আল্লাহ মুখাপেক্ষীহীন। তিনি (কাউকে) জন্ম দেননি এবং তিনি
(কারও) জন্মিত নন। তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।[21]
২.
মহান আল্লাহ বলেন, اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ
لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي
الْأَرْضِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ
مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ
عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ
وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ- অর্থাৎ আল্লাহ
যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক। কোন
তন্দ্রা বা নিদ্রা যাকে স্পর্শও করে না। আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সবকিছু
তাঁরই। তাঁর অনুমতি ব্যতীত এমন কে আছে যে তাঁর নিকটে সুফারিশ করতে পারে?
তাদের সম্মুখে ও পিছনে যা কিছু আছে সবকিছুই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসমুদ্র
হ’তে তারা কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না, কেবল যতুটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর
কুরসী আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত। আর এ দু’য়ের রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে মোটেই
শ্রান্ত করে না। তিনি সর্বোচ্চ ও মহীয়ান।[22]
৩.
মহান আল্লাহ বলেন, هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ
الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ- অর্থাৎ তিনিই
আল্লাহ যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যমান সবকিছু জানেন।
যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু।[23]
৪. মহান
আল্লাহ বলেন, وَمَا نَتَنَزَّلُ إِلَّا بِأَمْرِ رَبِّكَ لَهُ مَا بَيْنَ
أَيْدِينَا وَمَا خَلْفَنَا وَمَا بَيْنَ ذَلِكَ وَمَا كَانَ رَبُّكَ
نَسِيًّا- অর্থাৎ জিব্রাঈল বলল, আমরা আপনার প্রতিপালকের আদেশ ব্যতীত অবতরণ
করি না। তাঁরই মালিকানায় সবকিছু, যা রয়েছে আমাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে ও এ
দু’য়ের মধ্যস্থলে। আর আপনার প্রতিপালক (কোন কিছু) ভুলে যান না।[24]
৫.
মহান আল্লাহ বলেন, فَاطِرُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ
أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَمِنَ الْأَنْعَامِ أَزْوَاجًا يَذْرَؤُكُمْ
فِيهِ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ- অর্থাৎ তিনি
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টিকর্তা। তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য
জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং চতুষ্পদ জন্তুদের মধ্য থেকে তাদের জন্য জোড়া সৃষ্টি
করেছেন। আর ঐ জোড়ার গর্ভেই তোমাদের বংশ বিস্তার করেছেন। তাঁর তুলনীয় কিছুই
নেই। তিনি সবকিছু শোনেন ও দেখেন।[25]
৬.
মহান আল্লাহ বলেন, اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ
الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوا
أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ
بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا- অর্থাৎ আল্লাহ সপ্ত আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং
পৃথিবীকেও সেই পরিমাণ। এসবের মধ্যে তাঁর আদেশ অবতীর্ণ হয়। যাতে তোমরা জানো
যে, আল্লাহ সকল কিছুর উপর ক্ষমতাশালী। আর আল্লাহ সবকিছুকে তাঁর ইলম দ্বারা
বেষ্টন করে রেখেছেন।[26]
৭. নবী মুহাম্মাদ
(ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنَامُ وَلاَ يَنْبَغِى لَهُ أَنْ يَنَامَ
يَخْفِضُ الْقِسْطَ وَيَرْفَعُهُ يُرْفَعُ إِلَيْهِ عَمَلُ اللَّيْلِ
قَبْلَ عَمَلِ النَّهَارِ وَعَمَلُ النَّهَارِ قَبْلَ عَمَلِ اللَّيْلِ
حِجَابُهُ النُّورُ لَوْ كَشَفَهُ لأَحْرَقَتْ سُبُحَاتُ وَجْهِهِ مَا
انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ- অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ ঘুমান না
এবং ঘুমানো তার জন্য সঙ্গত নয়। তিনি মীযান (তুলাদ-) নীচু করেন এবং উঁচু
করেন। রাতের কর্মকান্ড দিনের কর্মকান্ডের পূর্বেই এবং দিনের কর্মকান্ড
রাতের কর্মকান্ডের পূর্বেই তার নিকট পোঁছানো হয়। তাঁর পর্দা হচ্ছে নূর
(জ্যোতি)। তিনি তাঁর পর্দা তুলে নিলে তাঁর চেহারার জ্যোতি বা মহিমা তাঁর
সৃষ্টির দৃষ্টির সীমা পর্যন্ত সব কিছু ভস্মীভূত করে দিত।[27]
বস্ত্ততঃ
কাদিয়ানীরা আল্লাহ সম্পর্কে যে সকল নিকৃষ্ট কথাবার্তার অবতারণা করেছে
আল্লাহ তাদের এ সমস্ত আজগুবি কথা থেকে পূত পবিত্র। মহান আল্লাহ বলেন,
يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ
أَنَّى يُؤْفَكُونَ- ‘এরা তো পূর্বেকার কাফেরদের মতই কথা বলে (যারা বলত
ফেরেশতারা আল্লাহর মেয়ে)। আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন ওরা (তাওহীদ ছেড়ে) কোথায়
চলেছে? [28]
(ক্রমশ)
[1]. আলোচনা দেখুন : ড. গালিব আওয়াজী, ‘ফিরাকু মু‘আছরাহ তানতাসিবু ইলাল ইসলাম ওয়া মাওক্বিফিল ইসলাম মিনহা পৃঃ ৪৮৭; ওয়াল মাওসূ‘আতুল মুয়াসসারাতু ফিল আদইয়ান ওয়াল মাযাহিবিল মু‘আছারাহ পৃঃ ৩৮৯; আবুল আ‘লা মওদূদী, ওয়ামা হিয়াল কাদিয়ানিয়্যাহ, পৃঃ ৯; মুহাম্মাদ খাযের হুসাইন, ত্বায়েফাতুল কাদিয়ানিয়্যাহ, পৃঃ ৭ এবং ড. মুহাম্মাদ শামাহ, আছারুল বীয়া’তি ফী যুহূরিল কাদিয়ানিয়্যাহ। বিস্তারিত দ্র. ইহসান ইলাহী যহীর, ‘আল-কাদিয়ানিয়্যাহ : দিরাসাত ওয়া তাহলীল’ (লাহোর : ইদারাতু তারজুমানিস সুন্নাহ, ১৪০৪ হিঃ ১৯৮৩খ্রি.), পৃঃ ১৯।
[2]. ইহসান ইলাহী যহীর, আল-কাদিয়ানিয়্যাহ, ৯৭ পৃঃ।
[3]. তদেব।
[4]. প্রাগুক্ত, ৯৯ পৃঃ।
[5]. প্রাগুক্ত, ৯৭ পৃঃ।
[6]. তদেব।
[7]. আব্দুল্লাহ তায়মাবূরী গোলামের একজন ভক্ত মুরীদ। সেও পরবর্তীতে গোলামের মত নবুঅত দাবী করেছিল। আর গোলামই নাকি তাকে এ সুসংবাদ দিয়েছিল। তার জন্ম- মৃত্যুর কোন তথ্য পাওয়া যায় না। প্রাগুক্ত, ২৬৬ পৃঃ।
[8]. প্রাগুক্ত, ৯৮-৯৯ পৃঃ।
[9]. প্রাগুক্ত, ৯৯ পৃঃ।
[10].ইয়ার মুহাম্মাদ কাদিয়ানী কাদিয়ানীদের অন্যতম একজন নেতা। সে নবুঅত দাবী করেছিল এবং সেও গোলামের একজন শিষ্য। এই ইয়ার মুহাম্মাদ কাদিয়ানীদের পরবর্তী খলীফা গোলাম পুত্র মাহমূদ আহমাদের শিক্ষক ছিলেন। তারও নাম ও বংশ পরিচয় অজ্ঞাত। দেখুন : ইহসান ইলাহী যহীর, আল-কাদিয়ানিয়্যাহ, ২৬৫ পৃঃ।
[11]. প্রাগুক্ত, ৯৯-১০০ পৃঃ।
[12]. প্রাগুক্ত, ১০০ পৃঃ।
[13]. তদেব।
[14]. তদেব।
[15]. তদেব।
[16]. তদেব।
[17]. তদেব।
[18]. তদেব।
[19]. তদেব।
[20]. ইহসান ইলাহী যহীর, ‘আল-কাদিয়ানিয়্যাহ, ১০১ পৃঃ।
[21]. আল-কুরআন, সূরা ইখলাছ, আয়াত- ১১২/১-৪।
[22]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ, আয়াত-২/২৫৫।
[23]. আল-কুরআন, সূরা হাশর, আয়াত-৫৯/২২।
[24]. আল-কুরআন, সূরা মারইয়াম আয়াত-১৯/৬৪।
[25]. আল-কুরআন, সূরা শূরা, আয়াত-২৪/১১।
[26]. আল-কুরআন, সূরা তালাক, আয়াত-৬৫/১২।
[27]. মুসলিম হা/২৯৩, 'ঈমান' অধ্যায় ‘আল্লাহ ঘুমান না’ অনুচ্ছেদ, ৩য় খন্ড ১৭ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/১৯৫, 'মুকাদ্দামা' ‘জাহমিয়্যাহদের অস্বীকৃতি’ অনুচ্ছেদ।
[28]. আল-কুরআন, সূরা তাওবাহ, আয়াত-৯/৩০।