খ্রিস্টান পাদ্রী সামি ফার্নান্ডেজ-এর ইসলাম গ্রহণ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 9904 বার পঠিত

ইসলাম এক পরিপূর্ণ ও সার্বজনীন ধর্ম। মানুষের জীবনের সব দিকের চাহিদা মেটায় এই ধর্ম। ইহুদী ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হওয়া পাকিস্তানী নাগরিক মুহাম্মাদ আসাদের ভাষায়, ‘ইসলাম হচ্ছে এমন এক ভবনের মত যার প্রতিটি অংশের মধ্যে রয়েছে সমন্বয় এবং প্রতিটি অংশ অন্য অংশগুলোর সহযোগী ও পরিপূরক। এ ভবনে কোনো কিছুর ঘাটতি নেই। ফলে বিরাজ করছে নিরঙ্কুশ ভারসাম্য ও প্রশান্তি। আর ইসলামের নীতি হ’ল, ‘প্রত্যেক জিনিস যেখানে থাকা দরকার তা ঠিক সেখানেই থাকতে হবে’।

নও-মুসলিম সামি ফার্নান্ডেজ ছিলেন একজন খ্রিস্টান পাদ্রি। মুসলমান হওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি খ্রিস্টধর্ম প্রচারের প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর দক্ষিণ ফিলিপাইনের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব পান। এ সময় প্রাচ্যের ধর্মগুলো সম্পর্কে লেখালেখি করাও ছিল তার আরেকটি দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইসলামী দর্শন সম্পর্কে লেখালেখির সুযোগ পান সামি ফার্নান্ডেজ। এ প্রসঙ্গে সামি বলছেন, ‘ইসলামী দর্শন সম্পর্কে লেখালেখির জন্য আমি ইসলাম ও এই ধর্মের নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কিত নানা বই-পুস্তক সংগ্রহ করতে থাকি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় আমি এটা শিখেছিলাম যে, যদি শত্রুকে পরাজিত করতে চাও তাহ’লে তার সম্পর্কে সব কিছু জানতে হবে’।

এ প্রসঙ্গে সামি বলেছেন, ‘পবিত্র ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কেউ ভালোভাবে জানতে চাইলে কেবল অমুসলিম তথ্য-সূত্রের ওপর নির্ভর করে এটা জানতে পারবে না যে, এ ধর্ম সত্য বা খাঁটি ধর্ম। কারণ, ইসলাম বিদ্বেষী খ্রিস্টান আলেম বা পাদ্রিরা ও পশ্চিমা সরকারগুলো জনগণের কাছে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক চিত্র তুলে ধরেন না, বরং তারা বিশ্বনবী (ছাঃ) সম্পর্কে নানা মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে। তারা মুসলমানদেরকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘জ্ঞানহীন’ ও ‘উগ্র’ বা ‘হিংস্র’ মানুষ বলে প্রচার করে আসছে। কিছু সমস্যা ও বিদ্বেষের কারণে বা পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের ফলে মুসলমানদের ভেতরে যেসব যুদ্ধ ঘটে পাশ্চাত্য সেগুলোর জন্য ইসলামকেই অপবাদ দেয়। এভাবে তারা সত্যকে ঢেকে রাখে। কিন্তু সত্য-পিয়াসী ব্যক্তি মুসলমানদের কাছ থেকে ও তাদের বই-পুস্তক পড়ে সত্যকে জানতে পারে’।

নও-মুসলিম সামি ফার্নান্ডেজ আরো বলেছেন, ‘শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম সম্পর্কে যেসব বই পেলাম সেগুলোর বেশীরভাগ লেখকই ছিলেন অমুসলিম। তারা ইসলামকে নিজের মত করে ব্যাখ্যা করেছেন। তাই নিজেকে বললাম, মুসলমানদের লেখালেখি থেকে কেন ইসলামকে জানার চেষ্টা করব না? ফলে ইসলাম সম্পর্কে মুসলিম লেখকদের লেখা বই-পুস্তক সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকি’।

এভাবে ইসলাম সম্পর্কে মুসলিম ও অমুসলিম উভয় গ্রুপের লেখা বই পড়ে এ ধর্ম সম্পর্কে তাদের মতামতে গভীর পার্থক্য দেখতে পান সামি। তিনি এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘যখনই আমরা ইসলামকে কেবল একদিক থেকে দেখব তখন আমরা এর বাস্তবতাকে ঠিক যেভাবে বোঝা উচিত তা বুঝতে পারব না। ইসলামের সৌন্দর্য ও মূল্য তখনই আমাদের কাছে ফুটে উঠবে যখন আমরা এর সব দিক নিয়ে বিশ্লে­ষণ করব’। 

ইসলাম সম্পর্কে মুসলিম লেখকদের বইগুলো পড়ার পর নও-মুসলিম সামি ফার্নান্দেজের চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তিনি আর আগের মত ইসলাম-বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করতেন না এবং ইসলামের বাস্তবতাগুলোর নেতিবাচক ব্যাখ্যা দিতেন না। বরং ইসলাম সম্পর্কে তার জানার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। ফিলিপাইনের বাইরের কয়েকটি কেন্দ্র তাকে ইসলাম সংক্রান্ত কিছু বই দেয়। সামি বলছেন, ‘এ বইগুলো ছিল বেশ ভালো বই। তাই শুরু করি পড়াশোনা। ফলে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণাগুলো অর্জন করতে সক্ষম হই এবং বুঝতে পারি যে ইসলাম সত্য ধর্ম। এর আগে বিশ্বের প্রচলিত অন্যান্য ধর্ম ও মতবাদগুলো সম্পর্কে পড়াশোনা করেছিলাম। এমনকি চীন ও ভারতের ধর্মবিশ্বাসসহ এশিয়ার ধর্ম বিশ্বাসগুলো সম্পর্কেও গবেষণা করেছিলাম’।

সাবেক পাদ্রি সামি ফার্নান্দেজের মতে, একটি পরিপূর্ণ ধর্মের যেসব বিধান ও বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার খ্রিস্টধর্মের তা নেই। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি বুঝতে পারায় খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে আমার বিশ্বাস ক্রমেই দুর্বল হ’তে থাকে। বুঝলাম যে এতগুলো বছর অর্থহীনতায় কাটিয়েছি। কারণ, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সরকার পরিচালনা সম্পর্কে কোনো বিষয়ই পাওয়া যায় না খ্রিস্টধর্মে। সামাজিক সম্পর্ক, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক ও সমাজ সংক্রান্ত আপনার কোন প্রশ্নেরই উত্তর পাবেন না খ্রিস্টধর্মে। অথচ কমিউনিস্ট মতবাদের ভুলগুলোর কথা বাদ দিয়ে বলা যায় যে, এ মতবাদও অর্থনীতি ও সমাজ সম্পর্কে কথা বলে। কিন্তু খ্রিস্টধর্মে এসব বিষয়ে কিছুই নেই। কারণ খ্রিস্টধর্ম গির্জার চার দেয়ালের ভেতরেই সীমিত। মানুষের জীবনের দৈনন্দিন সমস্যা সম্পর্কে এ ধর্ম কোনো পথ দেখায় না। অন্যদিকে ইসলাম এই সব বিষয়েরই সমাধান দেয়। কারণ মহান আল্লাহই বিশ্বনবী (ছাঃ)-কে নবী হিসেবে দায়িত্ব দেয়ার দিন থেকে ক্বিয়ামত বা বিচার দিবস পর্যন্ত মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য একমাত্র ধর্ম হিসেবে ইসলামকেই মনোনীত করেছেন। পূর্ণাঙ্গ ধর্ম বলেই এ ধর্ম মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকসহ জীবনের সব দিকের বিধান দেয় এবং একজন সত্যপিয়াসী মানুষের সব প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম’।

তিনি বলেন, ‘প্রায় এক বছর ধরে বই-পুস্তকের মাধ্যমে ইসলাম নিয়ে গবেষণা করে বুঝলাম এ ধর্মের মধ্যেই রয়েছে আমার হারানো সত্তা। আমার মনের যেসব প্রশ্নের জবাব পাইনি খ্রিস্টধর্মে, সেই সব প্রশ্নেরই সদুত্তর পেলাম এই পবিত্র ইসলাম ধর্মে। কিন্তু তারপরও গির্জায় গিয়ে উপাসনা করা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কারণ, আমি যে মুসলমান হয়ে গেছি তা ঘোষণা করতে পারছিলাম না। এ জন্য দীর্ঘ সময় দরকার ছিল। এ অবস্থায় পড়াশোনা অব্যাহত রাখি এবং অনুভব করছিলাম যে ইসলাম স্থান করে নিচ্ছে আমার হৃদয়ের গভীর থেকে গভীরে। এ অবস্থায় ইসলামের নির্দেশিত দায়িত্বগুলো পালনের চেষ্টা করলাম। সেই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আমার অন্তরকে আবিষ্ট করেছিল তা হ’ল, তাওহীদ বা একত্ববাদ। আমার মতে একত্ববাদই ইসলামের সবচেয়ে সুন্দর শিক্ষা। এটা ছিল সেই শিক্ষা যার স্পর্শ হৃদয়ে অনুভব করতাম ইসলামের পরিচয় পাওয়ার অনেক আগেই’।

যে তিনটি বিষয় নও-মুসলিম সামি ফার্নান্ডেজকে সবচেয়ে বেশী উৎসাহিত করেছে ইসলাম গ্রহণের দিকে তা হ’ল, ‘মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির সঙ্গে এ ধর্মের মিল থাকা,  আধ্যাত্মিক ও পার্থিব দিকসহ এ ধর্মে মানুষের জীবনের সব দিকের বিধান থাকা এবং ইসলামের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের বার্তা। এ বার্তা হ’ল, আদম ও হাওয়ার সন্তান হিসাবে সব মানুষ সমান। এই বিশ্বজনীন ঐক্যের জন্য কোনো সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সংস্থায় বা দলে যোগ দিতে হয় না, কেবল মুসলমান হওয়াই যথেষ্ট। কারণ, ভাষা ও বর্ণের পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের আল্ল­াহ, কুরআন, নবী ও কিবলা এক এবং অভিন্ন। আর এ জন্যই তারা সবাই ভাই ভাই’।



আরও